আজ ওদের মন ভালো নেই
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৫.
চৈত্রের তান্ডবে ক্লান্ত পৃথিবীকে দু’দন্ড স্বস্তি দিতে নেমে এসেছে গোধূলি। হাসপাতাল চত্ত্বরে ছড়িয়ে আছে বিকেলের নরম আলো। মিথি দাঁড়িয়ে আছে হাসপাতালের বাইরে। ফর্সা মুখটা রোদ আর ক্লান্তিতে ম্লান। একটু আগেই তার সামনে দিয়ে হুঁস করে বেরিয়ে গিয়েছে সাফাতের মার্সিডিজ বেঞ্জ। মশার জুস খেয়ে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। কর্তব্যরত ডাক্তার ফুড পয়জনিং এর কারণ জেনে প্রথমে খুবই আশ্চর্য হলেন। মিথিকে চেম্বারে ডেকে নিয়ে হেসে ফেলে বললেন,
‘ কী ঔষধ দিই বলুন তো? গোটা ব্যাপারটাই ওনার মানসিক। জুসে সাধারণ একটা মশা পড়লে কারো এতোবার বমি হওয়ার কথা না। ওনি বিষয়টা জেনেছেন বলে বমি করছেন। না জানলেই দেখতেন একদম ফিট। আপাতত অতিরিক্ত বমি আর গরমের ধকলের জন্য স্যালাইনই প্রেফার করতে পারি। এছাড়া কিছু প্রয়োজন নেই।’
মিথি ডাক্তারের পরামর্শ শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। পুরো ব্যাপারটা সাফাতের মানসিক নাকি শারীরিক তাতে তার কোনো যায় আসে না। তার দুর্ভোগ এতে তিলখানিও কমবে না। সাফাতের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন পড়েছে, এটুকুই মিথির জীবনে ঝড় বইয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিছুটা ঝড় ইতোমধ্যে বয়েও গিয়েছে। সাফাতের ঘনঘন বমি হচ্ছে, তাকে মশার জুস খাওয়ানো হয়েছে, সাফাত আর এই নাটকে অভিনয় করবে না — এই সকল খবর শুনেই পরিচালক মোখলেসুর আলম মিথির সাথে পশুর মতো ব্যবহার করেছে। মানুষের ব্যবহার যে কতটা নীচ ও জঘন্য হতে পারে তা মিথি এই লাইনে কাজ করতে এসে জেনে গিয়েছিল। আজ জানল, এর থেকেও খারাপ ব্যবহার হতে পারে। সবশেষে মোখলেসুর আলম মিথিকে সাফাতের চিকিৎসার যাবতীয় খরচ বহনের হুমকি এবং তার অধীনে কাজ করার চিন্তা ভুলে যেতে বলেছেন। মিথি সেই খরচ বহন করতেই সাফাতের সাথে হাসপাতালে এসেছিল। সাফাত জনপ্রিয় অভিনেতা, মেডিকেলে না গিয়ে সরাসরি মস্ত এক প্রাইভেট ক্লিনিকে এসে ঢুকেছে। একটা কেবিন, একটা স্যালাইন, ডাক্তারের সার্ভিস চার্জ মিলিয়ে বিল এসেছে হাসপাতালের মতোই মস্ত। মিথি পারিবারিক সম্পত্তিতে বিশ্বাসী নয়, তার কাছে আমিত্বই আসল। পরিবার ছেঁটে ফেলে দিলে ব্যক্তি মিথি খুবই দরিদ্র রমণী। তার পক্ষে ওই মুহূর্তে অতোগুলো টাকা জোগাড় করা সম্ভব ছিল না। সাফাত অবশ্য মিথির থেকে টাকা-পয়সা কামনা করেনি। সে নিজের খরচ নিজেই বহন করেছে। মিথি বিল পরিশোধ করতে চায় শুনে বরং আশ্চর্য হয়ে শুধিয়েছে,
‘ আপনি কেন দিবেন!’
মিথি উত্তরে ক্ষতিপূরণের কথা জানাতেই প্রচন্ড হৈচৈ করেছে সাফাত। খুব হম্বিতম্বি করে বলেছে,
‘ আমার শরীরের ক্ষতিপূরণ মাত্র এই ক’টা টাকা? আপনি আমাকে এতো সস্তা ভাবেন? এতো সস্তা আমার শরীর? আনবিলিভেবল! আমি যদি মরে যেতাম তাহলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে কী দিতেন? কাফনের কাপড় আর আগরবাতি?’
সে কথার জবাব মিথি দেয়নি। সাফাত মিথির দিকে প্রচণ্ড ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গিয়েছে।
মিথি কিছুক্ষণ নীরব দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটতে লাগল। ইট-পাথরের নিষ্প্রাণ পথে তার হঠাৎ করে জীবনানন্দের কথা মনে পড়ল। কী যেন ছিল সেই কবিতাটা?
‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে…’
মিথিরও মনে হলো, এই নিষ্প্রাণ শহরে তার হেঁটে চলার বয়সও যেন সহস্রাব্দ। হাজার বছর পর জীবনানন্দ পেয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন। পেয়েছিল টলটলে দিঘির মতো স্বস্তি। মিথির কোনো স্বস্তি নেই। আঙ্গারের মতো জ্বলতে থাকা শুকনো শহরে তার কোনো দিঘি নেই। দিঘি শব্দটা মস্তিষ্কে বলের মতো ঢপ খেতেই আচমকা দুটো দিঘিসুলভ চোখের কথা মনে পড়ল মিথির। আর কিছুই তো মনে নেই, কেবল শান্ত দুটো চোখ। হিজলের ছায়ায় টলটলে ঠান্ডা জল দেখলে যেমন আরাম লাগে। ঠিক তেমনই আরামদায়ক, শীতল দুটো দৃষ্টি…
আমিনবাজার থেকে মিরপুর-১০ পর্যন্ত আসতেই পশ্চিম আকাশে নামল ধূসর সন্ধ্যা। বহুদিন বাদে এতো জলদি বাড়ি ফিরল মিথি। কয়েকটা সরু গলি পেরিয়ে তিন তলার উপর পরিচিত দরজায় কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দিলেন খালামণি। গরমে তার বিশাল শরীরটা দরদর করে ঘামছে। মিথির খালুর টাকা-পয়সা ভালো। স্ত্রীকে সুখী করতে ফ্ল্যাটে চারটা এসি লাগিয়েছেন। এসি খালামণিকে খুব একটা সুখী করতে পারছে বলে মনে হয় না। মিথি ভেতরে ঢুকে নিজের ঘরের দিকে যেতেই তাকে প্রশ্নে প্রশ্নে ক্লান্ত করে তুললেন খালামণি। সকলই তার বিয়ে ও বর সংক্রান্ত প্রশ্ন। ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে বার দুয়েক তাদের একান্ত সময়ের কথাও জানতে চাইলেন। ভাগ্নি বলে সরাসরি বলে ফেলতে পারলেন না। মিথি প্রশ্নগুলো না শোনার ভান করে নিজের ঘরে দরজা দিল। গ্রাজুয়েশন শেষ করে ভার্সিটি হল ছেড়ে দেওয়ার পর এক রকম বাধ্য হয়েই খালামণির বাসায় এসে উঠেছে মিথি। খালামণি মিথিকে ভালোবাসেন। মৃত বোনের মেয়ের হৃদয়ে তিনি মায়ের মতো করে অধিষ্ঠিত হতে চান। মিথি মা’কে কখনও দেখেনি। মায়ের প্রতি তার আবেগ নেই। বাবার সাথেও খুব একটা সম্পর্ক নেই। বাবা আত্মভোলা ধরনের মানুষ। তাকে দাদু বিয়ে করিয়েছিলেন হুট করে। হুট করে বিয়ে করা বউটি বাচ্চা দিতে গিয়ে হুট করেই মরে গেল। বাবা এই হুটহাট ব্যাপারটায় কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন মিথি জানে না। বাবা স্ত্রীকে খুব সম্ভবত ভালোবাসতেন না। আবার অপছন্দও করতেন না। যেমন আবেগ তিনি রাখেন মিথির ক্ষেত্রে। মিথির দৃঢ় ধারণা, বাবা তার সম্পূর্ণ নামটাও ঠিক করে জানেন না। প্রতিবার দেখা হলেই তিনি চিন্তিত মুখে মিথির দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ স্থির চেয়ে থেকে বলেন,
‘ তুমি দেখতে কিছুটা তোমার মায়ের মতো হয়েছ। তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?’
মিথি প্রত্যেকবারই উত্তর দেয়, ‘ভালো চলছে বাবা।’ অথচ তার গ্রাজুয়েশন শেষ হয়েছে আরও এক বছর হলো। মাঝেমাঝে মিথি ভাবে, এইযে এতোগুলো মানুষের জীবন নিয়ে আশ্চর্য এক খেলা খেলছেন দাদাভাই তাতে কী তাকে ঘৃণা করা উচিত না? মিথি নিজের বিয়েটাকে নিয়ে আফসোস করে না। এই বিয়েটাকে সে নিয়েছে একটা ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে। কিন্তু, বাবা? বাবাকে এইভাবে বিয়ে দিয়ে কী তিনি বাবা-মা আর তার জীবনটাকে একটা নাট্যশালা বানিয়ে ফেলেননি? বাবার নিজের জীবন নিয়ে কী নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত থাকতে পারে না? পরমুহূর্তেই মনে হয়, হয়তো পারে না। দাদাভাই ওভাবে বিয়ে না দিলে তার আত্মভোলা বাবা বোধহয় কোনোদিন বিয়ের কথা ভাবতেনই না। মিথির এই পৃথিবীতে আসার জন্য বিয়েটা দরকার ছিল। যে দাদাভাই তাকে এই পৃথিবীতে আসতে সাহায্য করেছেন তাকে ঘৃণা করা উচিত না। মিথি অনুচিত কাজ খুব কম করে। নিজের স্বার্থ ছাড়া কাউকে ঘৃণা করে আবেগের অপচয় ঘটানোও তার ভয়ংকর অপছন্দ। খালামণিকে মিথি মায়ের মতো না দেখলেও মায়ের কাছাকাছি ভালোবাসতে চেষ্টা করে। কিন্তু যে জানেই না মাকে কী করে ভালোবাসতে হয়, তার জন্য কাউকে মায়ের কাছাকাছি ভালোবাসা কঠিন। মিথি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছিনায় গা এলিয়ে দিল। সৃষ্টিকর্তার এই কঠিন পৃথিবীতে মিথি আরও কঠিন করে বাঁচতে ভালোবাসে। খালামণি বহুবার বলার পরও খালুর পয়সায় নিজের ঘরে এসি লাগানোর অনুমতি সে দেয়নি। তাই তার মাথার উপর খটখট করে ঘুরছে একটা পাখা। সেই পাখার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তার আচমকা মনে হলো, এই পৃথিবীর পথে একলা হেঁটে সে বড় ক্লান্ত। তার বোধহয় একটা মা থাকা উচিত ছিল। যার কোলে শুয়ে সে সহজেই বলে ফেলতে পারত, আজ ওর মন ভালো নেই…
_____________
চৈত্রের অসহ্য গরমে ক্লান্ত পৃথিবীতে রাত্রি নেমেছে। রাস্তার দু’পাশে রাত বাতির আলো। গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত হলেও মৌনির মন ফুরফুরে। আজ নীলক্ষেত থেকে নতুন কিছু বই উদ্ধার করেছে সে। প্রায় প্রত্যেকটা বইয়ের শুরুতেই লেখা আছে ছোট ছোট নোট। নোটের নিচে তারিখ দেখে বুঝা যাচ্ছে, বইগুলো কমপক্ষে বছর পঞ্চাশেক পুরোনো। পঞ্চাশ বছর আগে কোনো প্রেমিক বুকের ভেতর দুরুদুরু অনুভূতি নিয়ে প্রেয়সীকে যে বইটি উৎসর্গ করেছিল। মৌনি সেই বই হাতে বসে আছে ভাবতেই তার গা শিরশির করছে। কে জানে? এই বইটা হয়ত কোনো প্রেয়সীর বুক ব্যথার কারণ হয়েছিল, কোনো প্রেমিকা হয়ত লুকিয়েছিল তাকে আঁচলের তলায়, কেউ-বা হয়ত উত্তেজনায় ছোট্ট একটা চুমুও খেয়ে ফেলেছিল ওই নামের জায়গাটায়!
