আজ ওদের মন ভালো নেই
৮.
কৃষ্ণচূড়া গাছে ঝাঁকিয়ে ফুল এসেছে। চৈত্রের তপ্ত দুপুরে রাস্তার ধারে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নাহিদের মনে হলো, আজকের দুপুরে এই কৃষ্ণচূড়া গাছটিই একমাত্র ভালো দৃশ্য।
‘ সম্পাদকের সাথে ঝামেলা করে এভাবে চাকরি ছেড়ে দেওয়া কী ভালো কাজ হলো?’
ঢাকা শহরে গরমের দাপট ভয়ংকর। কাওরান বাজারে সেই গরম আরও দুই ডিগ্রি ওপরে। ভরা দুপুরে এদিকটায় মানুষের ভিড় খুব একটা নেই। কাঠফাটা রোদে দোকানগুলোকে বড় অলস দেখাচ্ছে। নাহিদ চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে কৃষ্ণচূড়া গাছের কয়েকটা ছবি তুলল। মিষ্টিকে ছবিগুলো পাঠিয়ে দিয়ে ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে অমায়িক হেসে বলল,
‘ দূর ব্যাটা! আর কত চাকরি করবি? কিছুদিন পড়াশোনায় মন দে। সুন্দর চেহারাখানা ভার্সিটিতে একটু দেখিয়ে আয়। চাকরি কোনো বিষয় হলো? সম্পাদকের পিনিক কমলে শালা আমাদের দিনে দশবার করে মনে করবে।’
সৌধ নির্ভার হতে পারল না। কণ্ঠে একটু চিন্তা প্রচ্ছন্ন রেখে শুধাল,
‘ পস্তাতে হবে না তো?’
‘ পস্তাবে তো সম্পাদক মশাই।’
সৌধর দ্বিধা কাটে না,
‘ যদি না পস্তায়?’
নাহিদ কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলে,
‘ না পস্তালে না পাস্তাবে। তাতে কী? সে না পস্তালে আমাদের পস্তাতেই হবে, এই রকম চিন্তা বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে আয়। নিজেকে কখনও দুটো অপশনের মাঝে ফেলে অসহায় বানিয়ে ফেলবি না। দেয়ার আর কাউন্টলেস অপশনস্ ইন দিস ওয়ার্ল্ড। ইউ জাস্ট হ্যাভ টু কিপ ইউর আইস ওপেন। দ্যাটস্ ইট!’
সৌধ ঠোঁট চেপে নাহিদের নিরুত্তাপ মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। নাহিদ মুখ ফুলিয়ে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে সিগারেটটা চায়ের কাপে ডুবিয়ে দিয়ে বলল,
‘ কী বলতে চাস বলে ফেল।’
সৌধ খেঁকিয়ে উঠে বলল,
‘ বা* অপশন আছে। সম্পাদকের সামনে যে খুব বড় মুখ করে আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়ে এলি আমাদের অনেক অপশন? সেই অপশনটা কোন প্রহরে পয়দা হলো? এই মুহূর্তে আমাদের কাছে কোনো অপশন নেই। কিন্তু ভাবসাব দেখিয়ে এলি, আল জাজিরা থেকে প্রপোজাল এসে বসে আছে।’
নাহিদ হো হো করে হেসে উঠল। খুব মজা পেয়েছে এমন চনমনে কণ্ঠে বলল,
‘ মনের আল-জাজিরাই বড় আল জাজিরা মনা। ব্যাটার মুখটা কী রকম কালো হয়ে গিয়েছিল দেখেছিস? অলরেডি কিন্তু একটা টেনশনে পড়ে গিয়েছে?’
সৌধ হেসে ফেলল,
‘ তা পড়েছে।’
নাহিদ চোখের কোণে কৌতুকী হাসি নিয়ে বলল,
‘ ব্যাটার চ্যানেলের টিআরপি বাড়াতে আমাদের তথ্যগুলো তার দরকার। আমরা নিশ্চিন্তে বেরিয়ে এসেছি। আমাদের নিশ্চিন্ত দেখে তার দুশ্চিন্তা ঊর্ধ্ব গতিতে বাড়বে। সে চিন্তা করবে, আমরা যদি এই তথ্য-উপাত্ত অন্য কোনো চ্যানেলের কাছে বিক্রি করে দিই? অথবা আরও ভালো অফারে অন্য কোনো খবরের কাগজে যোগ দিয়ে ফেলি? আমাদের নিরুত্তাপ মুখ বলে দেবে, এই সমস্ত সুযোগগুলো আমাদের হাতে প্রতুল পরিমাণে আছে। এই তথ্য ফাঁস হলে খবরটা যে কমপক্ষে এক মাস ট্রেন্ডিং-এ থাকবে সেটা সম্পাদক মহাশয় খুব ভালো করে জানেন। চিন্তায় চিন্তায় ব্যাটা পাগলা কুত্তা হয়ে যাবে, মাম্মা।’
সৌধ মাথা ঝাঁকাল। আবার কী ভেবে বলল,
‘ যদি এরকম চিন্তা না করে?’
