হে_সখা #অক্ষরময়ী চতুর্দশ পর্ব

0
128

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
চতুর্দশ পর্ব

সৈকত দাঁড়িয়ে আছে বসের কেবিনের বাইরে। ভেতরে যাবে কিনা ভাবছে। বেশ কয়েকদিন ধরে বসের আলোচনা করার চেষ্টা করছিলো কিন্তু কোনো কারণে বসের মন-মেজাজ ভালো নেই। মুখ থমথমে করে অফিস আসে। সামান্য ভুল পেলেই সবাইকে ধমকায়। সারাটাদিন সবাইকে দৌড় করিয়ে তারপর শুকনো মুখে অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। এসবের মাঝে কি আর সৈকত তার ব্যক্তিগত আলোচনা করার সাহস পায়!

লিতুন এক কাপ ব্ল্যাক কফি হাতে বসের কেবিনের দিকে যাচ্ছিলো। দরজার সামনে সৈকতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থেমে গেলো৷
– সৈকত স্যার, আপনি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছেন?

হঠাৎ লিতুনকে দেখে সৈকত খানিকটা ভড়কে গেলেও নতুন আশা খুঁজে পেলো। সে ফিসফিসিয়ে লিতুনকে বললো,
– আচ্ছা লিতুন ম্যাম, স্যারের মেজাজ আজকে কি রকম?
– ভালোই। অন্যদিন যেমন থাকে।
– না মানে গত কয়েকদিন বেশ রাগারাগি করলো।
– তা করেছে। কিন্তু আজকে ঠিকঠাকই দেখলাম।
– কফি কি আপনি স্যারের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন?
– হ্যাঁ। কেনো?
– স্যারকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে আমাকে জানাবেন প্লিজ। স্যারের সাথে আমি খুব জরুরি বিষয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি। এই সময় স্যারের ফুরফুরে মেজাজে থাকা খুব জরুরি।

লিতুন সৈকতকে গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো। বেচারা এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেনো এক্ষুনি কেঁদে দিবে।

– কি এমন কথা বলবেন?
– সে আপনাকে পরে বলবো৷ আগে আপনি ভেতরের আপডেট জানান আমাকে।
-আচ্ছা ঠিক আছে। আমি দেখে এসে জানাচ্ছি।

কিছুক্ষণ পরে লিতুন কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো। ওর থেকে পজেটিভ রেসপন্স পেয়ে সৈকত এসেছে তার বসের সাথে জরুরি কথা বলতে। স্বল্প বিবরণে যতোটুকু জানানো যায়, সেইটুকু বলার পর কার্ডটি বসের হাতে তুলে দিয়েছে। ওর বস এখন গভীর মনোযোগ দিয়ে কার্ডের ভেতরে লেখাগুলো পড়ছে৷ বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে সৈকত খানিকটা সোজা হয়ে বসলো। টেনশনে গত কয়েকদিন বাথরুম হয়নি ঠিকঠাক। এখন মনে হচ্ছে প্রাণ পাখিটাও উড়ে যাবে। নিজের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করা তার পক্ষে সম্ভব হলো না। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
– আসলে স্যার হঠাৎ করে সব ঠিকঠাক হয়ে গেলো। পাত্রী দেখতে গিয়ে মায়ের এতো পছন্দ হয়ে গেলো যে আর দেরী করতে চাইলেন না। আমার নাকি বিয়ের বয়সও পেরিয়ে যাচ্ছে। মায়ের জোড়াজুড়িতে মাসখানেকের মধ্যে বিয়ের স্বল্প আয়োজনে বিয়েটা সেড়ে নিতে হচ্ছে। আপনি যদি পরিবারসহ উপস্থিত হতেন খুব খুশি হতাম। বেশিক্ষণ সময় দিতে হবে না স্যার। আপনার সুবিধামতো একটা সময় এসে দাওয়াত কবুল করে একটু দোয়া দিয়ে যাবেন।

