#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
অষ্টাদশ পর্ব
সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট প্রত্যেক প্রাণীর মধ্যে অভিযোজন ক্ষমতা বিদ্যমান। বিরুপ পরিবেশের সাথে লড়াই করতে করতে যারা টিকে যায়, তারাই বেঁচে থাকার স্বাদ ভোগ করে। জীবনে পরিবর্তন আসবেই, তা মেনে নিয়ে নিজেকে খানিকটা ভেঙেচূড়ে নতুন করে গড়ে নিতে হয়। আঁধারে বসবাস করতে করতে গুলিস্তাও একসময় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কীভাবে টিকে থাকতে হয়, ভালো থাকতে হয় বুঝে গেছে। যে স্মৃতিগুলো ওকে ভীষণ পীড়া দেয়, সেগুলো এখন আর মনে করে না। ভুলে গিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করে।
গতকাল রিসিপশন থেকে ফিরে এসে সেই যে ঘুমিয়ে পরেছিলো, এক ঘুমে সকাল এসে গেছে। চোখ মেলে ভোরের আলোয় স্নান করে ভালো থাকার প্রত্যয় নিয়ে নতুন দিন শুরু হলো। বিছানার অপরপাশের জায়গাটুকু ফাঁকা। রেহবারের খোঁজে দ্রুত হলরুমে এসেও ওর দেখা মিললো না। চিন্তিত মনে কিচেনে গিয়ে ব্রেকফাস্ট তৈরী করে নিলো। ডাইনিং টেবিল খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করতে করতে বারংবার ঘড়ির দিকে চোখ তাকানো।
রেহবার ফিরতে ফিরতে প্রায় নয়টা বেজে গেলো। অফিসে যেতে হবে। ফ্রেশেনআপ হতে বাড়ি ফেরা৷ ডাইনিং টেবিলে গুলিস্তাকে দেখে ক্ষীণকাল চিন্তা ভাবনা করে নিলো। এভাবে দু’পক্ষই চুপচাপ থাকলে সমাধান মিলবে না। গুলিস্তা তো চিরকাল মৌনব্রত পালন করে অনায়াসে দিন কাটিয়ে দিতে পারবে কিন্তু রেহবার? ওর পক্ষে এভাবে দিন পার করা অসম্ভব। একটা রাত কেটেছে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে৷ বাকি দিনগুলো এহন যন্ত্রণা ভোগ করার কথা ভাবলেই শ্বাস আটকে যাবার যোগাড়।
রেহবারকে দেখে গুলিস্তা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পরলো। ও নিশ্চয়ই এখনো ব্রেকফাস্ট করেনি। শুকনো মুখে বসে আছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো। সকালের অনেকটা পেরিয়ে গেছে৷ ওর নিশ্চয়ই ক্ষুধা লেগেছে৷ তাই বললো,
– ফ্রেশ হয়ে আসছি।
সিড়ি বেয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে রেহবার নিজের ভাবনা চিন্তায় নিজেই অবাক হলো৷ সে এখনো গুলিস্তার খাওয়া নিয়ে ভাবছে। এতোকিছুর পরেও মেয়েটার জন্য মন উগ্রীব হয়ে উঠছে। কখন এতোটা ভালোবেসে ফেললো ওকে!
