আজ ওদের মন ভালো নেই
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
২.
মিথির বিয়ে হলো চারটা বেজে পঞ্চাশ মিনিটে। দাদাভাই তাকে ডেকে পাঠাল আটটা বেজে ঊনত্রিশ মিনিটে। মিস্টার জহিরুল্লাহ দরজার কাছে এসে অত্যন্ত বিনয়ী কণ্ঠে জানালেন,
‘ আম্মাজান মিথিলাতুন্নেসা, স্যার আপনাকে বিশেষ দরকারে ইয়াদ করেছেন। আপনি দয়া করে উপস্থিত হোন।’
মিথি তখন শুটিংয়ের স্ক্রিপ্টগুলো গোছাতে ব্যস্ত। দাদাভাইয়ের বিশেষ দরকার তাকে বিশেষ চিন্তিত করতে পারল না। চিন্তিত করতে না পারলেও যথেষ্ট বিরক্ত করল। বিরক্তিতে তেঁতো হয়ে গেল জিভ। স্ক্রিপ্টের কাগজগুলো একপাশে সরিয়ে রেখে যত্ন করে শাড়ি পরল। তারপর অত্যন্ত স্বাভাবিক মুখে দাদাভাইয়ের ‘ইয়াদ’ কে আশ্বস্ত করতে বেরিয়ে গেল। এ বাড়ির প্রত্যেকটি আকস্মিক বিয়ের পর হতবিহ্বল পরিবারবর্গকে নিয়ে একটা আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে দাদাভাই কিছুক্ষণ গম্ভীরমুখে ভাষণ দেন। খোদার দরবারে দু’হাত তোলে নব দম্পতির সুখ চেয়ে কান্নাকাটি করেন। তার বিশদ কান্নাকাটিতে হতবিহ্বল পরিবারবর্গ আরও হতবিহ্বল হয়। দাদাভাই তখন কান্নাকাটিতে সাময়িক ইস্তেফা দিয়ে কঠিন ধমক দেন,
‘ এই মূর্খের দল! আমিন বল!’
মূর্খের দল আমিন বলে। এই মূর্খের দলের জ্যৈষ্ঠ সদস্য মিথির বড় চাচা, ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। তারপরের জন রিটেয়ারপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, এখন এক্সপোর্টের ব্যবসা করছেন। চাচার ক্ষুরদার বুদ্ধিতে ব্যবসা হুড়মুড় করে প্রসার পাচ্ছে। মূর্খের দলের প্রধান সদস্যদের একজন হয়ে চাচারা কী করে এহেন গর্ব ছিনিয়ে আনছেন তা গবেষণার বিষয়। মিথি শান্ত মুখে বৈঠক খানায় গিয়ে বসল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, হতবিহ্বল পরিবারবর্গের চোখেমুখে খুব একটা বিহ্বলভাব নেই। সবাই খুব সহজ হয়ে বসে আছে। আকস্মিক বিয়ে দেখতে দেখতে আকস্মিক ব্যাপারটা বোধহয় দুধ ভাত হয়ে গিয়েছে। বিস্মিত হওয়ার মেশিন নষ্ট। এতো নষ্ট যন্ত্রের ভিড়ে একজনকে ব্র্যান্ড নিউ যন্ত্র নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়ভাব প্রবল। ভারী কাচের চশমাও তার চোখের বিস্ময় লুকোতে পারছে না। সে স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে। মিথি বুঝল, ইনিই হলেন আজকের নাটকের প্রধান চরিত্র। দাদাভাই গম্ভীরমুখে আলোচনা শুরু করলেন। আলোচনা সভায় তিনি দুই পাতার স্মারকপত্র গড়গড় করে মুখস্থ বলে যান। এই স্মারকপত্র মিথিদের সকলেরই