#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
একবিংশ পর্ব
জীবনের অস্থিরতম মুহুর্তে রেহবারের বিরক্তবোধ করা উচিত। অথচ রেহবারের বিরক্ত লাগছে না৷ বরং ভীষণ ভালো লাগছে। রাস্তার দু ধারে সবুজ গাছপালা, চারদিকে মৃদুমন্দ বাতাস, পাশের সীটে ঘুমন্ত প্রিয়তমা। ছোট্ট জীবনে এর থেকে বেশি আর কি চাই! গনগনে মেজাজ নিয়ে বগুড়ায় উদ্দেশ্যে রওনা দিলেও ফিরতি পথে মন এখন ভীষণ ফুরফুরে। বগুড়ার সনামধন্য আকবর বাড়ির মানুষগুলো উপর মেজাজ চটে ছিলো কিছুক্ষণ আগ মুহুর্ত পর্যন্ত। তারপর ভাবলো, অযথা ওই মানুষগুলো কথা ভেবে নিজের মেজাজ খারাপ করার কী দরকার!
পথিমধ্যে গাড়ি দাঁড় করিয়ে গুলিস্তাকে হালকা নাস্তা খাইয়ে প্রয়োজনীয় ঔষধ খাওয়ানো হয়েছে। এর পর থেকে সীটে হেলান দিয়ে আরাম করে ঘুমাচ্ছে। ড্রাইভিং করার পাশাপাশি কিছুক্ষণ পরপর ঘুমন্ত গুলিস্তার দিকে তাকাচ্ছে রেহবার। সালোয়ার কামিজ গায়ে ওকে হাইস্কুল পড়ুয়া কিশোরী মনে হচ্ছে। বাড়িতে সারাক্ষণ শাড়ি পরে ঘুরাঘুরি করতো। লম্বা চওড়া শারীরিক কাঠামোয় শাড়ি পরিহিতা গুলিস্তাকে তখন ওতোটা ছোট মনে হয় না।
বগুড়া থেকে সিলেটের পথটুকু আধোঘুমে, আধো জাগরণে কেটে গেছে গুলিস্তার৷ মাকে ফোন করে গুলিস্তাকে নিয়ে আসার খবর দেওয়া, মালাকে দিয়ে বাড়ি পরিষ্কার করানো সবকিছু রেহবার একা হাতে সামলিয়েছে। রাতের বেলা সামান্য রান্না করে গুলিস্তাকে খাইয়ে যখন নিজে ঘুমাতে গেলো, তখন বেশ রাত হয়ে গেছে।
গত রাতে পূর্বপাশের জানালাটা বন্ধ করে দিলেও পর্দা টেনে দেওয়া হয়নি। চোখে মুখে আলোর ছটা এসে পরছে। ভীষণ বিরক্ত হয়ে গুলিস্তা চোখ খুলে তাকালো। ক্ষণিক বাদে বুঝতে পারলো, এটা বগুড়ার সেই ছোট ঘরটি নয়। পাশ ফিরলে দেখতে পেলো রেহবার বেশ আরাম করে ঘুমাচ্ছে। ঘুম ভেঙে এমন দৃশ্য গুলিস্তার নিকট ভ্রম মনে হলো। সে তো নিজের বাড়িতে ছিলো। রোজকার মতো মায়ের হাতে মার খেয়ে জ্বরে কুপোকাত। ফ্লোর থেকে উঠে বিছানায় শুয়ে ছিল। এরপর? কিছু মনে করতে পারলো না। এটা কল্পনা নাকি বাস্তবতা? পরীক্ষা করে নিতে ধীর গতিতে ঘুমন্ত রেহবারের দিকে হাত বাড়ালো। ওর দিকে মুখ করে ঘুমাচ্ছিলো রেহবার। গালে আলতো হাতের ছোঁয়া পেয়ে চকিতে চোখ মেলে তাকালো। রাতের দিকেও গুলিস্তার গায়ে হালকা জ্বর ছিলো। বারবার ঘুম থেকে জেগে জ্বর চেক করতে হয়েছে। ঘুমালেও মস্তিষ্কের মধ্যে কোথাও চিন্তাটা রয়ে গেছে। তাই তো হালকা ছোঁয়ায় ঘুম ভেঙে গেলো। রেহবার চোখ মেলে তাকাতেই গুলিস্তা দ্রুত হাত সরিয়ে নিতে গেলে, রেহবার খপ করে হাতটি ধরে ফেললো। টান দিয়ে গুলিস্তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসে কপালে হাত ঠেকিয়ে দেখলো, জ্বর এখনো রয়ে গেছে কিনা?
– জ্বর কেটে গেছে বলে বিছানা ছেড়ে কোথায় ছুটছিলে?
ওকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে রেহবার আরাম করে চোখ বন্ধ করে নিলো। রেহবারের বুকে আটকা পরে গুলিস্তা বললো,
– ঘুম ভেঙে গেছে। আর ঘুম আসবে না।
– না আসুক। জেগে জেগে আমাকে পাহারা দেও।
টানা কাজ করার পর অফিস থেকে কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছে রেহবার। মূল উদ্দেশ্য গুলিস্তার সাথে সময় কাটানো। শর্মীর সাথে কথা বলে নিলে সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যেতো। কিন্তু শর্মীর সাথে আর যোগাযোগ হয়নি।
সেদিন জেরিনের কথা শুনে রেহবার মনে কষ্ট পেয়েছে। যতোই বলুক, গুলিস্তার অতীত নিয়ে ওর কোনো সমস্যা নেই। মনের মধ্যে কিছু একটা খচখচ করতেই থাকে। তাই রেহবার ঠিক করেছে, সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করবে। গুলিস্তা নিজে থেকে স্বাভাবিক আচরণ না করলে ট্রিকস অবলম্বন করে হলেও ওকে দিয়ে স্বাভাবিক আচরণ করিয়েই ছাড়বে। ঘুম থেকে উঠে প্রথমে গুলিস্তার হাতে ফোনের চার্জার ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– ফোনে পর্যাপ্ত চার্জ দিয়ে রাখবে। আর কখনো যেনো চার্জারের অভাবে ফোন বন্ধ হয়ে না যায়। সেদিন আমি কতোবার ফোন করেছি, কোনো আইডিয়া আছে তোমার?
গুলিস্তা মিনমিন করে জবাব দিলো,
– বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।
সারাদিন দুজনে মিলে রান্না করলো, ঘরবাড়ি গুছালো, বাগানের ফুল গাছে পানি দিলো। বিকালের দিকে গুলিস্তার ক্ষতস্থান গুলোতে ঔষধ লাগিয়ে দেওয়ার সময় রেহবার বললো,
– তুমি কি এখনো ছোট বাচ্চা আছো নাকি! এখনো মায়ের হাতে মাইর খাও। কী হাস্যকর ব্যাপার!
– মা হয় তো।
– মা বলেই ন্যায় অন্যায় বিচার না করে মারবে! একজন পরিণত মানুষের গায়ে হাত তোলা রীতিমতো অন্যায়, অনৈতিক কাজ৷ মুখ বুঝে সহ্য করাও অন্যায়। আর কখনো অন্যায়কে প্রশয় দিবে না। আমি কখনো গায়ে হাত তোলার চেষ্টা করলেও প্রতিবাদ করবে। মনে থাকবে?
রাতের ঘুমানোর সময় রেহবার তখনো ল্যাপটপে কাজ করছিলো। সব গুছিয়ে গুলিস্তা রুমে ফিরে এলে ল্যাপটপটি সরিয়ে রেখে গুলিস্তার কোলে মাথা রেখে আবদার করলো,
– চুলে হাত বুলিয়ে দেও তো। মাথা ধরেছে ভীষণ।
গুলিস্তা বিনাবাক্যে রেহবারের চুলে হাত বুলিয়ে দেওয়া শুরু করলো। পুরোটা সময় রেহবার নির্নিমেষ চেয়ে রইলো গুলিস্তার মুখের দিকে। গুলিস্তা কখনো সেই চোখে চোখ রাখে, আবার কখনো অস্বস্তিতে চোখ সরিয়ে নেয়।
– বাবার বাড়িতে দিন কেমন কাটলো?
– ভালো।
– মিথ্যুক কোথাকার! দেখতেই তো পাচ্ছি কতো ভালো দিন কেটেছে৷ মুখে হাতে চোট পেয়েছো, জ্বরে বেহুশ হয়ে পরে ছিলে।
অপ্রস্তুত হয়ে গুলিস্তা মাথা নিচু করে ফেললো। গুলিস্তার হাত দুটো টেনে নিজের বুকের উপর চেপে ধরে রেহবার জানতে চাইলো,
– একা নাইয়র যেতে নেই, এই কথাটা আমাকে বলোনি কেনো? মা আমাকে কতোগুলো বোকা দিয়েছে জানো?
রেহবারের কথা শুনে গুলিস্তা বেশ অবাক হলো৷ আন্টি বকাও দেয় নাকি? ওকে তো কখনো বকা দেয়নি।
– বাড়িতে জানতে চায়নি, আমি সাথে যাইনি কেনো?
– চেয়েছে।
– কি বলেছো?
– কিছু বলিনি।
– কেনো বলোনি?
– জানি না যে।
– তোমার সেই প্রতিবেশির কথা শুনে রেগে গিয়েছিলাম, তাই সাথে যাইনি। এ আবার বুঝতে পেরেছো?
গুলিস্তা উত্তর দিলো না। এক পাশে মাথা বাঁকিয়ে জানালো সে বুঝতে পেরেছে। রেহবার এতো সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সহজে বুঝতে না পারলে সে এখন থেকে গুলিস্তাকে প্রতিটি কথা, প্রতিটি অনুভূতি কথায় প্রকাশ করে বুঝিয়ে দিবে৷ গুলিস্তাকে চুপ থাকতে দেখে রেহবার বললো?
