আজ ওদের মন ভালো নেই ১০.

0
29

আজ ওদের মন ভালো নেই

১০.

টলটলে ঠান্ডা জলের দিঘি। সিমেন্টে বাঁধাই করা ঘাটের দু’পাশে মস্ত দুটো হিজল ফুলের গাছ। দিঘির সাথে কানে কানে কথা বলার অভিলাষ নাকি প্রেমিকের মতো মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকে দেখবার লোভেই কে জানে? গাছদুটো ঝুঁকে আছে দিঘির ওপর। প্রেমে উন্মাদ প্রেমিক যেমন প্রেয়সীর খুশির জন্য বিসর্জন দিতে পারে তার শেষ রক্তকণা পর্যন্ত। হিজল গাছদুটোও নিজের শেষ সম্বল হয়ে ফুটে থাকা ফুলগুলোকে রোজ ঝরিয়ে দেয় ঠান্ডা দিঘির রূপসজ্জার জন্য। টলটলে জলের উপর পশমি শাড়ির মতো ভাসতে থাকে সেই ফুল। মৈয়ন দু’হাতে ফুলের আস্তরণ সরিয়ে হাতের আঁজলায় তুলে নিল ঠান্ডা, স্বচ্ছ জল। ঘাড় ফিরিয়ে বলল,

‘ পানি কী ঠান্ডা রে! গোসল করতে ইচ্ছে হচ্ছে।’

চৈত্রের শেষ রজনী। ঘন্টা দুয়েক হলো, বিদ্যুৎ নেই। গরমে এক রকম অতিষ্ঠ হয়ে ভাই-বোনেরা এসে বসেছে দাদাজানের দিঘিপারের ঘাটে। দাদাজানের পয়সা কম নয়। কৃপণতাও তিনি করেন না। বাড়িতে খুব আগ্রহ করে জেনেরেটর লাগিয়েছেন। কিন্তু চালানোর অনুমতি নেই। বাড়িতে কখনও জরুরি অবস্থা চালু হলেই কেবল সরব হয় এই মেশিন। তুচ্ছ গরম কোনো জরুরি অবস্থা না। অতএব, গরমে সিদ্ধ হও৷ জীবাত্মা ত্যাগ কর। দিঘি পারের ঝিরিঝিরি ঠান্ডা হাওয়ায় গায়ের ঘাম শুকাতে শুকাতে আরিফ বলল,

‘ এই বু্ড়ো মরবে কবে শালা? জীবনটা জাহান্নাম বানিয়ে রেখেছে। এই বুড়ো মরলে আমি ডিজে পার্টি দেব।’

আরিফের কথার প্রত্যুত্তরে একেকজন একেকরকম অভিলাষ জ্ঞাপন করল। চটপটে মৌনি আজ কথা বলছে না। আকাশে বিশাল একটা চাঁদ উঠেছে। দিঘির ঠান্ডা হাওয়ায় বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে কী ভীষণ ভালো লাগছে! নাহিদ ক্রেচ হাতে সিঁড়ির উপর হাঁটাহাঁটি করছিল। মৈয়নের মন্তব্যে গম্ভীরমুখে কয়েক ধাপ নিচে নেমে এলো। ভাবখানা এই, মৈয়নের কথা তার বিশ্বাস হয়নি। সে নিজে পানি ছুঁয়ে দেখবে। পানি ছোঁয়ার বাহানায় দিঘির কিনারায় বসে থাকা মৈয়নকে আচমকা পায়ের ঠেলায় ফেলে দিল দিঘিতে। মৈয়ন এই আক্রমনের জন্য প্রস্তুত ছিল না। ‘ঝপাৎ’ একটা শব্দ তুলে কয়েকবার ঠান্ডা জলে হাবুডুবু খেয়ে ভেসে উঠল। বুক সমান পানিতে দাঁড়িয়ে ডান হাতে মুখের পানি মুছে ফেলে বিস্ময় আর ক্রোধ নিয়ে বলল,

‘ এটা কী হলো!’