মুখস্থ। কলেজ পাশ করে বাড়ি ছাড়ার আগ পর্যন্ত প্রতিটি বিবাহ সম্মেলনে মিথিকে উপস্থিত থাকতে হয়েছে। এই একই পত্র এতোবার শুনেছে যে গত পাঁচ বছর না শুনেও মনে হলো, এক্ষুনি গড়গড় করে বলে দিতে পারবে। পরীক্ষা নিলে পাবে, দশে দশ। দাদাভাইয়ের আলোচনার মাঝপথে ভেতরে এলেন বাংলা একাডেমির যুগ্মসচিব, মিথির বাবা। তিনি সবসময়ই কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত থাকেন। এখনও তাকে চিন্তিত দেখা যাচ্ছে। তিনি ভেতরে ঢুকে চিন্তিত স্বরে বললেন,
‘ সরি আব্বা। দেরি হয়ে গেল।’
আলোচনার মাঝে অহেতুক যন্ত্রণা দাদাভাইয়ের খুবই অপছন্দ। তিনি দু’চোখ দিয়ে ছেলেকে ভস্ম করে ফেলার চেষ্টা করে বললেন,
‘ বেকুব।’
দাদাভাইয়ের মুখে ‘বেকুব’ শুনেও বাবা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন বলে মনে হলো। চিন্তিতমুখে ঘরের একপাশে বসে পড়লেন। দাদার দীর্ঘ বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর দোয়ার নামে তার ভয়ংকর কান্নাকাটি শুরু হলো। এতো কান্নার বাহার দেখে মিথির একবার মনে হলো, বুড়ো বুঝি এক্ষুনি শ্বাস আটকে টপকে যাবেন। বুড়ো টপকালেন না। মোনাজাত শেষে ক্যামেরাম্যানকে নবদম্পতির যুগল ছবি তোলার নির্দেশ দিলেন। মিথি এতক্ষণে খেয়াল করল, দরজার পাশে তেঁতো মুখে দাঁড়িয়ে আছে ক্যামেরামন হাশিম বরকত। হাশিম বরকতের হাতে একটা পুরোনো ক্যামেরা। এই ক্যামেরা দিয়ে তিনি বিগত ত্রিশ বছর ধরে দাদার নির্দেশ পালন করছেন। মিথির বাবা-মায়ের যুগল ছবিও এই ঝঞ্জাল ক্যামেরা দিয়েই তোলা। হাশিম বরকত এগিয়ে এসে একেবারে মুখের সামনে ক্যামেরা ধরলেন। আজকের নাটকের প্রধান চরিত্রটি চমকাল। বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে মাথা পিছিয়ে নিল। আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল,
‘ করছেন কী!’
হাশিম বরকত তার কথায় কান না দিয়ে নির্বিকার মুখে আরও একটু এগিয়ে আনলেন ক্যামেরা। যেন এক্ষুনি গাল চেপে ধরে মুখের ভেতর পুরে দিবেন। দাদাভাই স্তব্ধ, বিস্মিত পুরুষকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন,
‘ আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নাই। সে হাশিম বরকত, আমাদের পারিবারিক ফটোগ্রাফার। তার ছবি তোলার হাত ভালো। সে ছবি তুললে বিবাহিত জীবন বরকতের হয়। শান্ত হয়ে বসো। নড়াচড়া করবা না। সে এঙ্গেল ঠিক করছে।’
ভদ্রলোক বিস্ময়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন বোধহয়। ভুরু কুঁচকে অবাক বিস্ময় নিয়ে বিড়বিড় করলেন, ‘আশ্চর্য! আশ্চর্য! আশ্চর্য!’
