হে_সখা #অক্ষরময়ী নবম পর্ব

0
121

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
নবম পর্ব

হাতে ধরে থাকা আরণ্যক বইটি পড়া শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। এতোক্ষণ বইয়ের পাতা উল্টিয়ে চুম্বকাংশগুলো আরেকবার পড়ে দেখছিলো। সেগুলোও পড়া শেষ হয়ে গেলে বইটি বেড টেবিলে রেখে ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত প্রায় একটা বাজতে চললো। রেহবার এখনো বাড়ি ফিরেনি। এদিকে অপেক্ষা করতে করতে গুলিস্তা পর পর দুটো উপন্যাস পড়ে ফেলেছে। একটানা পড়ার কারনে মাথাটা ভীষণ ধরেছে,প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে। এখন আর বই সামনে নিয়ে বসে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু এভাবে বসে থাকলে এক্ষুণি ঘুমিয়ে পরবে। স্বামী বাড়িতে ফিরেনি অথচ সে ঘুমিয়ে পরেছে এ কথা মায়ের কাছে পৌছালো, ওকে আস্ত রাখবে না। গুলিস্তা হাই তুলতে তুলতে কিচেনের দিকে গেলো। সকালের জন্য পরোটার ডো বানিয়ে রাখলে কাজও এগিয়ে যাবে, সময় কাটবে। এক কাপ চা খেলে মাথা ব্যথাটা কমে যেতো। কিন্তু এখন চা খেলে আবার ঘুম কেটে যাবে। ঘুমের ব্যঘাত ঘটলে সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী হবে। সবদিক বিবেচনা করে আর চা বানালো না।
রেহবার ফিরলো কিছুক্ষণ পর। স্বাভাবিক ভাবে বাড়িতে প্রবেশ করে গুলিস্তাকে রান্নাঘরে দেখে বললো,
– এতো রাতে রান্নাঘরে কি করছো? ঘুমাওনি কেনো এখনো?
– সকালের জন্য কিছু কাজ গুছিয়ে রাখছিলাম। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন, টেবিলে খাবার দিয়ে দিচ্ছি।

স্বাভাবিকভাবেই কথাগুলো বলে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। রেহবার ভেবেছিলো ওর দেরীতে বাড়ি ফেরা নিয়ে গুলিস্তা অন্তত প্রশ্ন করবে। সেজন্যই তো ইচ্ছে করে অফিস থেকে দেরী করে বাড়ি ফিরলো। নাহ, এই মেয়ে এতো সহজে পথে আসবে না। শুধু শুধু এতোক্ষণ অফিসে বসে পিঠের ব্যথা ধরালো। রেহবারের মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো।

খেতে বসে রেহবার এক হাতে ফোন ধরে রেখেছে। খুব মনোযোগ দিয়ে কিছুটা একটা দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে। এদিকে মাথা ব্যথার কারনে গুলিস্তা কিছু খেতে পারছে না। প্লেটের খাবার নাড়াচাড়া করে যাচ্ছে। রেহবারের খাওয়া শেষ হলে সে উঠে যাবে। সবকিছু দ্রুত গুছিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে পারলেই শান্তি। কিন্তু রেহবারের খাওয়া শেষ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সে ফোনে মুখ গুঁজে কোনোরকম দু চারটে ভাত মুখে তুলছে। এভাবে খেতে থাকলে রাত পার হয়ে যাবে তবুও প্লেটের খাবার শেষ হবে না। আর সহ্য করতে না পেরে গুলিস্তা টেবিল ছেড়ে উঠে পরলো। তা দেখে রেহবার ফোন হতে চোখ তুলে চাইলো।
– খাওয়া শেষ? কিছুই খেলে না দেখছি। প্লেটে খাবার ওভাবেই পরে আছে।

খাবার অপচয় করা গুলিস্তার পছন্দ নয়। বাধ্য হয়ে আজকে খাবার ছেড়ে উঠতে হলো। তার উপর রেহবারের প্রশ্নে থমথমে খেয়ে বললো,
– খেতে ইচ্ছে করছে না।

ও উঠে চলে যেতেই রেহবার ফোন রেখে দ্রুত খেয়ে নিয়ে টেবিল গুছানোর কাজে সাহায্য করলো। দুজনে মিলে কাজ করাতে দ্রুত কাজ শেষ হয়ে গেলো। ঘরে গিয়ে হঠাৎ ট্রাউজারের পকেটে হাত দিয়ে ফোন খুঁজে না পেয়ে গুলিস্তাকে বললো,
– ফোনটা মনে হয় টেবিলের উপর রেখে এসেছি। নিয়ে এসো না, প্লিজ।