নাহিদ নির্বিকার,

‘ তোর গোসল করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না? আমি হেল্প করলাম।’

মৈয়ন ক্রুদ্ধ চোখে নাহিদের দিকে তাকাল। দিঘি থেকে দ্রুত উঠে এসে দাঁড়াল নাহিদের কাছে। নাহিদ চাইলেই পালাতে পারে কিন্তু সেই চেষ্টা করল না। বরং তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল মৃদু হাসি। মৈয়নকে রাগতে দেখে খুব উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এলো আরিফ। ইশতিয়াক দূরের এক বেঞ্চিতে বসে ছিল। ওদের অভিলাষ বুঝতে পেরে মৃদু ধমক দিয়ে বলল,

‘ ওকে পানিতে ফেলিস না। ওর পায়ের ব্যান্ডেজ ভিজানো ঠিক হবে না৷’

বড় নিষ্ঠুর এই ভাই-বোনদের হৃদয়। ইশতিয়াকের নিষেধ তারা অগ্রাহ্য করল। নাহিদের ব্যান্ডেজ নিয়ে ভাববার প্রয়োজন বোধ করল না। নাহিদের সাথে হাতাহাতি করে সুবিধা করতে পারবে না জেনেই আরিফ-মৈয়ন দু’জন দু’পাশ থেকে চ্যাংদোলা করে দিঘির পানিতে ছুঁড়ে ফেলল তাকে। ক্রেচটা পড়ে রইল ঘাটে। নাহিদ পানিতে পড়ে কোনো উদ্বেগ দেখাল না। ভারী বা’পা নিয়ে প্রথমে হিমশিম খেলো কিন্তু কয়েক মিনিটেই কাটিয়ে উঠল সে প্রতিকূলতা। ক্রূর, ফিনফিনে একটা হাসি খেলে গেল তার ঠোঁটের অগ্রভাগে। নিজের ধৈর্য নিয়ে খেলা নাহিদের প্রিয় শখ। আজ খেলা জমবে ভালো। নাহিদকে দিঘিতে ফেলার পরপর পানিতে নামল মৈয়ন। শার্টটা বাঁধানো বেঞ্চিতে খুলে রেখে লাফিয়ে পড়ল আরিফও। ইশতিয়াক বলল,

‘ এই নাহিদ উঠে আয়। পুকুর অনেক গভীর। এক পায়ে ব্যালেন্স রাখতে পারবি না।’

উত্তরে নাহিদ চমৎকার এক হাসি হাসল। চাঁদের আলোয় খেলে উঠল তার কপোলের টোল। ভাইকে আশ্বস্ত করে বলল,

‘ দিঘিটা একটু চক্কর দিয়ে উঠছি।’

স্বস্তির বদলে অস্বস্তি হলো ইশতিয়াকের। তবে নাহিদের আত্মবিশ্বাসী মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না। নিজেও শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে নেমে গেল পুকুরে। তার দেখাদেখি সোহান ও দিব্যও। আম-জাম-লিচু আর হিজল গাছের ছায়ায় ঘেরা দিঘির জলে চিকচিক করছে জ্যোৎস্নার আলো। সেই ভেসে যাওয়া জ্যোৎস্নায় ছয় ভাইয়ের হৈ-হুল্লোড় জলকেলি যে সৌন্দর্যের সঞ্চার করল, যে মায়া মায়া আবেশ দিল, সে আবেশ অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করলে বোধ করি বদ্ধ নাস্তিকের মনও সৃষ্টিকর্তার অপার লীলায় তরল হতো। ভিজে আসতো দু’চোখ।

প্রায় মিনিট বিশেক পর উঠে এলো নাহিদ। কাঠা পাঁচেক জায়গার উপর কাটানো এই দিঘি। সুস্থ সময়ে এই দিঘি পেরুতে তার সময় লাগে সর্বোচ্চ সাত থেকে আট মিনিট। আজ ভারী পা নিয়ে লাগল মিনিট বিশেকের মতো। নাহিদ কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো। কিন্তু আবার জেদ করার বোকামো করল না। শরীর ভেঙে আসতে চাইছে। এই পা নিয়ে আবার সাঁতরাতে গেলে আর ফিরে আসা হবে না। নাহিদ ঘাটে উঠে এসে মৌনির পাশে বসল। মৌনির ওড়নার প্রান্ত ধরে বলল,

