হলুদ_শহরের_প্রেম – [০২] লাবিবা ওয়াহিদ

0
57

#হলুদ_শহরের_প্রেম – [০২]
লাবিবা ওয়াহিদ

নিপুণ এক ব্যাগ বাজার নিয়ে বের হতেই দেখতে পেল কিছুটা দূরে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুপ্ত। চোখ-মুখ ফুলে কিছুটা লাল হয়ে আছে, যেন ঘুম থেকে উঠে সোজা এখানেই এসেছে। নিপুণ সুপ্ত’র দিক থেকে নজর সরিয়ে নিজ পথে হাঁটা ধরল।

সুপ্ত শাহবাগ থেকে ফিরেছে আটটা নাগাদ। মিনহাজ সাহেব ফজরের সময়ই তার ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছিল। নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হতেই দেখে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির দিকে আনমনে চেয়ে থাকার সময়ই হঠাৎ তার মাথায় শাহবাগ যাওয়ার ভূত চেপেছিল। বাবাকে ছাতার সাথে বাড়ি পাঠিয়ে দীপককে কল করে মসজিদের সামনে আনায়। ঘুম চোখে দীপকও ছুটতে ছুটতে এসে ব্যস্ত কণ্ঠে বলেছিল,
–“কীরে? ইমার্জেন্সি ডাকলি কেন?”

সুপ্ত তখন বলেছিল,
–“শাহবাগ যাব, ফুল আনতে। চল।”

দীপকের তখন পুরো জন্মের রাগ একসাথে জড়ো হয়েছিল সুপ্তকে ঝাড়ার জন্য। শালা ফুল কিনতে যাওয়ার জন্য দীপকের এত সাধের ঘুমে জল ঢেলে দিলো? ফুল আনা কোনো ইমার্জেন্সি কাজের মধ্যে পড়ে? দীপকের ইচ্ছে হচ্ছিল বড়োসড়ো পাথর দিয়ে সুপ্তের মাথা ফাটিয়ে দিতে৷ দীপক অবশ্য থামেনি, পুরোটা পথ সুপ্তকে সে বকেই গেছে। আর সুপ্ত? সে তো যেন কোনো কথা কানেই নেয়নি। ময়লা ঝাড়ার মতো করে দীপককে এড়িয়ে গেছে।

ফেরার পর সুপ্ত বাসায় গিয়ে ঘুম দিয়েছিল। আর দীপক মুখ ভার করে রাস্তা-ঘাটে ঘুরে বেরিয়েছে। তার চোখে এই বেলায় আর ঘুম ধরা দিলো না। হাঁটা-চলার মাঝেই দীপক নিপুণকে দেখতে পেয়েছিল বাজারে যেতে। তখনই দীপক নিজের মনের ঝাল পুরো দমে মেটানোর পরিকল্পনা পেল। সুপ্তকে কল দিয়ে বাজে ভাবে তার কাচা ঘুম ভেঙে দেয়। সুপ্ত যখন ঘুম ভাঙার অপরাধে দীপককে গা*লি দিলো তখন দীপক যেন সমস্ত জগতের শান্তি নিজের ভেতর খুঁজে পেল। গালির চাইতে কারো ঘুম ভাঙানোর মতো পৈশাচিক আনন্দ আর কী-ই বা হতে পারে?

সুপ্তও চটে ছিল বেশ। পরপর দুবার তার ঘুমে ব্যঘাত ঘটেছে। দীপক অবশ্য বেশি সময় নেয়নি সুপ্তকে নিপুণের ব্যাপারে জানাতে। সুপ্ত নিপুণের কথা শুনে দমে যায়। ছুটতে ছুটতে চলে আসে বাজারের সামনে। সুপ্তর উষ্কখুষ্ক অবস্থা দেখে দীপক পেটে হাত চেপে হাসছিল। প্রেমে পড়লে বীরের মতো পুরুষরাও বেড়াল বনে যায়। প্রেমের কতটা শক্তি যে একজন কঠিন মানুষকে সরল করে ফেলে।