গুলিস্তাকে ফোন নিয়ে আসতে হলরুমে ফিরে যেতে দেখে রেহবার আরাম করে বিছানায় শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। এবার তার বরফ কঠিন ডোন্ট কেয়ার টাইপের স্ত্রী আর চুপ করে থাকতে পারবে না। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে গুলিস্তা স্বাভাবিকভাবেই ঘরে ফিরে এলো। ফোন হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিছানায় অপরপ্রান্তে নিজের জায়গায় শুয়ে পরলো। হতম্বভ রেহবার কিছুক্ষণ পর ওর ভারী নিঃশ্বাসের আওয়াজ পেয়ে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো। ফোন চেক করে শিওর হয়ে হলো ওর প্ল্যান ঠিকমতো কাজ করেছিলো। স্ক্রীনে এখনো ছবিটি দেখা যাচ্ছে। তাহলে আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া পেলো না কেনো?

ফোনের স্ক্রীনে রেহবারের সাথে একটি মেয়ে ভীষণ কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। দুজন দুজনের কাঁধে হাত দিয়ে হাস্যোজ্জবল মুখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। যে কেউ এক পলক দেখে, পারফেক্ট লাভ বার্ডের খেতাপ দিতে বাধ্য। মূলত ভার্সিটির ফেস্টিভ্যালের একটি ড্রামার একটি অংশের মোমেন্ট ক্যাপচার করা হয়েছে ছবিটিতে। আজ সারাদিন অনেক খুঁজে গুগল ড্রাইভ থেকে ছবিটি উদ্ধার করে পরিকল্পনা সাজিয়েছে। ইচ্ছে করেই ডাইনিং টেবিলের উপর ফোনটি রেখে এসেছিলো। স্ক্রীনটাইম বাড়িয়ে পাঁচ মিনিট করে রেখেছিলো। যাতে গুলিস্তা ফোনের কাছে গিয়ে উজ্জ্বল স্ক্রীনে এই ছবিটি দেখতে পায়। প্ল্যান অনুসারে দেখেছিলোও কিন্তু পরবর্তী ধাপে হিংসা কিংবা সন্দেহের যে অংশটি ছিলো সেটি আর দেখা গেলো না। রেহবার হতাশ হয়ে ফোনটি রেখে বিড়বিড় করে বললো, কোনো পাত্তাই দিলো না। আজব!

পরদিন অফিসে লিতুনের মেজাজ ফুরফুরে থাকলেও বসের মেজাজ ছিলো তুঙ্গে। সামান্য ভুলেও একে ওকে ধমকে বকে একাকার অবস্থা। অফিসের সবাই তটস্থ হয়ে কাজ করছে। এমনকি নির্ধারিত সময়ের পরেও অনেকে লাঞ্চ ব্রেকে গেলো না। ভুল সংশোধন করার কাজে ব্যস্ত থাকলো।
লাঞ্চের পর রেহবারের জন্য এক কাপ ব্ল্যাক কফি নিয়ে যায় লিতুন। আজ কফি কাপ হাতে কেবিনের ভেতরে যাওয়ার আগে সাহস যোগাতে হচ্ছে। লিতুন বুঝতে পারছে না, গতকাল যে মানুষটা ফুরফুরে মেজাজে ছিলো তার আজকে হঠাৎ কি হলো! ক্ষণিকেই মনে পরলো, স্যারের তো এখন বিয়ে হয়েছে। ঘরে বউ থাকলে বউয়ের মুড সুয়িং এর সাথে ছেলেদের মেজাজের পরিবর্তন ঘটে। তাই বিয়ের পর মেজাজের এমন খেই হারানো অস্বাভাবিক কিছু নয়।

কেবিনের শীতল আবহাওয়ায় রেহবারের গম্ভীর মুখখানা দেখে লিতুনের আত্মা পালাই পালাই করছে। বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে সে কফির মগ এগিয়ে দিলো।
– স্যার আপনার কফি।

রেহবার হাত বাড়িয়ে কফি নিয়ে শীতল কন্ঠে আদেশ দিলো,
– বসো।

লিতুন ভেবেছিলো কফি দিয়েই সে ফুড়ুৎ করে উড়াল দিবে। তা আর হলো না। বাধ্য মেয়ের মতো চেয়ার টেনে নিঃশব্দে বসলো। রেহবার আয়েশ করে কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
– তুহিনের সাথে অন্য মেয়ের ছবি দেখে তুমি রিয়েক্ট করেছিলো কেনো?