জোর করে খাবার টেবিলে বসলেও এখন রেহবারের মেজাজের পারদ তিরতির করে উপরে উঠে যাচ্ছে। গুলিস্তা অন্যসব দিনের মতো স্বাভাবিকভাবেই নাস্তা খাচ্ছে, আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে৷ অথচ রেহবারের মুখে সব বিস্বাদ ঠেকছে। ওকে অশান্তির সাগরে ফেলে দিয়ে একটা মানুষ এমন আয়েশ করছে, ভাবতেই সারা গা জ্বালা করে উঠলো। নাস্তার প্লেট সামনে থেকে সরিয়ে টেবিলে দু হাত রেখে লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো। কখনো এমন কথা মুখে আনতে হবে, স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। তবুও পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে বলতেই হচ্ছে।
– তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে। মনোযোগ দিয়ে শুনবে এবং বুঝার চেষ্টা করবে। আমার বিনীত অনুরোধ, সব বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকবে না।
রেহবারের শান্ত কন্ঠ, চোখে মুখে কঠোরতা। গুলিস্তার ভড়কে যাওয়া উচিত ছিলো কিন্তু সে ভড়কালো না। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে স্বাভাবিকভাবে বললো,
– বলুন।
রেহবার মনে মনে কথা গুছিয়ে রেখেছিলো। গতরাত রাস্তায় গন্তব্যহীন ড্রাইভ করে যেসব ভেবেছিলো, যেভাবে কথা গুছিয়ে নিয়েছিলো এখন সেগুলো এলোমেলো লাগছে। তবুও আজ বলতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে ও নিজেই মানসিক রোগীতে পরিণত হয়ে যাবে নিশ্চিত।
– দেখো, আমি তোমার মতো সকল পরিস্থিতিতে শান্ত থাকতে পারি না। এতো কিছু ঘটে যাওয়ার পরেও কিছুই হয়নি এমনভাবে দিন কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বিয়ের পর থেকে আমি অনেক কিছু ইগনোর করে গেছি কিন্তু গতকালের ঘটনাটি ইগনোর করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি এতোটাও মহানুভাব নই যে তোমার সম্পর্কে এসব জানার পরও আমি তোমার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করে হেসেখেলে সংসার করবো। মানুষের অতীত থাকতেই পারে। মেয়ের পরিবার সেটা লুকিয়ে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে সেটিও স্বাভাবিক। এখানে ভুল আমাদেরও রয়েছে, আমরাও কোনো খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করিনি। এ পর্যন্ত সবকিছু আমি মেনে নিতাম যদি আমাদের সম্পর্কটাকে তুমি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে৷
বিয়ের পর থেকে গুলিস্তার ঠান্ডা স্বভাব, নির্লিপ্ততার কথা ভেবে রেহবারের গলা শুকিয়ে এলো। সামনে থাকা পানির গ্লাস থেকে পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে বললো,
– তুমি বুঝতে পারছো, আমি কোন অস্বাভাবিকতার কথা বলছি?
গালে হাত দিয়ে খানিকক্ষণ ভেবে গুলিস্তা জবাব দিলো,
– নাহ।
রেহবার মনে মনে ভীষণ অবাক হলেও মুখে বাঁকা হেসে বললো,