‘ মন?’
ম্যাসেঞ্জারের টুং শব্দে ঘোর কাটল মৌনির। প্রতিদিন রাতের ঠিক এগারোটায় ম্যাসেজ পাঠানো শাওনের এক যুগের অভ্যাস। মৌনি সাথে সাথেই উত্তর দিল,
‘ তোমাকে বলেছি না? আমাকে মন বলে ডাকবে না?’
‘ কেন? মন ডাকলে কী হয়?’
মৌনি বিরক্ত হয়ে লিখল,
‘ ডাকতে মানা করেছি, ডাকবে না। নাম শর্ট করে এমন লুতুপুতু ডাক আমার অসহ্য লাগে। আমরা তো প্রেম করছি না। তাহলে কেন তোমার এতো ঢং করে ডাকতে হবে?’
শাওন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মৌনির মেজাজ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল বলেই সচেতন হয়ে বলল,
‘ আচ্ছা, সরি। আর ডাকব না। প্লিজ মুড ঠিক করো।’
মৌনির মুড ঠিক হলো না। মৌনির মেজাজ ঠিক করতে খুব দ্রুত প্রসঙ্গ বদলাল শাওন। বলল,
‘ এই মৌনি? সেদিন তুমি তোমার যে বান্ধবীটির কথা বললে, তার এখনও ব্রেকাপ হয়নি? এতো সুন্দর একটা মেয়ের ব্রেকাপ হচ্ছে না এটা কেমন কথা? তার সাথে কথা বলে মনে হয়েছে, তাকে আমি পটিয়ে ফেলতে পারব।’
তুমুল উচ্ছ্বাসে লাফিয়ে উঠল মৌনি। তৎক্ষনাৎ শাওনকে ফোন লাগাল,
‘ একেই বলে মিনমিনে শয়তান! তোমার ওর সাথে কথা হয়!’
মৌনির উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে মৃদু হাসল শাওন। উৎসাহ নিয়ে বলল,
‘ টুকটাক। সে আমার কাছে তার বয়ফ্রেন্ড সম্পর্কে বিস্তর অভিযোগ জানাল। যদিও আমি তার প্রেমিককে চিনি না। তবে তার দুঃখে আমি ব্যথিত। আর দু’দিন গেলেই আমি বলব, “ছেড়ে দাও সেই নরাদমকে যে তোমার মূল্য বুঝে না। আমার কাছে চলে আসো আমি তোমায় একটুও কষ্ট দিব না।”
শাওনের কথায় হো-হো করে হেসে উঠল মৌনি। মৌনির উচ্ছ্বাস, মৌনির হাসি সবসময়ই ঊর্ধ্বগামী। একবার শুরু হলে সহজে নিচের দিকে নামে না। মৌনি হেসে গড়িয়ে পড়তে পড়তে বলল,
‘ এইযে রোমিও! এতোও সহজ না বুঝলে? মেয়েরা এতো সহজেও পটে না!’
শাওন ফট করে বলে ফেলল,
‘ তুমি ছাড়া সব মেয়েরাই পটে। তোমাকে কী করে পটাতে হয় জানি না। যে তোমার প্রেমিক হবে অথবা তোমার ভাষ্যমতে যিনি তোমার প্রেমিক, যাকে আমি আদৌ বিশ্বাস করি না, তার থেকে আমি টিউশন নিব।’
মৌনি হেসে ফেলল। প্রসঙ্গ বদলে প্রচন্ড উচ্ছ্বাস নিয়ে বইয়ের আলাপ জুড়ল। পুরাতন বইয়ের ভেতর যে কী আশ্চর্য ভালোবাসার নজির আছে তা বলতে গিয়ে ক্ষণে ক্ষণে আশ্চর্য হতে লাগল। ফোনের ওপাশে নীরব শ্রোতা হয়ে সেই সকল কথা নিশ্চুপে শুনে গেল শাওন। মৌনির এতো উচ্ছ্বাস দেখে টিপ্পনী কাটল,
‘ তোমার নাম গিনেস বুকে লেখা থাকা উচিত মৌনি। তোমার মধ্যে একটা উইপোকা টাইপ ব্যাপার আছে। নয়তো যেখানেই পুরাতন বই সেখানেই তুমি এটা কেমন কথা?’
