হলুদ_শহরের_প্রেম – [০৪] লাবিবা ওয়াহিদ

0
44

#হলুদ_শহরের_প্রেম – [০৪]
লাবিবা ওয়াহিদ

–“এ কী, নিপুণ? তুমি সত্যি সত্যি ছাগলগুলোকে দেখতে হসপিটাল চলে এলে?”

হাসপাতালের বিরাট বড়ো কেবিনে সারিবদ্ধ ভাবে দশটি করে মোট কুড়িটি বেড সাজানো। প্রত্যেক বেডেই রোগীরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত৷

আজ সকালেই একটি দুর্ঘটনায় বেশ কিছু আহত মানুষ হসপিটালে ভর্তি হয়েছে।
নিপুণ মূলত আরেকজন রিপোর্টারের সাথে হাসপাতালে এসেছিল সেসব পর্যবেক্ষণ করতে। কাজের ফাঁকে গতকাল রাতের ঘটনা মাথায় এসেছিল তার। সুপ্ত দুইজনকে একই বেডে রাখবে ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছিল না, কারণ যতদূর জানে হাসপাতালে এই ধরণের তেমন নিয়ম নেই।

এজন্যই ব্যাপারটা সত্য নাকি মিথ্যে সেটা দেখতেই কলিগ রিপোর্টারের থেকে বিয়োগ হয়েছে সে। তবে এখানে এসে যা দেখলো তাতে তার চোখ ছানাবড়া! আসলেই এক জোড়া বেডে চারজন চাপাচাপি করে পাশাপাশি শুয়ে। একজন নার্সকে সে জিজ্ঞেস করেছিল, এরকম কেন করতে দেওয়া হয়েছে? নার্স জবাব দেয়নি বরং এড়িয়ে গেছে।

এমতাবস্থায় পাশ থেকে সুপ্তের গলা শুনে নিপুণ ভীষণ চমকে যায়। পাশ ফিরে চাইতেই দেখল সুপ্তকে। তবে পোশাকের দিক থেকে আজ তাকে ভিন্ন লাগছে। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরেছে সে। পাঞ্জাবির হাতা কনুই অবধি গুটানো। প্রতিদিনের এলোমেলো দেখা চুলগুলো আজ সুন্দর ভাবে গোছানো। সবশেষে মুখে কালো মাস্ক। মাস্কের আবরণে সুপ্ত থাকলেও সুপ্তকে চিনতে নিপুণের খুব একটা অসুবিধা হলো না। সুপ্তের নজর প্রতিবারের মতোই ইডিয়েট মার্কা। নিপুণ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“আমার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? আমি আমার ডিউটিতে আছি। একদম ডিস্টার্ব করবেন না।”

সুপ্তের চোখ জোড়া হাসলো যেন৷ সুপ্ত হঠাৎ বুক টানটান করলো। মুখ-ভঙ্গিতে গুরুতর ভাব এনে বেশ ভারী গলায় বলল,
–“আমিও ডিউটিতে আছি মিস রিপোর্টার। আপনার লজ্জা করছে না আমার সাথে লাইন মারতে? মেয়েরা যে এমন কেন, সুপুরুষ দেখলেই গায়ের সাথে লাগতে চলে আসে!”

সুপ্তের এহেম কথা শুনে নিপুণের চোখ কপালে উঠে গেল। বাক্যহারা হয়ে সে চেয়ে রইলো সুপ্তের দিকে। এগুলা কোন ধরণের কথা, নিপুণ কখন সুপ্তের গা ঘেঁষল? নিপুণ অস্ফুট স্বরে বলল,
–“মানে?”