– তোমার থেকে এমনটাই উত্তর মিলবে, এ আর নতুন কি! শুনো মেয়ে, বিয়ের পর থেকে তুমি আমাকে প্রতিনিয়ত অপমান করে গেছো। তোমার প্রতি আমার অনুভূতিকে, আমার ভালোবাসাকে, আমাদের বৈবাহিক সম্পর্কে তুমি অপমান করেছো। তোমার মনে অন্য কারো বাস, অথচ দিনের পর দিন আমার সাথে ছিলে, আমার ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছো। এসব ভাবতেই আমার গা গুলিয়ে উঠছে। এতোদিন তুমি কীভাবে নীরব ছিলে? আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করোনি। আরে তুমি তো এমন এক আজব প্রানী যে, আমাদের কাউকে বুঝতেও দেওনি। আগ্রহ প্রকাশ না করলেও, অনাগ্রহও দেখাওনি কখনো। আমরা বুঝতাম কীভাবে? আমার নিজের এখানে কোনো দোষ না থাকা সত্ত্বেও অপরাধবোধে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। একটা মেয়ের সম্মতি না থাকার পরেও আমি তাকে ছুঁয়েছি। আমার পবিত্র ছোঁয়ায় তার নিশ্চয়ই গা গুলিয়ে উঠতো। মনে মনে রক্তাক্ত হতো প্রতিক্ষণ। তুমি ভাবতেও পারবে না, নিজের কাছে সবসময় স্বচ্ছ থাকা মানুষটির জন্য এই অপরাধবোধের অনুভূতিটুকু কতোটা যন্ত্রণার।
যাক গে সেসব কথা। যে নিজে চোখ বন্ধ করে থাকে, তাকে দুনিয়ার আলো দেখানো সম্ভব নয়। আমার নিজেরও আর কোনো ইচ্ছা নেই৷
তবে তোমাকে বলে রাখি, কাজটি তুমি একদম ঠিক করোনি। বিয়ের পরে আমাকে জানাতে পারতে।
সেসব কথাও না হয় বাদ দিলাম। ওগুলো এখন অতীত। কিন্তু গতকাল তুমি যে কাজটি করছো, সেটা কি ঠিক ছিলো? তোমার থেকে কোনো এক্সপ্লেইনেশন পাওয়ার অধিকার কি আমি রাখি না? অথচ তুমি নীরব রইলে।
– আমি তো উত্তর দিলাম।
রেহবার আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে দেখলো গুলিস্তা নিজের দুটো হাতের আঙ্গুল কচলে যাচ্ছে অস্বাভাবিকভাবে। যেনো এই বিষয়ে কথা বলতে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। মেয়েটা তাহলে সামান্য হলেও ন্যায় অন্যায়ের জ্ঞান রাখে৷ ওর অস্বস্তি দেখে রেহবারের খানিকটা ভালো লাগলো। সে নিজে অপরাধবোধে মরে যাচ্ছে আর এই মেয়ে এতো এতো অন্যায় করেও মাথা উঁচু করে চলাফেরা করে যাচ্ছিলো। নিজের অপকর্মের লজ্জা, অপরাধবোধে না ডুবা পর্যন্ত রেহবার ওকে কিছুতেই ক্ষমা করবে না। খানিকটা প্রতিশোধের নেশায় ভেতরটা বুদ হয়ে রইলো। সাইলেন্ট ট্রিটমেন্ট ও একাই করতে পারে না। একই অস্ত্র রেহবার নিজেও ব্যবহার করবে ওর বিপক্ষে। নিজের ভুল মেনে নিয়ে, অন্যায় স্বীকার করে যদি খানিকটা কেঁদেকেঁটে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবেই রেহবার পুনরায় ভেবে দেখবে। না হলে নিজের সিদ্ধান্তে সে বদ্ধ পরিকর।
খানিকটা কড়া সুরেই আলোচনার সমাপ্তি টেনে বললো,
– অনেক ভেবেচিন্তে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমার দিকে তাকালে, তোমার আশেপাশে থাকলে আমার মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। তোমার দেওয়া ধোঁকা, তোমার করা অন্যায় আমাকে শান্তি দিচ্ছে না। আমার কিছুদিন সময় দরকার। নিজেকে বুঝাতে, নিজের মনের কথা বুঝতে আমি কিছুদিন স্থির মস্তিষ্ক নিয়ে দিন কাটাতে চাই। তোমার সংস্পর্শে সেটা সম্ভব নয়। তাই আমি ঠিক করেছি, তুমি কিছুদিন তোমার বাবার বাড়িতে গিয়ে থাকবে। আমাদের দুজনেরই কিছুদিন সময় নেওয়া উচিত। তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নেও রাতের বাসে তুলে দিয়ে আসবো।
গুলিস্তা অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
– আমি একা যাবো?
