#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
ষষ্ঠ পর্ব
(১৬+ সতর্কতা)
হালকা নীলচে আলোয় ঘরের চেনার পরিবেশ রহস্যময় হয়ে উঠে। এই আলো আধারীতে রেহবারের ঘুম ভালো হয়। সে ছোটবেলা থেকেই একদম অন্ধকারে ঘুমাতে পারতো না। ঘরে আলো জ্বেলে ঘুমাতো। ও ঘুমিয়ে গেলে আম্বিয়া খাতুন ছেলের ঘরে এসে আলো নিভিয়ে দিয়ে যেতো। রেহবার এখন বড় হয়েছে, আম্বিয়া খাতুনেরও বয়স হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে উঠানামা খুব কম করেন। তাছাড়া রেহবারের বাড়ি ফেরার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। কখনো বাড়ি ফিরতে ফিরতে মাঝ রাত হয়ে যায়। এখন সে ডীম লাইটের আলো জ্বালিয়ে রাখে সারারাত।
গভীর রাতে হঠাৎ করে রেহবারের ঘুম হালকা হয়ে গেলো। পাশ ফিরে শুতে গিয়ে দেখলো গুলিস্তা বিছানায় নেই। প্রথমে ভাবলো হয়তো ওয়াশরুমে গিয়েছে। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করেও ঘুম এলো না। মনের মধ্যে খচখচ করছে। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পর আবার চোখ খুলে নীলচে আলোয় ঘরের চর্তুদিকে নজর বুলিয়ে নিলো। গুলিস্তাকে ঘরের কোথাও দেখতে না পেয়ে উঠে বসলো। না চাইতেও মনের মধ্যে সন্দেহ ঘুরাঘুরি করছে। কিছুটা একটা ঠিক নেই, এই ভাবনা থেকেই আজকাল রেহবার সতর্ক চোখে সবকিছু নিরীক্ষণ করে।
বেড টেবিলের উপর গুলিস্তার মোবাইল রাখা। ওয়াশরুম চেক করে সেখানেও গুলিস্তাকে পাওয়া গেলো না। বাইরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। হলরুমে দেখবে ভেবে ঘর ছেড়ে বের হতে গিয়ে কী যেনো মনে করে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গেলো। ব্যালকনির দরজা খুলতেই ঘরের হালকা নীল আলোয় অন্ধকার কেটে গুলিস্তার অবয়ব ভেসে উঠলো। গ্রীল ধরে এপাশে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি আকাশের ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের দিকে। রেহবার সাবধানে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ালো। হঠাৎ কারো উপস্থিতিতে ভয় পেতে পারে ভেবে ধীর কন্ঠে ডাকলো,
– ফুল?
গুলিস্তা ভয় পেলো না। বরং স্বাভাবিক ভাবেই পাশ ফিরে তাকালো। ততোক্ষণে ব্যালকনির দরজা বন্ধ হয়ে চারদিক অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। মৃদু চাঁদের আলোয় আবছা অবয়ব ছায়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবুও ওরা একে অপরের দিকে চেয়ে রইলো।
– তুমি এখানে কি করছো?
– ঘুম আসছে না।
– আমাকে ডাকতে। এভাবে একা একা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতে ভয় লাগছে না?
– আমার অন্ধকার ভালো লাগে।
– অদ্ভুত! তোমাকে আমি মাঝেমধ্যে বুঝতেই পারি না।
আজকাল রেহবারের দিন কাটে কাজে কর্মে আর বিশ্রাম নিয়ে। গভীর ঘুমের পর জেগে যাওয়ার কারনে এতোক্ষণে ঘুম কেটে গেছে। শরীর ও মনে ফুরফুরে ভাব। গভীর রাতে জীবন সঙ্গীর সাথে কিছু মুহুর্ত কাটানো মন্দ বলে মনে হচ্ছে না। রেহবার এক হাতে গুলিস্তাকে নিজের কাছে টেনে নিলো। গুলিস্তা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি ছুড়ে দিলো ওর দিকে। সে দৃষ্টি উপেক্ষা করে রেহবার খোলা আকাশে তাকিয়ে বাহানা খুঁজে যাচ্ছে মন ভালো করার। মাথার উপরে খোলা আকাশ, তাতে তারার মতো উজ্জ্বল এক ফালি চাঁদ। চারদিকে নিস্তবদ্ধতা, বুকের সাথে লেপ্টে থাকা প্রিয়তমা স্ত্রী। মনে জমে থাকা অবান্তর মেঘগুলো উড়ে যেতে বেশি সময় লাগলো না। পরিষ্কার আকাশে কোথা থেকে মেঘ এসে খালিক পর পর চাঁদকে ঢেকে দিচ্ছে। তারপর ধীরে ধীরে চাঁদকে ছেড়ে চলেও যাচ্ছে। মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলায় চাঁদের আলো একেক সময় একেক ধাঁচের আলো বিলিয়ে দিচ্ছে ধরণীর বুকে। রেহবার দু হাতে শক্ত করে আগলে নিলো অদ্ভুত আচরণের মেয়েটিকে।
যেতে যেতে সময় অনেকখানি চলে গেছে। খানিকবাদেই চারপাশে আলো ফুটতে শুরু করবে। রেহবার গুলিস্তার মাথায় থুতনি ঠেকিয়ে শুধালো,
– ঘুম আসছে না এখনো?