রেহবার এতোক্ষণ কার্ডে উল্লেখিত বিয়ের তারিখ দেখছিলো। ৩০ নভেম্বর রিসেপশন। এর আগে গায়ে হলুদ, মেহেদী, আকদ, বিদায়, বৌ ভাত সবমিলিয়ে সপ্তাহ লেগে যাবে। অথচ সৈকত মাত্র চারদিনের ছুটির জন্য আবেদন করেছে। তাড়াহুড়োয় বিয়ে করে সে নিজে এখনো ভুগছে। আর কেউ এমন পরিস্থিতির স্বীকার হোক, এটা অন্তত সে চাইবে না। কার্ডটি টেবিলের উপর রেখে সৈকতকে বলল,

– সৈকত সাহেব, বিয়ে জীবনের একটু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাই বিয়ের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করতে হয় না। চারদিনে বিয়ের আয়োজন ঠিকঠাকভাবে করতে পারবেন না। ছুটতে ছুটতে দিন কেটে যাবে। আপনাকে আমি সাতদিনের ছুটি দিচ্ছি। শুক্রবার সহ মোট আটদিন৷ বিয়ের সকল আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করুন। মন খুলে ইনজয় করুন। একবার বিয়ে হলে গেলে পরে আফসোস করলেও আর এমন দিন ফিরে পাবেন না।

সৈকত খুশিতে বাকহারা হয়ে গেলো। ইচ্ছে করছে এখানে ইয়াহু বলে একটা লাফ দিতে। কিন্তু চাইলেই তো বসের সামনে লাফিয়ে উঠা যায় না। দেখা যাবে বস তার ব্যাঙের মতো লাফানো দেখে বলল, সৈকত সাহেব আপনার চারদিনের ছুটির আবেদন না মঞ্জুর করা হলো। অফিস থেকে গিয়ে বিয়ে করবেন। বাসর করে আবার সকালে অফিসে হাজির হবেন। তাই মনের খুশি ধামাচাপা দিয়ে সে বিনয়ের সাথে বললো,
– অনেক ধন্যবাদ স্যার। স্যার, দাওয়াত কবুলের ব্যাপারটা?
– পরিবার বলতে একমাত্র স্ত্রী ছাড়া আর কেউ আপাতত সাথে নেই, সৈকত সাহেব। কোনো ঝামেলায় আটকে না গেলে ইনশাআল্লাহ যাবো।

বসের কেবিন থেকে বেরিয়ে সৈকত সত্যি সত্যি একটা লাফ দিলো। সে ভাবেইনি স্যার তার রিসিপশনে যাওয়ার প্রস্তাবে এতো সহজে রাজি হয়ে যাবেন। সে তো কোনো আশা ছাড়াই দাওয়াত করেছিলো। এভাবে সরাসরি তো ছুটি চাওয়া যায় না। বিয়ের দাওয়াতের সাথে ছুটির আবেদন করলে বস গোষ্ঠীর মানুষেরা না করতে পারে না। ছুটি চাওয়ায় মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখের উপরে না বলে দিতে উনাদের বিবেকে বাঁধে। তাই দেখা যায়, চারদিনের জায়গায় দুইদিন ছুটি মঞ্জুর করে বিদায় করে দেয়।

বেডরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গুলিস্তা নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। আর বিছানায় বসে গালে হাত দিয়ে বসে স্ত্রীর কান্ডকারখানা দেখছে রেহবার। অন্য কোনো মেয়ে হলে এতোক্ষণে স্বামীকে প্রায় দশবার জিজ্ঞাসা করতো, এই আমাকে কেমন দেখাচ্ছে? এই শাড়ির সাথে ইয়ার রিংটা মানিয়েছে? খোপা করবো নাকি চুল ছেড়ে দিবো? কুচিগুলো একটু ঠিক করে দেও।

গুলিস্তা এমন কোনো প্রশ্ন করেনি। রেহবারকে এসব টুকটাক কাজও করে দিতে হয়নি। কারন গুলিস্তা নিজেকে থেকে কোনো কিছুই চুজ করেনি।

রেহবারের এড ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির আউটডোর ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার সৈকত। ওর বিয়ের রিসিপশনে উপস্থিত থাকতে হবে, এই কথা যখন গুলিস্তাকে জানালো, তখন সেই সরলতার প্রতিমা তার সরল কন্ঠস্বরে সরল ভাবে জানতে চাইলো,
– কি পরে যাবো?

