হে_সখা #অক্ষরময়ী ত্রয়োদশ পর্ব

0
149

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
ত্রয়োদশ পর্ব

মনের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধলে সেটা সংক্রমণ রোগের মতো ছড়িয়ে পরতে থাকে। রেহবার নিজের সাথে নিজে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ করে হাঁপিয়ে উঠেছে। ওর ভরসার একমাত্র স্থান, মা। তাই অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই ব্যাপারে আম্বিয়া খাতুনের সাথে কথা বলবে। কিন্ত সে তো নিজেই জানে না, গুলিস্তার সাথে তার কি সমস্যা হচ্ছে। বিবাহিত জীবনের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার অন্য কাউকে জানানোর কাজটি সে করতে পারবে না। হোক অপরপাশের ব্যক্তিটি তার মা। তবুও সব কথা বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তাই রেখে ঢেকে যতোটুকু বলা সম্ভব, সেইটুকুই বলবে।

ছেলের উদাস চেহারা দিকে তাকিয়ে আম্বিয়া খাতুন শংকিত হলেও স্বাভাবিকভাবেই রেহবারকে প্রশ্ন করলেন,
– তুমি ঠিক আছো? অসুস্থ মনে হচ্ছে।

রেহবার খানিকটা হাসার চেষ্টা করলো, কিন্তু সেই হাসি তার চেহারাতে আরও বেশি করুণ দেখালো।
– আমি ঠিক আছি।
– তাহলে মুখ এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেনো?

মায়ের মন সন্তানের অনুভূতি জানতে বেশি সময় নেয় না। সন্তান চাইলেও মায়ের থেকে লুকিয়ে রাখতে পারে না। মা যদি পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় কি হয়েছে জানতে চায়, সন্তান তার ভয়ংকর অপরাধের কথাও স্বীকার করে ফেলতে পারে। রেহবার ফোনের স্ক্রীনে ভেসে থাকা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মনের সকল কষ্ট নিয়ে ডাকলো,
– মা?

আম্বিয়া খাতুনের বুকটা এক নিমিষেই হু হু করে উঠলো। রেহবার উনার প্রথম সন্তান। মাতৃত্বের প্রথম অনুভূতি। ছেলের থেকে দূরে থাকতে সারাটা ক্ষণ মন পুড়ে। তিনি অস্থিরতা বোধ করলেও নিজেকে শান্ত রেখে জানতে চাইলেন,
– কি হয়েছে রেহবার? কোনো সমস্যায় পরেছ?

