#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
সূচনা পর্ব
১
রান্নাঘরে বড় পাতিলে পানি ফুটছে টগবগ করে। শর্মীর সেদিকে খেয়াল নেই। সে সমস্ত মনোযোগ একাগ্র করে পাশের বসার ঘরের আলোচনা শোনার চেষ্টা করছে। স্পষ্ট কিছু বুঝা না গেলেও সীমা বেগমের কর্কশ কণ্ঠস্বর ঠিকই কানে বাজছে। এই তো খানিকক্ষণ আগেই ছোট ছেলের উপর রুষ্ট হয়ে চিল্লিয়ে উঠলেন,
ওর আবার মতামতের কি আছে? আমরা যা বলবো তাই করবে।
সীমা বেগমের কথায় সবাই স্বস্তি পেলেও শর্মীর মনটা ভার হয়ে গিয়েছিলো। মেয়েটার জন্য শর্মীর বড় মায়া হয়। কেমন পুতুলের মতো সবাই নাচাচ্ছে তাকে। যে যার মতো সুতোয় টান দিচ্ছে আর মেয়েটা দুলে উঠছে। সবার চোখে সেই দুলে আবার উঠা তিক্ত ঠেকে। তারপর শুরু হয় পাশবিক নির্যাতন। শর্মীর মন পুড়লেও সে চুপ থাকে। এ সংসারে টিকে থাকতে হলে চোখ বুজে, বিবেকের দরজায় তালা বদ্ধ করে রাখতে হয়। এতোদিন অবশ্য সে তাই করে এসেছে। কিন্তু এই শেষবেলা এসে মনটা কেমন করে উঠছে।
বসার ঘর থেকে সীমা বেগম চিল্লিয়ে উঠলেন,
– বড় বউ, চা বানাতে পাঠাইলাম। তুমি দেখি পানি সেদ্ধ করে গ্যাসের সিলিন্ডার খালি করা শুরু করছো। সেই কখন থেকে পানি উতাল দিতেছে! আমি এই ঘর থেকে শুনতে পাচ্ছি। তোমার কানে যাচ্ছে না? কাজকর্মে মন নাই, খালি ধান্দাবাজী।
শাশুড়ির চিল্লানিতে শর্মীর ধ্যান ভাঙলো। আসলেই অনেকক্ষন ধরে পানি ফুটছে। সে দ্রুত হাতে চা বানিয়ে নিলো। শাশুড়ির আদেশ মতো রং চায়ে খানিকটা লবণও মিশিয়ে দিলো। এতে নাকি চিনি কম লাগে। লবণের কারনে হালকা মিষ্টিও কড়া স্বাদ দেয়। এদিকে যে চায়ের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায় সেদিকে কে নজর দিবে!
বসার ঘরের একপাশে একটি চৌকি রাখা। সেখানে গদি বিছিয়ে তার উপর বেডশীট, কুশন দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। সীমা বেগমের সারাদিন কাটে এই চৌকির উপর বসে কিংবা শুয়ে। তবুও গভীর রাতে শোবার ঘরে যেতে উনার বেশ কষ্ট হয়। ক্লান্ত শরীরটা নাকি আর চলতে চায় না। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকেই তিনি অসুস্থ বোধ করছেন। সংসার টিকিয়ে রাখতে তড়িঘড়ি করে বড় ছেলের বিয়ে করিয়ে শর্মীকে নিয়ে এলেন। কথা ছিলো সংসারের দায়িত্ব ছেলের বউয়ের হাতে তুলে দিয়ে তিনি এবেলা বিশ্রাম করবেন। কিন্তু সরল চোখে ঘটনা এমন দেখালেও সিংহাসন ছাড়ার পরেও সমস্ত ক্ষমতা এখনো সীমা বেগমের মুঠোর মধ্যেই রয়েছে। শর্মী শুধু উনার আদেশের পালন করে।