মৌনি ফুঁসে উঠল। এই ছেলেটার এই এক সমস্যা। কথা বলবে না বলবে না আবার হুট করে এমন একটা কথা বলবে মৌনির শীতল মেজাজে তীব্র বিস্ফোরণ ঘটে যাবে। মৌনি মেজাজ হারিয়ে প্রচন্ড ধমক দিল ,
‘ তুমি একটা অসহ্য শাওন। তুমি নিজে কুনোব্যাঙ বলে আমাকে উইপোকা বলবে? পুরাতন বইয়ের আবেগ যারা বই পড়ে তারা জানে। তোমার মতো গেইম, মুভি, সিরিজ পাগল মানুষ সে আবেগ বুঝবে কেমন করে? নিজে তো জীবনে একটা বই ঘেঁটে দেখলে না। আবার বড় বড় কথা!’
শাওন হাসে। কথাটা মিথ্যা নয়। মৌনির মতো অতো বই পড়ার শখ শাওনের নেই। অবসর কাটাতে গেমস, মুভি, সিরিজ তার প্রথম পছন্দ। কিন্তু মৌনি জানে না, এসি ঘরের আরামদায়ক ভিডিও গেমস্, মন ভরানো মুভি ফেলে রেখে এই ছেলেটিও নীলক্ষেত চষে বেড়ায়। কাঠফাঁটা রোদে পুড়ে খুঁজে খুঁজে বের করে মৌনির পছন্দের বই। হাতের লেখা চিনে ফেলার ভয়ে বিভিন্ন বন্ধুদের দিয়ে দারুণ দারুণ নোট লেখায় বইয়ের পাতায়। পুরোনো পুরোনো তারিখ বসায়। তারপর মৌনি যে দোকানটি থেকে সবথেকে বেশি বই কিনে সেই দোকানের ছেলেটির হাতে তুলে দিয়ে আসে বিনামূল্যে। সাথে এক টুকরো অনুরোধ, মৌনি এলে তার আশেপাশে যেন ফেলে রাখা হয় বইগুলো। তার এই অসীম ধৈর্য, কঠিন পরিশ্রমের ফলাফল মেলে মৌনি যখন বইগুলো খুঁজে পায়। গর্ব ও আনন্দে আত্মহারা হয়ে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ায়। শাওনকে বারবার করে শুনায় কী করে, কত পরিশ্রম করে সে বইগুলো সংগ্রহ করেছে। বইয়ের ভেতরের দু’লাইনের লেখাগুলো কত অর্থবহ! শাওন নীরব শ্রোতা হয়ে শুনে যায়। ক্ষণে ক্ষণে আশ্চর্য হয়, চমকে উঠার নিঁখুত অভিনয় করে। শাওনের এই বিস্ময় মৌনিকে ঘুণাক্ষরেও আন্দাজ করতে দেয় না গল্পের পেছনেও গল্প হয়। সেই গল্প শাওনের নিজস্ব। এই গল্প সে আড়াল করে রাখে সঙ্গোপনে। বুকের ভেতর অজস্র পাথর চাপা দিয়ে রাখে সর্বক্ষণ। তারপরও এই আশ্চর্য মেয়েটির মন ভালো করতে, তাকে একটু খুশি করার লোভে পাথর চাপা বুকের ভেতর থেকে পিছলে বেরিয়ে আসা টুকরো টুকরো ভালোবাসাগুলো কত রকম পাগলামোই না করে বসে! সে সকল পাগলামোতে শাওনের হাত নেই। সে সকল পাগলামো মৌনি কখনও জানবে না। জানা উচিতও না। মৌনির উচিত কেবল খুশি থাকা। হাসতে থাকা। মৌনিকে হাসতে দেখলে পৃথিবীটাকে ঠিক পৃথিবী বলে মনে হয় না শাওনের। মনে হয়, এ যেন স্নিগ্ধ এক ফুল! মৌনির কথার ফোয়ারা বই থেকে ঘুরে এসে নানান জায়গায় বাঁক নিয়ে অবশেষে ভাই-বোনদের কাছে এসে থামল। চোখ বড় বড় করে শুধাল,
‘ এই শাওন! তুমি সিগারেট খাও?’
শাওন কানে এয়ারপ্লাগ লাগিয়ে আপন মনে লাগেজ গুছাচ্ছিল। আচমকা এমন প্রশ্ন অবাক হয়ে বলল,
‘ না তো। কেন? তুমি খাও?’
মৌনি খেঁকিয়ে উঠে বলল,
‘ আমি সিগারেট খাব কেন আশ্চর্য!’
শেষ টি-শার্টটা ব্যাগে তুলে রেখে হেসে ফেলল শাওন। বলল,
‘ বাপরে! এমন রণচণ্ডী রিয়েকশন কেন দিচ্ছ? সিগারেট খাওয়া তেমন কোনো ভয়ংকর অন্যায় নয়।’
মৌনি একটু ভেবে বলল,
‘ তা নয়। কিন্তু আমার সিগারেটের গন্ধ অসহ্য লাগে। ভবিষ্যতে যদি আমি বিয়ে করি তাহলে বরের কাছে আমার প্রথম শর্ত থাকবে সিগারেট খাওয়া যাবে না।’
ব্যাগের চেইন আটকাতে আটকাতে শাওন উত্তর দিল,
‘ বেশ! মাথায় রাখলাম। তোমার জন্য সিগারেটবিহীন পাত্র দেখব। তবে আমি ঠিক করেছি, সিগারেটখোর মেয়ে দেখেই বিয়ে করব। মৌনি প্লিজ, তোমার ওই বান্ধবীটিকে সিগারেট খাওয়া শেখাও না!’