সুপ্তের আর জবাব দেওয়া হলো না। দীপক এসে সুপ্তকে বলল,
–“কীরে, কই ছিলি? তোর কথা মতো সবই এনেছি। আয়, আহতদের পরিবার তোর জন্য অপেক্ষা করছে।”

নিপুণ শুনলো দীপকের কথা। সুপ্ত একপলক নিপুণের দিকে তাকিয়ে দীপকের সাথে চলে গেল। নিপুণ সেই ওয়ার্ড থেকে বের হতেই দেখল সুপ্তকে বেশ কিছু সাংবাদিকরা ঘিরে রেখেছে। সুপ্ত মাস্ক খুলে যথাসম্ভব তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছে। নিপুণ সাংবাদিকদের মাঝে নিজের দুজন কলিগকেও দেখতে পেল। হঠাৎ নিপুণকে এসে ধরলো রিয়া। রিয়া নিপুণকে দেখে বলল,
–“কোথায় চলে গিয়েছিলে নিপুণ? শামিম ভাইয়া বলল তুমি তাকেও বলোনি।”

নিপুণ আমতা আমতা করে বলল,
–“আশেপাশেই ছিলাম।”

রিয়া সেভাবে ঘাটল না নিপুণকে। সামনে মাহদী আরাভ সুপ্ত রয়েছে। এজন্য তার বলা কথাগুলো শোনা বেশ জরুরি। তার কথার উপরই রিপোর্ট লিখতে হবে। এজন্য রিয়া নিপুণকে টেনে সেদিকেই নিয়ে গেল।

সুপ্তের মুখ-ভঙ্গি অস্বাভাবিক গম্ভীর। তার এই গম্ভীর ব্যক্তিত্ব নিপুণের কাছে সম্পূর্ণ নতুন-ই বলা চলে। এই লোক যে সামনের নির্বাচনের জন্য একজন প্রার্থী তা তার চলাফেরা কিংবা ত্যাড়া – বাঁকা কথাবার্তায় বোঝা দায়। এইযে এখন, কতটা প্রফেশনাল মুডে আছে সে। নিপুণ প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে এতে।

হঠাৎ এক প্রশ্ন কানে এলো নিপুণের। একজন সাংবাদিক শুধালো,
–“আপনার নির্বাচনের প্রস্তুতি কেমন?”

নিপুণের কপালে বিরক্তির ভাঁজ পড়ে। এরকম একটা মুহূর্তে এই ধরণের প্রশ্ন? সুপ্ত অবশ্য এই প্রশ্ন এড়িয়ে গেল। সাংবাদিকদের বেশি সময় দিতে পারেনি সে। চলে যাওয়ার আগে ভীড়ের মাঝে নিপুণের ঘামে ভিজে থাকা মুখখানার দিকে একপলক চেয়ে সে চলে গেল। নিপুণ বিষম খায়, এই ভীড়ের মাঝে সুপ্ত তাকে দেখল কী করে?

নিপুণ দুপুর পর্যন্ত হাসপাতালের এদিক ওদিক ছুটল। একসময় কিছুটা সময় পেয়ে হসপিটালের করিডরে থাকা এক ফাঁকা আসনে গিয়ে বসল। ভীষণ ক্লান্ত সে। সকাল থেকে পেটেও কিছু পড়েনি। নাস্তা তৈরি করে নিশাতকে ডেকে ওঠাতে গিয়েই জরুরি কল এলো। দুর্ঘটনার কথা শুনে তাকে কোনোরকমে তৈরি হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। ব্যস্ততার কারণে খাওয়ার মতো সময় হয়নি। এখন পেট জ্বলছে খুদোয়। অতীতে কত খালি পেটে থেকেছে সে। হয়তো সেই থেকেই দীর্ঘসময় না খেয়ে থাকার অভ্যাসটা থেকে গিয়েছে। অতীত মাথায় নড়েচড়ে উঠতেই নিপুণ লম্বা কয়েক নিঃশ্বাস ফেলল।

নিপুণের সামনে দিয়ে মানুষজন ব্যস্ত পায়ে চলাচল করছে। এমতাবস্থায় কেউ একজন তার পাশে এসে বসল। নিপুণ পাশ ফিরে চাইতেই মাস্ক পরিহিত সুপ্তকে দেখতে পেল। সুপ্ত নিপুণের দিকে একমনে চেয়ে আছে। নিপুণ অপ্রস্তুত হয়ে আশেপাশে ভীত নজরে তাকাল। সুপ্ত কোন আক্কেলে তার পাশে এসে বসেছে? নিপুণ নিচু গলায় বলল,
–“আপনি এখানে কী করছেন?”