‘ এই মৌনি টৌনি? তোর ওড়নাটা দে না একটু গা মুছি।’

প্রত্যুত্তরে মৌনি আগুন চোখে তাকিয়ে টেনে নিল নিজের ওড়নার প্রান্তভাগ। চোখে নীরব শাসন। নাহিদ মৌনির সিংহী চাহনিকে পাত্তা দিল না। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,

‘ দিবি না? না দিলি। তোর বান্ধবীটা পাশে নেই বলে। নয়তো ঠিকই সে মুছে দিত।’

মৌনি একবার কটমট করে তাকিয়ে জ্বলন্ত দৃষ্টিখানা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কমলার উপর তাক করল। মেয়েটা ষোড়শী। এই বাড়িতে কাজ করে। দাদাজান এই আপদকে আগামী তিনদিনের জন্য মৌনির ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিয়েছেন৷ দাদাজানের বিচারে মৌনির তিনদিনের মৌনব্রতের শাস্তি হয়েছে। সারাদিন ফটফট করে সকলের মাথা ধরিয়ে দেওয়া মৌনির জন্য ‘কথা না-বলতে পারার’ শাস্তি ভয়ংকর শাস্তি। তারথেকেও বড় শাস্তি এই আপদকে নিয়ে চব্বিশ ঘন্টা ঘুরে বেড়ানো। মৌনি কমলার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে হাত দিয়ে বাড়ির রাস্তা দেখিয়ে দিল। অর্থাৎ, ‘এক্ষণ আমার চোখের সামনে থেকে বিদেয় হ।’ কমলা বিদেয় হলো না। মৌনি নাহিদের বাজুতে দুটো থাপ্পড় দিয়ে নাহিদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল। নাহিদ ইচ্ছে করেই মৌনির দিকে তাকাল না। সামনের দিকে তাকিয়ে থেকে মিটিমিটি হাসতে লাগল। নিজের ধৈর্য পরীক্ষা শেষ। এখন তার মৌনির ধৈর্য পরীক্ষার শখ হয়েছে। মৌনির ধৈর্যের অবস্থা খুবই খারাপ। নাহিদের দেখার ইচ্ছে, মৌনি প্রচণ্ড রেগে কথা বলে ফেললে নানাজান তাকে আবার কী শাস্তি দেন? নাহিদের মনোযোগ না পেয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল মৌনির। অপেক্ষা জিনিসটা তার দু’চোখের বিষ। রেগে ফুঁসে উঠে নাহিদের ভেজা চুলগুলো দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে জোরপূর্বক মাথা ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফেরাল। ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে কিছু বলবে ঠিক তখনই ফোনে মগ্ন থাকা ঋতি মুখ তুলে চিৎকার করে বলল,

‘ কুল মৌপু। কুল! কথা বলে ফেলতেছ কিন্তু।’

মৌনি মুহূর্তেই মুখ বন্ধ করে ফেলল। তবে নাহিদের চুলের গোছায় পাকড় আরও শক্ত হলো। নাহিদ চিৎকার করে বলল,

‘ আল্লাহ! ছাড় মহিলা, ছাড়। তুই মেয়ে নাকি গজব ভাই? কয়টা চুল ছিঁড়ে ফেলছিস গুণে দেখ। প্রতি চুলের জন্য দশ হাজার করে পে করবি তুই।’

মৌনি ছাড়াছাড়ির আশেপাশে গেল না। নাহিদ বেকায়দায় পড়ে বলল,

‘ আচ্ছা বাপ ছাড়। বলছি আমি, বলছি।’

