#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
একাদশ পর্ব
🚩18+, abusive & disturbed content
প্রায় রাতে গুলিস্তা বিছানা ছেড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে। রেহবার দিনভর কাজেকর্মে ব্যস্ত, অফিসের কাজে ছুটোছুটি করে এসে রাতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পরলে আর টের পায় না। সকালে আবার তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে হয়। কখনো মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে গুলিস্তাকে পাশে না পেলে এখন আর বিচলিত হয় না। সেদিনের ঘটনার পর সে বুঝে গেছে গুলিস্তা কোথায় যেতে পারে।
ডিনারের পর রেহবার নিজেই আজ দাঁড়িয়ে আছে ব্যালকনিতে। গুলিস্তার সঙ্গ তাকেও আঁধারের প্রতি আকৃষ্ট করে ফেলছে ভেবে নিজেই খানিকটা হেসে নিলো।
খোলা চুলগুলো বেণী করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে এসে রেহবারকে দেখতে পেলো না গুলিস্তা। ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলো রেহবার সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সকালের কথা মনে হতেই ব্যালকনির দরজায় টোকা দিয়ে মৃদু শব্দ করে রেহবারের মনোযোগ আর্কষণের চেষ্টা করলো। রেহবার চকিতে পেছন ফেরে দেখে গুলিস্তা দাঁড়িয়ে আছে৷
– ফুল, এদিকে এসো। দেখো আজকে চাঁদটা কী সুন্দর দেখাচ্ছে।
গুলিস্তা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যেতেই রেহবার ওকে নিজের কাছে টেনে নিলো। গুলিস্তার পিঠ ঠেকেছে রেহবারের বুকে৷ দু হাতে আড়াআড়িভাবে উদর জড়িয়ে ধরে থুতনি ঠেকালো ওর কাধে। আকাশের চাঁদ যেনো আজ জমিনের একটু বেশি কাছে চলে এসেছে। ছোট্ট চাঁদের আকার আজ বহুগুণ বেড়েছে। আলোর তেজে চারদিক চকচক করছে। চাঁদের গায়ে লেপ্টে থাকা কলঙ্ক ক্ষীণ দেখাচ্ছে। গুলিস্তা সেদিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। ওর চোখে মৃদু নমনীয়তা।
উদাসীন চোখের এই পরিবর্তন রেহবারের দৃষ্টি এড়ালো না। চাঁদের সাথে গুলিস্তার কীসের এতো সখ্যতা? যে দৃষ্টি কখনো নিজ পতীর প্রতি নমনীয় হয় না, সে চাঁদের কাছে এতো কোমল কেনো!
গুলিস্তার গায়ে সী গ্রিন কালারের একটি শাড়ি জড়ানো। রাউন্ড নেকের ব্লাউজ পরার কারনে গলা, পিঠের বেশ কিছু অংশ অনাবৃত৷ চাঁদের আলোয় অনাবৃত ফর্সা ত্বকে আলোর প্রতিফলন রেহবারের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। সে আলতো চুমু দিলো গলার অনাবৃত অংশে। হঠাৎ স্পর্শে গুলিস্তা চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। ওকে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে থাকার কারনে ওর শরীরের প্রতিটি পরিবর্তন রেহবার বুঝতে পারছে৷ রেহবারের মূল লক্ষ্য স্ত্রীকে আদর করা নয়, বরং তার প্রতিটি প্রতিক্রিয়া গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্যই এমন পদক্ষেপ নেওয়া।
চমকে উঠলেও গুলিস্তা দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো। পিঠ হতে বেণী সরিয়ে রেহবার সেখানে এলোমেলো চুমুতে ভরিয়ে দিতে থাকলো৷ চাঁদ হতে দৃষ্টি সরিয়ে গুলিস্তা তাকিয়ে আছে নিজের পায়ের দিকে। পা দুটো কি একটু কেঁপে উঠলো? হয়তো না। রেহবার কোনো পরিবর্তন খুজে পেলো না। সেই আগের মতোই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। শরীরে জাগেনি কোনো শিহরণ। রেহবারের ছোয়া তাকে এলোমেলো করে দিতে পারেনি। পা টলে উঠেনি। কেপে উঠে স্ব-শরীরের ভার রেহবারের উপর ছেড়ে দেয়নি।
শুধু শক্ত করে আঁচল চেপে ধরেছে হাতের মুষ্টিতে৷
চাঁদের পবিত্র মোহনীয় আলোয় যেখানে চারিধারের আঁধার কেটে যাচ্ছে সেই মুহুর্তে চোখজোড়া বন্ধ করে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির প্রতি রেহবারের ভীষণ ঘৃণা জন্মালো। এতো বছরের জমানো ভালোবাসার সম্পূর্ণটুকু ঢেলে দিয়েছে নিজের স্ত্রীকে। আর সে কিনা দিনের পর দিন তার ভালোবাসার পবিত্র ছোঁয়াকে এভাবে অপমান করে! ভালো না লাগলে অন্তত প্রতিবাদ করুক। দু হাতে ঠেলে দিক রেহবারকে৷ রেহবার আর কক্ষনো ফিরে চাইবে না, ছুয়ে দিবে না। ভালোমন্দ কিছু তো বলুক। এভাবে অনুভূতিহীন দাঁড়িয়ে থাকার মানে কি?
