হে_সখা #অক্ষরময়ী বিংশ পর্ব

0
139

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
বিংশ পর্ব

সকালে একগাদা মার খেয়ে পেট ভরে গেছে তাই মেয়েটা সকালে আর কিছু মুখে তুলেনি৷ রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকায় শর্মী নিজেও খোঁজ নেওয়ার সময় পায়নি৷ সীমা বেগম নিজেও গোঁ ধরে বসে আসেন, ছেলের সংসারের অন্ন আর মুখে তুলবেন না। শর্মী অনেক অনুরোধ করে, ক্ষমা চেয়ে দুপুরের দিকে ভাত খাওয়াতে পেরেছে। মাকে সামলে মেয়ের খোঁজ নিতে গিয়ে আঁতকে উঠলো শর্মী। গুলিস্তা গায়ে ভীষণ জ্বর। বিছানায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে অনবরত কেপে যাচ্ছে পাতলা গড়নের শরীরটি। লেপ, কম্বলে শরীর মুড়ে দিয়ে সে ছুটলো রান্নাঘরে। গরুর গোশতে বড় আকারে আলু কেটে দিয়ে কষানো তরকারি গুলিস্তার ভীষণ পছন্দ। ঝাল দিয়ে রান্না করে ভাত মেখে নিজে হাতে একটু খাইয়ে দিলো। খালি পেটে ঔষধ খাওয়া যাবে না দেখে কষ্ট হলেও গুলিস্তা খানিকটা খেয়ে নিলো৷ ঔষধ খাইয়ে ঘর ছাড়তেই গুলিস্তা ছুটে গেলে বাথরুমে। পেটের মধ্যে যা ছিলো সবটুকু উগড়ে দিলো। ক্লান্ত শরীরটি টেনে বিছানায় নিয়ে আসার মতো শক্তি অবশিষ্ট নেই। নেহাত শর্মী ছিলো। কোনোরকম ধরে বিছানায় শুইয়ে দিতেই নিদ্রা পথে পাড়ি দিলো গুলিস্তা। দিনভর ছোটাছুটি করে শর্মী নিজেও ক্লান্ত৷ জলপট্টি দেওয়া দরকার কিন্তু শর্মীর দেহ আর সায় দিচ্ছে না। খানিকটা বিশ্রাম দরকার। গুলিস্তার শিয়রে বসে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেওয়া যায়৷

রেহবার যখন বগুড়া পৌছালো, তখন তপ্ত সূর্য ম্লান হতে চলেছে। শীতের আগমনের বার্তা স্বরুপ সূর্যটাও দ্রুত পালাই পালাই করে। তিক্ত অনুভূতি রেহবারের মন জুড়ে৷ আজকে একটা রফাদফা করে তবেই ফিরবে। রেহবার না হয় খানিকটা সময় চেয়ে ওকে বগুড়ায় পাঠিয়ে দিয়েছে, কিন্তু এই মেয়ের এতো ভাব যে বগুড়া পৌঁছানোর পর একবার কল দিয়ে জানানোর প্রয়োজনটুকুও মনে করেনি। ভোর থেকে রেহবার ফোনের দিকে চেয়ে ছিলো। গুলিস্তা ঠিকমতো পৌছালো কিনা এই চিন্তায় রাতভর অস্থির ভাবে বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কেটেছে। ভোর পেরিয়ে সকাল হলো, সকাল পেরিয়ে দুপুর। বাধ্য হয়ে রেহবার নিজেই কল দিয়েছিলো। মেয়ে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন যে, ফোনটা বন্ধ করে রেখে দিয়েছে। রাগে, অপমানে রেহবারের ইচ্ছে করছিলো তখনি বগুড়ায় এসে জোরসে একটা ধমক দিতে।
নিজে ফোন বন্ধ করে রেখে ভাব দেখাচ্ছিলো আর এখন শ্বাশুড়ি-দেবর সবাইকে কল দিয়ে নালিশ করা হচ্ছে। পুরো বংশের রেফারেন্স নিতে পারবে তবুও রেহবারের নিকট মাথা নোয়াবে না। এসব নিয়ে যতোই ভাবছে, ততোই মেজাজ খারাপ হচ্ছে।
আজকে এখানেই সব সম্পর্ক চুকেবুকে দিয়ে ফিরে যাবে নিজ শহরে। অনেক হয়েছে ধৈর্যের পরীক্ষা।