রেহবার অনেক দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করলো,
– তোমার মনে হয় না গুলিস্তার সাথে আমার বিয়েতে অনেক তাড়াহুড়ো করে ফেলেছি? কোনো খোঁজ খবর নিলাম না, কোনো কথাবার্তা হলো না। দেখা হলো, বিয়ে হলো।
– পরিস্থিতিই এমন ছিলো। কিন্তু এতোদিন পর এসব কথা আসছে কেনো? বিয়ে যেভাবেই হোক, এখন তো আলহামদুলিল্লাহ সবকিছু ভালোই চলছে। তাহলে এসব বলছো কেনো?
– কিছু একটা ঠিক নেই মা। বিদায়ের সময় দেখেছো, গুলিস্তার বাড়ির লোকজনের আচরণ কেমন অদ্ভুত ছিলো। যেনো মেয়ে বিদায় করে দিলেই বেঁচে যায়। বিয়ের পর রীতিমতো যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। মেয়ে কেমন আছে, তার কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা, শ্বশুরবাড়ির লোকজন ভালো কিনা -এসব নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। ও বাড়ির কেউ আমাদের সাথে যোগাযোগ করে না। বিয়ের পর গুলিস্তার ছোট ভাই দু একবার কল দিয়ে খোঁজ নিয়েছিলো। এখন তো সেটাও করে না।
– তুমি হঠাৎ ওর বাবার বাড়ির লোকজনদের নিয়ে চিন্তা করছো কেনো? শ্বশুরবাড়ির আদর-আপ্পায়ন মিস করছো? তোমার কথাবার্তা টিপিক্যাল বাঙালিদের মতো শোনাচ্ছে। শ্বশুরবাড়ির লোকজন খোঁজ নেয় না, দাওয়াত দেয় না, কোনো উপহার পাঠায় না।
– তোমার কি সত্যি আমাকে এমন মনে হয়? এসবের অপ্রয়োজনীয় রীতিনীতি আমার কখনোই পছন্দ ছিলো না।
– তাহলে এসব নিয়ে এতো ভাবছো কেন? তোমার বুঝা উচিত, উনারা ব্যস্ত মানুষ। পারিবারিক ব্যবসা নিয়ে সবার দিনরাত ছোটাছুটি করে। আপন বলতে আছে গুলিস্তার মা। উনি বৃদ্ধ মানুষ। বেশিরভাগ সময় বিছানায় শুয়ে বসে কাটায়। সেই বগুড়া থেকে সিলেট এসে মেয়ের খোঁজ খবর নেওয়া সম্ভব নয়।
– কল দিয়েও তো খোঁজ নেওয়া যায়।
– পুরনো আমলের মানুষজনের প্রযুক্তি ব্যবহারে একটি আধটু অনীহা থাকে। তাছাড়া সবাই যে তোমার আমার মতো করে ভাববে সেটা তো নাও হতে পারে। উনারা হয়তো মেয়ের বিয়ের পর তার সাথে যোগাযোগ কম রাখে। অনেকে জায়গায় মেয়েদের পরের বাড়ি সম্পদ হিসেবেই গণ্য করা হয়। বিয়ের আগ পর্যন্ত তাকে পরের আমানত হিসেবে দেখভাল করে। বিয়ের পর তাকে নিয়ে আর চিন্তা করে না। দায়িত্ব থেকে মুক্তি মিলেছে এই ভেবে নিজের জীবনে এগিয়ে যায়।
তোমার বিয়ে হয়েছে গুলিস্তার সাথে, আমরা বাড়ির বউ করে ওকে এনেছি। ওর পুরো পরিবারের দায়ভার নিয়ে সে আসে নি। তাই অন্যদের আচরণের প্রেক্ষিতে ওকে বিচার করবে না।
– তোমার গুলিস্তাকে অস্বাভাবিক মনে হয় না?

রেহবার ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে মাকে প্রশ্নটা করেই ফেললো। আম্বিয়া খাতুন ভ্রু কুচকে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। কি উত্তর দিবেন ভেবে পাচ্ছেন না। গুলিস্তার সাথে তিনি সময় কাটিয়েছেন, মাত্র ছয়দিন। মেয়েটা সারাক্ষণ উনার গা ঘেঁষে থাকতো। আদেশ-উপদেশ বিনাবাক্যে শুনেছে। দেশ ছেড়ে আসার পর প্রতিদিন নিয়ম করে গুলিস্তাই কল দিয়েছে। এখন আম্বিয়া খাতুন নিজেই ব্যস্ত হয়ে পরায় প্রতিদিন নিয়ম করে কথা বলা হয় না। তবে সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও দুজনের কথা হয়। কখনো কোনো কিছু অস্বাভাবিক মনে হয়নি। মেয়েটা যথেষ্ট ভদ্র এবং আদব কায়দা সম্পন্ন। শুধু একটু কথা কম বলে। এই আর কি। কিন্তু এটা তো দোষের কিছু নয়। তিনি গম্ভীর স্বরে ছেলের কাছে জানতে চাইলেন,
– কি বলতে চাইছো তুমি?

মা রেগে গেলো গলার স্বর গম্ভীর হয়ে যায়৷ প্রশ্নটা যে মায়ের পছন্দ হয়নি, তা টের পেয়ে রেহবার সতর্ক হলো। চেয়ার খানিকটা নড়েচড়ে বসে আমতাআমতা করে বললো,
– না মানে সারাক্ষণ চুপচাপ থাকে, কথা বলে মেপে মেপে। ধরতে গেলে নিজে থেকে কখনো কথা বলেই না।
– চুপচাপ থাকা কোনো দোষের কথা না। আমরা একেকজন একেকরকম মানুষ। কেউ স্বল্পভাষী হলেই সে অস্বাভাবিক হয়ে যায় না।
– ও কখনো হাসে না, কাঁদে না। মন খারাপ পর্যন্ত করতে দেখি নি।
– হাসতে হলে কারন লাগে। অহেতুক কারা হাসে জানো? পাগল। তুমি ওকে হাসির কারন দিতে পারোনি, এটা তোমার ব্যর্থতা। আর কখনো কাঁদেনি, এটা তোমার জন্য ভালো। যদি কখনো কাঁদিয়েছো, আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। ওকে আমি বাড়ির বউ করে নিয়ে আসিনি। নিজের মেয়ে মেনেছি। আশা করি আমার মান রাখবে।