নিপুণ সুপ্তর পাশ কেটে যেতে নিতেই সুপ্ত তাকে শুনিয়ে বলল,
–“একজনকে জানাচ্ছি শুভ সকাল। তাকে রোদহীন ম্লান দিনে সুন্দর লাগছে।”

নিপুণের পা থমকে যায় সুপ্ত’র কথা শুনে। কথাটা যে তাকে বলা হয়েছে তা নিপুণ হাড়ে হাড়ে বুঝে নিয়েছে। সে পিছ ফিরে সুপ্তের দিকে তাকালো। সুপ্তের ফোলা চোখ তখনো নিপুণের দিকে। নিপুণ চাইতেই সুপ্ত খোলা এক হাসি দিলো। নিপুণ বলে ওঠে,
–“সমস্যা কী আপনার?”

সুপ্ত অবাক হওয়ার ভান ধরলো। বলল,
–“আমার সমস্যা? কিসের, কোথায়?”

–“তাহলে প্রথমে ফুল আবার এখন আমাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলা, এসব কী?”

–“ফুল আমি দিয়েছি, এটা ঠিক। তবে আমি তোমাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলেছি.. এর প্রমাণ কী? দীপক, আমি রিপোর্টার ম্যামকে কিছু বলেছি?”

দীপক হ্যাবলার মতো চেয়ে ছিল সুপ্ত’র দিকে। হ্যাঁ, না কিছুই বলল না। তা দেখে সুপ্ত বলল,
–“যাহ, বাদ দে। তুই তো থাকিস অন্য খেয়ালে। নিপুণ, তুমি চাইলে ফ্রিতে তোমার বাড়ি অবধি বাজারের ব্যাগ পৌঁছে দিতে পারি।”

নিপুণ এতে কিড়মিড় চোখে তাকালো সুপ্তের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“আপনার মতো মানুষের থেকে উপকার পাওয়ার ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই আমার নেই।”

নিপুণ চলে যেতে নিলে সুপ্ত পিছু ডাক দিয়ে বলল,
–“আমি কিন্তু থ্যাঙ্কিউ পাওনা আছি।”

নিপুণ থেমে পিছে ফিরে ভ্রু কুচকে তাকায়। সুপ্ত কিছু বলতে নিলে নিপুণ এবার আর না দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যায়। নিপুণের সুপ্তকে এড়িয়ে চলা দেখে দীপক বলল,
–“তোকে তো পাত্তাই দেয় না।”

সুপ্ত একমনে নিপুণের যাওয়ার পানে চেয়ে আনমনে বলল,
–“এজন্যই তো তাকে ভালোবাসি।”

–“ডিভোর্সি মেয়ে তো তুই ডিজার্ভ করিস না সুপ্ত!”

সুপ্ত এবার চোখ লাল করে তাকালো দীপকের দিকে। সুপ্তের রাগ দেখে দীপক দমে গেল। সুপ্তের সামনে কিছুতেই “ডিভোর্সি” শব্দটা উচ্চারণ করা যায় না। সুপ্ত দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“আর কখনো যাতে তোর মুখে এই শব্দ না শুনি।”

সুপ্ত থেমে আবার বলল,
–“আজকে পার্টি অফিসে কোনো ঝামেলা নেই। এজন্য সাড়ে বারোটার আগে ভুলেও কল দিবি না। এবার কল করলে তোর হাতের ফোন ভাঙাচোরা অবস্থায় পাবি, গুড নাইট।”

