ভালোবাসা_নামক_প্রিয়_অসুখ #writer_sumaiya_afrin_oishi #পার্টঃ৪৩

0
120

#ভালোবাসা_নামক_প্রিয়_অসুখ

#writer_sumaiya_afrin_oishi

#পার্টঃ৪৩

মাথার উপরে প্রকান্ড আকাশ, বিশাল এই আকাশ জুড়ে কত রঙ্গের পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। মেঘেরা এদিকে সেদিক ভেসে যাচ্ছে। ছাদে এসে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ঐশী। সন্ধ্যা হতে আর কিছু সময় বাকি, গোধূলির হলুদ আভা ছড়িয়ে পড়ছে ঐশী’র মুখশ্রী জুড়ে। সেই সাথে খোলা চুল গুলো বাতাসে উড়ছে, হঠাৎ কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো ঐশী। পিছনে ঘুরে তাকিয়ে কাঙ্খিত পুরুষ’টি কে দেখে মুখে হাসি ফুটলো।

রাফিন ঐশী’কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বললো,

“শুভ সন্ধ্যা মায়াবিনী!”

ঐশী হেসে বললো,

“আপনি কখন আসলেন? আজকে এতো তাড়াতাড়ি যে বাসায়, কারণ কী?”

“মাএ’ই এসেছি,ডিউটি শেষ করেই বাসায় আসলাম। তোমাকে রুমে পেলাম না তাই ভাবলাম ছাদেই আছো, তাই চলে আসলাম এখানে। ”

“আচ্ছা চলুন রুমে যাই।”
.
.
রাফিন ফ্রেশ হয়ে এসে কয়েকটি শপিং ব্যাগ খুললো, বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি, মা ও বউয়ের জন্য দুইটা শাড়ী এনেছে। এগুলো ঐশীর হাতে দিয়ে বললো,

“আজকে আমার চাকরি জীবনের প্রথম ইনকাম দিয়ে, তোমাদের সবার জন্য সাধারণ কিছু উপহার। দেখো কেমন হয়েছে?”

“অবশ্যই সুন্দর হয়েছে। কিন্তু আপনার জন্য কিছু কিনলেন না কেনো?”

রাফিন ক্ষীণ হেসে বললো,

“এতবড় পৃথিবীতে মা-বাবা, তুমি, তোমারা তিনজন ছাড়া আমার আপন বলতে কেউ নেই । তোমাদের কিছু দিতে পারলে আমার খুব ভালো লাগে। যা নিজের জন্য হাজারটা কিনলে এতো আনন্দ পাই না। বাবা-মা হয়তো এখানে নেই তবে প্রথম বেতন দিয়ে তোমাদের সবার সাথে আনন্দ’টা ভাগাভাগি করে নিলাম। বাকি টাকা তো আমার কাছেই আছে, আমার প্রয়োজন হলে পরে কিনে নিবো।”

ফের পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে ঐশীর হাতে দিয়ে বললো,

“এগুলো তোমার কাছে রাখো। এগুলো তোমার, এটা দিয়ে তুমি যা ইচ্ছে করো।”

ঐশী অবাক হয়ে বললো,

“আমি টাকা দিয়ে কি করবো? সব কিছু তো আপনি’ই এনে দেন। আপনি রেখে দিন আমার লাগবে না।”

“আমি তো সব সময় বাসায় থাকি না। তোমার কিছু প্রয়োজন হতে পারে, রেখে দেও। এখন টাকা আছে দিতে পারলাম পরে নাও দিতে পারি। তুমি বাসায় থাকো তাই বলে এমন নয় যে তোমার টাকা প্রয়োজন হতে পারে না। মেয়েদের মাঝে মাঝে অদ্ভুত কিছু ইচ্ছে জাগে, যা মেয়েরা সঙ্গী বা আপনজন কে বলতেও, লজ্জা বা দ্বিধা কাজ করে। তখন তাদের কাছে কিছু টাকা থাকলে নিজ ইচ্ছায় তা পূরণ করতে পারে। তুমি এ টাকা দিয়ে কি করলে আমাকে কখনো বলতে হবে না, আর না আমি জিজ্ঞেস করবো। তোমার ইচ্ছে মতো খরচ করিও।

এই মানুষটার সব কাজ যেন ঐশী’কে অবাক করে দেয়। এতোটা অনুভুতি প্রবনতা সম্পূর্ণ মানুষ কি করে হয়, ঐশী ভেবে পায় না। ঐশী রাফিনের মুখশ্রী’র দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইলো। রাফিন মৃদু কন্ঠে বললো,

“কি দেখছো এমন করে?”

