হলুদ_শহরের_প্রেম – [০৩] লাবিবা ওয়াহিদ

0
153

#হলুদ_শহরের_প্রেম – [০৩]
লাবিবা ওয়াহিদ

বাবার কথা শোনার পর থেকেই নিপুণ কেমন অন্যমনস্ক, চুপসে গিয়েছে। কাজ ছাড়া কলিগদের সাথে এমনিতেও তেমন কথা বলে না। কিন্তু আজ কাজের কথা হুঁ, হা, না-তে সেরেছে। নিশাত কল করেনি এরপর। নিপুণ বিকালে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে। কাজ আজ তুলনামূলক বেশি থাকা সত্ত্বেও কাজ সময়ের আগে শেষ করে ফেলেছে। সঙ্গে যতটুকু কাজ বাকি ছিল সেগুলো বাসায় করে নিবে।

বাসে উঠেই দুই সিট একসাথে খালি পেল নিপুণ। তাই সে দ্রুত জানালার সিটটা দখল করে নিলো। ক্লান্ত মুখে একটু দমকা হাওয়া ছুঁয়ে দিলেই নিপুণ বড্ড স্বস্তি অনুভব করে। জানালার কাঁচটা টেনে খুলতেই হুড়মুড়িয়ে বাতাস ছুঁয়ে যায় তাকে। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে পানি কয়েক ঢোঁক গিলতেই নিপুণ অনুভব করলো তার পাশে কেউ বসেছে। নিপুণ মুখে পানি নিয়ে পাশে ঘুরে তাকাতেই দেখল পাশে সুপ্ত বসে আছে। সুপ্তকে দেখে অসাবধানবশত নিপুণের গলায় পানি কিছুটা আটকে যায়। যার ফলস্বরূপ মুখে থাকা সব পানি সুপ্তের মুখে গিয়ে ছিটকালো। সুপ্ত সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে ফেলেছে অধরজোড়া চেপে। পরপরই কানে ভেসে আসল অট্টহাসির শব্দ।

এরকম এক বাজে পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যাবে নিপুণ কল্পনাও করতে পারেনি। সে তড়িঘড়ি করে ব্যাগ থেকে রুমালটা বের করে সুপ্তের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
–“আমি অত্যন্ত দুঃখিত, এরকমটা হবে সত্যিই বুঝতে পারিনি।”

নিপুণের তখনো থেমে থেমে কাশি হচ্ছে। সুপ্ত দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নেয়। কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে নিপুণের হাতের স্পর্শ পেয়ে সুপ্ত গলে যায়। সে সুন্দর করে রুমালটা দিয়ে নিজের মুখ মুছে নেয়।

দীপকও বাসে উঠেছিল। সুপ্তের এ অবস্থা দেখে সে-ই ফিক করে হেসে দিয়েছিল। হাসতে হাসতে নিজ মনেই বলল,
–“আহারে বেচারা, প্রেম করতে গিয়ে যে কতকিছু সহ্য করতে হয়! সত্যি বস, তোর দারুণ ধৈর্য!”

সুপ্ত মুখ মুছে রুমালটা নিজের কাছে নিয়ে বলল,
–“এত বড়ো অকাজের জন্য রুমালটা আজ থেকে আমার হলো।”

সুপ্তের এ কথা শুনে নিপুণের মুখ থেকে দুঃখী ভাব উড়ে গেল। সে বোধহয় ভুলে গেছিল তার পাশে বসা লোকটি মোটেও সাধারণ ধাঁচের কেউ নয়। নিপুণ ভ্রু কুচকে বলল,
–“রুমাল দিয়ে কী করবেন?”

–“ভালোবাসার জিনিস যত্ন করে আগলে রাখব। রুমালটা এই মুহূর্তে আমার ভালোবাসা চাচ্ছে। ভালোবাসা দিতে আমি আবার কৃপণতা করি না।”

নিপুণের কুঁচকানো ভ্রু আরও কুচকে যায়। বিরক্তির শব্দ করে জানালার দিকে মুখ ফেরাল। মিনমিন করব বলল,
–“অসভ্য!”

–“কিন্তু আমি তো সভ্য। অসভ্যতামি কবে করলাম তোমার সাথে?”