মৌনি এবারে ছাড়ল। নাহিদ চুল ঠিক করতে করতে কমলার দিকে তাকিয়ে মধুর হাসি হাসল। কমলার ষোড়শী হৃদয় একটু লজ্জায় নত হলো। নাহিদ ভাইজানকে তার বড় ভালো লাগে। সবথেকে ভালো লাগে ইশতিয়াককে। ওমন ফর্সা, ছিমছিমে, দীর্ঘদেহী সুদর্শন সে কোনোদিন দেখেনি। তারওপর সে ডাক্তার। দুয়েক দিনের জন্য বাড়ি ফিরে যখন গম্ভীরমুখে গ্রামের লোকদের চিকিৎসা দেয়। কী যে ভালো দেখায়! ইশতিয়াক তার সামনে দাঁড়ালে লজ্জায় বুক কাঁপতে থাকে কমলার। নাহিদ কমলাকে বলল,

‘ তুই তো ভারি বেয়ারা কমলা! মৌনি আপা কী বলছে, শুনছিস না? দাদাজান তোকে মৌনি আপার সাথে সাথে থাকতে বলেছে। তুই এতো দূরে দূরে আছিস কেন? কাছে আয়। কাছে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়া। কতক্ষণ ধরে ডাকছে তোকে তোর মৌনি আপা। কী হলো, আয়।’

নাহিদের কথায় মাথা নিচু করে মুচকি হেসে ফেলল কমলা। মৌনির মেজাজ চটে গেল। নাহিদের দিকে তাকিয়ে সে যেমন ভয়ংকর সিংহীর মতো নিঃশ্বাস ফেলছে। নাহিদ মোটামুটি নিশ্চিত এখনই কান ফাটানো একটা চিৎকার পড়বে। মৌনির জন্য এতো রাগ হজম করা কঠিন। নাহিদ মনে মনে গুণতে লাগল, এক- দুই-তিন….। নাহিদকে অবাক করে দিয়ে শেষ পর্যায়ে এসে বড় বড় দম ফেলে নিজেকে শান্ত করে ফেলল মৌনি। নাহিদকে ধাক্কা দিয়ে প্রায় ফেলে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। নাহিদ বেঞ্চির গা খামচে কোনোরকম টিকে গিয়ে বলল,

‘ জংলী!’

মৌরি আর ঐশি এতোক্ষণ দিঘির পার ধরে হাঁটছিল আর নিজেদের মধ্যে কুটকুট করে গল্প করছিল। এবার তারা কাছে এসে বলল,

‘ মিথি আপা, এদিকের গাছগুলোতে প্রচুর আম ধরেছে। চলো না, সবাই মিলে ভর্তা মেখে খাই।’

ততক্ষণে দিঘি থেকে একে একে উঠে এসেছে সবাই। মৈয়ন বলল,

‘ ওগুলো পাড়তে লাঠি লাগবে।’

মৌরি মুখ ফুলিয়ে বলল,

‘ লাঠিই যদি লাগে তাহলে তোমাদের মতো এতো লম্বা লম্বা ভাই দিয়ে কী দরকার?’

তাদের মধ্যে থেকে সবথেকে দীর্ঘদেহী ইশতিয়াক। মৈয়ন ইশতিয়াকের দিকে তাকিয়ে বিগলিত গলায় ডাকল,

‘ ভাই!’

ইশতিয়াক মিথির পাশে বসে পড়ে শার্ট দিয়ে গা মুছতে মুছতে বলল,

‘ তোরা যা। আমি যাব না।’

সবার আগে উঠে দাঁড়াল নাহিদ। ঘুরে ঘুরে আমের পরিমাণ দেখে এসে বলল,

‘ ভাই? এই দিঘির পারেই আম গাছ প্রায় দশটার কাছাকাছি। একদিন রাতে সব গাছের সব আম চুরি করে বিক্রি করে দিলে কেমন হয়? প্রতি গাছ থেকে কমপক্ষে দুই মণ আম পাওয়া যাবে। দশ গাছে বিশ মণ। কাঁচা আমের বাজার দর এখন আশি। বিশ মণে হবে চৌষট্টি হাজার টাকা।’

