হে_সখা #অক্ষরময়ী অষ্টম পর্ব

0
90

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
অষ্টম পর্ব

মন যখন অস্থির হয়ে কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকে তখন মস্তিষ্ক ভালো-মন্দ বিচার করার সুযোগ পায় না। উত্তাল সমুদ্রে কিছু আঁকড়ে ধরে স্থিরতা লাভের আশায় হাত-পা ছোড়াছুড়ি করতে থাকে৷ রেহবারকে বাইরে থেকে স্বাভাবিক দেখালেও তার মনের সমুদ্রে চলছে প্রলয়কারী ঝড়। মস্তিষ্ক জুড়ে ক্ষণে ক্ষণে আকাশ পাতাল এক করে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে৷ স্থির হওয়ার প্রচেষ্টায় মস্তিষ্ক জুড়ে তুমুল আলোড়ন। অথচ তার চোখের পাতা জোড়া ভীষণ স্থির। একনিষ্ঠে চেয়ে আছে সামনে থাকা ফাইলের দিকে। দেশের জনপ্রিয় একটি কোম্পানি Freez নামক নতুন একটি ড্রিংকস লঞ্চ করেছে। প্রোডাক্টির আউটডোর ইভেন্ট মার্কেটিং এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রেহবারের এজেন্সিকে। এজেন্সির একটি চৌকস টিমকে সেই দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা নিরলসভাবে গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ইভেন্ট আয়োজন করে প্রোডাক্ট মার্কেটিং করছে। রেহবার এতোক্ষণ গতকালের প্রোগ্রেসিং রিপোর্ট দেখছিলো। সামনে বসে আছে, ওর পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট লিতুন।

সদ্য গ্রাজুয়েশন সম্পন্নকারী বুদ্ধিমতী, সুন্দরী এবং চটপটে লিতুন এজেন্সির শুরু থেকেই যুক্ত আছে। বরাবর শান্ত থাকা মেয়েটিকে আজকে ডেস্কের অপরপাশে বসে উশখুশ করতে দেখে রেহবারের মনোযোগ তার দিকে ছুটে যাচ্ছিলো। ঠিকঠাক রিপোর্ট চেক করতে না পারায় সে বিরক্ত হয়ে হাতে ধরে থাকা কলমটি ফাইলের উপর শব্দ করে রেখে লিতুনের দিকে শীতল দৃষ্টিপাত করে শুধালো,

– কি সমস্যা তোমার?

লিতুন চমকে উঠে চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বললো,

– কোনো সমস্যা নেই স্যার৷

– তাহলে এমন নড়াচড়া করছো কেনো? পেটে গন্ডগোল দেখা দিয়েছে? টয়লেটে যেতে হবে?

– না স্যার।

– তাহলে নড়াচড়া বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকো।

লিতুনের কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও সফল হলো না। অস্থির চিত্তে আবারও মুঠোফোন হাতে নিয়ে স্ক্রল করতে শুরু করলো। রেহবার হাতের ফাইলটি পাশে সরিয়ে রেখে লিতুনের দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে শুধালো,

– পার্সোনাল ইস্যু?

লিতুন মাথা দুলিয়ে উত্তর দিলো,

– ইয়েস স্যার।

– ওয়ান্না টক এবাউট ইট।

বলবে না, বলবে না করেও লিতুন ফট করে খানিকটা উচ্চস্বরেই বলে ফেললো,

– আপনারা ছেলেরা লয়্যাল থাকতে পারেন না কেনো?

রেহবার প্রথমে থমকালো। অবাক চোখে লিতুনের দিকে তাকিয়ে খানিকটা নড়েচড়ে বসে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বললো,

– হোয়াট ডু ইউ মিন?

লিতুন নিজের বোকামি ততোক্ষণে বুঝতে পেরেছে। আরেকজনের কর্মকান্ডের জন্য পুরো পুরুষজাতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ঠিক নয়। তবুও এই মুহুর্তে পুরো পুরুষজাতিকেই ঠকবাজ মনে হচ্ছে। তবুও মন চাইলে তো আর নিজের বসকে এভাবে বলা যায়। পরে চাকরী নিয়ে টানাটানি পরে যেতে পারে।

– স্যরি স্যার। দ্যাটস নট লাইক হোয়াট আই মিন।

– এমন ডিস্টার্ব থাকলে কাজে মনোযোগ দিতে পারবে না। আগে নিজের মুড ঠিক করে এসো। তারপর কাজ।

– তাই তো চেষ্টা করছি। কিন্তু বেয়াদবটা মেসেজ সীন করতেছে না।

লিতুনের মিনমিনিয়ে বলা কথাগুলো রেহবার শুনতে পেলো। সে চেয়ে আসছে শান্ত মেয়েটার দিকে। যে সবসময় কাজে মনোযোগী ছিলো। যার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, প্রখর স্মৃতিশুক্তি, অসীম ধৈর্য্য রেহবারকে সদা মুগ্ধ করে।