– ঘুম পেয়েছে?
গুলিস্তা মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালে রেহবার হেসে বললো,
– কাল দিনরাত মিলে যতো ঘুমিয়েছো! আর কোথা থেকে ঘুম আসবে! আজকে বরং জেগে জেগে আমাকে গল্প শোনাও।
গুলিস্তার দু হাতের আঙ্গুল নিয়ে খেলতে খেলতে জানতে চাইলো,
– জাহিদের সাথে সেদিনের ঘটনাটা বলো তো শুনি।
গুলিস্তা থমকে গিয়ে রেহবারের হাত থেকে নিজের হাত দুটো সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু রেহবার আরও শক্ত করে বুকের সাথে চিপে ধরে রইলো।
– তুমি তো শুধু প্রশ্নের উত্তর দিতে জানো। ঠিক আছে, প্রশ্ন করেই জেনে নিচ্ছি। জাহিদকে কীভাবে চিনতে?
– একই পাড়ায় থাকতাম। ছোটবেলায় একসাথে খেলতাম।
– তুমি ওকে পছন্দ করতে?
গুলিস্তা মাথা দুলিয়ে না জানালো৷ রেহবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকায় তা দেখতে পেলো না। আবার প্রশ্ন করলো,
– পছন্দ করতে?
– নাহ।
– তাহলে তোমাদের প্রেমের গুঞ্জন ছড়ালো কীভাবে? ও তোমাকে পছন্দ করতো?
– রাস্তাঘাটে বিরক্ত করতো। বান্ধবীদের দিয়ে চিঠি পাঠাতো। চিঠি নিতে না চাইলে বান্ধবীরা সেই চিঠি মায়ের হাতে দেওয়ার ভয় দেখাতো।
– সেদিনও বিরক্ত করছিলো?
হটাৎ হেঁচকি তুলে গুলিস্তার দেহ কেঁপে উঠলো। রেহবার দ্রুত উঠে বসে দেখলো গুলিস্তা কাঁদছে। নিচের ঠোঁট দাঁতের ফাঁকে চিপে ধরেছে৷ এই প্রথম ওকে এভাবে কাঁদতে দেখলে রেহবার বিচলিতবোধ করলেও নিজেকে ধাতস্থ করে দু হাত বাড়িয়ে ওর চোখ মুছিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো,
– কী করেছিলো?
নিজের বা হাত দেখিয়ে দিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো,
– হাত ধরে টানাটানি করতেছিলো। প্রেমের প্রস্তাবে রাজি হইনি, তাই সরাসরি বিয়ে করতে বলতেছিলো। বিয়ে করে রেখে ট্রেনিং করতে যাবে।
অসময়ে রেহবারের খুব হাসি পেলো। সে ফিক করে হেসেও ফেললো। গুলিস্তা কান্না বন্ধ করে অবাক হয়ে তাকালো ওর দিকে। এখানে হাসির কি হলো? জবাবদিহিতার মতো করে রেহবার বললো,
– অল্প বয়সের আবেগে কী সব পাগলামি করে মানুষ! কোন ক্লাসে পড়তে তখন?
– এইটে।
– ও তোমার হাত ধরে টানাটানি করছিলো আর তুমি দাঁড়িয়ে রইলে! ডান হাত দিয়ে জোরসে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেওয়া উচিত ছিলো।
– ভয় পেয়ে গেছিলাম।
– এখন দাও দেখি।
ওর বাম হাতের কব্জি ধরে মুখ সামান্য এগিয়ে নিয়ে রেহবার অপেক্ষা করলো। গুলিস্তা অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
– কি দিবো?
– থাপ্পড় দিবে। এভাবেই তো হাত ধরেছিলো। তুমি উল্টো হাতে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেও। কই? দেও, দেও।
রেহবারের কোনো কথায় গুলিস্তা অসম্মতি জানায় না। কখনো প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা সামান্য ‘না’টুকুও বলে না। আজকে হয় না বলবে, না হলে সাহস করে থাপ্পড় দিয়ে সেদিনের ট্রমা কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠবে। রেহবারকে অবাক করে দিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে গুলিস্তার ডান হাত রেহবারের গাল ছুঁলো।
– এটা থাপ্পড় ছিলো? মানুষ মশা মারতেও এর থেকেও বেশি শক্ত প্রয়োগ করে। তোমার শরীরে এতটুকুও শক্তি নেই!
গুলিস্তা ঘুমিয়ে গেলে রেহবার খুব সাবধানে বিছানা ছেড়ে উঠে টেবিলে বসে নিজের অফিসের কাজ করছিলো। হঠাৎ ফোন কেঁপে উঠল। এতো রাতে আননোন নাম্বার থেকে কল আসতে দেখে বুঝে নিলো এটা কে হতে পারে। ঘর থেকে বেরিয়ে স্টাডিরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।
চলবে…