আজ ওদের মন ভালো নেই লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা ১.

0
330

আজ ওদের মন ভালো নেই
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

১.

মানুষের জীবনে নানারকম সমস্যা থাকে কিন্তু মিথির জীবনের একমাত্র সমস্যা হলো, দাদাভাই। মিথির দাদার ‘বিবাহ বাতিক’ নামে অদ্ভুত এক ব্যাধি আছে। সারা জীবন তিনি অন্যের বিয়ে দিয়ে বেরিয়েছেন। সকালে ঘুম ভেঙে সবাই চা-নাস্তা করে। আর দাদাভাই চোখের সামনে অবিবাহিত কাউকে পেলেই খপ করে তার হাত চেপে ধরে বলেন – ‘ এই! আজ তোর বিয়ে।’

বছর দুই আগের শুমারী অনুযায়ী মিথিরা ভাই-বোন মোটে ছয়ত্রিশ জন। এই দু’বছরে প্রডাকশনে হালি দুয়েক বেড়েছে কি-না মিথির জানা নেই। মিথিরা যে বাড়িটিতে থাকে তা আয়তনে বিশাল। ভোর হলেই সেই বাড়িতে খান পঞ্চাশেক মানুষের রান্না বসে। টেবিলে খাবার ঢাকা থাকে। যার যখন ইচ্ছে খেয়ে বেরিয়ে যায়। কলেজ পাশ করে ফেলার পর পছন্দ সই ইউনিভার্সিটি নির্বাচন করে বাড়ি ছাড়ার অনুমতি আছে। পরিবারের জরুরি বৈঠক আর বছরের দুই ঈদ ছাড়া দাদাভাই সাধারণত কারো খোঁজ করেন না। কার বাচ্চা হলো, ভাই-বোন-ভাগ্নে-ভাতিজা গণনা কতবার রেকর্ড ছাড়াল সে খবর রাখা এই বাড়িতে বাহুল্য। সবাই নিজের জান বাঁচাতে ব্যস্ত। বিশেষ করে মিথিরা। মিথিরা বলতে, বাড়ির বিবাহযোগ্য অথচ অবিবাহিত সংগঠনের ছেলেপেলে। তাদের প্রত্যেকেই বাড়ির বাইরে বিভিন্ন শহরে থাকে। শহর ভিন্ন হলেও তারা রাতে একই আতঙ্ক নিয়ে ঘুমোতে যায়। ঘুম ভেঙে নিজেকে অবিবাহিত দেখে যথারীতি আশ্চর্য হয়। এই আতঙ্ক ও আশ্চর্যের দিনগুলোতে অবশেষে মিথির নামে ফরমান জারি হলো। মিথির বড় খালা এক দুপুরে ফোন করে চিৎকার করে উঠলেন,

‘ মিথি রে! এই মিথি? তুই তো মরে গেলি রে? তোকে তো আর বাঁচাতে পারলাম না রে?’

মিথি তখন পরিচালক মোখলেসুর আলমের সাথে দাঁড়িয়ে ছিল। এক্ষুনি একটা সিরিয়াস শট হবে। মিথিকে থাকতে হবে ফুল ফোকাসড্। এই সময়ে খালামণির বারংবার ফোনে বিরক্ত হলো মিথি। সরে গিয়ে ফোন তোলার পর বিরক্তিটা বেড়ে চেড়ে মাথার উপর দেই দেই করে নাচতে লাগল। তবুও শান্ত স্বরে বলল,

‘ বাঁচাতে যখন পারলেই না তখন জানাজা পড়িয়ে মাটিচাপা দিয়ে দাও। আমাকে ফোন করেছ কেন? জানাজা সম্বন্ধে কোনো অনুমতি চাও?’

বড় খালামণি ক্ষেপে গেলেন। ধমক দিয়ে বললেন,

‘ দুইদিন ক্যামেরা ধরে আমার সঙ্গে মশকরা করিস? আমার সঙ্গে তোর মশকরার সম্পর্ক?’

‘ না। তোমার আর আমার ভালো বাসাবাসির সম্পর্ক। এবার বলো, ঘটনা কী?’