ট্রেতে চায়ের কাপ সাজিয়ে বসার ঘরে প্রবেশ করতেই শর্মীর গা কাঁটা দিয়ে উঠলো। আকবর বংশের রাজসভায় আজ সকল কূটনৈতিক ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে। সবাই গম্ভীর মুখে বসে আছে। শীতল চোখগুলো তাকিয়ে আছে শর্মীর দিকেই । শর্মী প্রথম চায়ের কাপটা শাশুড়ির হাতে তুলে দিলো। সামান্য ভুলের কারনে এক্ষুণি শুনতে হতে পারে, শর্মীর মুরুব্বি জ্ঞান নেই। বাবার বাড়ি থেকে কোনো ভালো শিক্ষা পায়নি। নিচু জাতের ঘর থেকে বউ আনলে এমনি দুর্দশা হয়। আরও কতো কি! আগে প্রতিটা বাক্য শর্মীর মনে থাকতো। সেসব মনে করে চোখের জল ফেলতো। এখন সেসব সহনশীলতার পর্যায়ে চলে এসেছে দেখে আর মনে থাকে না।
একে একে দুই চাচা শ্বশুরকে চা দিয়ে দিদারের হাতে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো। দিদার এমনভাবে শর্মীর হাত থেকে চায়ের কাপ গ্রহণ করলো যেনো সামনে দাঁড়িয়ে আছে অপরিচিত কেউ। সামনে স্বয়ং তার স্ত্রী দাঁড়িয়ে অথচ একবার চোখে চোখ রাখলো না, কোনো উষ্ণতা ছুঁয়ে গেলো না। হতাশ শর্মী দ্রুত সরে গিয়ে দাঁড়ালো ছোট দেবর দিহানের সামনে। ওর চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে আছে। নিশ্চয়ই সারারাত না ঘুমিয়ে সিনেমা দেখেছে আর এখন অনিদ্রার অভাবে মাথা ব্যথা নিয়ে এখানে মুখ কালো করে বসে আছে। ভাবীর হাতের চা অবশ্য সে হাসি মুখেই নিলো। ছোট করে ধন্যবাদ জানাতেও ভুললো না।
চা পরিবেশনের সময়টুকু সবাই চুপ রইলো বলে শর্মী কথা শুরু করতে পারছে না। সে ট্রে হাতে একপাশে দাঁড়িয়ে সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকলো। তা দেখে সীমা বেগম বললেন,
– দুপুরের রান্নার ব্যবস্থা না করে দাঁড়ায় আছো কেন?
– কি রাঁধবো আজকে?
– এতোদিন ধরে সংসার করতেছো, এখনো একবেলা রান্নাটা সামলাইতে পারতেছো না? সব কাজ আমারেই দেখায় দেওয়া লাগে। কয়দিক সামলাবো আমি! ফ্রিজ থেকে মুরগীটা বের করো। মুরগীর সাথে বড় বড় করে কয়েকটা আলু কেটে দিবা। করলা কয়েকটা চিকন করে কেটে ভাজি করে নেও।
শর্মী মাথা নেড়ে সায় জানালো। প্রতিদিন এই ঘটনাই ঘটে। একই এপিসোড রিপিট টেলিকাস্ট। শুরুর দিকে একদিন শর্মী নিজের মতো খাবারের আইটেম করেছিলো। সীমা বেগমের সেকি রাগ! ঘরের বউ তাকে সম্মান দেয় না। রান্নার আগে একবার জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করেনি। নিজে মাতাব্বরি করে ছোটলোকের মতো শাকপাতা রান্না করে বসে আছে। সেসব দিয়ে তিনি আর সেবেলা ভাত খেতে পারেননি। এরপর আর শর্মী নিজের বিবেক-বুদ্ধি অপচয় না করে সীমা বেগমের কাছে ছুটে এসে প্রতিদিন নিয়ম করে রান্নার আইটেম জেনে নেয়।
রান্না ঘরের দিকে ফিরে যেতে যেতেও শর্মী ঘুরে দাঁড়িয়ে শাশুড়িকে মিনমিনিয়ে বললো,
– কলেজটা শেষ করে বিয়ের আয়োজন করলে হতো না, আম্মা?