রেহবার ভাবলো, সত্যিই তো কি পরে যাবে?
বিয়ের পরে যা কেনাকাটা করা হয়েছিলো সেগুলো নিত্য ব্যবহারের জন্য। অনুষ্ঠানে যাওয়ার মতো গর্জিয়াস ড্রেস গুলিস্তার নেই। তাছাড়া যেকোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে নতুন করে কেনাকাটা করা মেয়েদের অলিখিত অধিকার। ওয়ারড্রব ভর্তি পোষাক থাকলেও অনুষ্ঠানে পরে যাওয়ার জন্য পোশাকের সংকট দেখা দিবেই। অফিস থেকে ফিরে গুলিস্তাকে নিয়ে শপিংমলে গিয়ে রেহবার পরলো আরেক বিপদে৷ গুলিস্তা শুধু ঘুরে ঘুরে দেখছে, কোনো কিছুতেই তার চোখ থমকে যাচ্ছে না। পছন্দ হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করলে মাথা নাড়ায়। অবশেষে বাধ্য হয়ে রেহবারকেই মাঠে নামতে হলো।

শপিংমলে একটি ম্যানেকুইনের গায়ে রয়েল ব্লু রঙয়ের একটি শাড়ি পরানো ছিলো। ম্যানেকুইনের দিকে তাকিয়ে ওর জায়গায় রেহবার মনে মনে গুলিস্তাকে কল্পনা করে থমকে গেলো। রাতের আঁধারে বিয়ের অনুষ্ঠানের উজ্জ্বল আলোতে গুলিস্তার সৌন্দর্য ঠিকরে পরছে।৷ ভাবতেই রেহবারের সারা দেহে শিহরণ ছড়িয়ে গেলো। নিজের পছন্দকৃত শাড়িটি প্যাক করার আগে গুলিস্তার রায় জানতে চাইলে সে এক বাক্যে সম্মতি জানিয়েছিলো।

এখন আয়নার সামনে সেই রয়েল ব্লু শাড়িটি পরে নিজেকে ঘুরে ফিরে দেখছে। মূলত সে নিজেকে সেই ম্যানেকুইনটির সাথে মিলানোর চেষ্টা করছে৷

ভি নেক রয়েল ব্লু রঙের ফুল স্লিভস ব্লাউজ, গলায় স্টোনের চিকন হার ও ম্যাচিং ইয়ার রিং। আলগা খোপায় একটি নকশা করা কাটা। এমনি তো ছিলো ম্যানেকুইনটির সাজসজ্জা। শাড়ির সাথে এসব ম্যাচিং করা ছিলো বলে রেহবার সেগুলোও নিয়ে নিয়েছে৷ এতে আলাদা করে অর্নামেন্স কেনার ঝামেলা পোহাতে হয়নি। কিন্তু হুবহু সেই ম্যানেকুইনটির মতো না সেজে নিজের পছন্দ মতো তো রেডি হওয়া যেতো। গুলিস্তার আবার নিজের পছন্দ! এই ভেবে নিজের ভাবনার কারনে নিজেকেই ধিক্কার জানিয়ে রেহবার বিছানা ছেড়ে উঠে গুলিস্তার পেছনে গিয়ে দাড়ালো। দু হাতে ওর কোমড় জড়িয়ে থুতনি ঠেকালো ঘাড়ে। আয়নায় ভেসে উঠা দুজন মানব মানবির মাঝে বিন্দুমাত্র দূরত্ব নেই। একে অপরের গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। রেহবার আয়নায় ভেসে উঠা গুলিস্তার প্রতিবিম্বের চোখের দিকে চেয়ে বললো,
– ভরা পূর্ণিমার চাঁদের মতো দ্রুতি ছড়াচ্ছো৷ এই সামান্য আয়নার কি সাধ্য সেই সৌন্দর্যের প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে।

গুলিস্তা কিছু বুঝলো কিনা কে জানে! সে তাকিয়ে রইলো আয়নার ফুটে উঠা স্যুট-কোট পরা এক টগবগে যুবকের প্রতিবিম্বের দিকে। যার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাদকতা ছড়ানো।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here