নাহিদের মুখস্তের মতো হিসেব বলে যাওয়ায় স্তব্ধ বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইল ইশতিয়াক। বাকিরা হৈহৈ করে উঠল। এতোক্ষণে কাজের মতো কাজ পাওয়া গিয়েছে। তারা এখানে তিনদিন থাকবে। এই তিনদিনে একটা এডভেঞ্চারের খুব দরকার ছিল। আরিফ বলল,

‘ বুড়ো ধরে ফেললে কিন্তু ডিরেক্ট ফাঁসি দিয়ে দিবে। আমের বদলে একটা করে কিডনিও চেয়ে বসতে পারে। অসম্ভব কিছু না।’

দিব্য বলল,

‘ আগে দেখতে হবে বুড়ো কোথাও ক্যামেরা ফিট করে রেখেছে কি-না। বুড়োর যা শয়তানী বুদ্ধি!’

মিথি কমলার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা স্বরে বলল,

‘ এই তুই বাড়ি গিয়ে বটি, বাটি, শুকনো মরিচ আর নুন নিয়ে আয়, যা।’

মিথির কথায় সকলে চমকে তাকাল কমলার দিকে। এই পদার্থের কথা তো তারা ভুলেই বসেছিল! কমলা অন্ধকারে চোখের আড়াল হতেই সোহান ফুঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল,

‘ এ তো একেবারে ডগায় বসে গাছ কেটে ফেলার মতো অবস্থা হলো। এই রাজসাক্ষীর একটা ব্যবস্থা না করলে তো উপায় দেখছি না!’

ঐশি ফট করে বলল,

‘ আমরা ওকে কিডন্যাপ করে ফেললে কেমন হয়?’

ল’য়ের সিরিয়াস ছাত্র দিব্য ধমক দিল,

‘ তোর মাথা হয়। সোনা-দানা-হিরা-জহরত চুরি করলে তবু একটা কথা ছিল। শেষমেশ আম চুরি করার জন্য মানুষ কিডন্যাপ? মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের ৩ ও ৬ নম্বর ধারায় স্পষ্ট করে লেখা নারী ও শিশু অপহরণ মামলায় যাবজ্জীবন জেল। কমপক্ষে চৌদ্দ বছর সশ্রম কারাদণ্ড।’

ঐশি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আম পাড়া, চুরির রোমহষর্ক পরিকল্পনা ইত্যাদি নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে আড্ডাটা যখন জমে ওঠল। ঠিক তখনই চারদিক আলো করে বিদ্যুৎ এলো। দাদাজান পুকুরপাড়ে কয়েকটা গাছ অন্তর অন্তর বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। চারদিকে আলোর বন্যা দেখে এই প্রথম তাদের মন খারাপ হয়ে গেল। মনে হলো,

‘ অন্ধকারই তো বেশ ছিল। এই পৃথিবীতে বিদ্যুৎ না থাকলে কী এমন অসুবিধা হতো!’

____________

দিঘিপার থেকে ফিরেই মিথি খবর পেল, দাদাজান তাকে ইয়াদ করেছেন। অতিশীঘ্রই তার সাথে সাক্ষাৎ করা কর্তব্য। মিথি একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে দাদাজানের সাথে দেখা করতে গেল। আজ সারা সন্ধ্যা সে মৌনির কথাগুলো ভেবেছে। নিজেকে সুখী ভাবতে গিয়ে সে হঠাৎ আবিষ্কার করেছে, এই যে সকলে প্রাণখোলে হাসছে। মিথি কোনোদিন প্রাণখোলে হাসেনি। আশ্চর্যের ব্যাপার, মন থেকে হাসার মতো তার জীবনে কী কোনোদিন কোনোকিছুই ঘটেনি? দাদাজানকে আজকেও বারান্দায় পাওয়া গেল। ধবধবে সাদা একটা পাঞ্জাবি গায়ে। রাশভারি মুখ। দাদাভাই মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছেন। দাদাভাইয়ের ঘরে পুরোনো আমলের একটা গ্রামোফোন আছে। এটি দাদাভাই এনেছিলেন সুদূর লাহোর থেকে। গ্রামোফোনে এখন নজরুল গীতি বাজছে। একটি ভক্তি নত কণ্ঠ ভক্ত ভরে গাইছে,

‘ দে দে পাল তুলে দে মাঝি, হেলা করিস না।
ছেড়ে দে নৌকা, আমি যাব মদিনায়…’

মিথি বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে শুধাল,

‘ দাদাজান আসব?’