– হ্যাঁ। টিকিট বুক করা হয়ে গেছে৷ রাত দশটার বাস ছাড়বে। রেডি হয়ে থেকো।
রেহবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কোর্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। মনে অদ্ভুত শান্তি লাগছে। চ্যালেঞ্জিং কোনো ক্লাইন্ট মিটিং শেষ হওয়ার পর যেমন ভারহীন লাগে, তেমন লাগছে।
এদিকে গুলিস্তা অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে রেহবারের যাওয়ার পাণে চেয়ে আছে৷ ওর তো আরও কিছু বলার ছিলো। মানুষটা না শুনে চলে গেলো কেনো?
ও কখনো একলা জার্নি করেনি। রাতের বাসে একলা কীভাবে এতোটা পথ পাড়ি দিবে? বিয়ের পর প্রথমবার বাবার বাড়ি যাচ্ছে। জামাই ছাড়া মেয়ে একলা কীভাবে নাইয়র যাবে! বাড়ির লোকজন জানতে চাইলে কী জবাব দিবে? পাড়ার লোকজন শুনলে আবার একগাদা কথা ছড়াবে। সেসব কীভাবে সামলাবে?
কতোদিন থাকবে সেটাও তো বলে গেলো না। সেই হিসেব করে প্যাকিং করতে হবে তো নাকি! গুলিস্তা চলে গেলে রেহবারের খাওয়া দাওয়ার কী হবে সেটাও একটা চিন্তা। মালা এমনিতেই ফাঁকিবাজ মেয়ে। কাজে আসে না ঠিকমতো৷ গুলিস্তা না থাকলে সে আরও ফাঁকিবাজী করবে।
ঠান্ডা হয়ে আসা চায়ের কাপে ঝটপট চুমুক দিয়ে গুলিস্তা শক্ত করে কোমড়ে আঁচল গুজে নিলো। এখন অনেক কাজ গুছাতে হবে। ফ্রিজ থেকে গরুর গোশতের পুরো প্যাকেট বের করে বরফ ছাড়তে দিলো। এগুলো কষিয়ে পটে ভরে রেখে দিলে রেহবার গরম করে খেয়ে নিতে পারবে। ও যেহেতু নিজে রাঁধতে পারে, তাই ভাতটুকু গরম গরম রেঁধে নিতে সমস্যা হবে না। কিন্তু অফিস থেকে ফিরে ভাত তরকারী রান্না করে খাওয়ার কষ্ট ওকে দিতে ইচ্ছে করছে না। ক্লান্ত শরীরে একটুও রাঁধতে ইচ্ছে করে না। ঝামেলা হবে অফিস থেকে ফেরার পর কফি খাওয়া নিয়ে। ক্লান্ত শরীরে নিজে কফি বানিয়ে খেতে মানুষটার যা কষ্ট হবে! এই ভেবে গুলিস্তার মন কেমন করে উঠলো। কেবিনেটের একদম সামনের দিকে কফির পট, চিনি, কফি মগ গুছিয়ে রেখে দিলো।
প্যাকিং করতে গিয়ে সে আরেক ঝামেলা। কাবার্ড ভর্তি শাড়ি। কোনটা রেখে কোনটা নিবে ভেবে পাচ্ছে না। ছোট একটা কাপড়ের ব্যাগে রাফ ইউজের দুটো শাড়ি ও আনুসাঙ্গিক জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে অপেক্ষার করলো রেহবারের ফেরার।
দুপুরের খাবার খেতে রেহবার এলো না। রোজ সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি ফিরতো অথচ আজকে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলো রেহবার এলো না। এইটুকু সময়ে গুলিস্তা পুরো বাড়ি গুছিয়ে নিয়েছে। ঘরের প্রতিটি কোণা পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা যাতে অন্তত সপ্তাহ খানিক ঘর এলোমেলো না হয়।
সন্ধ্যা থেকে ছাদে হাঁটাহাঁটি করে পার করলো। কখনো সদর দরজায় চেয়ে রইলো। অবশেষে রেহবার এলো রাত নয়টা পেরিয়ে। সদর দরজা পেরিয়ে রেহবারের গাড়ি ভেতরে প্রবেশ করতেই গুলিস্তার মুখে হাসি ফুটলো। চটজলদি সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে সে হাসি লুকিয়ে ফেলে স্বাভাবিকভাবে রেহবারের সামনে দাঁড়ালো। ওর দিকে তাকিয়ে রেহবার বললো,
– রেডী হওনি এখনো?