মৌনি বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
‘ তুমি সিগারেটখোর মেয়ে বিয়ে করবে?’
‘ হ্যাঁ। আমি পুরোদস্তুর জেন্টেলম্যান। আমার বউ একটু দুষ্ট প্রকৃতির হলে ভালো মানাবে।’
মৌনি যেন উথালপাতাল চিন্তায় পড়ে গেল এবার। ভেবেচিন্তে বলল,
‘ তোমার পাত্রী খোঁজার জন্য তাহলে অতিশীঘ্রই নাহিদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। আমাদের কাজিনদের মধ্যে কেউ সিগারেট খায় না। কেবল নাহিদ খায়। শুধু সিগারেট না ও গাঁজাও খায়।’
‘ গাঁজা খায়!’ অবাক হলো শাওন।
‘ কিন্তু ওকে দেখে ঠিক গাঁজা খাওয়ার মতো ছেলে মনে হয় না। খুব হ্যান্ডসাম চেহারা। নিড এন্ড ক্লিন। যদিও প্রায় বছর দশেক আগে দেখেছিলাম।’
মৌনি উৎসাহ নিয়ে বলল,
‘ নাহিদ ইজ নাহিদ। ও এখনও সুন্দর। আগে কী চমৎকার গায়ের রঙ ছিল! এখন ভন্ডামী করে, রোদে পুড়ে গায়ের রঙটাকে করেছে তামাটে। তারপরও আমাদের ভাইদের মধ্যে সবথেকে হ্যান্ডসাম বোধহয় নাহিদ। ওর চেহারায় আলাদা একটা চটক আছে।’
শাওন অপ্রস্তুত হলো। নাহিদ তাদের সমবয়সী। সে যেমন মৌনির খালামণির ছেলে, নাহিদও তেমনই তার ফুপুর পুত্র। নাহিদ শাওনের মতো মৌনির খুব কাছের বন্ধু না হলেও দাদার দিকের একমাত্র সমবয়সী হিসেবে হালকা-পাতলা বুঝাপড়া নিশ্চয় আছে? তারওপর মৌনি বলছে সে সুদর্শন। শাওন ভেতর ভেতর অদ্ভুত এক ঈর্ষাবোধ করে। সুদর্শন তো সে নিজেও। দারুণ ফিট শরীর, ছ’ফুটের কাছাকাছি লম্বা। কই? মৌনি তো কখনও তার প্রশংসা করে না? শাওনের মুখ গম্ভীর হলো। মৌনি তখনও অনর্গল কথা বলে চলেছে,
‘ নাহিদ যে কী পরিমাণ চাপা মারতে পারে তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। একবার আমাকে বলল, বুঝলি মৌনি? আমি না একবার টিন দিয়ে ঘুড়ি বানিয়েছিলাম। ঘুড়ি উড়ে উড়ে মেঘ কেটে নিয়ে চলে এলো। আমি বসে বসে মেঘ খেলাম। মেঘ খেতে এমনিতে ভালো। কিন্তু চিবোতে গেলে হঠাৎ হঠাৎ বৈদ্যুতিক শকের মতো হয়। চিন্তা করতে পারো? কী পরিমাণ চাপা সে মারে! আর কথায় কথায় ছত্রিশটা মিথ্যা কথা। ওর মুখের রস আর চেহারার জোরেই এত এত মেয়ে পটাতে পারে। তুমি চিন্তাও করতে পারবে না ওর কতগুলো গার্লফ্রেন্ড। যদিও একসাথে একাধিক কখনও থাকে না। একটার পর একটা। সবগুলোর নাম আমার মুখস্থ। দাঁড়াও বলছি…’
উফ মৌনি উফ! গাম্ভীর্য ভুলে হেসে ফেলল শাওন। এই মেয়েটা এতো কথা কোথায় পায়? সকলের হাঁড়ির খবর তার কাছে আছে। কার সাথে কার প্রেম, কার জীবনে কী চলছে? কে কাকে চুমু খেয়ে ফেলল থেকে শুরু করে খবরের কাগজের বিনোদন পাতা- সাহিত্য পাতা সব খবর মৌনির জানা। এই সবজান্তা মৌনি যখন ফটফট করে কথা বলে যায় শাওনের বুকের ভেতর তখন ঘূর্ণিঝড় হয়। সেই ঘূর্ণিঝড়ে গুনগুনিয়ে বাজে একটাই নাম – মন মন মন। ছটফটে মৌনি ছটফট করে বলল,
‘ নাহিদের রিসেন্ট গার্লফ্রেন্ডটা চার বছর ধরে চলছে। মেয়েটার নাম মিষ্টি। নামের মতোই নম্র, শান্ত একটি মেয়ে। এটা বোধহয় নাহিদের সিরিয়াস প্রেম। যত মেয়ের সাথেই ফ্লার্ট করুক। ঘুরেফিরে এই মিষ্টিতে এসেই আটকায়। মেয়েটি আমাদের ভার্সিটিতেই পড়ে। নাহিদ একদিন…’
শাওন নীরবে খবরের রাণী মৌনির খবরসমূহ শুনতে লাগল। রাত তিনটার আগে সে থামবে না। না থামুক। শাওন মৌনিকে কখনও থামাতে চায় না। এই বাইশ বছরে তাকে থামিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন কখনও শাওনের পড়েনি।
____________
প্রচন্ড গরমে অস্থির হয়ে ব্যালকণিতে এসে বসেছে নাহিদ-সৌধ। শহরজুড়ে লোডশেডিং হচ্ছে। ঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছে কারেন্ট আসার নামগন্ধ নেই। এই মানুষ মরা গরমে দিব্যি নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে ইশতিয়াক। গরম বা মশা কোনোটাতে তার তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সৌধ অবাক হয়ে বলল,
‘ দোস্ত, তোর ভাই বোধহয় মরে গেছে। নয়তো এই গরমে এমন ঘুম অসম্ভব!’