মাথার ভেতরে দপদপ করা রোগটা ফিরে এসেছে। শিরায় লোহিত কণিকাদের তীব্র বেগে ছোটাছুটি। দাঁতে দাঁত চেপে অনিয়ন্ত্রিত মেজাজকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইছে। তবুও আজ কেনো যেনো নিজেকে সামলানো দায় হয়ে উঠেছে। হাত পা শিরশির করছে। ব্যালকনিতে সুসজ্জিত আছে কিছু সবুজ গুল্মলতা। চোখে আরামদায়ক সেই উদ্ভিদগুলোকে টবসহ ফ্লোরে আছড়ে ফেললে রাগ কিছুটা সংবরণ করা যেতো। নিজের ভেতরে জেগে উঠা অনিয়ন্ত্রিত সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে রেহবার বেশ খানিকটা সময় নিয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়লো।
ওর ভেতরে চলন্ত ঝড়ের কোনো আভাসই পেলো না গুলিস্তা। ওকে যখন কোলে নিয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো, তখনো অন্যসব রাতের মতোই গুলিস্তা নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো। আলতো ছোঁয়ায় কিছুক্ষণ চোখ বুজে সয়ে নিবে।
গুলিস্তাকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া মাত্রই সে স্বভাব অনুয়ায়ী চারদিকে আঁধার ছড়িয়ে নিজের চোখের ঝাপি বন্ধ করে দিলো। কিন্তু রেহবার আজ হেরে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিবে না। সে দু হাতে ভর দিয়ে গুলিস্তার উপর ঝুকে কিছুক্ষণ ওকে পর্যবেক্ষণ করলো। সমত বয়ে যাচ্ছে, গুলিস্তার সেই প্রথম খানিকটা অস্বস্তি হলো। অস্থিরভাবে দুপাশে মাথা দোলালো। রেহবার ওর গালে হাত রেখে বললো,
– চোখ খোলো। আজকে একদম চোখ বন্ধ করবে না।
যে কন্ঠ এতোদিন উষ্ণতা ছড়াতো সেখানে আজ অন্তরে কাঁপন ধরা শীতলতা। গুলিস্তা চোখ মেলে চাইতে বাধ্য হলো। ঘরে নীলচে মৃদু আলো জ্বলছে। এই সামান্য আলোতেও রেহবার নিজের এই রুক্ষতার প্রতিফলন দেখার সাহস পেলো না। হাত বাড়িয়ে নিভিয়ে দিলো একমাত্র আলোর উৎস।
ব্যালকনির দরজা খোলা। চাঁদের আলো হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে ঘরের ভেতর।
সেই আলোতে গোলাপি ঠোঁটের সন্ধান পেতে রেহবারের খুব একটা সমস্যা হলো না। পাতলা ঠোঁটজোড়া রেহবার ঠোঁট আকড়ে ধরতেই গুলিস্তার চোখজোড়া নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেলো। রেহবার যখন সে দৃশ্য দেখলো, শক্ত হাতে গুলিস্তার চোয়াল চেপে ধরলো। দাতে দাঁত চিপে ওর মুখের কাছে হতে মুখ না সরিয়ে বলল,
– চোখ বন্ধ করতে বারণ করেছি না? একদম অবাধ্যতা করবে না। এর ফল ভালো হবে না কিন্তু।
এর বেশি কিছু গুলিস্তাকে বলতে হলো না। সে লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজের চোখে নিজের বাস্তবতা দেখার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো। মায়াহীন, অনুভূতিহীন বিশ্রী একজোড়া দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে রেহবারের গা গুলিয়ে উঠলো। সারা শরীরে ছড়িয়ে পরলো ক্ষোপের রোশানল। ঠোঁটের ছোয়া আলতো হতে রুক্ষ হলো। নিজের গায়ের পাঞ্জাবিটা এক হাতে টেনে খুলে ফেলে দূরে কোথাও ছুড়ে ফেললো।