সুপ্ত নিপুণের প্রশ্নকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল,
–“তোমার মুখ এমন শুকিয়ে আছে কেন? কিছু খাওনি?”

নিপুণ কিছুটা থতমত খেল।
–“সেটা জেনে আপনার কাজ কী? আপনি আপনার কাজে যান।”

সুপ্ত ভ্রু কুচকে বলল,
–“কাজই তো করতে বসেছি। খাবে চলো।”

–“একদম না। জোরাজুরি করলে কিন্তু আমি উঠে চলে যাব। বিরক্ত করবেন না প্লিজ।”

–“উঠে যেতে গিয়ে যদি হাতে টান খাও তখন কী হবে ভেবে দেখেছ? চারপাশে এত মানুষ! দেখলে কী ভাববে বলো তো?”

সুপ্তের নরম গলার হুমকি শুনে নিপুণ চোখ বড়ো করে তাকাল।
–“হুমকি দিচ্ছেন?”

–“কোথায়? আঙুল বাঁকাতে চাচ্ছিলাম। সোজা আঙুলে ঘি সচরাচর উঠতে চায় না তো!”

নিপুণ এবার চোখ রাঙালো। সুপ্ত তা তোয়াক্কা না করে কাউকে দিয়ে বিরিয়ানির প্যাকেট আনালো। সেটা নির্দ্বিধায় নিপুণের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
–“হ্যাপি ফুডিং হার্ট।”

————————
নিপুণ ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলো। এক প্যাকেট বিরিয়ানি নিশাতের হাতে ধরিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। আজ তার রান্না করার শক্তি নেই, এজন্যই খাবার কিনে আনা।

নিপুণ ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই জানালায় বৃষ্টির অনবরত ফোঁটা পড়ার শব্দ কানে এলো। বিকাল থেকেই আকাশ কেমন মেঘলা ছিল। নিপুণ সেসব তোয়াক্কা না করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। ঘুমে জড়িয়ে যাওয়ার আগে নিশাতকে ডেকে বলে দিলো তাকে যেন না জাগানো হয়, সে খেয়ে এসেছে।

ঘন্টা দুয়েক পর নিপুণ যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখনই ফোনের বিরক্তকর শব্দএ বেজে ওঠে। এতে নিপুণের ভ্রু কুচকে গেল। ঘুমটা ভাঙতেও বেশি সময় লাগল না। নিপুণ চোখ বুজেই ফোনটা হাতড়ে খুঁজল বালিশের পাশে। কোনোরকমে ফোনটা হাতে নিয়ে পিটপিট করে নামটা দেখে নিলো। অফিস থেকে কল। নিপুণ চোখ বুজেই কল রিসিভ করলো, সালাম দিলো। ওপাশ থেকে বেশ কিছু কাজ এলো। কাজের কথা শুনে নিপুণের না চাইতেও ঘুম কেটে গেল। চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসল সে। মাথা ধরে উঠে বসে মিনমিন করে বলল,
–“এগারোটার আগেই রিপোর্ট রেডি হয়ে যাবে স্যার। আমাকে ঘন্টাখানেক সময় দিন।”

কল কাটতেই নিপুণ দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। ড্রিম লাইটের আলোয় দেখলো ঘড়ির কাঁটা নয়টার কোঠায়। নিপুণ একরাশ বিরক্তি নিয়ে বাথরুম থেকে মুখ ধুঁয়ে এলো। ঘুমের রেশ কাটাতে রুম থেকে বের হতেই দেখল নিশাত সোফায় এক পা তুলে কার্পেটে শুয়ে মোবাইল দেখছে। নিশাত নিপুণকে দেখতেই সেভাবে শুয়েই বলল,
–“আপা, এত জলদি উঠে গেলা যে?”