চকিতে ঘরের সবাই অবাক হয়ে শর্মীর দিকে তাকালো। সীমা বেগম তো পারলে চোখ দিয়ে শর্মীকে ভস্ম করে দেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে দিদার ধমকে উঠলো,
– তোমার এতোকিছু না ভাবলেও চলবে, তুমি রান্নাঘর সামলাও।
সীমা বেগম মনে মনে খুশি হলেন। ছেলেরা তার শিক্ষা ভুলে যায়নি। চার ছেলেই মায়ের সম্মান, ভালোবাসায় কোনো কমতি রাখে না। তিনি শর্মীকে বললেন,
– এক পোয়া চাল বেশি করে দিবা। তোমার চাচা শ্বশুরেরা দুপুরবেলা এখানে খাবেন।
শর্মী আর দেরী না করে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। ভাগ্য ভালো দিদার শুধু ধমক দিয়েছে। চাচা শ্বশুর দুজন উপস্থিত না থাকলে নিশ্চিত দুটো চড় জুটতো শর্মীর কপালে।
শর্মী রান্নাটা চুলায় চাপিয়ে দিয়েছে মাত্র। সীমা বেগম রান্না ঘর পরিদর্শনে এলেন। উনার কথা মত কাজ কতটুকু হলো, তা না দেখা পর্যন্ত উনি স্বস্তি পান না। আজকালকার মেয়েছেলের হাতে কাজ ছেড়ে দিলে গড়বড়ের আশংকা থাকে বেশি। সবকিছুর দিকে তিক্ষ্ন দৃষ্টিপাত করতে করতে শর্মীকে উদ্দেশ্যে করে বললেন,
– মাইয়া মানুষেরে বেশিদিন ঘরে রাখা মানে, হাতের তালুতে জ্বলন্ত কয়লা নিয়া ঘুরা। সারাক্ষণ হাত জ্বালা করে। মাইয়ার বিয়ার বয়স হইছে। গায়ে গতরে তরতর কইরা বাড়তাছে। তার নিজেরও তো স্বামীর ঘর করার শখ কম না। গায়ের জ্বালা বেশি বইলাই তো আমাগো মান সম্মানের কথা চিন্তা না করে এক বছর আগেই কম কান্ড ঘটায় নাই। পড়াশোনায় মনোযোগ থাকলে কেউ এমন কাজ করে না। যেই মাইয়ার মনে একবার শরীরের ক্ষুধা জেগে উঠে তারে আর ঘরে রাখতে নাই। কথা কওয়ার আগে আগ পাছ বিবেচনা কইরা কইবা।
দুপুরবেলা খাওয়া শেষে সকলে বিদায় নিলো। রান্নার তোরজোড়ে আলোচনায় কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো তা শর্মী জানতে পারেনি। তবে সে নিশ্চিত বিয়েটা হচ্ছে। তবুও মন মানছে না। দিহান এখনো নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে। ওর জন্য খাবার আলাদা করে রেখে বাকিগুলো ফ্রিজে তুলে রাখলো। ডাইনিং টেবিল থেকে নোংরা থালা-বাসন নিয়ে বেসিনে রাখলো। গুলিস্তা আজকাল নিজের ঘরেই খায়। এঁটো প্লেট আনতে আবার ওর রুমে যেতে হবে। কোণার মাঝারি আয়তনের একটা ঘরে থাকে গুলিস্তা। দরজায় নক করতে গিয়ে দেখলো দরজা লক করা নেই। শর্মী ওকে না ডেকেই ঘরে প্রবেশ করলো। ডাকলেও জবাব মিলবে না সেটা ও জানে।
জানালার পাশে চেয়ারে টেবিলে বসে বই পড়ছিলো গুলিস্তা। ঘরে শর্মীর প্রবেশ বুঝতে পেরেও মাথা তুলে তাকালো না। একমনে অংক কষে যাচ্ছে। ফ্লোরে একপাশে রাখা এঁটো থালা বাসন গুছিয়ে নিয়ে শর্মী ওর দিকে তাকালো। এতো মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে দেখে শর্মীর ভীষণ রাগ হলো। এদিকে মেয়ের জীবন নিয়ে টানাটানি, আর সে বইয়ে মুখ গুজে বসে আছে। তিরিক্ষি মেজাজে গলায় ঝাঁঝ নিয়ে সে বললো,