দাদাজান রাশভারি মুখখানা তুলে তাকালেন। চোখের ইশারায় বসতে বলে অমায়িক কণ্ঠে শুধালেন,

‘ বুবু, আপনি কেমন আছেন?’

মিথি জানাল সে ভালো আছে। দাদাজান কিছুক্ষণ মুখ গম্ভীর করে বসে থেকে বললেন,

‘ বুবু, আপনার জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে।’

দাদাজান তাকে ঘরে ঢেকে কী ধরনের দুঃসংবাদ দিতে পারে বুঝতে না পেরে শান্ত চোখে চেয়ে রইল মিথি। দাদাজান গভীর দুঃখ নিয়ে বললেন,

‘ তোমার স্বামীকে বিশেষ দূত মারফত দাওয়াত পাঠান হয়েছিল। কিন্তু সে আসেনি। ঘটনাটায় আমি খুবই দুঃখ পেয়েছি।’

মিথি বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা ধাক্কা অনুভব করল। সাব্বির দাওয়াত রক্ষা করেনি তাতে মিথির দুশ্চিন্তা হবে, মন খারাপ হবে এইরকম সম্পর্ক তাদের মধ্যে হয়নি। কিন্তু সাব্বিরের আজকের এই না আসায় তীব্র এক প্রত্যাখানের ব্যথা মিথির ভেতরটা ছিন্নভিন্ন করে ফেলল। সাব্বির নিমন্ত্রণ পেয়েও আসেনি অথচ মিথি বিনা আমন্ত্রণেই তার কাছে ধরা দিয়েছিল। হঠাৎ করেই নিজেকে খুব ছোট বলে বোধ হতে লাগল মিথির। একটা তীক্ষ্ণ অপমান সুচের মতো বিঁধতে লাগল সমস্ত গায়ে। সে যদি সাব্বিরের বাড়ি না যেত, ওই চিরকুটটি না লিখত তবে আজ সাব্বিরের এই নীরব প্রত্যাখ্যান মিথির কাছে বড় পানসে ঠেকত। কিন্তু…মিথি দাদাজানের সামনেই দুই হাতে মুখ ঢেকে ঝিম ধরে বসে রইল। এতোদিন এতোকিছু সহ্য হয়েছে অথচ আজ এই অপমানের ভার তার সহ্য হতে চাইছে না। নিজেকে এতো ক্ষুদ্র, এতো অকারণ তার আগে কখনও মনে হয়নি। মিথি দাদাজানের বাকি কথাগুলো শুনতে পেল না। তার কাছে মনে হলো, এই পৃথিবী মিথ্যা। মিথ্যা এই পৃথিবীর সকল সম্পর্ক। এই পৃথিবীর আসল মটোই হলো, একাকিত্ব। মানুষ এই সত্য থেকে পালাতে চায় বলেই ভালোবাসা, মায়া, সম্পর্ক এসব টার্ম দিয়ে সাজিয়ে ফেলতে চায় মিথ্যা এক পৃথিবী। মিথি খালামণি, মৌনি সকলের কথা শুনে ভুল করেছে। স্টুপিড সব চিন্তা-ভাবনা করে সময় নষ্ট করেছে। জাগতিক সুখ-দুঃখ ছুঁতে পারার মতো মেয়ে তো মিথি না। তার কাছে ক্যারিয়ার, স্বপ্নের থেকে বড় কিছু নেই। তাহলে এই দু’দিন কী সব ভাবছিল সে? কেন এই অধঃপতন হয়েছিল তার? মিথি যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসল। সকল আবেগ থেকে আলোকবর্ষ দূর রোবটের কাছাকাছি যে মিথি? সেই মিথি হয়ে যেতে হবে তাকে। সেখানে দুঃখ নেই, কষ্ট নেই। হতাশা থাকলেও মন পুড়ানো অপমান নেই। মিথি যেন কী এক ঘোরের মধ্যেই উঠে দাঁড়াল। অপমানে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখে দাদাজানের কাছে ঘরে যাবার অনুমতি চাইল। নিজের দুঃখের মধ্যে ডুবে থাকল বলেই হয়ত মিথি লক্ষ্য করল না দাদাজান নামক অতিশয় ধূর্ত চরিত্রটির চোখে ভাসছে তখন পরিমিত কৌতুকের হাসি।