নাহিদ বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ মানুষ মরলে নাক ডাকে? ভুস ভুস করে নাক ডাকছে শুনিস না?’
সৌধ মন খারাপ করে বলল,
‘ এটাও একটা ফ্যাক্ট!’
সৌধর কণ্ঠ শুনে মনে হলো, ইশতিয়াক আসলেই মরে যায়নি ব্যাপারটা তাকে ব্যথা দিচ্ছে। মরে গেলে ভালো হতো। নাহিদের লুঙ্গির খুঁটে গুঁজে রাখা মোবাইলটা থেকে থেকে ভাইব্রেট করছে। সন্ধ্যা পর থেকে মা একের পর এক ফোন করে চলেছেন। কে জানি কোথা থেকে তিনি খবর পেয়েছেন, আজ নাহিদের রেজাল্ট হয়েছে। সৌধ রেজাল্ট দেখে এসেছে। দুটো ইম্প্রুভ, একটা সাপ্লি দিতে হবে। সিজিপিএ-এর অবস্থা জঘন্য। নাহিদ খুব পড়াশোনা না করলেও পরিষ্কার মাথার ছেলে। এতো খারাপ রেজাল্ট হওয়ার কথা তার না। তারপরও হয়ে গিয়েছে, কিছু করার নেই। রেজাল্ট নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথাও নাহিদের নেই। সে জানে, রেজাল্ট তার ভবিষ্যৎ আটকাতে পারবে না। কিন্তু বাবাকে বুঝানো মুশকিল। বাবার সাথে নাহিদের সম্পর্ক ভয়ংকর। নাহিদকে তিনি দুই চোখে দেখতে পারেন না। দু’জনের মধ্যে কথাবার্তাও বন্ধ। নাহিদের রেজাল্ট নিয়ে তিনি কোনো উচ্চবাচ্যই করবেন না। কিন্তু মায়ের সাথে প্রচন্ড ঝামেলা করবেন। ঝগড়ার এক পর্যায়ে দু’জনের মধ্যে হাতাপায়ী হয়ে যাওয়াও আশ্চর্য নয়। বাড়িতে তার একটা ছোট বোন আছে। তার জন্য বাবা-মায়ের এমন ঝগড়া সুখকর হবে না। নাহিদ ফোন তুলল। ওপাশ থেকে মা চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
‘ ফোন তুলছিস না কেন? কোথায় আছিস তুই?’
‘ ভালো জায়গাতেই আছি।’
‘ ভালো জায়গাটা কোথায়?’
‘ তুমি জেনে কী করবা?’
শাহিনুর চেঁচিয়ে উঠে ছেলেকে দুটো গালাগাল দেওয়ার পর নাহিদ উত্তর দিল,
‘ ইশতিয়াক ভাইয়ের ফ্ল্যাটে আছি।’
শাহিনুর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘ সেটা আগে বললে কী হতো?’
নাহিদ হেসে বলল,
‘ তোমার সাথে একটু ফাজলামো করলাম। তা, তোমার স্বামীর খবর কী?’
শাহিনুর বললেন,
‘ খবর ভালো। তুই একটু ঠিকঠাকভাবে চলাফেরা করতে পারিস না? তাহলেই কিন্তু তোর আব্বু ওমন রাগ করে না।’
নাহিদ বলল,
‘ আমি ভালো করেই চলাফেরা করি আম্মু। আর যদি ভালো করে চলাফেরা না-ও করি তারপরও তার রাগ করা উচিত না। সে শখ করে বিয়ে করেছে। আমাকে জন্ম দেওয়ার জন্য বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে এমন কোনো ব্যাপার নেই। তার চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে আমি পৃথিবীতে চলে এসেছি। আমি না এলেও অন্য কেউ আসত। অর্থাৎ, আমাকে জন্ম দিয়েছে বলে তাকে নমঃ নমঃ করার কোনো দরকার নেই। যেহেতু আমার অনুমতি ছাড়া আমাকে পৃথিবীতে এনেছে সুতরাং আমার সাবালক হওয়া পর্যন্ত সকল খরচ বহন করা তার কর্তব্য। এখন আমি সাবালক। এখন আমি তার থেকে টাকা-পয়সা-আদর-
ভালোবাসা-ঢং-আহ্লাদ কিছুই প্রত্যাশা করি না। তাহলে সে কেন আমার চলাফেরা নিয়ে এতো মন খারাপ করবে? আশ্চর্য!’
শাহিনুর দুঃখী কণ্ঠে বললেন,
‘ সে হিসেবে তো আমারও তোর জন্য দুশ্চিন্তা করা উচিত না। তুই বলতে চাচ্ছিস, ছেলের প্রতি ভালোবাসা থাকা অন্যায়?’