– এই তো হচ্ছি।
অফিসের পোশাক না ছেড়ে শুধুমাত্র ল্যাপটপের ব্যাগটি জায়গা মতো রেখে বিছানায় বসলো৷ গুলিস্তাকে বিদায় করে একেবারেই ফ্রেশ হয়ে নেওয়া যাবে। চোখ বন্ধ করে বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছে মাত্র, গুলিস্তা এসে কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বললো,
– আপনার কফি।
এই মেয়ে এখনো কফি নিয়ে পরে আছে! অবাক হলেও তা প্রকাশ করলো না। ওর সাথে কোনো কথা বলতেই ইচ্ছা করছে না। নীরবে কফির মগ হাতে নিয়ে তাতে চুমুক দিলো। গুলিস্তা আবার প্রশ্ন করলো,
– টেবিলে খাবার দিয়ে দিবো?
রেহবারের ইচ্ছে করলো বলতে,“কিছু করতে হবে না৷ তুমি শুধু আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হও।”
বিদায়বেলায় আর রুক্ষ আচরণ করতে মন সায় দিলো না। “আর মাত্র কিছুক্ষণ সহ্য করো।” মনকে বুঝিয়ে অনাগ্রহ নিয়ে বললো,
– এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি দ্রুত রেডী হয়ে নেও। বের হতে হবে।
মাথা দুলিয়ে সায় দিয়ে চলে যেতে গিয়েও ফিরে তাকিয়ে বললো,
– কোন শাড়িটা পরবো?
সংসার জলে ভেসে যাচ্ছে এমন সময় এরকম প্রশ্ন শুধুমাত্র গুলিস্তাকে দিয়েই সম্ভব। সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে ওর মধ্যে কোনো ভীতি কিংবা দুঃশ্চিন্তা, কোনোটাই দেখা যাচ্ছে না। দু চোখ কয়েক সেকেন্ড বন্ধ রেখে নিজেকে শান্ত করে নিয়ে রেহবার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। চেঞ্জিং রুমে প্রবেশ করে একটা কম্ফোর্টেবল শাড়ি নিয়ে এসে গুলিস্তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আবার বিছানায় বসে কফির কাপ হাতে নিলো। শাড়ি হাতে নিয়ে গুলিস্তা খুশি মনে রুম হতে বিদায় নিলে রেহবার পুরো ঘরে সচেতনভাবে দৃষ্টি ঘুরালো। চেঞ্জিং রুমে গুলিস্তার পোশাক-পরিচ্ছদ আগের মতোই রয়ে গেছে। ড্রেসিং টেবিলের উপর মেয়েলি জিনিসপত্র এখনো বিদ্যমান। গুলিস্তা কি তাহলে প্যাকিং করেনি? সোফার পাশে একটি ছোট ব্যাগ দেখে রেহবারের আগ্রহ জন্মালো। ব্যাগ খুলে নিশ্চিত হলো এটি গুলিস্তা সাথে নেওয়ার জন্য গুছিয়েছে। ব্যাগে স্বল্প পরিমাণ পোশাক দেখে রেহবারের মনে হলো গুলিস্তাকে আরও কিছু পোশাক নিতে বলা উচিত। কিন্তু মনের মধ্যে বিতৃষ্ণা চলে এলে আগ্রহ এমনিতেই কমে যায়। সে যা ইচ্ছে করুক। রেহবার ওকে যতোটুকু সম্ভব বুঝিয়ে বলেছে। এরপরেও না বুঝে অবুঝের মতো কার্যকলাপের দায় রেহবার নিজের কাঁধে নিবে না।
গুলিস্তা রেডি হয়ে বেরিয়ে এলে রেহবার নিজেই কাপড়ের ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। একজন ভদ্র লোক কখনো নিজে খালি হাতে হেঁটে, মহিলা মানুষের হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিতে পারে না। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার মুহুর্তে ডাইনিং টেবিলে গুলিস্তার মোবাইলটি দেখতে পেয়ে রেহবার জানতে চাইলো,
– মোবাইল রেখে যাচ্ছো কেনো?