গুলিস্তার জ্বল জ্বল করা চোখ দুটোতে কোনো ভাষা নেই৷ যেনো কালো রঙের দুটো কাগজ মাত্র। যেখানে আছে শুধু আঁধার। রেহবারের মনে হলো, এর থেকে বদ্ধ চোখজোড়াই বুঝি বেশি ভালো ছিলো। ভালোবেসে আলতো করে চুমু দিলে মন শান্ত হয়ে যেতো।
গ্রীবাদেশে এলোমেলো চুমু গুলিস্তাকে টলায় না, অথচ ওর শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণ রেহবারের নাসিকারন্ধ্রে প্রবেশ মাত্র মস্তিষ্কে মাদকতা ছড়িয়ে পরে। শরীরের প্রতিটি লোম পর্যন্ত জেগে উঠে। শাড়ির আচল সরিয়ে দিলে উন্মুক্ত হয় কারুকার্যময় শরীরের খাঁজ। মসৃণ ত্বকের উদরে রেহবার পরম ভালোবাসায় চুমু এঁকে দেয়। গুলিস্তা দুপাশে দু হাতে বিছানার চাদর খামচে ধরে তাকিয়ে আছে সিলিং এর দিকে৷ রেহবারের করুণ দৃষ্টি ওর মুখের দিকে ক্ষীণকাল স্থির রয়৷ ‘একবার চাও, ফুল। ভালোবেসে না হোক, তীব্র অবহেলা নিয়ে অথবা একগাদা অভিযোগ নিয়ে হলেও একবার এই চোখে চোখ রাখো।’
নিষ্ঠুর প্রিয়তমা সে আকুতি শুনে না।
বক্ষ বন্ধনী অনাবৃত করে সুউচ্চ উপত্যকায় হারিয়ে যায় রেহবার। কতো ছলাকলা, কতোশত ছোয়া তবুও গুলিস্তার হাত দুটো ওর মাথার চুল আকড়ে ধরে না। সে শক্ত হাতে বিছানার চাদরকেই আকড়ে রয়৷ রেহবারের মাথার চুলগুলো ভীষণ শিরশির করে উঠে। নিদারুণ অবহেলায় তারা বোধহয় খুব প্রতিবাদ করলো। রেহবারের আর কিছু ঠিকঠাক মনে নেই। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তলিয়ে গেলো কোনো অতল আঁধারে৷
শিরা উপশিরাগুলো শান্ত হয়ে এলে ক্লান্ত শরীরের ভার ছেড়ে দিলো গুলিস্তার শরীরের উপর৷ ওর বুকে মাথা রেখে জোরালো শ্বাস নিয়ন্ত্রণে আসার অপেক্ষা করলো৷ খানিকবাদে স্বাভাবিক হয়ে এলো হৃৎপিন্ডের গতি৷ নিজের বালিশে মাথা ঠেকিয়ে তাকালো গুলিস্তার দিকে৷ ওর চোখ দুটো প্রায় নিভু নিভু। খুব বেশি ক্লান্ত হয়ে পরেছে কি? ঘুম পেয়েছে মনে হয়৷ রেহবার ওর গালে হাত ঠেকিয়ে ডাকলো,
– ফুল, এই ফুল।
গুলিস্তা সাড়া দিলো না। রেহবারের ডাকে ওর ফুল কখনো সাড়া দেয়নি এমনটা অসম্ভব। মুখে কিছু না বললেও সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ ঠিকই রাখে। তবে আজ ফিরে চাইলো না কেনো? খুব রাগ করেছি কি? রেহবার মাথা উচু করে খানিকটা ঝুঁকে ডাকলো। ততোক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে গুলিস্তার চোখ জোড়া। গুলিস্তার হাত দুটো ওর মাথার উপরের দিকে দু পাশে অবহেলায় পরে আছে। তা দেখে রেহবারের মনে হলো কিছু একটা ঠিক নেই। বিছানা থেকে উঠে দ্রুত ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিলো। গুলিস্তার হাত দুটো মাথার দিক হতে নামিয়ে আনতে গিয়ে রেহবার চমকে উঠলো। দু হাতের কব্জি ভীষণ লাল হয়ে আছে। ফর্সা ত্বকে সেই আঘাত দেখে মনে হচ্ছে চামড়া ভেদ করে রক্ত গলিয়ে পরছে। রেহবারের নিঃশ্বাস আটকে যাবার উপক্রম। কীভাবে হলো এমন?