আশ্চর্য ঘটনা তখনও শুরু হয়নি। দাদাভাই ভদ্রলোককে আরও আশ্চর্য করে দিতেই বোধ করি নব দম্পতির বাসরের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলেন। মিথি তখন নিজের ঘরে ফিরে এসেছে। সারাদিনের মানসিক অবসাদে সে ক্লান্ত। বাসরের ঘটনাটা সে জানে না। তখন তার মাথায় কেবল কাজের চিন্তা। পরিচালক মোখলেসুর আলমের সঙ্গে কাজ করাটা তার স্বপ্ন যাত্রার প্রথম সিঁড়ি। কিন্তু মনে হচ্ছে, খুব একটা এগোতে পারবে না। মোখলেসুর আলম তাকে যেকোনো দিন বিনা বিজ্ঞপ্তিতে ছাঁটাই করে দিবেন। মোখলেসুর আলমের সাথে দুয়েকটা সফল কাজ করতে পারলেই নিজে একটা নাটকের কাজ ধরবে মিথি। গল্প তার বাছাই করা। কিন্তু প্রডিউসার পাওয়া দুষ্কর। সে হিসেবে দাদাভাইকে ভজিয়ে বাজিয়ে যদি লাখ পঞ্চাশেক টাকা আদায় করা যায়! সে চিন্তা থেকেই দাদাভাইয়ের ছকে ছকে খেলছে মিথি। কিছুতেই দাদাভাইকে নারাজ করা যাবে না। সেজন্য বিয়ে করতে হলে, হলো। বিয়ে মিথির জন্য কোনো বড় বিষয় না। জীবনে বিয়ে নিয়ে বাড়াবাড়ি কোনো পরিকল্পনাও তার ছিল না। মিথি আবার শাড়ি খুলে রেখে কাজের মধ্যে ডুবে গেল। এটা তার এক ভয়ংকর সমস্যা, সে ঘরের লক্ষ্মী মেয়েদের মতো সর্বক্ষণ কাপড়ের স্তুপ হয়ে বসে থাকতে পারে না। দমবন্ধ হয়ে আসে।
ঘড়ির কাঁটা ঢং ঢং করে রাত্রি এগারোটার খবর জানাল। সেইসাথে দরজায় করঘাত। মিথির ভুরু কুঁচকে গেল। এতো রাতে দরজায় কে? দরজা খুলে সে হতভম্ব। দরজার সামনে সেই বিস্মিত পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে-মুখে বিভ্রান্তি। মিথি ঠান্ডা স্বরে শুধাল,
‘ কী ব্যাপার? আপনি এখানে?’
ভদ্রলোক হতাশ কণ্ঠে বললেন,
‘ ঠিক বুঝতে পারছি না। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমি কী ভেতরে আসতে পারি? আমার মাথা চক্কর দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, যেকোনো সময় মাথা ঘুরে পড়ে যাব।’
মিথি সরে গিয়ে ভদ্রলোককে ভেতরে আসার জায়গা করে দিল। ভদ্রলোক এদিক ওদিক না তাকিয়ে ভূতগ্রস্তের মতো বিছানায় গিয়ে বসল। মিথি দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল,
‘ আপনি কী আপনার ঘর খুঁজে পাচ্ছেন না? আমাদের বাড়ির গেস্টরুমগুলো সাধারণত নিচের তলায় হয়। আর আপনি এখন তিন তলায়।’
ভদ্রলোক দুই হাতে মাথা চেপে বসে ছিলেন। মিথির কথায় মাথা তুলে বিভ্রান্ত চোখে তাকালেন,
‘ আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি ভেবেছিলাম, আমাকে এখন বাড়ি ফিরে যেতে দেওয়া হবে। কিন্তু এক ভদ্রলোক আমাকে এই ঘরের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন, এই ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।’
ভদ্রলোক একটু থামলেন। মিথির দিকে ভালো করে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘ আচ্ছা আপনি শুধু ব্লাউজ পেটিকোট পরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? প্লিজ ভিন্ন কিছু পরুন। আমার অস্বস্তি হচ্ছে।’
মিথি চমকাল। তৎক্ষনাৎ তার খেয়াল হলো, তার গায়ে শাড়ি নেই। কাজের খেয়ালে শাড়ির কথাটা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড বিব্রত হলেও নির্লিপ্তমুখে দাঁড়িয়ে রইল মিথি। বাঙালি মেয়েদের লজ্জায় লাল হয়ে ন্যাকা ন্যাকা ঢঙ তার অসহ্য লাগে। শক্ত কণ্ঠে বলল,
‘ আমি রাতের বেলা শাড়ি পরে ঘুমুতে পারি না।’
ভদ্রলোক একটু নীরব থেকে বললেন,
‘ আপনিও এই ঘরে ঘুমুবেন?’