নিপুণ চরম বিরক্ত হলো। আফসোস করলো কেন একে সরি বলল? পানি ফেলেছে ভালোই তো হয়েছিল। এখন যেন একদম মাথায় চড়ে আছে। নিপুণ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“চুপ থাকবেন প্লিজ? আপনার আজেবাজে কথা শুনে মাথা ধরেছে।”

সুপ্ত অল্প করে হাসলো। নিপুণকে বিরক্ত করতে তার ভীষণ ভালো লাগে। পাশাপাশি বসেও কম আনন্দ হচ্ছে না তার। সুপ্ত নিপুণের কানের কিছুটা কাছাকাছি মুখ নিয়ে আস্তে করে বলল,
–“টিপে দিব?”

নিপুণ গরম চোখে তাকাল। বাস এতক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। সুপ্ত আর জ্বালালো না নিপুণকে। সুপ্ত বাসের বাইরে থেকেই দেখেছিল নুপুণের মলিন মুখ। এজন্য জেনে-শুনেই বাসে উঠেছে সে। এখন নিপুণ রাগের চোটে যেন ভুলে বসেছে মন খারাপের কথা। যাক, এতেই সুপ্তের স্বস্তি।

কিছুদূর যেতেই সুপ্ত আবার মুখ খুলল,
–“নিপুণ, একটা সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য।”

নিপুণ ভ্রু কুচকে তাকায় সুপ্তের দিকে। সুপ্ত হেসে বলল,
–“সদর হাসপাতালে চারজন নতুন ছাগল ভর্তি হয়েছে। প্রত্যেকের হাত-পা ভাঙা। ছাগলদের সুন্দর রূপে দেখে আসতে চাইলে যেতে পারো।”

নিপুণের চোখ কপালে উঠে গেল সুপ্তের কথা শুনে। চারজন ছাগল আর গতকাল রাতের সুপ্তের দেওয়া হুমকি; সব যেন নিপুণের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই নিপুণের চোখ-মুখে আতঙ্ক ফুটে ওঠে। অস্ফুট স্বরে বলল,
–“আপনি কী পাগল?”

–“ভালো কাজ করতে পাগল হওয়ার প্রয়োজন হয়?”

–“মা*-মা/রি ভালো কাজ?”

–“অন্তত খারাপ না। মেরে যদি খারাপ গুলোকে সোজা করা যায় তাহলে ক্ষতি কী? এছাড়া আমি ভবিষ্যৎ রাজনীতিবিদ বলে কথা, আমারও তো সমাজ সেবার কথা চিন্তা করা উচিত তাই না?”

–“এটাকে সমাজ সেবা বলে নাকি সমাজকে উস্কে দেওয়া বলে?”

সুপ্ত অকপটে বলল, “সমাজ সেবা।”

–“খারাপকে ভালো করার জন্য আইনি ব্যবস্থা আছে।”

সুপ্ত চোখ ছোটো ছোটো করে বলল,
–“আমারও আইন আছে। নিজস্ব আইন।”

নিপুণ আর কথা বাড়ায় না। এই লোকের সাথে কথা বললে কথা খামাখা বাড়বে। নিপুণ আবারও বাইরে নজর ফেরালো। কেন যেন তার ভেতর সেরকম খারাপ লাগা কাজ করছে না। গতকাল যারা বাজে ব্যবহার করছিল তাদের একটা শাস্তি অন্তত দরকার ছিল। নিপুণ এতটাও উদার মনের কেউ নয় যে অন্যায়কারীকে নিয়ে চিন্তা করবে বা তাদের মাফ করে দিবে।

সে শুধু শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে ঝামেলাহীন থাকতে চায়। কোনোরকম ঝামেলায় জড়াতে চায় না। এটাই শুধু তার ভয়। এছাড়া আর কিছু না। তবে সুপ্তকে যতটুকু চিনেছে সে সহজে নিপুণের কথা সবার সামনে আনবে না। নিপুণের হঠাৎ মনে পড়ে যায় সেদিনের ঘটনা। যেদিন সুপ্তকে সে চড় মেরে বসেছিল। সেই বোকামির কথা ভাবতেই নিপুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

নিপুণ বাড়ি ফিরতেই দেখল নিশাত দরজার খুলে সিঁড়ির আশেপাশে পায়চারী করছে। যেন সে নিপুণেরই অপেক্ষা করছিল। নিশাত তাকে দেখে খুশি হয়ে যায়। নিপুণ একপলক ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জুতো খুলে নেয়। ভেতরে প্রবেশ করতে করতে নিশাতের উদ্দেশে বলল,
–“কী ব্যাপার নিশাত? আজ এত খুশি খুশি লাগছে যে?”