–“কাজ আছে।”

এটুকু বলেই নিপুণ রান্নাঘরে চলে গেল চা বানাতে। চায়ে চুমুক দিতে দিতেই সে রুমে চলে গেল। রিয়ার সাথে কলে কথা চালিয়ে যেতে যেতে সে একমনে ল্যাপটপে রিপোর্ট লিখল। আজ এগারোটায় তাদের ফেসবুক চ্যানেল থেকে লাইভ নিউজ টেলিকাস্ট হবে। অনলাইন মিডিয়া হওয়ায় এখানে এত আয়োজন নেই।

নিপুণ রিপোর্ট লিখতে গিয়ে কিছুটা বিরক্ত হলো৷ রিপোর্টের একটা অংশ সুপ্তকে নিয়ে। সুপ্ত তাকে যখন বিরিয়ানি ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়, নিপুণ তখন চেয়েও বিরিয়ানিটা ফেলে দিতে পারেনি। এক সময়ে খাবারের জন্য সে যেই কষ্ট করেছে তাতে সে খাবারের মূল্য কত সেটা হাড়ে হাড়ে জানে। তাই তো সুপ্তের উপর রাগ থাকা সত্ত্বেও খাবারটা ঠিকই খেয়ে নেয়। এই অতিরিক্ত নিপুণের সান্নিধ্যে থাকা সুপ্তকে নিয়ে তার রিপোর্ট লিখতে হবে সেটা সে ভাবেনি কখনো। তাই কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলেই সুপ্তকে ঘিরে লেখা রিপোর্টটি সে সাবমিট করলো।

ঘন্টাখানেকের মধ্যে সব ই-মেইল করে দিতেই আবারও ম্যানেজারের কল এলো। গম্ভীর গলায় বলল আগামীকাল একটু লেটেই সে যেতে পারবে। আর কাল হসপিটালও অন্যরা রিপোর্টের জন্য যাবে। নিপুণ কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সব গুছিয়ে পুণরায় লাইট নিভিয়ে শুতেই আবারও ফোনটা শব্দ করে উঠল। মোবাইল চেক দিতেই দেখল সুপ্তের মেসেজ। লিখেছে,
–“ক্লান্ত রিপোর্টার কী এখনো কাজ করছে? এত কাজ কিসের হুঁ, লাইট নিভিয়ে ঘুমাও। ক্লান্তির ছাপ সুন্দরীদের মুখে মানায় না। গুড নাইট হার্ট।”

নিপুণ এবার রাগের চটে রিপ্লাই না করে পারল না। টাইপ করল,
–“রাত-বিরেতে অন্যের ঘরের লাইটের দিকে উঁকি দেওয়া ভালো না নেতা সাহেব। নিজের চরকায় তেল দিলে বেশি ভালো হয়।”

কিছুটা সময় নিয়েই সুপ্তের থেকে রিপ্লাই এলো,
–“নেতা সাহেব? তোমার মুখে এই সম্বোধন শুনতে আমি হাজারবার তোমার ঘরে উঁকি দিতে রাজি। শুধু উঁকি না, তুমি চাইলে তোমার বাসাতেও পৌঁছে যাব। ‘নেতা সাহেব’ শুধু তোমার, নিপুণ।”

নিপুণ নিজের দোষে নিজেই কপাল চাপড়ালো। মোবাইলটা বালিশের পাশে রেখে বিরক্তির সাথে “ধ্যাত” বলে উঠলো।

চলবে—

বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম। দেরীর জন্য দুঃখিত। কয়েকদিন যাবৎ বাসায় প্রোগ্রাম ছিল, এজন্য গল্প লেখার সময় হয়ে ওঠেনি। এই পর্ব কেমন লেগেছে জানাবেন কিন্তু। সুন্দর সুন্দর, মন ভোলানো মন্তব্য চাইইই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here