‘ সেরকমই তো হওয়ার কথা। এটা আমার ঘর।’
ভদ্রলোক বিব্রত হলেন। ধরফর করে বিছানা থেকে উঠে পড়ার চেষ্টা করে বললেন,
‘ তাহলে কী আমি বেরিয়ে যাব? আমাকে বোধহয় ভুল ঘর দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এগিয়ে গিয়ে বিছানার উপর থেকে শাড়িটা তুলে নিয়ে মনের সুখে শাড়ি পরতে পরতে বলল,
‘ তাতে বোধহয় খুব একটা লাভ হবে না। আপনি বেরিয়ে গেলে আপনাকে আবারও এই ঘরেই পাঠানো হবে। হিসেব মতে, আজ আমাদের বাসর হওয়ার কথা। আমার দাদা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, বিয়ের রাতে সাকসেসফুলি ওয়েডেড না হলে বিয়েতে বরকত আসে না। সাকসেসফুলি ওয়েডেড হওয়ার জন্য কী করতে হবে বুঝতে পারছেন?’
ভদ্রলোক হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইল। ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ আপনি! আপনার সাথেই আমার বিয়ে হয়েছে?’
মিথি মিষ্টি করে হাসল। ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
‘ তাই তো মনে হচ্ছে। মনঃ পূত হয়েছে? বাসরের জন্য চলবে?’
ভদ্রলোক উত্তর দিলেন না। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে নীরবে বসে রইলেন। মিথি বলল,
‘ আপনি কী তৈরি? আমি কাছে আসব?’
ভদ্রলোক মাথা তুলে অবাক হয়ে শুধাল,
‘ কীসের জন্য তৈরি হব?’
মিথি ততোধিক অবাক হয়ে বলল,
‘ ওমা! একটু আগে কী বললাম? আপনাকে আর আমাকে একই ঘরে রাত্রিযাপন করতে দেওয়ার হেতু বললাম না? দেখুন, আমার হাতে অনেক কাজ। রাত জেগে কাজ করতে হবে। আপনাকে দেওয়ার মতো সময় খুবই অল্প। জলদি কাজ শেষ করবেন।’
ভদ্রলোক প্রথমে বিস্মিত তারপর হতাশ পরিশেষে তীব্র অনিচ্ছা নিয়ে বলল,
‘ অসম্ভব, আমি পারব না।’
‘ কী পারবেন না? জলদি জলদি শেষ করতে পারবেন না? ইউ নীড মোর টাইম? তাহলে তো বিপদ!’
শেষ কথাটাতে প্রচ্ছন্ন দুশ্চিন্তা ঝুলিয়ে রাখল মিথি। ভদ্রলোক অতিষ্ঠ হয়ে বললেন,
‘ আপনি দয়া করে চুপ করুন। আমার মাথা ফেঁটে যাচ্ছে। আপনার সাথে কোনো রকম ইন্টিমেসি তৈরি করা আমার পক্ষে অসম্ভব।’
মিথি ভুরু বাঁকিয়ে তাকাল। বিছানার সামনে একটা চেয়ার টেনে বসল। সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
‘ কেন? আপনি কী বিবাহিত? বউ ছাড়া অন্য কাউকে স্পর্শ করবেন না, এমন প্রতিজ্ঞা আছে?’
এই অহেতুক প্রশ্নে ভদ্রলোক মাথা তুলে মিথির দিকে তাকালেন। তাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। মিথি প্রশ্নটা আরেকটু বিশ্লেষণ করল,
‘ না মানে, আজকের আগে আরও বিয়ে করেছিলেন? নাকি এটাই প্রথম?’