গুলিস্তা ঝটপট সেটা হাতে তুলে নিলো।
মা কিনে দিয়েছিলো বলে রেখে যাচ্ছে নাকি? প্রশ্ন মনের মধ্যে রেখেই ঘর ছাড়লো। গাড়িতে বসে রেহবারের খেয়াল হলো, গুলিস্তা ওকে ডিনারের কথা বলেছিলো। তার মানে মেয়েটা নিজেও কিছু খায়নি। অন্য সময় হলে হয়তো একটু ভালো লাগতো। কিন্তু এই মুহুর্তে এইসব ন্যাকামি মনে হলো। দীর্ঘপথ জার্নি করতে হবে জেনেও না খেয়ে থাকার বোকামি করতে তো রেহবার ওকে করতে বলেনি। নিজে থেকে এসব আদিখ্যেতা করলে নিজেকেই ভুগতে হবে৷
ব্যস্ত নগরীর কোনো ক্লান্তি নেই। একদল দিনে জেগে রাতে ঘুমায়৷ আরেকদল রাতে জেগে উঠে৷ তাই নাগরিক জীবন সদা সজীব। বাসস্ট্যান্ডে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি বাস। যাত্রীর কোলাহলে মুখরিত বাসস্ট্যান্ড। গাড়ি থেকে নামতেই গুলিস্তা অবাক হয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখলো। ওর দিকে তাকিয়ে রেহবারের মনে পরলো ওদের বিয়ের রাতের কথা। এয়ারপোর্টে নেমে তখনও এভাবে অবাক হয়ে চেয়েছিলো ব্যস্ত শহরের দিকে।
যান্ত্রিক জীবনে কেউ কারো জন্য অপেক্ষায় থাকে না। সবাই নিজের তাগিদে ছোটাছুটি করছে। বাস ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে। যাত্রীরা বাসের সামনে ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ নিজের সীটে বসে পরেছে, কেউবা আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে বিদায় নিতে ব্যস্ত। অফিস ফেরত ক্লান্ত চাকুরীজীবি একপাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে৷ বৃহস্পতিবার রাত, বাড়ি ফিরে যাওয়ার আনন্দ ঢাকা পরে গেছে দিনভর অফিসের ফাইলের ক্লান্তিতে৷
রেহবারের পিছু পিছু গুলিস্তা ভীরু পায়ে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে। জানালার পাশের সীট নেওয়া ছিলো। গুলিস্তাকে বসিয়ে দিয়ে সীটের উপরের ফাঁকা জায়গায় ব্যাগ রেখে ওকে বললো,
– নামার সময় মনে করে ব্যাগ সাথে নিবে।
গুলিস্তা মাথা দুলিয়ে সায় জানালো।
– তুমি বসো, আমি একটু আসতেছি৷
ওকে বাসে রেখে বাসস্ট্যান্ডের পাশের দোকান থেকে কিছু স্ন্যাকস, কেক, খাবার পানি কিনে নিলো। বোকামির জন্য না খেয়ে বাসে তো উঠে গেলো। দূরের পথের জার্নি। রাত কেটে যাবে জেগে থেকে। ক্ষুধা পাবে নিশ্চয়ই। ক্ষুধায় আধমরা হয়ে গেলেও এই মেয়ে বাস থেকে নেমে খাবার কিনে নিতে পারবে না। বাসের দিকে ফিরে যেতে গিয়ে খেয়াল করলো, গুলিস্তা চঞ্চল চোখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ওকে খুঁজছে। রেহবার ইচ্ছে করে খানিকক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলো। গুলিস্তা চাতক পাখির মতো তাকিয়েই আছে। রেহবারকে দেখতে পেয়ে তবেই স্থির হয়ে নিজের সীটে বসলো।