সুপ্তের পুরো নাম মাহদী আরাভ সুপ্ত। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান সে। বাবা মিনহাজ সাহেব ব্যবসায়ী এবং তাদের থানার এক স্কুলের কমিটিতে আছে। সুপ্তের বড়ো ভাই মাহমুদ বিবাহিত, এখন অন্যত্র থাকছে চাকরির সুবাদে। মাহমুদ শুরু থেকেই কিছুটা ভীত এবং শান্তিপ্রিয় মানুষ৷ আর সুপ্ত একদমই মাহমুদের বিপরীত। সে চরম ঝামেলা করার অদম্য সাহস নিয়ে জন্মিয়েছে। ঝামেলা, মাত্রাতিরিক্ত সাহস আর মুখ চালানোতে ভীষণ পটু সে। সুপ্ত চাকরি, ব্যবসার প্রতি ভীষণ উদাসীন। তবে উদাসীন ছেলেটার একটি স্বপ্ন ছিল; রাজনীতি করার। এজন্য ছাত্র বয়স থেকেই সে রাজনীতির সাথে একপ্রকার আঠার মতো লেগে আছে।

মিনহাজ সাহেব একজন সৎ, শান্ত, নিষ্ঠাবান মানুষ হিসেবে এলাকার মানুষের কাছে পরিচিত। কিন্তু এই শান্ত মানুষের ঘরেই অসংখ্য বিচার এসেছে ছোটো ছেলের নামে। সুপ্ত বরাবরই অবাধ্য, চঞ্চল স্বভাবের ছেলে। তার মধ্যে আলাদা এক তেজ ছিল, যেই তেজের তীক্ষ্ণ ছায়াও কেউ মাড়াতে পারত না। মিনহাজ সাহেব যা অপছন্দ করেন সেটাই সুপ্ত আজীবন করে গেছে। আবার রাজনীতি বিষয়টাও তিনি ভীষণ অপছন্দ করেন। যতদিনে ছেলের ব্যাপারটা কানে আসল ততদিনে ঘটনা বহুদূর গড়িয়ে গেছে। সুপ্তকে মে*রে, ঘরে আটকেও দমিয়ে রাখা যাচ্ছিল না। শেষমেষ মিনহাজ সাহেবের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। ছেলে যেই চতুর, বেপথে চলে যাবে সেই ভয়ও তাকে নাড়া দিচ্ছিল৷ এজন্য একপ্রকার বাধ্য হয়েই মেনে নিলেন, সঙ্গে এমন কিছু শর্ত জুড়ে দিলেন যা সুপ্তের জন্য পালন করা খুবই কঠিন। তবুও সুপ্ত সেসব শর্ত দাঁতে দাঁত চেপে মেনে নিলো। কিন্তু একটা শর্ত সে কিছুতেই মানতে চায় না। ওই যে, মা*রপিটের ব্যাপারটা। তার ভাষ্যমতে মা*র-পিট না করলে তাকে কেউ ভয় পাবে না। ভয় না পেলে রাজনীতি করে কী লাভ? রাজনীতির মজাটা তো ওই ভয়েই আটকে আছে। তখন মিনহাজ সাহেব রেগে বলেছিলেন,
–“মজা না লাগলে করবে না রাজনীতি। তাও মা*-রপিট বন্ধ।”

সুপ্ত তখন মুখ ভার করে বলেছিল,
–“আচ্ছা, ঠিক আছে। কাউকে মা*রলে তার ব্যথায় মলম দিয়ে দিব। তাতে চলবে?”

সুপ্তের এহেম কথায় মিনহাজ সাহেব হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিলেন। সেই থেকে মিনহাজ সাহেব সুপ্তের সাথে ঠিক ভাবে কথা বলেন না। যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলেন।

সুপ্ত দীপককে বলেছিল যেন কল না করে। সেখানে সুপ্ত নিজেই দীপককে কল করলো। দীপক কিছুটা চমকে গিয়ে কল রিসিভ করল,
–“হ্যাঁ, বল।”
–“জা*য়ার গুলারে খুঁজে পাইছিস?”
–“বিকালের মধ্যে খবর পেয়ে যাব।”
–“বিকাল কেন? ঘুম থেকে উঠেই ওদের আপডেট চাই। যেখানেই দেখবি মে* হাত-পা ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে আসবি। তবে হ্যাঁ, হাত-পা যাতে ভালো ভাবে ভাঙে। আমি তিন-চার মাস ওদের হাসপাতালে পড়ে থাকতে দেখতে চাই, গট ইট?”