লিতুন অবাক হয়ে ক্ষীনকাল চেয়ে রইলো। অফিসের এমন থমথমে পরিবেশে বস তার সাথে ব্যক্তিগত বিষয়ে আলোচনা করছে, ব্যাপারটা ওর বিশ্বাস হচ্ছে না। রেহবার উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে আছে দেখে হড়বড় করে বললো,
– আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে কেউ এভাবে ছবি তুলবে আমি কিছু বলবো না!
– অবশ্যই বলবে। কিন্তু কেনো বলেছো?
– ছবিতে অন্য মেয়ের সাথে ওকে দেখে আমার খারাপ লেগেছে, রাগ হয়েছে।
– সব মেয়েরা এমন রিয়েক্ট করে?
– অবশ্যই করে। আমরা মেয়েরা নিজেদের জিনিস নিয়ে অনেক পজেসিভ। এখানে তো লাইফ পার্টনারের কথা। সামান্য কারনেই বুক ছ্যাঁত করে উঠে। হারিয়ে ফেলার ভয়ে মাথায় উল্টাপাল্টা খেয়াল আসে। ভয়ের কারনেই রিয়েক্ট করে বসি। যেমনটা গতকাল আমি করেছিলাম।
– আর কেউ যদি এমন সিচ্যুয়েশনে রিয়েক্ট না করে, তাহলে?
– মানে? বুঝলাম না স্যার।
– মানে, তোমার কোনো জিনিস তোমার থেকে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখতে পেয়েও তুমি কোনো রিয়েক্ট করলে না। কখন করবে এমনটা? কেনো করবে?

লিতুন খানিকক্ষণ ভাবলো। কিছু হারিয়ে গেলে, অন্য কারো দখলে চলে গেলে খারাপ লাগবে না, কিছু অনুভব করবে না। এমনটা কি হতে পারে? লিতুন বরাবর নিজের জিনিসপত্রের প্রতি ভীষণ যত্নশীল এবং পজেসিভ। সাজগোজের জিনিসপত্রও ছোটবোনকে ছুতে দেয় না। শুধু একবার নিজের সুন্দর একটা ড্রেস ওকে দিয়েছিলো। লিতুন তখন থ্রিপিস পরতো না। কিন্তু ছোট খালা ওর জন্য ইন্ডিয়া থেকে একটি থ্রিপিস এনে দিয়েছিলো। মায়ের জেদে সেটি একবার পরার পর আর কখনো গায়ে জড়ায়নি। দেখতে খুব সুন্দর ছিলো বিধায় ছোটবোন একদিন পরতে চেয়েছিলো। লিতুন সেটা ওকে একেবারে দিয়েছে।

– তখনই রিয়েক্ট করবো না, কষ্ট পাবো না, কোনো কিছু অনুভব করবো না যখন সেই জিনিসের প্রতি আমার কোনো আগ্রহ থাকবে না। আমার পছন্দের কিছু হলে সেটির প্রতি ভালো লাগা থাকবে। তাই সেটি হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখলে আপনা থেকেই প্রতিক্রিয়া চলে আসবে এবং রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবো।
– জরুরি কিছু হলেও প্রতিক্রিয়া দেখাবে না?

লিতুন ভাবলো, ড্রেসটি জরুরি একটি পণ্য ছিলো কিন্তু সেটির বিকল্প অন্য অনেক ড্রেস ছিলো। তাই প্রয়োজনবোধ অন্য ড্রেস দ্বারা পূর্ণ হয়েছে।
– হাতে অল্টারনেটিভ থাকলে খুব একটা প্রয়োজনবোধ হয় না। হারিয়ে গেলোও অভাববোধ হবে না। থাকা না থাকা সমান। বরং কাছে থাকলে হাঁসফাঁস লাগতে পারে। চোখের সামনে পরলে অস্বস্তি হতে পারে। যতো দ্রুত নজরের বাইরে করে ফেলা যায়, স্বস্তি মিলে। আর জরুরি প্রয়োজনটি যদি অন্য কিছু দ্বারা পূর্ণ করা সম্ভব হয় এবং সেটি আমাদের হাতের নাগালে থাকে, বিকল্পটি আমাদের বেশি পছন্দের হয় তাহলে শুধু শুধু হারিয়ে যাওয়া বস্তুর কথা ভেবে সময় নষ্ট কেনো করবো? লাইফ গোস অন, রাইট? তাই আমরাও মুভ অন করে যাই।

রেহবার মনে মনে প্রশ্ন করতে থাকলো, আমার প্রতি তোমার আগ্রহ নেই, নাকি আমি তোমার জীবনে জরুরি কেউ নই? আমার অল্টারনেটিভ কেউ আছে নাকি আমাকে তোমার প্রয়োজন নেই? তোমাকে আমি বুঝি না, ফুল? কিন্তু আমার যে এই ধাঁধার উত্তর চাই। সে যে করেই হোক।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here