রেহবারকে দেখে সীমা বেগম খানিকটা নড়েচড়ে বসলেন। ফোন করার পর এতো দ্রুত চলে আসবে এমনটা ভাবেননি তিনি। সকালবেলা যখন মেয়ের ঘর ছেড়েছিলেন, ওর অবস্থা তেমন একটা ভালো ছিলো না। এখন কী অবস্থায় আছে কে জানে! জামাইয়ের সামনে মেয়েকে এমনভাবে হাজির করা তো যায় না। কাছাকাছি কোথাও শর্মীকেও দেখা যাচ্ছে না। রেহবারকে দরজা খুলে দিয়েছিলো আলিয়া। সীমা বেগমের নিকট পৌছে দিয়ে এই মেয়ে ছুটে গেছে রান্না ঘরে। সীমা বেগম ডাকলেন,
– আলিয়া, এই আলিয়া।
রান্নাঘর থেকে আলিয়া উত্তর দিলো, আসতেছি।
সামনে বসে থাকা রেহবারের দিকে তাকিয়ে সীমা বেগম একটু হাসার চেষ্টা করলেন।
– অল্প বয়সী মেয়েকে বাড়ির বউ করে আনলে যা হয় আরকি। সারাক্ষণ ছোটাছুটি করে৷ স্থির হয়ে এক জায়গায় বসা এদের ধাতে নাই৷ অনেকটা পথ পাড়ি আসছো। তুমি বসো, রেস্ট নেও।

আশেপাশে নজর বুলিয়ে রেহবার বললো,
– গুলিস্তা কোথায়? ওকে দেখছি না।
– নিজের ঘরে আছে। তোমার আসার খবর পায়নি। ওরে তো জানানোই হয়নি যে তুমি আসতেছো। আমি লুকিয়ে সব ব্যবস্থা করছি। সারাদিন মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাই ভাবলাম সারপ্রাইজ দেই।

হো হো করে হেসে উঠলেন সীমা বেগম। সেই হাসি রেহবার যোগ দিলো না। অস্থিরভাবে চতুর্দিকে তাকালো। বাধ্য হয়ে সীমা বেগম বললেন,
– খবর পাঠাইতেছি৷ ওই আলিয়া, শর্মী কই?
– জানি না। গুলিস্তার ঘরে গেছিলো। তারপর আর দেখি নাই। ওখানেই আছে মনে হয়।

রেহবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে বললো,
– আমি বরং নিজেই গিয়ে দেখা করে আসি৷ কোন ঘরটা?
– আরে তুমি যাইবা কেন! বসো, বসো। বড় বউমা ওরে নিয়ে আসতেছে।
– আমি নিজেই যেতে পারবো। ঘরটা দেখিয়ে দিন।

সীমা বেগম হাতের ইশারায় ঘর দেখিয়ে দিলেন। আজকাল হাঁটুর ব্যথাটা ভীষণ বেড়েছে। হাঁটাচলা করায় ভীষণ বেগ পেতে হচ্ছে। সকালের পর তো ঠিকমতো দাড়াতেই পারছেন না। পুরনো আমলের বাড়ি। বৈঠকখানা থেকে উপরের সবগুলো দেখা যায়৷ সিড়ি বেয়ে রেহবার ঘরের দিকে যাচ্ছে৷ সীমা বেগম অস্থিরভাবে ডাকতে থাকলেন, শর্মী, এই শর্মী…

দরজায় কড়া নাড়তেই শর্মীর ঘুম ভেঙে গেলো। ও ভাবলো আলিয়া এসেছে। নিজেকে ধাতস্থ করে উত্তর দিলো,
– দরজা খোলা আছে।

দরজা খুলে রেহবারকে প্রবেশ করতে দেখে শর্মী কিছু মূহুর্ত স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলো। একবার রেহবারের দিকে তাকায়, আরেকবার বিছানায় শুয়ে থাকা গুলিস্তার দিকে। রেহবার নিজেও অবাক চোখে গুলিস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে এসেছে। এবেলা কে ঘুমিয়ে থাকে!
ধীর পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতেই শর্মী খানিকটা দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে বললো,
– গায়ে ভীষণ জ্বর।