ঐশী হুট করে রাফিনের চোখে’র উপরে চুমু খেলো। আনন্দে চোখ দু’টো ছলছল করছে, ক্ষীণ স্বরে বললো,

“আপনি এতো ভালো কেনো রাফিন ভাই?”

রাফিন এবার গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

“আমি তোমার কোন জন্মের ভাই ঐশী! কথায় কথায় ভাই এগুলো কী? বউ যদি নামের সাথে ট্যাগ লাগিয়ে ভাই ডাকে, পরে দেখা যাবে আমার বাচ্চা কাচ্চারা ও কিনা, বউয়ের ভাই ডাকার রেশ ধরে মামা ডাকে।”

“ছিঃ! মামা ডাকবে কেনো? স্যরি আসলে পুরনো অভ্যা’স তো তাই হয়ে যায়, আর হবে না। কানে হাত দিয়ে বললো ঐশী।”

“মনে থাকবে তো?”

“একদম পা’ক্কা!”

ঐশী উঠে রান্না ঘরে চলে গেলো, লম্বা ঘোমটা টেনে হাতে এক কাপ কফি নিয়ে আসলো। রাফিনে’র দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

“ও গো সোয়ামী শুনছেন? নিন আপনার কফি।”

ঐশী’র এমন রুপ দেখে রাফিন বিষম খেলো। চোখ বড় বড় করে কিয়াৎক্ষণ তাকিয়ে শব্দ করে হেসে দিলো। সাথে ঐশী ও হেসে দিলো।
.
.
ঐশী রাতে’র জন্য রান্না করবে বলে সবকিছু রেডি করছে। রাফিন এসে থামিয়ে দিয়ে বললো,

” এই কি করছো? রান্না করতে হবে না আজকে। রেডি হয়ে নেও, আজকে তোমাকে নিয়ে বাহির থেকে ঘুরে আসি।”

ঐশী প্রথম রাজি না হলে ও, রাফিন এক প্রকার জোর করে নিয়ে গেলো। রাফিন বুঝতে পারে অহেতুক টাকা খরচ হবে তাই রাজি হয় না ঐশী। মেয়েটা তাকে নিয়ে এতো চিন্তা করে, ভাবতেই ভিতরটা জুড়ে ভালো লাগার শিহরণ বয়ে যায় রাফিনের।

_______________

এদিকে অন্ধকার রুমে বসে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে জান্নাত। বাবা তার বিয়ের জন্য ছেলে দেখেছে। কাল নাকি ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে তাকে, ভাবতেই বুকটা ভারী হয়ে আসছে তার। সে যে আদিত্য নামে ছেলেটাকে ভীষণ ভালোবাসে, তার সমস্ত হৃদয় জুড়ে এই মানুষটার বিচরণ। সেখানে কি করে অন্যে একজনের সাথে সংসার করবে, প্রশ্ন আসে না। বারবার বাবা’কে বলেছিলো, সে অন্য একজন কে ভালোবাসে। কিন্তু জান্নাতের বাবা “রহমান আলী” স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছে,

“তুমি আমাদের বড় মেয়ে, সবার অনেক আদরের। আমরা নিশ্চয়ই তোমার খারাপ চাইবো না মা। যে ছেলের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করেছি, সে তোমাকে অনেক সুখে রাখবে। ছেলে দেখতে, শুনতে মাশাআল্লাহ! তার উপরে ছেলে একজন উকিল। তোমাকে ছেলে দেখেছে তোমার অগোচরে, সে তোমাকে পছন্দ করেছে,কাল গার্ডিয়ান আসবে। আশা করি তুমি অমত কিংবা কোনো ঝামেলা করবে না।”

জান্নাত বরাবরই ভীষণ ভয় পায় বাবা কে। তবুও আজ সাহস করে বাবা’র মুখের উপরে বলেছিলো,