মিথ্যা বলা গুলিস্তার কর্ম নয়। সে স্বল্প শব্দে উত্তর দিলো,
– উহু।
ভোরের আগমনের শুরুতে জেগে উঠা শরীরে সাথে তাল মিলিয়ে রেহবারের ঠোঁটে ফুটলো দূর্বদ্ধ হাসি। গুলিস্তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,
– রুমে চলো। তোমার ঘুমের ব্যবস্থা আমি করতেছি।
অবুঝ গুলিস্তা রেহবারের কথার অর্থ বুঝতে না পেরে তার দিকে তাকাতেই যাচ্ছিলো। কিন্তু ওকে সেই সুযোগ না দিয়ে রেহবার ওকে পাঁজাকোলে তুলে রুমে এনে বিছানায় শুইয়ে দিলো। বেড সাইডে টেবিল ল্যাম্প অন করে দিয়ে রেহবার গভীর দৃষ্টি দিলো গুলিস্তার স্নিগ্ধ মুখশ্রীতে। গুলিস্তা ততোক্ষণে আলতো করে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলেছে। রেহবার তার সম্মোহন কন্ঠে ডাকলো,
– ফুল, চোখ খোলো। তাকাও।
রেহবারের সম্মোহন বোধ হয় ঠিকঠাক কাজ করতে না পেরে বিফলে গেলো। গুলিস্তা উল্টো চোখদুটো শক্ত করে বন্ধ করে নিয়েছে। রেহবার ওর গালে আলতো করে এক হাতে ছুঁয়ে আবার ডাকলো,
– তাকাও প্লিজ।
গুলিস্তা পিটপিট করে চাইলো। একহাতে ভর দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে রেহবার। কালো চোখের মনি দুটিতে কামনার আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। কালো রং আরও কুচকুচে কালো দেখাচ্ছে। সেই চোখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। তবুও স্বামীর অনুরোধের কারনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকা। রেহবারের তৃষ্ণার্ত ঠোঁট জোড়া গুলিস্তার শুষ্ক ঠোঁটে নেমে আসতেই সে আবারও চোখ বুজে নিলো। রেহবার আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে সে দৃশ্য দেখে হেসে ফেললো। ঠোঁট ছোঁয়ালো বুজে থাকা চোখ জোড়ায়। হাতের আঙ্গুলগুলো দক্ষ বাদকের মতোন পিয়ানোর কী প্যাডে মৃদু সংগীত সৃষ্টির মতোই নেচে উঠলো গুলিস্তার অনাবৃত শরীর জুড়ে। রেহবারের ঠোঁটের ছোঁয়া সমস্ত মুখশ্রীতে নিজের ছাপ ফেলে ক্রমশ নিচে নেমে আসতে শুরু করেছে। গ্রীবাদেশ ছুঁয়ে আরোও নিচে নামতেই আলতো ছোঁয়া আগ্রাসী হয়ে উঠলো। এতোক্ষণ নিশ্চল শুয়ে থাকা গুলিস্তা খানিকটা নড়েচড়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রেহবারকে। গুলিস্তার ছোঁয়া পেয়ে রেহবার নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না। বাইরে তখন নিশির বুক চিরে প্রভাতের আগমন ঘটেছে। ক্লান্ত রেহবার গুলিস্তার গ্রীবাদেশে ডুবিয়ে রাখা মুখটি তুলে গুলিস্তার দিকে তাকালো। মেয়েটা এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। ওর মায়াময় মুখটা এলোমেলো চুলে ঢেকে আছে। এক হাতে যত্ন সহকারে চুলগুলো সরিয়ে গুলিস্তার শান্ত মুখের দিকে চেয়ে আরেকবার বন্ধ চোখের পাতায় চুমু খেলো।