– বইপত্র এবার ছাড়ো। এখন ওসব পড়ে আর কি হবে? এবার অন্যদিকে একটু মনোযোগ দেও। সবাই মিলে বসে তোমার বিয়ে ঠিক করতে লেগে পরেছে। বইপত্র বস্তাবন্দী করে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার প্রিপারেশন নেও।
প্রশ্নবিদ্ধ চোখে গুলিস্তা বড় ভাবীর দিকে তাকালো। দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছে। তেজ কমে আসা আলো জানালা পেরিয়ে গুলিস্তার ফর্সা মুখে এসে পরেছে। গোলাপি মুখখানায় পবিত্রতা উপচে পরছে। লম্বা চুলগুলো দুপাশে বেণুনী করা। গোল গোল দুটো চোখে কৌতুহল। অথচ শর্মী ভেবেছিলো ওই দুই সমুদ্রে থাকবে হতাশার নোনা জল। মেয়েটা এমনি, ভাবনার বাইরে কাজকর্ম করে চমকে দেয়। শর্মীর ইচ্ছে হলো, মেয়েটাকে আলতো হাতে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরতে। কেনো যেনো লজ্জা লাগে। গুলিস্তার পাশে বেশিক্ষণ থাকলে মেয়েটা ওকে মায়ায় ভাসিয়ে নিতে চায়। পবিত্রতায় ভরা মায়াবী মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে না পেরে ঘর ছাড়লো শর্মী। বের হতে হতে বলে এলো,
– গত সপ্তাহের আনা প্রস্তাবটাতে সবার আগ্রহ আছে। বিয়ের কথাবার্তা শুরু করতে যাচ্ছে। নিজেকে তৈরি করো।
গুলিস্তার বিচলিত হলো না। শুধু নিজের ঘরটার দিকে ঘুরে ফিরে তাকালো। দীর্ঘদিন ধরে তার বাস এই ঘরে। কতো নির্ঘুম রাত, কতো দীর্ঘশ্বাস, কতো চোখের জলের সাক্ষী এক ছোট্ট ঘরটা। এই ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে হবে ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। অবশ্য দম বন্ধ হয়ে যাক, এটাই তো আজকাল একমাত্র চাওয়ায় পরিণত হয়েছে।
গুলিস্তার মনে হলো এই ঘর ছেড়ে যাওয়ার থেকে এই দুনিয়া ছেড়ে যাওয়া বুঝি বেশি সহজ। জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকালো। এখান থেকে ঝাঁপ দিলে তার কি মুক্তি মিলবে? মন উত্তর দিলো দ্রুত। এই দোতলা থেকে ঝাঁপ দিলে হাত-পায়ের হাড়টুকুও ভাঙবে কিনা সন্দেহ আছে। মরে যাওয়া তো দূরের কথা। গুলিস্তা চেয়ার ছেড়ে টেবিলের উপর পা মুড়ে বসে পরলো। তারপর প্রিয় গণিত বইটার একটা একটা করে পাতা ছিড়ে জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দিলো। দস্যি পাতাগুলো সোজা নিচে না পরে খানিক উড়াউড়ি করে একটু দূরে গিয়ে পরছে। গুলিস্তা একেরপর এক পাতা ছিঁড়ে নিচে ফেলে দিচ্ছে কিন্তু কোনোভাবেই সেগুলো সোজা নিচের দিকে যাচ্ছে না। একে তো পাতলা কাগজ তার উপর বাইরে বইছে মাতাল হাওয়া।
চলবে…।
(আমার ভীষণ ইচ্ছে ছিলো রমজান উপলক্ষে পেজে নিয়মিত পোস্ট করবো। কিন্তু রানিং গল্পগুলো লেখা সম্ভব হচ্ছে না। ড্রাফট বক্সে এই গল্পটি অর্ধেক লেখা আছে। তাই সেটি পোস্ট করা শুরু করলাম। ঈদের আগে শেষ করতে পারবো ইনশাআল্লাহ।)