–“বলব, তার আগে ফ্রেশ হয়ে আসো!”

নিপুণ ফ্রেশ হতে চলে যায়। সন্ধ্যার জন্য হালকা-পাতলা নাস্তা বানাতে হবে। ফ্রেশ হয়ে, চেঞ্জ করে আসতেই নিপুণ দেখল দুই বাটি নুডুলস তার টেবিলের ওপর রাখা। নিশাত তার পাশেই অত্যন্ত উচ্ছ্বাসের সঙ্গে দাঁড়িয়ে। নিপুণ অবাক হয়ে বলল,
–“কে দিলো নুডুলস?”

নিশাত মুচকি হাসে।
–“আমি বানিয়েছি আপা। তুমি যেভাবে কল কেটে দিলে তাতে মনে হচ্ছিল তুমি মন খারাপ করেছ। তাই ভাবলাম তোমাকে একটু খুশি করা যাক। ইভানের বড়ো ভাই দারুণ নুডুলস বানাতে পারে, আমাদের একদিন খাইয়েছিল। তার কাছেই শিখে নিয়েছি। আর ইউটিউবেও কিছু রেসিপি দেখেছি। এখন খেয়ে দেখো তো কেমন লেগেছে? উত্তেজনায় নিজেই টেস্ট করতে ভুলে গেছি।”

নিপুণ নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলো ভাইটার দিকে। তার এই নিশাত যে বড়ো হয়ে গেছে তা তো সে খেয়ালই করেনি। ভাই এখন বড়ো বোনের হাসি-খুশির দিকটা খেয়াল রাখছে। সে কিসে খুশি, কিসে রাগ হতে পারে সেটাও ভাবে। নিপুণের চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে এলো। ইচ্ছে করছে ভাইটাকে জড়িয়ে ধরে বলতে, “তুই জগতের সবচেয়ে আদুরে ভাই নিশাত।”

ভাই-বোনের সম্পর্কটা খুব স্নিগ্ধ, সুন্দর হয়। এখানে যেমন ঝগড়া-ঝাটি, মার-পিট আছে তেমনই রয়েছে অন্তহীন ভালোবাসা, যা কেউ কেউ প্রকাশ করে আবার কেউ কেউ গোপন করে রাখে। নিপুণের চোখ-মুখে তৃপ্তি ফুটে ওঠে। ভাইকে নিয়ে বিছানায় বসে বলল,
–“একসাথে খাব চল।”

দুজন একসাথে খেতে বসেছে ঠিকই। তবে নিশাতের অনুরোধে নুডুলস প্রথমে মুখে পুরলো নিপুণ। নিশাত তখনো আগ্রহের সাথে নিপুণের মুখের দিকে চেয়ে। নিশাত বলল,
–“অনেস্ট রিভিউ দিবা আপা। আমি জানি কেউ-ই প্রথম ধাক্কায় ভালো রান্না করতে পারে না। সেখানে তো আমি নিতান্তই ছেলে মানুষ।”

নিপুণ ফিক করে হেসে দিলো। হাসি বজায় রেখে বলল,
–“ঝালটা বেশি হয়েছে আর লবণও পরিমাণমতো হয়নি।”

নিশাতের মুখ ভার হয়ে গেল। মিনমিন করে বলল,
–“ঝালের ব্যাপারটা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু ইউটিউব, ইভানের ভাই সবাই বলেছে স্বাদমতো লবণ দিতে। এখন তুমি-ই বলো আপা, প্রথম রান্নায় আমি কেমনে বুঝব লবণ কতটুকু লাগে? এদের কী কমনসেন্স নাই?”

নিপুণ আরেক দফা হাসলো। নিশাতের গাল টেনে বলল,
–“তবে সবকিছুর মধ্যেও একটা বিশেষ আইটেম আছে নুডুলসে।”

নিশাত চোখ জোড়া চকচক করে বলল,
–“সেটা কী আপা?”