রেহবার চুপ করে আছে। বলার আরও অনেককিছু থাকলেও সেসব মাকে বলা যায় না। মাকে কীভাবে বলবে, তোমার মেয়েসম বৌমাকে চুমু দিলে সে লজ্জা পায় না। বরং ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। কাছে টেনে নিলে লজ্জা পায় না, নির্লিপ্ত চেহারা লুকাতে বুকে মুখ গুজে থাকে। ও কখনো তীব্র কামনায় ভেসে যায় না। একটা জ্যান্ত লাশের মতো বিছানায় পরে থাকে।
রেহবার এক হাতে মাথার চুল টানছে। ছেলের মনের অস্থিরতা দেখে আম্বিয়া খাতুন খানিকটা নরম হলেন। আদুরে গলায় ছেলেকে ডাকলেন,
– রেহবার?

রেহবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকালো। আম্বিয়া খাতুন পারছেন না ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। সে কি এক অপারগতা! শুধু মায়ের মন বুঝে সেই অসহায় অনুভূতি। তবুও তিনি ছেলেকে আশ্বস্ত করতে চাইলেন।
– গুলিস্তার সাথে আমার প্রায় রোজ কথা হয়। সে কখনো তোমার নামে নালিশ দেয়নি। কোনো কিছু নিয়ে অভিযোগ করেনি। অথচ তুমি অভিযোগের পসরা সাজিয়ে বসে আছো। এটা তো ঠিক নয়।
তোমার মন অস্থির হয়ে আছে, আমি জানি। রাহিল, আমি চলে আসায় একা হয়ে গেছো। মানসিকভাবে ভেঙে পরেছো। আমাদের ছাড়া কখনো থাকোনি। তাই একাকিত্ব তোমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। আমাদের এভাবে তোমাকে একা রেখে আসা উচিত হয়নি। আমি ভেবেছিলাম নতুন জীবনের ব্যস্ততায় আমাদের কমতি তোমাকে বেশি পোড়াবে না। জীবনে নতুন মানুষের আগমন তোমার উপরে প্রভাব ফেলতে পারছে না কেনো বুঝতে পারছি না। হতে পারে তোমার অবচেতন মন বিয়েটা এখনো স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। চলে আসার তাড়াহুড়ায় এক প্রকার জোর করেই তোমার বিয়ে দেওয়াটা ভুল হয়েছে।
– বারবার নিজেকে দোষী প্রমাণ করতে চাইছো কেনো মা? বিয়েতে আমার সায় ছিলো বলেই তো বিয়েটা হয়েছে। তোমরা কেউ আমাকে জোর করো নি।
– যা ঠিক তাই বলছি। কিন্তু যা হয়ে গেছে সেটা বদলাতে পারবো না। এখন তোমাকে কষ্ট করে হলেও মানিয়ে নিতে হবে। যদি একবার মন থেকে মেনে নিতে পারো, যে সবকিছু ঠিক আছে। তবে দেখবে আর কোনো কিছু অস্বাভাবিক লাগছে না। বিয়ের দিন তুমি বলেছিলে, মেয়ের বয়স কম। সেই কথাটা সবসময় মাথায় রাখবে এবং সেই অনুপাতে গুলিস্তাকে ট্রিট করবে। ও যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠেছে। বিয়ের পর হঠাৎ সিলেট চলে এলো। এখানে সারাদিন একা থাকে, তুমি থাকো অফিসে। ওর ও তো একাকিত্বে ভুগে। হয়তো তোমাকে ভরসা করে উঠতে পারেনি বলে বলতে পারছে না। আমরা তার কাছেই নিজেকে প্রকাশ করি, যাকে ভরসা করা যায়। ওর ভরসার স্থানটা দখল করতে পারলে দেখবে তোমার সাথে অভিমান করবে, অভিযোগ দিবে, আবদার করবে। তোমরা নিজেদের অনুভূতিগুলো একে অপরের থেকে লুকিয়ে রেখেছো। কষ্টগুলো বুকের ভেতর চেপে রেখে নিজের মতো ভালো থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছো।
নিজেরা স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা না করে একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল হও।