ভদ্রলোক সে প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। চোখের চশমা খুলে ফেললেন। চোখদুটো দুই আঙুলে চেপে ধরে ক্লান্ত কণ্ঠে শুধালেন,
‘ আমি বিবাহিত হলে আপনার দাদা আমার সাথে আপনার বিয়ে দিতেন?’
মিথি হেসে ফেলে বলল,
‘ হয়তো দিতেন। দাদাভাইয়ের ঠিক নেই। একবার এক ছেলেকে তার খুব পছন্দ হলো। এক রকম ধরে আনলেন তার ছোট কন্যার সাথে বিয়ে দিবেন বলে। কাবিনের সময় দেখা গেল, ছেলেটা সনাতন। আচ্ছা, আপনি মুসলিম নাকি সনাতন?’
ভদ্রলোক উত্তর দিলেন না। হাঁপ ধরা কণ্ঠে বললেন,
‘ ও মাই গড! ও মাই গড! ও মাই গড!’
তারপর ক্লান্ত কণ্ঠে শুধালেন,
‘ তারমানে এমন ধরে আনা বিয়ে এর আগেও হয়েছে?’
মিথি অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বরে বলল,
‘ হবে না কেন! হরদম হচ্ছে। আমাদের পরিবারটাই তো ডাকাতে পরিবার। আপনি জানতেন না?’
ভদ্রলোককে দেখে মনে হলো, এই মুহূর্তে তিনি পৃথিবীর কোনো কিছুই জানেন না। বাংলাদেশ পৃথিবীর কোন গোলার্ধে অবস্থিত তাও তিনি বলতে পারবেন না। তাকে তার নাম জিজ্ঞাসা করলেও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবেন। ভদ্রলোক অবশ্য তাকিয়ে থাকলেন না। দুই আঙুলে চোখের কোণ মন্থন করতে করতে চোখ বোজলেন। বললেন,
‘ ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমি কী এখানে শুতে পারি? আমার ভয়ংকর শরীর খারাপ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমি মারা যাচ্ছি।’
কথাটি বলে, মিথির অনুমতির অপেক্ষা না করেই বিছানায় লম্বালম্বি হয়ে শুয়ে পড়লেন। মিথির ঠিক সেই মুহূর্তে মনে পড়ে গেল, ভদ্রলোকের নাম সাব্বির। সাদা শার্ট গায়ে লম্বাদেহী সাব্বিরের দিকে মিনিটখানেক অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে রইল মিথি। সাব্বির দেহের অর্ধেকটা বিছানার বাহিরে ফেলে শুয়ে আছে। এক হাতের মুঠোয় চশমা। অন্যহাতটি নিথর হয়ে পড়ে আছে তার বুকের ওপর। গুটানো আস্তিনের নিচে পাকানো, বলিষ্ঠ হাতের শিরাগুলো স্পষ্ট।
মিনিটখানেক অন্যমনস্ক বসে থেকে সচল হয়ে উঠল মিথি। দীর্ঘ রাতের থেকেও দীর্ঘ তার কাজের তালিকা। মিথি জানে, স্বপ্নের সাথে পাল্লা দিয়ে দৌঁড়াতে হলে ক্লান্ত হওয়ার উপায় থাকে না। ক্লান্তিকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয় অচেনা, অতল গহ্বরে। মিথি পুনরায় স্ক্রিপ্টের কাগজগুলো টেনে নিল কোলের কাছে। অনেক রাতে কাজের প্রয়োজনে ল্যাপটপটা খুলতেই চোখে পড়ল অসংখ্য নোটিফিকেশন। দাদাভাই গ্রুপে মিথি আর সাব্বিরের যুগল ছবি পোস্ট করেছেন। ছবিতে মিথি একটা নীল শাড়ি পরে শক্ত হয়ে বসে আছে। সাদা শার্ট পরিহিত সাব্বিরের মুখের অবস্থা ভয়ংকর। ল্যাপটপের স্ক্রিনে ‘টিং’ শব্দ তুলে ক্ষণিকের জন্য একটা ম্যাসেজ শো করল।