নাহিদ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
‘ ভালোবাসা থাকা অন্যায় নয় আম্মু। মানুষ হিসেবে প্রত্যেক মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকা উচিত। কিন্তু প্রত্যাশার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়।’
শাহিনুর স্তব্ধ কণ্ঠে বলল,
‘ মা হিসেবে তোর থেকে আমি কোনো প্রত্যাশা রাখতে পারব না!’
নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ রাখা তো উচিত নয়। কিন্তু তুমি রাখো আম্মু। জন্মাবার সময় আমি তোমাকে যত কষ্ট দিয়েছি তার কিছুটা আমি এই পৃথিবীতে পরিশোধ করে দেব। বাকিটুকু পরিশোধ করতে পারব না বলেই বারবার বলব, ভালোবাসি আম্মু।’
শাহিনুর জবাব দিলেন না। নাহিদ জানে, বাবা তার প্রতি যত রাগান্বিত মা ততটাই কোমল। ছেলেকে তিনি অন্ধের মতো ভালোবাসেন। যেমন অন্ধের মতো ভালোবাসেন বাবা রিফাকে। রিফার কথা মনে পড়তেও দীর্ঘশ্বাস ফেলল নাহিদ। হঠাৎ মনে পড়েছে এমন স্বরে বলল,
‘ শোনো আম্মু, তুমি তোমার স্বামীর সাথে মারামারি, কাটাকাটি, ঝগড়াঝাঁটি যেকোনো কিছু করতে পার। তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। তোমার স্বামী তোমার একচ্ছত্র অধিকার। কিন্তু দয়া করে, রিফার সামনে এই ধরনের আচরণ করবে না। ওকে একটা সুস্থ পরিবেশ দাও। ট্রমা দিও না। আমি আমার বোনের ট্রমা সহ্য করব না।’
শাহিনুর ছেলেমানুষী কণ্ঠে বললেন,
‘ তোর বোনের ট্রমা হোক আর বোমা হোক তাতে তোর কী? তোর থিওরি দিয়ে চিন্তা করলে তোর বোনের সাথে তো তোর কোনো সম্পর্কই নেই। আমি আর তোর আব্বু তোকে তাও জন্ম দিয়েছি। তোর জন্মানোর পেছনে তোর বোনের কোনো হাত নেই। সে তোর বোন না। সে শুধু একটা মেয়ে।’
নাহিদ হেসে ফেলল। মায়ের সাথে কথা শেষে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকাল। সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে। নাহিদ সেই চাঁদের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আবার আগের চরিত্রে ফিরে গেল। সৌধকে বলল,
‘ ইশতিয়াক ভাইকে ডেকে তোল তো। আকাশে সুন্দর চাঁদ উঠেছে। এমন সুন্দর রাতে মেয়ে নিয়ে খেলার সুযোগ নেই। সো, উই ক্যান প্লে কার্ডস্।’
নাহিদের কথায় দুই বন্ধু মিলে বহু কসরত করে ইশতিয়াকের ঘুম ভাঙাল। ইশতিয়াক এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে খানিকটা চোখ খুলতেই দুজনে আবদার করল,
‘ চলো ভাই বারান্দায় বসে কার্ড খেলি। এই গরমে ঘরের ভেতর দমবন্ধ লাগছে। মনে হচ্ছে, কবরে শুয়ে আছি।’
ইশতিয়াক তাদের আবদার ধূলিসাৎ করে দিয়ে আবারও নাক ডাকতে লাগল। নাহিদ-সৌধ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কেউ এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যেতে পারে তা জানতে পেরে তারা বিস্মিত। সৌধ তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ দোস্ত? তোর ভাই কোনোভাবে বাংলা টাংলা খায়নি তো? এমন দুনিয়া ভুলে ঘুমায় ক্যান?’
নাহিদ কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে বলল,
‘ ভাইকে টেনেটুনে বারান্দায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কর তো। তার এতো আরাম দেখে আমার গরম আরও বেড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে হিট স্ট্রোক করে ফেলব।’
বীর সৌধ বন্ধুর স্ট্রোক বাঁচাতে ইশতিয়াকের বিশাল শরীরকে টেনেটুনে বাইরে নেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা চালাল। চেষ্টার মাঝপথে ইশতিয়াকের ঘুম ছুটে গেল। তাদের এই টানাহিঁচড়ার অত্যাচারে বাকি পথটুকু সে নিজে নিজেই হেঁটে গেল। তারপর তাদের আশ্চর্য করে দিয়ে বারান্দার মেঝেতে বসেই ঘুমিয়ে পড়ল। নাহিদ-সৌধ তাকে ডেকে তুলে সে খেলায় একটা দান দেয় তারপর আবার ঘুম। আবার ডাকে, আবার দান দেয় আবার ঘুম। সৌধ এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ ধূর শালা! তোর ভাই তো দেখি বাংলাদেশের বৈদ্যুতের থেকেও নাটকবাজ। এভাবে খেলা সম্ভব? স্বপ্নে নিশ্চয় কোনো সুন্দরীর কোমর ধরে নাচছে। তাই জেগে থাকতে পারছে না। মন কেবল নাচ নাচ করছে।’
নাহিদ বলল,
‘ বাদ দে। চল, আমরা দু’জনই খেলি।’
সৌধ বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল,
‘ দু’জনে খেলে মজা আছে?’
এমন সময় পাশের বারান্দায় প্রভাকে দেখা গেল। প্রভা বারান্দায় হেঁটে হেঁটে পড়ছিল। ইশতিয়াককে ওমন ঢুলে পড়তে দেখে ব্যস্ত হয়ে শুধাল,
‘ ওনার কী হয়েছে?’