মায়ের সাথে কথা বলার পর রেহবার সিদ্ধান্ত নিলো, সে এতো সহজে হাল ছেড়ে দিবে না। ধৈর্য্য ধরে প্রচেষ্টা করে গেলে অবশ্যই সমাধান খুঁজে পাবে। সত্যি কোনো সমস্যা থেকে থাকলে সেটা গুলিস্তার থেকে জানতে হবে। আদর যত্নের কাছের হিংস্র পশুরাও হার মানে। গুলিস্তা তার ভালোবাসায় একদিন ঠিকই সাড়া দিবে।

আম্বিয়া খাতুন ঘুমাতে যাওয়ার আগে ছেলের সাথে একবার কথা বলেন। কয়েক মিনিট কথা বলেই ঘুমিয়ে যান। কিন্তু আজকে কথোপকথন এতো দীর্ঘ ছিলো যে রাত পেরিয়ে নতুন দিনের সূচনা হতে চললো, অথচ উনার চোখে ঘুম নেই। ফোন রেখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন ভোর তিনটা বাজে। আজকাল রাহিলের নতুন শখ হয়েছে, সকালে ঘুম থেকে উঠে পার্কে হাঁটতে যাওয়া। আম্বিয়া খাতুনের নাকি বয়স হয়েছে এখন নিয়মিত ব্যায়াম না করলে শরীরে রোগ বাসা বাধবে। তাই সকাল সকাল ছেলের সাথে হাঁটতে যেতে হয়। এখন ঘুমালে হাতে গোনা তিন ঘন্টা ঘুম হবে। তবুও কি আর করার! লাইট অফ করে শুয়ে পরলেন।

রেহবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হতাশ হতে গিয়েও মায়ের কথা স্মরণ করে নিজেকে শাসালো। মন উদাস না করে ধৈর্য্য ধরতে হবে। গুলিস্তা কখনোই অকারণ রেহবারের খোঁজ করে না। সারারাত বাড়ি না ফিরলেও দেখা যাবে এই মেয়ে নাক ডেকে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।

আনমনে হেসে ঘরে ঢুকে দেখলো গুলিস্তা বিছানায় আধশোয়া হয়ে উপন্যাস পড়ছে। দরজা বন্ধ করতে করতে বলল,
– তুমি দেখি এখনো জেগে আছো!

গুলিস্তা বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রেহবারের দিকে তাকালো। ওর ডাগর ডাগর চোখের অদ্ভুত দৃষ্টি রেহবারের পরিচিত। গুলিস্তার উত্তরের অপেক্ষা না করে সে নিজেই বললো,
– ঘুম আসছে না, তাই জেগে আছো। এটাই তো বলবে?

বিছানায় গুলিস্তার পাশের জায়গাটি দখল করে ওর হাত থেকে বইটি নিয়ে সযত্নে বেড টেবিলে রেখে দিলো। তারপর ওকে বালিশে শুইয়ে দিতে দিতে বললো,
– এসো, আমি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।

গুলিস্তা চকিতে রেহবারের দিকে তাকালো। এর পরের ঘটনা সে আন্দাজ করে ফেলেছে। ওর ওমন করে তাকানো দেখে রেহবার হো হো করে হেসে বলল,
– কোনো দুষ্টুমি করবো না। সত্যি বলছি। ভদ্রভাবে ঘুম পাড়িয়ে দিবো। এই যে এভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, চুলে বিলি কেটে দিলে দ্রুত ঘুম চলে আসবে। তুমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো।

রেহবার এক হাতে ভর দিয়ে শুয়ে অন্য হাতে অল্প কিছুক্ষণ গুলিস্তার চুলে বিলি কেটে দিলো। এরমধ্যেই গুলিস্তার ভারী নিঃশ্বাস পরছে। রেহবার নিজের বালিশে মাথা ঠেকিয়ে তাকিয়ে রইলো ঘুমন্ত গুলিস্তার দিকে। হালকা নীলচে আলোয় গুলিস্তার সরল মুখশ্রী আরও সরল ও নিশপাপ দেখাচ্ছে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here