” কিন্তু বাবা আমার মতামতের ও তো গুরুত্ব আছে। বিয়ে কি কোনো ছেলে খেলা, মনের মধ্যে একজনকে রেখে অন্য কারো সাথে সংসার কী ভাবে করে। শুধু টাকা পয়সা হলেই সুখে থাকা যায় না, মনের সাথে এডজাস্ট করে ও নিতে হবে। আমি আদিত্য কে ভালোবাসি! বিয়ে করলে তাকেই করবো। আমার উপরে জোর করলে ফলাফল একদম ভালো হবে না।”

“রহমান আলী মেয়ে’কে কিছু সময় পর্যবেক্ষণ করলো। যেই মেয়েটা বাবার মুখে’র দিকে তাকাতে ভয় পেতো, আজ বাবার মুখের উপরে কথা বলছে। একজন কে ভালোবাসলে মানুষ সব পারে। উনি কোমল স্বর বললেন,

” মা’রে এখন তোর ভিতরে আবেগ কাজ করে, তাই হয়তো অন্ধের মতো একজন কে বিশ্বাস করো। যার মুখের কথা বিশ্বাস করে ভালোবাসো,ছেলেটা তোর জন্য সঠিক নয়। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ছেলে ভালো হলে আমি কখনো অমত করতাম না। ছেলে-মেয়ে ভুল পথে গেলে বাবা-মা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। কেননা সব বাবা-মা চায় তার ছেলেমেয়ে ভালো থাকুক। আমি তোর জন্য সঠিক মানুষ বেছে নিয়েছি। তুই রাজি হয়ে যা মা।”

জান্নাত কিছু বললো না, বিনা বাক্যে নিজের রুমে চলে আসছে। ভালোবাসা কি এতো সমীকরণ কষে হয়, হুট করে’ই একজনার প্রতি গভীর ভালোবাসা জন্মায়। রুমে এসে সেই থেকে কান্না করছে , তার উপরে আদিত্যে’র কোনো রেসপন্স নেই।

রাত দশটা বেজে গেলো কিন্তু আদিত্যের সাথে এখনো যোগাযোগ করতে পারলো না জান্নাত। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না সে, নিজেকে পা’গ’ল পা’গ’ল লাগছে। চোখের পানি মুছে হঠাৎ গভীর সিদ্ধান্ত নিলো, যে করেই হোক তাকে পালাতে হবে বাসা থেকে। সে আদিত্যের ঠিকানা জানে, নিশ্চয়ই আদিত্য তাকে দেখলে ভীষণ খুশী হবে। পরক্ষণে বাবা-মায়ের সম্মানের কথা চিন্তা করে, থমকে গেলো, দোটানায় পড়ে গেলো জান্নাত। হঠাৎ যেন গায়েবি আওয়াজ শুনতে পেলো জান্নাত, কেউ যেন তাকে বলছে,

“তুই কেনো ফ্যামিলির কথা চিন্তা করবি,যে ফ্যামিলি তাদের সিদ্ধান্ত তোকে চাপিয়ে দিচ্ছে, তোর মতামতের গুরুত্ব দিচ্ছে না তাদের চিন্তা তোর করতে হবে না। তুই তোর প্রিয় মানুষটার কাছে যা জান্নাত! কেননা সে খানে গেলে তোর মানসিক শান্তি মিলবে। সবার কপালে প্রিয় জনের ভালোবাসা থাকে না, তুই যখন পেয়েছিস সময় থাকতে তাকে আগলে রাখ, না হয় ভীষণ ভাবে পস্তাতে হবে তোকে। তুই পালিয়ে যা জান্নাত! পালিয়ে যা আদিত্যে’র কাছে!”

কথাগুলো যেন পছন্দ হলো জান্নাতে’র, মুহূর্তে’ই মুখশ্রী জ্বলজ্বল করছে তার। মনে মনে ধন্যবাদ দিলো। নিজের কাছে কিছু টাকা ছিলো সব গুলো গুছিয়ে নিলো। সাথে ছোট্ট একটা ব্যাগ রেডি করলো। এখন শুধু গভীর রাত হবার অপেক্ষা করছে।