মিথি অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে তিন তলায় উঠে দেখল ইশতিয়াকরা তিন তলার লিভিং-এ বসে খেলা দেখছে। মিথির যাওয়ার কথা ছিল শোবার ঘরে কিন্তু সে শোবার ঘর লিভিং গুলিয়ে ফেলে গিয়ে বসল লিভিং রুমের সোফায়। খেলায় বিরতি চলছে। মৈয়ন সেই ফাঁকে ফোন ঘাটতে ঘাটতে বলল,

‘ আমাদের দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি স্বয়ং একটা সিনেমা। টিভির সিনেমার থেকে এদের রোজকার সিনেমা, নাটক দেখেই জনগণ আমোদিত হয় বেশি।’

ইশতিয়াক শুধাল,

‘ আবার কী হয়েছে?’

‘ এইযে এই সাফাত। শুটিং সেটের অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে দুইদিন আগে হাসপাতালে ভর্তি টর্তি হয়ে ভয়ংকর অবস্থা। অভিনেতা, অভিনেত্রী, দর্শকদের কত বিশ্লেষণধর্মী পোস্ট! সমবেদনা। দুইটা দিন ফেসবুকে টেকা যাচ্ছিল না। এখন যেই একটু পরিবেশটা শান্ত হয়েছে ওমনি সাফাত সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা করল, এটা স্রেফ একটা ভুল বুঝাবুঝি। শুটিং সেটে তেমন কিছু ঘটেনি। যতটুকু ঘটেছে সেটুকু কেবলই একটা এক্সিডেন্ট। কোনো সুযোগ সন্ধানী ইচ্ছে করে এমন খবর ছড়িয়েছে। সে হাসপাতালে গিয়েছিল রেগুলার চেকাপ আর গরমে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল তাই। সাংবাদিকরা তাকে না জানিয়ে এমন একটা খবর ছেপে দেওয়ায় সে হতাশ। আমার কথা হলো, ব্যাটা? এই যদি হয় কাহিনি তাহলে দুইদিন আগে বললি না কেন?’

ঋতি বলল,

‘ আমার মনে হয়, ইচ্ছেকৃত। কোনো নাটকের পাবলিসিটির জন্যই এমন করেছে। দর্শকদের ফোকাসটা গ্রেব করে ফেলল ঈদের আগে আগে।’

মিথি উঠে দাঁড়াল। মাথার ভেতরটা শূন্য লাগছে তার। সাফাত পুরো ঘটনাটাকে মিথ্যা বলে ঘোষণা দিয়েছে? কিন্তু, এরকম তো কথা ছিল না! মিথি লিভিং থেকে উঠে গিয়ে শোবার ঘরে গেল। বিছানায় ছেড়ে যাওয়া ফোনটা মা’হীন শিশুর মতো কাঁদছে। মিথি বিছানায় বসে ফোনের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল। তার চোখের সামনে পরিচালক মোখলেসুর আলম পর পর তিন বার ফোন করে ফেললেন। পরিশেষে একটা ম্যাসেজ পাঠালেন,

‘ মিথি কাল সকালে এফডিসিতে চলে আসো। একসাথে কাজ করলে এমন ছোটখাটো ব্যাপার ঘটে। কাল থেকে শুটিং শুরু হচ্ছে।’

#চলবে….

নৌশিন আহমেদ রোদেলা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here