নিপুণ মুচকি হেসে বলল,
–“আমার প্রতি তোর উপচানো ভালোবাসা।”

হাসা-হাসি, আড্ডার মাঝেই দুই ভাই-বোনের সময় কেটে যায়। নিপুণ চলে যায় রান্না করতে। রান্নার পাশাপাশি সে নিজের কাজগুলোও ল্যাপটপে টপাটপ করার চেষ্টা করলো। নিশাত পড়তে বসেছে। নিপুণ কী ভেবে নিশাতকে হাঁক ছেড়ে ডাকল।

–“নিশাত?”

নিশাত এক ছুটে রান্নাঘরে চলে আসল। নিপুণ নিশাতের উপস্থিতি টের পেয়ে রান্নায় মনোযোগ দিয়ে বলল,
–“বাবাকে কী ঠিকানা দিয়েছিস?”

–“না, দেইনি। জোর করেছিল, তোমার নাম্বারও চাইছিল। আমি কিছুই দেইনি।”

নিপুণ এবার গলা খাদে নামিয়ে বলল,
–“বকা দিয়েছে নিশ্চয়ই?”

নিশাত শুকনো হেসে বলল,
–“এ আর নতুন কী আপা? যাইহোক, ওনার গা*লি এখন আর গায়ে মাখি না। তুমিও চিন্তা করো না। সব ঠিক আছে।”

নিপুণ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। পুরানো তিক্ত, ভয়ংকর অতীত না চাইতেও তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। শারিরীক এবং মানসিক ব্যথায় কাঁতড়ে থাকা দিনগুলো মাথায় আসলেই নিপুণের ভয়ে গা হিম হয়ে আসে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। অনেক শক্ত মনোবল নিয়ে এখন নিজের জন্য, নিশাতের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে সে। এত সহজে নিপুণ সব এলোমেলো হতে দিতে পারে না। নিপুণের আর শক্তি নেই নতুন করে ভেঙে যাওয়ার। একজন মানুষ আর কত ভাঙবে, আঘাতপ্রাপ্ত হবে তাও কি না আপন মানুষদের দ্বারা?

নিশাত আবার বলল,
–“বাবা বলছিল আমাকেও ফিরে যেতে। কিন্তু সৎ মায়ের সংসারে আমি আর যেতে চাই না আপা। আমি তোমার সাথেই থাকব।”

নিপুণ আহত নজরে তাকায় ভাইয়ের দিকে। ভাইকে আশ্বস্ত করে বলল,
–“তুই আমার কাছেই থাকবি নিশাত, তোকে আমার থেকে আলাদা হতে দিব না কখনো। অন্তত ওই লোকের কাছে কখনোই তোকে ফিরতে দিব না, সেই ভরসা রাখ তোর আপার ওপর।”

————–
রাতে নিপুণ ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে যেতেই তার ফোন টুং করে শব্দ করে উঠল। নিশ্চয়ই কোনো মেসেজ। নিপুণ ফোন চেক করতেই দেখলো একটা ছবি। সেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, হাসপাতালে পাশাপাশি দুইটা বেডে চারজন ছেলে আহত অবস্থায় পড়ে আছে। ছোটো বেডে দুজনের জায়গা হচ্ছে না বোঝাই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ না কেউ ঠিক পড়ে যাবে। এরকম এক দৃশ্য দেখে নিপুণ কীরকম অভিব্যক্তি প্রকাশ করবে বুঝে উঠতে পারল না। ক্ষণিকের জন্যে যেন তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। পরপরই একটা মেসেজ আবারও শব্দের সাথে এলো। নিপুণ চোখ বুলালো মেসেজটার দিকে। সুপ্ত মেসেজে লিখেছে,

–“পকেটে তেমন টাকা নেই বুঝছ, তাই এদের জন্য আরেক জোড়া বেড ভাড়া নিতে পারিনি। এজন্য ভাবলাম একটা বেডই দুজন করে ভাগাভাগি করুক; এতে বন্ধুত্বের গভীরতা বাড়বে।

জানো, এই দৃশ্যটা বুকের বা পাশটায় খুব শান্তি দিচ্ছে। ইচ্ছে করছে ফেসবুকে ছবিটা আপলোড করে বলি, ‘আজকের দিনের সেরা ছবি’, ড্যা~ম।”

চলবে—

বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম, কেমন লেগেছে জানাবেন। এবং ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ নজরে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here