জ্বরের কারনে গুলিস্তার মুখমণ্ডল খানিকটা লালচে দেখাচ্ছে। শুষ্ক ঠোঁটগুলো যেনো রুক্ষ মরুভূমি। ঘুমন্ত গুলিস্তার পাশে বসে রেহবার আলতো করে গুলিস্তার গালে হাত রাখলো। ঠান্ডা হাতের স্পর্শে গুলিস্তা খানিকটা কেঁপে উঠলেও ক্ষণকাল পরেই আবার শান্ত হয়ে গেলো। খুব নিকটে থাকায় গুলিস্তার মুখমণ্ডল জুড়ে ক্ষুদ্র ক্ষতগুলো রেহবারের নজড় এড়াল না। ডান ভ্রু এর পাশে একটা ক্ষত দেখা যাচ্ছে। তাজা রক্ত শুকিয়ে কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। সেই ক্ষত আঙ্গুল দিয়ে ছুতেই গুলিস্তা চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। অজান্তেই লেপের নিচ থেকে হাত বের করে রেহবারের আঙ্গুল সরিয়ে দিলো। রেহবার অবাক হয়ে খেয়াল করলো ফর্সা হাতে কিছু ক্ষত দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু জায়গা জুড়ে লালচে ত্বক। শক্ত কিছুর আঘাতে যেমনটা হয়। গা থেকে লেপটি খানিকটা সরিয়ে ওকে পর্যবেক্ষণ করে রেহবার অবাক চোখে শর্মীর দিকে তাকালো।
লজ্জায় শর্মীর ইচ্ছে করছে মাটিতে মিশে যেতে। ও মাথা নিচু করে বললো,
– মা মেরেছে।

রাগে রেহবারের মুখের পেশিগুলো শক্ত হয়ে এসেছে। বহু কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে শর্মীর উদ্দেশ্যে বললো,
– ওকে একটু রেডি করে দিতে পারবেন? অসুবিধা না হলে ওর ব্যাগটা একটু গুছিয়ে দিন ভাবী।

রেহবারকে দ্রুত ঘর ছাড়তে দেখে শর্মী বলল,
– ওকে এখানে কেনো পাঠালে ভাই? এতোদিন ধরে একবার খোঁজ খবরও নিলে না।
জবাবদিহি করার মতো করে রেহবার বললো,
– আমি কল দিয়েছিলাম। ফোন বন্ধ করে রেখেছে।
– চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিলো। ভুলেই চার্জার রেখে এসেছে। ওকে একা পাঠানো উচিত হয়নি তোমার।
– মোটেও উচিত হয়নি। আর পাঠাবো না।

গুলিস্তার দরজায় বাইরে অপেক্ষমান কয়েক মিনিট রেহবারের নিকট কয়েক বছর মনে হলো। নিচ থেকে সীমা বেগমের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অনুভব করতে পেরেও সেদিকে তাকালো না। দরজা খুলে শর্মী উঁকি দিয়ে বললো,
– ভেতরে এসো।

কাপড় ভিজিয়ে গুলিস্তার মুখ হাত মুছে দিয়ে একটা সালোয়ার কামিজ পরিয়েছে। ঘুম ভেঙে গেলেও ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে গুলিস্তার। জ্বরের কারনে চোখ জ্বালা করছে। বেশিক্ষণ চোখ মেলে তাকিয়ে থাকা দায়। বিছানায় হেলাম দিয়ে সামনে তাকাতেই দরজা খুলে রেহবারকে প্রবেশ করতে দেখে গুলিস্তার চোখে জল জমতে শুরু করলো।
– হাঁটতে পারবে?

মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালেও উঠে দাড়াতেই মাথা ঘুরে উঠলো। রেহবারের হাত ধরে পতন ঠেকানো গেলেও এ অবস্থায় সিড়ি বেয়ে নিচে না সম্ভব নয়।
রেহবার বিনাবাক্যে ওকে কোলে তুলে নিলো। ওদের ধুপধাপ সিড়ি বেয়ে নামতে দেখে সীমা বেগম ভীষণ অবাক হলেন। কাঠিন্যে ভরা রেহবারের মুখ দেখে কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও এভাবে বাড়ি ছাড়ার ব্যাপারটা তিনি মেনে নিতে পারছেন না। কোথায় ভেবেছিলেন জামাইকে ডেকে এনে একটা দিন ভালোভাবে আপ্যায়ন করবেন, পাড়া প্রতিবেশীর নিকট জামাইকে উপস্থাপন করবেন। কিন্তু এভাবে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে পাড়ায় আরেক গুজব ছড়িয়ে পরবে। ওদের পেছনে কাপড়ের ব্যাগ হাতে শর্মী আসছে। ওকে দেখে সীমা বেগম বললেন,
– এই শর্মী, এসব কি হইতেছে? জামাই না মাত্র আসলো। এখনি কই যায়?
– চলে যাইতে আম্মা।
রেহবার ও শর্মী কেউ ক্ষণকাল এই মহিলার জন্য ব্যয় করতে প্রস্তুত নয়।

আকবর বাড়ির সামনে একটা চকচকে কার দাঁড়িয়ে আছে। এই দৃশ্য অনেকের কাছে নতুন। পাড়ার ছোট বাচ্চারা গাড়ির আশেপাশে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে দেখছে। মহিলা সদস্যরা ধৈর্য্য ধরে গাড়ির মালিককে দেখার এবং পরিস্থিতি বুঝায় চেষ্টা করছে। গুলিস্তাকে কোলে নিয়ে রেহবারকে বের হতে দেখে মুহূর্তেই গুঞ্জন শুরু হলো।
গুলিস্তাকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে রেহবার এক মুহুর্ত ব্যয় না করে নিজেও গাড়িতে বসে শর্মীকে বলল,
– ধন্যবাদ ভাবী।
– তোমার ফোন নাম্বারটা দাও তো ভাই। তোমার নিশ্চয়ই অনেক প্রশ্ন আছে৷
– সেসবের আর প্রয়োজন নেই। কোনো উত্তর জানতে চাই না আমি।
– কিছু কথা জেনে নিলে গুলিস্তাকে বুঝতে সুবিধা হবে। ও খানিকটা অন্যরকম। এতোদিনে নিশ্চয়ই বুঝে গেছো। তবুও এতোদিন সহ্য করেছো, তারমানে তোমার যথেষ্ট ধৈর্য্য আছে।
নিজের কার্ড বের বের করে শর্মীর হাতে দিলে সে বললো,
– আমি সুযোগ বুঝে কল করবো। এখন দ্রুত বের হও৷
কয়েকজন মহিলাকে এগিয়ে আসতে দেখে শর্মী দ্রুত পায়ে বাড়ির ফিরে যেতে চাইলো। কিন্তু ততোক্ষণে দেরী হয়ে গেছে।
– ব্যাপার কী রে শর্মী? জামাই নাকি?

মুখে হাসি ফুটিয়ে শর্মী বললো,
– হ্যাঁ, চাচি৷
– এমনে চলে গেলো কেন? কখন আসছে? আমরা কেউ দেখলাম না।
– ব্যস্ত মানুষ। শ্বশুরবাড়িতে থাকার সময় কই। গুলিস্তার জ্বর শুনে, কাজকর্ম ফেলে ছুটে আসছে।
– তোরা তো পারলে মেয়েটাকে মেরেই ফেলিস! বাপের বাড়ি আসতেই জ্বর বাধিয়ে ফেললো! অদ্ভুত!
– আমি যাই চাচি। ঘরে অনেক কাজ জমে আছে।

মহিলাদের এড়িয়ে গেলেও সীমা বেগমকে এড়িয়ে যাওয়া গেলো না। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শর্মীকে পর্যবেক্ষণ করে বললেন,
– ঘটনাটা কি ঘটলো বড় বউ? খুলে কও তো।
– গুলিস্তার গায়ে ভীষণ জ্বর। জামাই বললো ডাক্তার দেখানো লাগবে। এতো জ্বর সত্ত্বেও ঘরে ফালায় রাখছি, এই নিয়ে সামান্য নারাজ হইছে আম্মা। বেশি কিছু না। যেমনেই হোক, গুলিস্তাকে দ্রুত ফেরত পাঠানো গেছে এটা তো ভালোই। তাই না আম্মা?

সীমা বেগম গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন। শর্মী সেখানে আর দাঁড়ালো না। দ্রুত রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করলো।

(চলবে..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here