খালামণির গলার স্বর চোখের পলকে বদলে গেল। আবারও কাঁদো কাঁদো পর্যায়ে ফিরে গিয়ে বললেন,

‘ ঘটনা শুনে তুই কী করবি? তুই ক্যামেরা হাতে বসে থাক। এদিকে তোর বুইড়া দাদা যে তোকে এক ছালচামড়া ছাড়া ছেলের সাথে গছিয়ে দিচ্ছে, সেটা জানার আগ্রহ তো তোর হবে না। তুই হলি একটা অ-প্রাণিবাচক প্রাণী। তুই বুড়িগঙ্গায় ডুবে মরে যা।’

মিথির বুকের ভেতরটায় খামচি দিয়ে উঠল। গছিয়ে দেওয়া মানে কী? দাদাভাই কী হুট করে তার বিয়ে থা ঠিক করে ফেলল? ঠিক করে ফেললেও অবশ্য আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। মিথিদের বনেদী পরিবারে চাচাতো-ফুপাতো ভাইবোন মিলে যে বিশাল সংখ্যা তার অধিকাংশই দাদাভাইয়ের ‘বিবাহ বাতিক’ নামক অতি আবেগের শিকার। তাদের প্রত্যেককেই দাদার আবেগ সামলাতে মরুভূমি হয়ে যেতে হয়েছে। জীবনটাকে জগাখিচুরি বানিয়ে ফেলতে হয়েছে। দাদাভাই সেই জগাখিচুরি খুব আমোদ নিয়ে উপভোগ করেছেন। মিথিকেও যে তার জীবনটাকে একদিন জগাখিচুরি বানিয়ে ফেলতে হবে; দাদাভাইকে জগাখিচুরি উপভোগের দূর্দান্ত সুযোগ করে দিতে হবে তাতে তার কোনো রকম সন্দেহ ছিল না। মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

‘বিবাহ’ ছাড়াও দাদাভাইয়ের টেকনোলজির প্রতি অগাধ ভালোবাসা। ফেসবুক বস্তুটি শিখে ফেলার পর তিনি সর্বপ্রথম সকল পরিবার বর্গকে নিয়ে একটা গ্রুপ খুলেছেন। গ্রুপের নাম ‘আমার প্রাণের পরিবার’। এই ব্যাপারে, দাদাভাইয়ের একজন এসিস্ট্যান্ট আছে৷ এসিস্ট্যান্টের নাম মিস্টার জহিরুল্লাহ। জহিরুল্লাহর আগে মিস্টার বলা অনিবার্য, নয়তো ওনার মন খারাপ হয়। মিস্টার জহিরুল্লাহর প্রধান কাজ হলো, পরিবারবর্গের লিস্ট তৈরি করে এনাউন্সমেন্টে রেখে দেওয়া। বিবাহিত, অবিবাহিত, কিশোরী, শিশু আলাদা আলাদা ফাইল তিনি তৈরি করেন; মাসে মাসে সকলের কাজকর্মের হিসেব রেখে তা আপডেট করেন। চাচা-ফুপুরা এই গ্রুপে এসে আনন্দ নিয়ে ঝগড়াঝাঁটিও করেন। সেদিন বড়চাচা পোস্ট করলেন,

‘ নিচের তলার বেসিন থেকে টুথপেস্ট উধাও। হোলি কাউ! এখন কী আমি ব্রাশ না করে অফিস যাব?’

সেখানে আবার ছোটচাচা মন্তব্য করলেন,

‘ এটা নিশ্চয় ছোট আপার কাজ। ছোট আপার স্বভাব অত্যন্ত খারাপ। ফেরার সময় যা সামনে পায় তাই ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে যান।’

সেই মন্তব্যে দেখা গেল সাতটা লাইক, পাঁচটা এংরি রিয়েক্ট। এংরি রিয়েক্টকারী হলেন, মিথির পাঁচ ফুপু। লাইক দিয়েছেন, মিথির সাত চাচা। ভাই-বোন মিলে সেখানে একটা ভয়ংকর ঝগড়াঝাঁটি বেঁধে গেল। সামনাসামনি থাকলে তৎক্ষনাৎ একটা মার্ডার হয়ে যেত বলে মিথির বিশ্বাস। দাদাভাই ঝগড়ার এই অভিনব পন্থা বের করেছেন বলেই মিথিরা এখনও খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিচ্ছে। জেল-হাজতে পঁচে মরতে হচ্ছে না। মিথি কল কেটে গ্রুপে ঢুকল। গ্রুপে ঢুকতেই দাদাভাইয়ের বিখ্যাত পোস্ট সামনে এলো। তিনি সকল জরুরি পোস্ট লিখেন সাধু ভাষায়। তিনি লিখেছেন –