গুলিস্তার পাশের সীটে বসে পানির বোতল, কেকের প্যাকেট সহ বাকি খাবারগুলো গুছিয়ে রেখে দিলো। পকেট হতে কিছু ক্যাশ বের করে গুলিস্তার হাতে দিয়ে বললো,
– এগুলো রাখো। প্রয়োজনে খরচ করবে।
টাকাগুলো যত্ন সহকারে পার্সে রেখে গুলিস্তা রেহবারের দিকে তাকালো। আরও কিছু শোনার আগ্রহ সেই চোখে৷ রেহবারের তো আর কিছু বলার নেই। গুলিস্তার আগ্রহভরা চাহনিতে থমথমে খেয়ে রেহবার দ্রুত উঠে দাঁড়ালো।
– বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেছে৷ সাবধানে যাবে।
এক পা এগুতেই বাঁধা পেয়ে ফিরে তাকাতে হলো। গুলিস্তা ওর কোর্টের হাত টেনে ধরেছে৷ ফিরে তাকাতেই ডাগর ডাগর চোখ দুটোর দেখা মিললো।
– বাস থেকে নেমে বাড়ি যাবো কীভাবে?
সরল প্রশ্নটি রেহবারকে দ্বিধায় ফেলে দিলো। সে কি আদোও ঠিক কাজ করছে? একটু বেশি নিষ্ঠুর আচরণ হয়ে যাচ্ছে না?
গুলিস্তার হাতটি নিজের হাতে জড়িয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো।
– বাস বগুড়ায় থামবে। সুপারভাইজারকে বলে দিচ্ছি, বগুড়ায় পৌঁছে গেলে তোমাকে জানিয়ে দিবে। বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা নিয়ে বাড়ি চলে যাবে। বাসস্ট্যান্ড থেকে বেশি দূর নয় তোমাদের বাড়ি৷
গুলিস্তা যদি একবার বলতো, আমি একা এতোদূর যেতে পারবো না। রেহবার কোনোকিছু না ভেবে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতো। কিন্তু গুলিস্তা বললো,
– আচ্ছা।
বাস থেকে নেমে রেহবার অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। গুলিস্তার পাশের সীটের যাত্রীটিকে না দেখা পর্যন্ত স্বস্তি মিলছে না। গাড়ি ছাড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে একটি মেয়ে বাসে উঠে পরলো। গুলিস্তার পাশের সীটে বসে মিষ্টি হেসে বললো,
– এটা আমার সীট। একটু হলে বাস মিস করে ফেলতাম। রাস্তায় যা জ্যাম পরেছে আজ!
রেহবার দূর থেকে লক্ষ্য করলো। ধীরে ধীরে দৃষ্টি সীমা পেরিয়ে মিলিয়ে গেলো লাল রঙা বাসটি। রেহবার তবুও দাঁড়িয়ে রইলো। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাওয়া বাসটিতে কেউ একজন ছিলো, যাকে রেহবার ভীষণ ভালোবেসেছিলো। যার সাথে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন বুনেছিলো। চায়ের কাপে নিশ্চুপ রাত্রিটা না হয় রেহবার একা একা বকবক করে কাটিয়ে দিতো। পাশে থাকতো পৃথিবীর সবচেয়ে শান্ত মেয়েটা। যে একদৃষ্টিতে রেহবারের দিকে তাকিয়ে থেকে খুব মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শুনতো। তবুও তো কেউ একজন থাকতো রেহবারের পাশে। এখন একলা বাড়িতে সে কীভাবে রবে?
(চলবে)