– কিছুক্ষণ ব্রেক নেও। বাইরে থেকে ঘুরে এসে।

লিতুন সে কথা শুনলেও চেয়ার ছেড়ে উঠলো না। মনে হচ্ছে মেয়েটা এখানে থাকলেও ওর মন চলে গেছে অন্য কোথাও। কিছু একটা তাকে ভাবাচ্ছে। রেহবার ওর টেবিলের উপর ঢেকে রাখা পানির গ্লাসটা লিতুনের দিকে এগিয়ে দিলো।

– পানি খাও। ভালো লাগবে।

পানির গ্লাসে একটু চুমুক দিয়ে রেহবারকে বললো,

– একটা মানুষ আপনার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ করেছে। সেটা যদি মিথ্যে হয়, তাহলে আপনার কি উচিত নয় সত্যটা তাকে জানানো? যখন কেউ অন্যায় করে তখন এভাবে চুপ করে থাকে। নির্দোষ হলে জোর গলায় প্রতিবাদ করতো।

রেহবার কিছু বুঝলো না। শুধু চেয়ে রইলো। তা দেখে লিতুন লম্বা একটা দম ফেলে বলতে শুরু করলো,

– আমাদের রিলেশনটা অনেকদিনের। সেই কলেজ লাইফ থেকে। এতোদিনে একজন আরেকজনকে পুরোপুরি চিনে ফেলেছি। বয়স বেড়েছে সেই সাথে ম্যাচুরিটি এসেছে। তাই বলে অনুভূতি তো পাল্টে যায়নি। আগে যেমন ভালো বাসতাম এখনো বাসি। তো স্বাভাবিকভাবে আগে যতোটা ইনসিকিউরিটি ফিল হতো এখনোও হবে, তাই না?

রেহবার সাথে সাথেই উত্তর দিলো,

– অবশ্যই, অবশ্যই।

– সেদিন ও গেলো ওর এক বন্ধুর বিয়েতে। রাতভর সেখানে পার্টি করলো, আড্ডা দিলো। পুরোটা সময় আমাকে একবারও কল করেনি, মেসেজ করেনি। আমি কিন্তু এই নিয়ে কোনো ঝামেলা করিনি। বন্ধুর বিয়েতে অন্য সব বন্ধুরা আসবে, নিজেদের মতো সময় কাটাবে। সেখানে আমাকে কি আর মনে থাকে! বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে এসে সে নিয়ে আমাদের মাঝে কোনো কথা হলো না। ও আমাকে কোনো আপডেটও দেয়নি। আমিও আর কথা বাড়াইনি। আজকে হঠাৎ কি দেখলাম জানেন?

রেহবার আগ্রহ ভরে জানতে চাইলো,

– কি?

– ওর এক বান্ধবী সেদিনের কিছু পিকচার ফেসবুকে আপলোড করেছে। দেখে তো আমার মাথায় হাত। ওয়েট, আপনাকে দেখাচ্ছি।

লিতুন ওর হাতে ধরে থাকা মুঠোফোন থেকে একটা ছবি রেহবারকে দেখালো। কিছু সুদর্শন ছেলের সাথে গর্জিয়াস সাজে চারটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে বিয়ের অনুষ্ঠানে বন্ধুরা গ্রুপ ফটো তুলেছে। রেহবার অনেক খুঁজে, সূক্ষ্ম নজরে চেয়ে দেখেও অস্বাভাবিক কিছু খুঁজে পেলো না। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি মেলে লিতুনের দিকে চাইতেই দেখলো সে আগ্রহ ভরে রেহবারের দিকেই চেয়ে আছে। রেহবার আমতা আমতা করে বললো,

– গ্রুপ ফটো । বেশ সুন্দর এসেছে।

– আহা, আপনি ভালো করে দেখলেন না। এই যে এখানে দেখুন তুহিনের সাথে এই মেয়েটাকে দেখুন। কীভাবে কাঁধে হাত দিয়ে গায়ে ঢলে পরে ছবি তুলেছে।

ছবিটি জুম করে রেহবারকে দেখালো। ছবিটিতে একপাশে দাঁড়ানো একটি যুবকের পাশে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটি ছেলেটির কাঁধে কনুই ঠেকিয়ে দাড়িয়েছে। বন্ধুরা যেভাবে দাঁড়ায়। রেহবারের চোখে সেটি স্বাভাবিক ঠেকলেও একজন প্রেয়সীর চোখে তার পার্টনারের পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির সাথে এমন ঘনিষ্টতা স্বাভাবিক লাগছে না। তাই রেহবার বললো,