সকালে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে দেখলো গুলিস্তা কিচেনে দাঁড়িয়ে রান্না করছে। কাজের মেয়েটা বোধ হয় আজকে আসেনি। ফাঁকিবাজ মেয়ে প্রায় এমন করে। গুলিস্তা একা হাতে সবটা সামলে নেয়। এ নিয়ে কখনোই কাজের মেয়েটাকে একটা প্রশ্ন অব্দি করে না। রেহবার ভেবেছিলো শুধু ওর বিষয়ে গুলিস্তার কোনো আগ্রহ নেই, অভিযোগ নেই। কিন্তু এখন বুঝতে পেরেছে, কোনো কিছু নিয়েই গুলিস্তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। সে তার মত কাজ করে, খায় দায়, নিজের মতো সময় কাটায়। অন্য কেউ হলে হয়ত এমন বউ পেয়ে খুশি হতো। কিন্তু রেহবার খুশি হতে পারেনা। ওর মনে হয় একজন রোবটের সাথে সংসার করছে।
সকালবেলা এলোমেলো চিন্তার ঝুলি নিয়ে বসতে চায় না। তাই সেসব চিন্তা দূরে ঠেলে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালো। গুলিস্তা আজকেও শাড়ি পরেছে। বিয়ের পর থেকেই নিয়মিত শাড়ি পরে। প্রথম কয়েকদিন আম্বিয়া খাতুন সালোয়ার কামিজ পরিয়ে ছিলেন। উনি চলে যাওয়ার পর থেকে সেই যে শাড়ি পরা শুরু করেছে, আর সালোয়ার কামিজের ধারের কাছে যায়নি। প্রথম কয়েকদিন শাড়িতে এলোমেলো করে চলাফেরা করলেও দ্রুত মানিয়ে নিয়েছে। রেহবার খেয়াল করেছে গুলিস্তার ব্রেন ভীষণ শার্প এবং সে একজন কুইক লার্নার।
ভেজা চুলগুলো ঢিলা খোপা করায় পিঠের উপর হেলে পরেছে। রেহবার পেছনে দাঁড়িয়ে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে গালে আলতো করে চুমু দিলো। গুলিস্তা চুলায় প্যানকেক বানাচ্ছিলো। রেহবারকে দেখে প্যানকেকের প্লেট হাতে নিয়ে বললো,
– নাস্তা তৈরী হয়ে গেছে। এক্ষুনি টেবিলে দিয়ে দিচ্ছি।
রেহবার ওকে নিজের দিকে টেনে আরেকটু ঘনিষ্ট ভাবে জড়িয়ে ধরে বললো,
– স্বামী চুমু দিলে নাস্তা অফার করতে হয় না, ফুল। একটা চুমুর বিপরীতে দুটো চুমু ফিরিয়ে দিতে হয়।
গুলিস্তা প্যানকেকের প্লেট হাতে নিয়ে পেছন ফিরে রেহবারের দু গালে দুটো চুমু দিলো। রেহবার অবাক হয়ে চোখ বড় করে চেয়ে রইলো। বিস্ময়ে গুলিস্তার কোমড় জড়িয়ে ধরা হাত দুটো ছুটে গেছে। ওকে ওভাবে রেখে গুলিস্তা স্বাভাবিক ভাবেই কিচেন থেকে বেরিয়ে ডাইনিং সাজাতে লাগলো। তা দেখে সুবোধ বালকের মতো সেও গুটিগুটি পায়ে এসে ডাইনিং টেবিলে নাস্তা করতে বসলো। আজকেও গুলিস্তা রেহবারের পছন্দের ব্রেকফাস্ট তৈরী করেছে। মেয়েটার কি নিজের পছন্দের কোনো খাবার নেই? সবসময় রেহবারের পছন্দকে প্রায়োরিটি দিচ্ছে। ওর মতামত ব্যতীত কিছু করে না। নিজের কোনো ইচ্ছা ব্যক্ত করে না। এমন কেনো? শুধু কি সম্মান, ভালোবাসা থেকেই। নাকি ওর পরিবারকে থেকে ওকে এমন করতে বলা হয়েছে? বিয়ের পর মায়েরা মেয়েকে সংসার করার বিভিন্ন টিপস দিয়ে থাকে। আর মেয়েরা সংসার বিষয়ে আনাড়ি থাকায় মায়ের দেখানো পথ অন্ধের মতো অনুসরণ করে যায়। গুলিস্তার ক্ষেত্রেও কি ব্যাপারটি সেরকম কিছু? কিন্তু এই অতিরিক্ত পতি ভক্তি রেহবারের সহ্য হচ্ছে না।
(চলবে…)