‘ স্নেহাস্পদ মিথিলাতুন্নেছাকে জরুরি দরকারে শীঘ্রই পৈতৃক বাটীতে আসিতে বলা হইলো। আমরা আগামী এক প্রহরের মধ্যে তাহার আগমন প্রত্যাশা করিতেছি।

— আদেশান্তে গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ্।’

সেখানে সতেরো জন যুবক-যুবতী তাকে ম্যানশন করেছে। এরা প্রত্যেকেই অবিবাহিত সংঘের অধিবাসী। অন্যান্য সময় গ্রুপের আশেপাশে এমনকি ফ্যামিলি গেটটুগেদারেও লুকিয়ে থাকার যথাসাধ্য চেষ্টা এরা করে। আজ তারা উচ্ছ্বসিত মনে গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে। নিজেদের মাথার উপর থেকে বিপদ কেটে যাওয়ায় তারা অত্যন্ত আনন্দিত। মিথি পোস্টের দিকে চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভাই-বোনগুলোকে ভয়ংকর কিছু গালি দিতে পারলে আরাম পাওয়া যেত। কোনো এক অদ্ভুত কারণে দাদভাইকে তারা প্রচণ্ড ভয় করে। দাদাভাইয়ের ধরে দেওয়া সময়ের এক মিনিট এপার-ওপার হওয়া মানে ভয়ংকর বিপদ। কী বিপদ, সেটা অবশ্য মিথি জানে না। বোধহয়, পরিবারের কেউই জানে না। কেননা, এখন পর্যন্ত সেই সময়সীমা লঙ্ঘন করার সাহস কারো হয়নি। মিথি কিছুক্ষণ মূর্তির মতো স্থির দাঁড়িয়ে থেকে শুটিং স্পটে ফিরে এলো। এই কাজটা তার জীবনে টার্নিং পয়েন্ট। সেই ‘টার্নিং পয়েন্ট’ — এর ক্ষীণ হায়াতকে এক রকম হাতের মুঠোয় নিয়ে পরিচালকের কাছে অর্ধ বেলার ছুটি চেয়ে বসল। তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যের প্রস্ততি চলছে। বলতে গেলে ক্লাইম্যাক্স। এই দৃশ্যের উপর ভিত্তি করেই কাহিনি তিনশো ষাট ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরে যাবে। পরিচালকের মাথাও দুশ্চিন্তায় একশো ষাট ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরে আছে। নায়িকার ন্যাকামোতে তিনি অতিষ্ঠ। তারওপর মিথির ছুটি নিয়ে নতুন নাটকে তিনি ভয়ংকর ক্ষেপে গেলেন। মিথি ভেবেছিল, তাকে কাজ থেকে বহিষ্কার করা হবে। কিন্তু তেমন কিছু হলো না। তার বদলে চূড়ান্ত অপমান করলেন। ছুটির অনুমতি দিয়েই ধমকে-ধমকে অস্থির করে তুললেন সেটের সবাইকে। চা বিলি করার ছেলেটাকে অযথাই দুটো থাপ্পড় কষলেন। অপমানে, লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হলো মিথির। মিথি শিশু নয়। মোখলেসুর আলম যে ছেলেটার গালে নয় তার গালেই চড় বসালেন তা তাকে প্লেকার্ডে লিখে বলে দিতে হলো না। খা-খা দুপুরে মনটাও কেমন খা-খা করে উঠলো তার।

মিথি বাড়িতে ফিরল অপরাহ্নে। বাড়ির দরজায় মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন মিস্টার জহিরুল্লাহ। মিথিকে ঢুকতে দেখেই বিনয়ে গলে গিয়ে বললেন,

‘ আম্মাজান, ঠিক তিনটা বেজে এক মিনিটে স্যারের সাথে আপনার এপয়েন্টমেন্ট। এখন বাজে দুইটা বেজে ঊনষাট মিনিট। আপনি এক্ষুনি স্যারের ঘরে চলে যান। আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি।’