– জ্বী দেখতে পেয়েছি।

– এমন একটা ছবি দেখে আমার রেগে যাওয়া কি স্বাভাবিক নয়! আমি তবুও রেগে যাইনি। শুধু জানতে চেয়েছি এই মেয়েটার সাথে তার কি সম্পর্ক ? কেনো এভাবে গায়ের সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছে? ও আমার প্রশ্নের জবাব তো দিলোই না, উল্টো বলতেছে আমি নাকি তাকে সন্দেহ করেতেছি। ওর উপর নাকি আমার ভরসা নেই। ওদের বন্ধুত্বকে আমি অপমান করছি। এই বলে ফোন কেটে দিলো। এখন আমার মেসেজের রিপ্লাইও করতেছে না। কেনো মেজাজটা বিগড়ে যাবে না বলুন? আমার রেগে থাকা উচিত ছিলো। উল্টো আমি ওর রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করতেছি। আমার তো মনে হচ্ছে ও আমার সাথে চিট করতেছে। আমি এতোদিন কিছু বুঝতে পারিনি। এখন এই সামান্য ব্যাপারকে কেন্দ্র করে ও আমার থেকে পিছু ছাড়ার পায়তারা করতেছে।

রেহবার অবাক হয়ে খেয়াল করলো শক্তপোক্ত মেয়েটার চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। গলার স্বর ভারী, মনে হচ্ছে এখনি কেঁদে ফেলবে। হিংসা মেয়েদের সহজাত স্বভাব।পার্টনারের পাশে অন্য কাউকে সহ্য করা মেয়েদের পক্ষে অসম্ভব। যেকোনো পার্সোনালিটির মেয়ে এই এক জায়গায় এসে আটকে যায়। সেই সাথে যখন যুক্ত হয় সন্দেহ। সম্পর্কে ভাঙনের শুরুটা এখান থেকেই হয়।

– রাগের মাথায় মস্তিষ্ক ঠিকঠাক কাজ করতে পারে না। মনে অদ্ভুত সব খেয়াল আসে। এই যে তোমার মনে হচ্ছে তুহিন তোমার সাথে চিট করতেছে। এমন একটা চিন্তা তো এই ছবিকে কেন্দ্র করেই তোমার মস্তিষ্কে উদয় হয়েছে। এর আগে কখনোই তোমার এমন কথা মনে হয়নি। ইউ গাইজ ওয়াজ অ্যা হ্যাপি কাপল। তাহলে একটা ছবি দেখে এমন অ্যালিগেশন আনাটা ভুল হবে। যেখানে তুমি উপস্থিত ছিলে না, নিজে চোখে কিছু দেখোনি। হতে পারে সাধারণভাবে, বন্ধুত্বের খাতিরে কাঁধে হাত রেখেছে। তুমি সেখানে উপস্থিত থাকলে তোমার কাছে স্বাভাবিক মনে হতো। তাছাড়া ছবির অ্যাঙ্গেলও ম্যাটার করে। ছবিতে দুজনের মধ্যকার দূরত্বের সংকীর্ণতা দেখা যাচ্ছে। ক্যামেরার কারসাজির কারনে এমন দেখাচ্ছে। হতে পারে ওদের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা অনেক সুন্দর এবং সম্মানের। তুমি এভাবে রিয়েক্ট করায় তুহিন হয়তো মনে কষ্ট পেয়েছে। তোমাদের এতোদিনের সম্পর্ক। সম্পর্কের মূল ভিত্তি বিশ্বাস। সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় তুহিন হয়তো আশাহত হয়েছে। তোমরা সামনাসামনি বসে এ বিষয়ে কথা বলো। সন্দেহ না করে স্বাভাবিকভাবে জানতে চাও। দুজনের ক্লোজ পিক দেখে তোমার খারাপ লেগেছে, এ কথা ভালোভাবে জানাও। ও নিশ্চয়ই তোমাকে এক্সপ্লেইন করবে।

লিতুন কিছু বললো না। পুরোটা সময় গভীর মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনলো। রেহবার ফাইল গুছিয়ে ওকে বললো,

– আজকে আর অফিস করতে হবে না। লিভ নেও। প্রবলেম সলভ করে কালকে যথাযথ সময়ে অফিসে চলে এসো।

– কাজটা শেষ করে যাই, স্যার। ফাইলটা বুঝিয়ে দিতে বেশিক্ষণ সময় লাগবে না।

লিতুন চলে যাওয়ার পর রেহবার মনে মনে অনেকক্ষণ ভাবলো। হিংসার ক্ষেত্রে সব মেয়ে যেহেতু একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখায়, রেহবারের সাথে অন্যকে দেখলে গুলিস্তাও কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে? নির্লিপ্ত, বোবা মেয়েটার মুখে কি প্রশ্নের দেখা মিলবে? সেও কি রাগ করবে, বোকাবোকা অভিযোগ তুলবে?

(চলবে..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here