‘ মিথিকে গ্রুপ থেকে বহিষ্কার করা হোক। ও এখন বিবাহিত। অবিবাহিত সংঘের সাথে তার কোনো সম্পৃক্ততা থাকতে পারে না।’
মিথি ম্যাসেজে ক্লিক করে অবিবাহিত সংঘের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে ঢুকে গেল। মৌনি লিখল,
‘ বিয়ে হলেই যে বিবাহিত হয়ে যায় এই তত্ত্বে আমি বিশ্বাসী নই। দেহ-মন যে পর্যন্ত পিউর সে পর্যন্ত মিথি আপাকে অবিবাহিত ধরা যায়।’
মৈয়ন লিখল,
‘ ওর দেহ-মন যে এখনও পিওর তা তুই জানলি কী করে? আজকে ওর ফার্স্ট নাইট। পিওরিটি নষ্ট হওয়ার জন্য ওয়ান নাইট ইজ ফার এনাফ।’
ঋতি মিথিকে ম্যাসেজ সীন করতে দেখে উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,
‘ মিথি আপা? আজ না তোমার ফার্স্ট নাইট? কী করছ তোমরা? আমাকে বলবে, প্লিজজজ?’
আরিফ লিখল,
‘ তোর জানার এতো শখ?’
মৈয়ন ইশতিয়াককে ম্যানশন করল,
‘ ভাই! কিছু বলো? মিথিকে রাখা হবে নাকি না? ওর উচিত সজীব ভাইদের গ্রুপে এড হওয়া। বিবাহিত একজন অবিবাহিতদের সংঘে থাকলে বিষয়টা তো নীতির খেলাপ। মানা যাচ্ছে না।’
ইশতিয়াকের থেকে উত্তর এলো একটু সময় নিয়ে,
‘ আমি ওটির জন্য রেডি হচ্ছি। বিষয়টা গম্ভীর। ওটি থেকে বেরিয়ে আলোচনা করব। অপেক্ষা কর।’
মৌরি লিখল,
‘ তুমি অবিবাহিত সংঘের প্রেসিডেন্ট হয়ে সারাদিন ওটিতে বসে থাকো। এটা কেমন কথা?’
‘ বাসর ঘরে তো আর বসে থাকি না। তোর এতো সমস্যা কেন?’
এসব আলাপ-আলোচনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নাহিদ একটা ভিডিও পাঠাল। দারুন জাঁকজমক একটা হোটেল। সেখানে সে কী রকম আয়েশ করছে তার একটা ঝলক দেখানোই তার অভিলাষ। মৌনি বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ একটা গুরুগম্ভীর আলোচনায় তুই এসব আজাইরা ভিডিও পাঠাচ্ছিস কেন? কমন সেন্স নেই?’
নাহিদ ওসবের ধারেকাছে না গিয়ে একটা ছবি পাঠাল। গায়ে কালো রঙের পাঞ্জাবি, চোখে সানগ্লাস। নাহিদ লিখল,
‘ পাঞ্জাবিটা কেমন হয়েছে বল তো? আমার এক মেয়ে বন্ধু দিয়েছে। সানগ্লাসটার দাম বারো হাজার টাকা।’
মৌনি চটে গিয়ে বলল,
‘ আমরা জানতে চেয়েছি?’
নাহিদ সে কথা গায়ে না মেখে বলল,
‘ চলো, সবাই মিলে দার্জিলিং ট্যুরে যাই।’
একটা গুরুগম্ভীর আলোচনাকে বরবাদ করে কিছুক্ষণ একা একাই বকবক করল নাহিদ। মৌনি কয়েকবার তাকে তিরস্কার করার চেষ্টা করে একসময় নিজেই বিরক্ত হয়ে গেল। মিথি এদের ম্যাসেজ দেখে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। এরা যে অহেতুক এতো সময় নষ্ট করে। এদের কী মায়া হয় না?