সুপ্তের কথা শুনে দীপক শুধু অবাক হয়। আজ অবধি সুপ্ত যতবার মা*রার আদেশ দিয়েছে ততবারই সুপ্ত ওদের ব্যথায় মলমেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এত অদ্ভুত কেন এই সুপ্ত? এই সুপ্তকে পড়া ভীষণ কঠিন।

——————
নিশাতকে কোচিং-এ পাঠিয়ে নিপুণ তড়িঘড়ি করে নিজের অফিসের দিকে ছুটেছে৷ আইডি কার্ডটা কোনো রকমে নিজের গলায় ঝুলিয়ে অফিসের লিফটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এই বিল্ডিংটার পাঁচ এবং ছয় তলা মিলিয়ে নিপুণের অফিস। অফিসে প্রবেশ করতেই নিপুণ ম্যানেজারের থেকে বেশ কিছু কড়া কথা শুনলো। ম্যানেজার দেরী করে অফিস আসা পছন্দ করেন না। নিপুণ দাঁতে দাঁত চেপে ম্যানেজারের শুনে তাকে সরি বলল এবং জানালো সে আর দেরী করে আসবে না। সেদিনের মতো নিপুণ কড়া কথা শোনার পালা শেষ হলো। নিজের ডেস্কে গিয়ে বসতেই নিপুণের পাশের ডেস্কে বসা কলিগ রিয়া নিপুণকে ফিসফিস করে বলল,
–“বুড়োটারে মনে হয় বউ খেতে দেয় না। এজন্য বাড়ির রাগ এখানে আমাদের উপর এসে ঝাড়ে; বদ-জাত লোক।”

রিয়ার কথা শুনে নিপুণের স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ে গেল। স্কুলে পড়াকালীন সময়ে যখন পরীক্ষা থাকত, তখন কোনো স্যার গার্ড বেশি দিলেই সহপাঠীরা নিজেদের মধ্যে বলত,
“স্যার মনে হয় বাসা থেকে ঝামেলা করে আসছে, এজন্যই আমাদের উপর এমন রাগ ঝেড়েছে।”

নিপুণ তখনো নীরব স্রোতা ছিল, এখনো আছে। সে রিয়ার কথা এড়িয়ে বলল,
–“বাদ দাও এসব, রিয়া। নিজের কাজ দেখো।”
রিয়া মুখ বাঁকিয়ে নিজের মনিটরের স্ক্রিনে নজর স্থির করলো।

নিপুণের আজ নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় তেমন হলো না। নিত্যদিনের চাইতেও আজ বেশি কাজ পড়েছে তার। এর কারণ হয়তো অফিস দেরী করে আসা। এই পাঁচ তলায় মোট চার ডিপার্টমেন্ট কাজ করে। উপরে বাকি ডিপার্টমেন্টসহ খবর প্রচারের শুটিং স্পট রয়েছে।

লাঞ্চের সময়ও আজ নিপুণ কাজ করছিল। এমন সময়ই তার স্থির ফোন ভাইব্রেশন করে ওঠে। নিপুণ ব্যস্ত হাতে টাইপিং-এর ফাঁকে একপলক তাকালো ফোনের স্ক্রিনে। নিশাত কল করেছে। নিশাতের কল দেখে নিপুণ ভ্রু কুচকালো, এই সময়ে নিশাত তো কখনো কল করে না। নিপুণ টাইপিং থামিয়ে নিশাতের কল রিসিভ করল।

–“হ্যাঁ, নিশাত। বল।”

–“বাবা কল করেছিল আপা।”

বাবার কথা শুনে নিপুণের মুখে যেমন আতঙ্ক ফুটে ওঠে, তেমনই গাম্ভীর্য। ভারী গলায় নিপুণ বলল,
–“হুঁ, তো?”

–“বাড়ির ঠিকানা চাইছিল।”

চলবে—

বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ নজরে দেখবেন। গঠনমূলক, সুন্দর মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here