গুলিস্তার গায়ে চাদর মোড়ানো। রেহবার কাঁপাকাঁপা হাতে চাদর সরাতেই ভয়ংকর এক দৃশ্য দেখে ওর গলা শুকিয়ে গেলো। গুলিস্তার অনাবৃত দেহে নীলচে দাগ। কোথাও কোথাও সামান্য রক্ত লেগে আছে। গ্রীবাদেশের নিচ হতে বুকের দিকে ক্রমশ বেড়েছে সেই আঘাতের চিহ্ন।
রেহবার দুহাতে নিচের চুল খামচে ধরলো। চিন্তিত গলায় গুলিস্তাকে বেশ কয়েকবার ডাকলো৷ কিন্তু সে সাড়া দিলো না। গুলিস্তা জ্ঞান হারিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই৷ বারংবার ডাকেও সাড়া না পেয়ে রেহবার নিজেকে সামলে নিলো। যা হবার হয়ে গেছে। এখন পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে দ্রুত।
ওয়াশরুমে গিয়ে গরম পানিতে বাথটাব ভরে সেখানে গুলিস্তাকে শুইয়ে দিলো। পাশে বসে খুব সাবধানে গায়ের ক্ষত থেকে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত পরিষ্কার করতে লাগলো৷
তীব্র আক্রোশে রেহবারের বিবেক বুদ্ধি লোপ পেয়েছিলো। আলতো ছোয়া কখন রুক্ষ হয়ে গুলিস্তার শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে টেরই পায়নি। রেহবারের রুক্ষ ছোয়ার ফাঁকে দাতের আঘাত যখন গুলিস্তার পাতলা ত্বক ভেদ করে রক্ত বেরিয়ে আসছিলো, তীব্র যন্ত্রণায় গুলিস্তা দু হাতে রেহবারকে নিজের শরীর থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলো। উদ্ভ্রান্ত রেহবার ওর হাত দুটো নিজের একহাতে শক্ত করে ধরে মাথার উপরে আটকে দেয়৷
রেহবারের উগ্র ছোয়া, রুক্ষ আদরে গুলিস্তার চোখ বেয়ে অনেকদিন পর নোনাজল ঝরেছে।
সেই চোখের জলের শুকিয়ে যাওয়া দাগ আলতো হাতে মুছে দিলো রেহবার৷
হঠাৎ খেয়াল হলো, ওর নিজের চোখ বেয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পরছে। কখন থেকে কাঁদছে ও?
দু চোখ মুছে গুলিস্তার সংজ্ঞাহীন দেহটাকে বাথটাব থেকে তুলে নিলো। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে গেস্টরুমে গিয়ে গুলিস্তাকে শুইয়ে দিলো। দেহের ক্ষতে মেডিসিন লাগিয়ে দিয়ে শিয়রে বসে রইলো। ভোর হতে আর কতোক্ষণ বাকি? ফুলের জ্ঞান ফিরলে কী করে তার সাথে দৃষ্টি মিলাবে? এমন অন্যায় করার পরে নিজের সাথে তো নিজের দৃষ্টি মেলানোই দায়।
চলবে…