________
নিশ্চিহ্ন অন্ধকারে একটা ঝাউগাছের ঝোপের আড়ালে শুয়ে আছে দুজন যুবক। অনেকক্ষণ দৌঁড়ে তারা ক্লান্ত। বুকের কাছটা উঠানামা করছে হাপরের মতো। দু’জনের হাতেই ক্যামেরা। একজন ঝোপের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখল, আশেপাশে কাউকে দেখা যায় কি-না।
‘ শালারা কী আমাদের ছেড়ে দিল?’
‘ এতো সহজে ছাড়বে না।’
কথাটা বলে ক্লান্ত হাসল নাহিদ। পায়ে তার গুলি লেগেছে। ক্ষতি তেমন হয়নি। কিন্তু পালানো কঠিন। সৌধ কিছুক্ষণ জহুরি চোখে আশপাশটা নিরীক্ষণ করে নাহিদের দিকে চেয়ে বলল,
‘ পিঠে ওঠ। এখানে বসে ধরা খাওয়ার থেকে যতদূর পারি ছুটবো।’
নাহিদ নির্দ্বিধায় বন্ধুর পিঠে চেপে বসল। নাহিদকে পিঠে চাপিয়ে বীর সৌধ দশ কদম যেতেই পায়ের সাথে পা বাঁধিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেল। পড়ে গিয়ে তারা মাটি পেল না। গড়িয়ে গড়িয়ে কোথায় গিয়ে পড়ল হদিশ করতে পারল না। তবে এটুকু বুঝল এটা একটা নর্দমা। দুর্গন্ধে নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসার জোগাড়। সৌধ ফিসফিস করে বলল,
‘ কোথায় এসে পড়লাম রে? ফোনটা পকেট থেকে বের করে একটু আলো জ্বালিয়ে দেখ তো? মনে হচ্ছে তো নর্দমা।’
নাহিদ নির্বিকার কণ্ঠে বলল,
‘ নর্দমা হলে নর্দমা। এতে এতো দেখার কী আছে?তুই দেখলে স্বর্ণ হয়ে যাবে?’
‘ তারপরও মনের শান্তি। আমার মনে হচ্ছে আমি কিছুটা পানি খেয়ে ফেলেছি। এটা যদি নর্দমা হয় তাহলে আমার কী হবে বল তো?’
নাহিদ উত্তর দিল না। তখনই কাছে কোথাও এক দল মানুষের পায়ের আওয়াজ পেয়ে দু’জনেই নিজেদের যতটুকু পারা যায় নর্দমার জলে ডুবিয়ে স্থির হয়ে রইল। লোকগুলো কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে চলে গেলে সৌধ নিজেকে নর্দমা থেকে উঠানোর জোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু দেখা গেল, নাহিদ নির্বিকার। পকেট থেকে ফোন বের করে এক গাল হেসে বলল,
‘ ফোনটা ওয়াটার প্রুফ হয়ে বেশ সুবিধা হয়েছে বল? নষ্ট হয়নি।’
নাহিদের হাতে মোবাইল দেখে সৌধ যেন একটা আশার আলো দেখতে পেল। ফোনটা যেহেতু আছে নিশ্চয় কোনো ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু সৌধকে অবাক করে দিয়ে নাহিদ সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকে এর-ওর সাথে গল্পে মশগুল হয়ে গেল। দুটো মেয়ের সাথে প্রায় ‘ভালোবাসি’ বলি বলি পর্যায়ে চলে গেল। কাজিনদের সাথে মন খোলে আড্ডা দিচ্ছে। ওর ম্যাসেজ দেখে কে বুঝবে সে বুক পর্যন্ত নর্দমায় ডুবে আছে? সৌধর নতুন করে মনে হলো, এই ছেলে এক আশ্চর্য!
#চলবে…