মিথি কোনো রকম জবাব না দিয়ে দাদাভাইয়ের ঘরে চলে গেল। দাদাভাই থাকেন নিচতলার দক্ষিণের এক ঘরে। ঘরের বিশাল বারান্দায় বিশ-পঁচিশটি কবুতর পালেন। অবসরে সেই কবুতরের সাথে রসিয়ে রসিয়ে গল্প করেন। মিথি ভেতরে ঢুকে দেখল, দাদাভাই ইজিচেয়ারে বসে দুটো কবুতরকে গম্ভীরমুখে হাদিস বুঝাচ্ছেন,

‘ তোমরা সর্বদা একজন আরেকজনের সঙ্গে ল্যাপ্টে থাকো, ঘটনাটা তো সুবিধার না। দুই প্রাপ্ত বয়স্কের এমন ল্যাপ্টাল্যাপ্টি করা শরমের ব্যাপার। এইরকম আর করবা না। প্রেম-মোহব্বত সওয়াবের কাজ কিন্তু সেইটা বিবাহের পর। তোমাদের বিবাহ হয়েছে? হয় নাই।’

মিথির উপস্থিতি টের পেয়ে দাদাভাই থামলেন। মিথির দিকে ফিরে গম্ভীর মুখে বললেন,

‘ বুবু, তোমাকে এক প্রহরের মধ্যে উপস্থিত থাকতে বলেছি। তুমি এক প্রহরের মধ্যে উপস্থিত হয়েছ তাতে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। খোশখবর দিতে হয় খুশি মনে। তোমাকে আমি এখন একটা খোশখবর দিবো। তোমার জন্য একটা ছেলেকে আমার অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে। ছেলেটা বৈঠক খানায় বসে আছে। তাকে আমি রাস্তা থেকে ধরে এনেছি। ছেলেটা এখনও ঘটনা বুঝতে পারেনি বলে কিঞ্চিৎ আতঙ্কিত। তাকে দুধ, দই খাইয়ে ঠান্ডা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। খুব শীঘ্রই ঠান্ডা হয়ে যাবে। তারপর তোমাদের বিবাহ হবে। বিবাহের সময় ঠিক হয়েছে চারটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। বাদ আসরের পর বিবাহ খুবই শুভ। তোমাকে এক ঘন্টা পঞ্চাশ মিনিট সময় দেওয়া হলো। এর মধ্যে তুমি বিবাহের জন্য প্রস্তত হয়ে যাবা। খুশি মনে বলবা, আলহামদুলিল্লাহ কবুল। বুঝা গেল?’

মিথি মাথা নেড়ে জানাল, বুঝা গিয়েছে। দাদাভাই তাকে হাত নেড়ে বিদায় হতে বলে বললেন,

‘ এখন যাও। মেয়ে মানুষের সাজসজ্জা করতে সময় লাগে। বিবাহের সাজসজ্জা সময়ের ব্যাপার। সাজসজ্জা করোগে যাও।’

মিথি সাজসজ্জা করতে গেল না। নিজের ঘরে ফিরে সে একঘন্টা পঞ্চাশ মিনিট সময় নিয়ে গোসল করল। গোসল থেকে বেরিয়ে আটপৌরে একটা শাড়ি পরে অত্যন্ত স্বাভাবিক মুখে কবুল বলে দিল। রেজিস্ট্রারে সই করার সময় খালামণির বলা ‘ছাল চামড়াহীন’ ছেলেটার নামটাতে একবার চোখ বুলাল। অতঃপর শাড়ি টাড়ি খুলে ; কেবল ব্লাউজ-পেটিকোট পরে শুটিংয়ের কাজ গোছাতে বসে গেলো। দরজায় বড়ো খালার একের পর এক করাঘাত, বারান্দার রেলিঙে এসে বসা নিঃসঙ্গ কাকের ডাক আর কাঠ ফাঁটা রোদের দিকে চেয়ে মিথির ঠিক বিশ্বাস হতে চাইলো না – খুব বিষণ্ণ এক দুপুরবেলা কোনো এক ছালচামড়াহীন ছেলের সাথে তার বিয়েটা সত্যি সত্যি হয়ে গেল?

#চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here