“একটা মেয়ের পক্ষেই কেবল সম্ভব, ভালোবাসা’র মানুষটার জন্য সব কিছু ছেড়ে ছু’ড়ে দেওয়া, একটা মেয়েই কেবল পারে অনেক উপযুক্ত ছেলে প্রত্যাখ্যান করে, একটা সাধারণ ছেলেকে বেছে নিতে। মেয়েরা শুধু শান্তি খুঁজে, সে যেখানে থাকুক আভিজাত্য না থাকুক অন্ততো শান্তি থাকুক। একটু শান্তি পাবার জন্য মেয়েরা অট্টোলিকা ছেড়ে কুঁড়ে ঘরে থাকতে দ্বিধা করে না। কেবল একজন মেয়ের পক্ষেই সম্ভব ভালোবাসা’র মানুষের সাথে থাকার জন্য পরিবার, সমাজ, সবার র’ক্তা’চক্ষু উপেক্ষা করে, আভিজাত্যকে পায়ে ঠেলে, সাধারণ জীবন বেছে নেওয়া। তাইতো জান্নাত গভীর রজনী’তে একাকী বেরিয়ে পড়লো তার ভালোবাসা”র ঠিকানায়। কিন্তু আদৌও কী তার কপালে ভালোবাসা মিলবে জানা নেই। পরবর্তী কী হবে তার সাথে তাও জানে না, তবুও চলে গেলো বাসা থেকে। দূর থেকে একজোড়া চোখ জান্নাতকে দেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো।
.
.
রাত তিন’টা ঐশী’র মুঠে ফোনটা ভেজে চলছে অনবরত। ঘুম ঘুম চোখে ফোন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে রিয়া’র কান্না’র শব্দে ঘুম ছুটে গেলো ঐশী’র। উঠে বসলো, মনের মধ্যে কুঁ’ডাক দিলো, অস্হির হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“কি-কি হয়েছে রিয়ুু? তু-তুই কাঁদছিস কেনো এতো রাতে? বল আমাকে কী হয়েছে।”

রিয়া অস্পষ্ট’স্বরে কান্না করতে করতে বললো,

“জা-জান্নাত বাসা থেকে পালিয়েছে ঐশী। আন্টি আমাকে বললো (জান্নাতে’র আম্মু), কোথায় গিয়েছে তারা কেউ কিছু জানে না।”

“ঐশী যেন স্তব্ধ হয়ে গেলো, এতো রাতে কোথায় গেলো মেয়ে’টা। আদিত্য কি আদৌও ওকে বুঝবে, কোনো ক্ষতি হবে না তো ওর। দুশ্চিন্তা’য় মাথা ব্যথা করছে ঐশীর, এই বন্ধু গুলো যে তার খুব কাছের, কারো কিছু হলে নিজেকে অসহায় লাগে। এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিলো জান্নাত অথচ তাদের কিছু বললো না,কিংবা জানালো না। ঐশী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, কান্নারতো কন্ঠে বললো,

” তুই যেখানে থাকিস ভালো থাকিস জান্নাত। আল্লাহ তোর মঙ্গল করুক! যাতে কোনো বিপদ আপদ না হয় তোর।”

ঐশীর কান্না’র শব্দ কানে যেতেই রাফিন দরদরিয়ে উঠে বসলো। অস্হির হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“এ্যাই ঐশী! তুমি কাঁদছো কেনো সোনা? কি হয়েছে তোমার? দুঃস্বপ্ন দেখেছো কোনো? প্লিজ কেঁদে না, আমাকে বলো? ভয় লাগছে তোমার? বলেই ঐশী’কে জড়িয়ে নিলো নিজের বাহুডোরে।

“ঐশী সবকিছু খুলে বললো। রাফিন ভরসা দিয়ে বললো,

” চিন্তা করো না সোনা। ওর কিছু হবে না, নিশ্চয়ই আদিত্যের সঙ্গে’ই আছে।”

“কিন্তু ছেলেটা কে আমার মোটেও ভালো লাগছে না। সবাই তো আর আপনার মতো না, যদি কোনো ক্ষতি করে দেয় ওর।”

“আরে কিছু হবে না। এতো রাতে তো কিছু করা যাবে না। তুমি চিন্তা করো না, সকাল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো।”

ঐশী কিছু বললো না, বারবার জান্নাতের নাম্বারে কল দিচ্ছে। কিন্তু, প্রত্যেকবার বন্ধ বলছে, দুশ্চিন্তায় কেউ আর ঘুমালো না।

চলবে……

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ! ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here