নাহিদ-সৌধ ভূত দেখার মতো চমকাল। প্রভাকে চিনতে পেরে অমায়িক হেসে বলল,
‘ স্ট্রোক করেছে। স্লিপ স্ট্রোক।’
প্রভা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এই বদ ছেলেদুটোর সাথে আর কক্ষনো কথা বলবে না। কিন্তু কৌতূহল নিবারণ সম্ভব না হওয়ায় সন্দিহান কণ্ঠে শুধাল,
‘ স্লিপ স্ট্রোক? এটা আবার কেমন স্ট্রোক। কখনও শুনিনি তো।’
নাহিদ মুখ গম্ভীর করে বলল,
‘ স্বপ্নের মধ্যে সুন্দরী মেয়েরা চলে এলে এই ধরনের স্ট্রোক হয়। আমি আর সৌধ ধারণা করছি, ভাই স্বপ্নে আপনাকে দেখছেন।’
প্রভা লজ্জা পাবে নাকি রেগে যাবে বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে বলল,
‘ আমাকে কেন দেখবে?’
নাহিদের মুখ আগের থেকেও গম্ভীর হলো,
‘ শুনেছি, বোনেরা সবসময় বিপরীত ধর্মী হয়। এক বোন শান্ত হলে আরেক বোন চঞ্চল। আপনার মামাতো বোন আমাকে যে রকম স্লিপলেস স্ট্রোক দিল! সেখান থেকে ধারণা করলাম, আপনি উল্টোটাই হবেন। এক বোন ঘুম হারাম করে দিয়েছে। আরেক বোন স্বপ্নে এসে ঘুমের সাগর বানিয়ে ফেলছে।’
প্রভা অবাক হয়ে বলল,
‘ আপনি আমার মামাতো বোনকে চিনেন!’
নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আজকে তার বিয়ে হয়ে গেল না?’
প্রভার বিস্ময় বাড়ল। নাহিদ নাটক করে বলল,
‘ কী করে পারল বলুন তো? আমাকে রেখে অন্য একজনকে বিয়ে করতে কী তার বুক কাঁপল না?’
প্রভা বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
‘ আপনার সাথে নাহার আপুর কী কোনো সম্পর্ক ছিল?’
নাহিদ উদাস কণ্ঠে বলল,
‘ ভালোবাসার সম্পর্কের থেকে বড় সম্পর্ক কী এই পৃথিবীতে হয়? এই কঠিন সম্পর্ক ছিন্ন করে নাহার বিয়ে করে ফেলল, ভাবতেই আমার বুক ধরফর করছে। এই কষ্ট থেকেই সকালে আপনার সাথে ওমন ব্যবহার করেছি। আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না।’
প্রভা ব্যথিত হলো। তার নাহার আপু একটা ছেলের সাথে সম্পর্কে ছিল এবং তাকে ছেড়ে অন্য একজনকে বিয়ে করে ফেলেছে ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। নরম কণ্ঠে বলল,
‘ নাহার আপুর সাথে আপনার সম্পর্ক কী করে হলো?’
নাহিদ চোখে-মুখে দার্শনিক ভঙ্গি নিয়ে বলল,
‘ ভালোবাসার সম্পর্ক তো অপার্থিব প্রভা। পার্থিব জীবনের হিসেব কী সেখানে খাঁটে?’
প্রভার মন আরও কোমল হয়ে এলো,
‘ আপনি কী করে জানলেন আমি নাহার আপুর মামাতো বোন? আপু বলেছিলেন?’
‘ উঁহু।’
‘ তাহলে জানলেন কী করে?’
নাহিদ দুঃখী কণ্ঠে বলল,
‘ আপনিই তো বললেন।’
প্রভা অবাক,
‘ আমি? কখন?’
‘ কেন? সকালে। ইশতিয়াক ভাইকে বলছিলেন, আপনার সুন্দরী মামাতো বোনের আজ বিয়ে। সেটা শুনেই তো আমি প্রেমে পড়ে গেলাম। আপনার বোন কী করে পারল বলুন তো? আপনারা মেয়েরা কী এমনই? স্বার্থপর!’
প্রভার সেকেন্ড কয়েক লাগল ঘটনা বুঝতে। বুঝার পর সাপের মতো ফুঁসে উঠল। নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল,
‘ আপনি এতোক্ষণ মজা করছিলেন আমার সাথে!’
নাহিদ অসহায় মুখে বলল,
‘ মজা কেন করব? আপনার আপুকে আমি সত্যিই ভালোবাসি। তার বিয়ের কথা শুনে আমার ঘুম উবে গিয়েছে। আর আপনি বলছেন, মজা করছি! কষ্ট পেলাম।’
সৌধ এতোক্ষণ ঠোঁট চেপে বসে ছিল। এবার মলিন কণ্ঠে বলল,
‘ প্লিজ, আমার বন্ধুর ভালোবাসা নিয়ে কোনো অন্যায় কথা বলবেন না। ও খুব খাঁটি ছেলে, ওর ভালোবাসাও খাঁটি। ওর ভালোবাসা নিয়ে তো একটা কবিতাও আছে। এক বিখ্যাত কবি ওর ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন-
বিশ্বজুড়ে শ্বশুরালয় মোর
সবার আমি অনুরক্ত
নতুন দেখা নবীন মেয়ের
প্রেমে পড়ছি দিবারাত্র…’
প্রভা কবিতার মাঝপথেই তাদের দিকে তীব্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
‘ বেয়াদব!’
নাহিদ দুঃখে গলে গিয়ে বলল,
‘ দোস্ত, মেয়েটা এমন করে কেন?’
#চলবে….