নাহিদ নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল,
‘ তাহলে আর কী? তথ্য, ফুটেজগুলো চড়া দামে বেঁচে দেব।’
সৌধ চোখ বড় বড় করে বলল,
‘ বেঁচে দিবি? সত্যি সত্যি বেঁচে দিবি?’
‘ হ্যাঁ, বেঁচব। এতো কষ্ট করে, জীবন পানি করে তথ্য, উপাত্ত, ফুটেজ সংগ্রহ করলাম আর বাল ব্যাটায় চায় সেখানে আমাদের নাম থাকবে না? সম্পাদকের দুটো মধুর কথায় আমরা ভুলে যাব? যদি নাম না’ই থাকবে তাহলে টাকা থাকুক। তাকে ফ্রীতে কেন দিব? এই খবরের দাম আমি এক কোটির কাছাকাছি টাকায় বিক্রি করতে পারব। আর যদি কোনো ভালো জার্নাল আমাদের নামসহ প্রকাশ করতে চায় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। হয় টাকা, নয়তো নাম। কম্প্রোমাইজ শব্দটা আমার ডিকশনারিতে নেই। কারো দিকে হা করে চেয়ে থাকার সময়ও আমার নেই। দেবে না। জোর করে নেব।’
সৌধ বলল,
‘ এই সম্পাদক যদি সব চাল উড়িয়ে দিয়ে একেবারে ভিন্ন কার্ড চালে? বাংলা সিনেমার ভিলেনের মতো, “আমি পাব না তো কেউ পাবে না” চিন্তা মাথায় নিয়ে শত্রুর কানে আমাদের নামটা ভজিয়ে দেয়? এদের হাতে কালি কিন্তু কম না বন্ধু।’
নাহিদ বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসে। সৌধর দিকে ঝুঁকে কণ্ঠ নামিয়ে বলে,
‘ একটা প্ল্যান তো ফিক্সড বন্ধু, আজ হোক অথবা ষাট বছর পর মরতে আমাদের হবেই। ফিক্সড জিনিস নিয়ে এতো আতঙ্ক কীসের? এই মুহূর্তে মরতে হলেও আমার খুব একটা আফসোস নেই। তবে, মারার আগের মুহূর্তে কাউকে ভয়ে কাঁপিয়ে দিতে পারলে মৃত্যুটা আরামের হবে। সম্পাদককে শুধু কাঁপানো নয় তাকে নরকে পাঠানোর ব্যবস্থাও আমার কাছে যথেষ্ট আছে। আমি মরব সে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একা একা বেঁচে থাকবে, সেটা কী আমি হতে দিতে পারি?’
সৌধ অবাক চোখে সামনে বসে থাকা বেপরোয়া ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইল। নাহিদ তাকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে তার ঘাড়ে হাত রেখে নিজের দিকে টেনে এনে বলল,
‘ এতো মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছিস কেন? চুমু খেতে চাস? আয় একটা চুমু খাই।’
সৌধ লাফিয়ে উঠে বলল,
‘ ছিঃ! সর! এতোই যদি চুমু খেতে ইচ্ছে হয় তাহলে তোর প্রেমিকার কাছে যা।’
নাহিদ একটা সিগারেট ধরিয়ে ঠোঁট টিপে হাসে। গালভর্তি রুক্ষ দাড়ির ভিড়ে হঠাৎ নজরে আসা মোহনীয় টোল নাহিদের একহারা ধারালো চেহারায় অদ্ভুত এক মায়া ঢালে। ক্রাচ হাতে বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে,
‘ সে ওই টাইপের মেয়ে না। সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাবা-মায়ের আদর্শ বড় কন্যা। ওকে চুমু খেতে হলে আগে বিয়ে করতে হবে। নয়তো ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে। আপাতত তুইই ভরসা।’
সৌধ অগ্নি দৃষ্টিতে নাহিদের দিকে তাকায়। এক লাফে বন্ধুর থেকে দশ হাত দূরে গিয়ে বলে,
‘ খবরদার আমার কাছে আসবি না তুই।’
নাহিদ গলা ছেড়ে হাসে। ঠোঁট টিপে হাসি থামানোর চেষ্টা করে করুণ স্বরে বলে,
‘ তুই তো দেখি মেয়েদের মতো কষ্ট দিয়ে কথা বলছিস। এমন করা কী ঠিক? কাছে আয়।’
সৌধ আরও দু’পা পিছিয়ে যায়। নাহিদ হাসি চাপার প্রাণপণ চেষ্টা করে এগিয়ে আসে। সৌধ পেছন ফিরে প্রাণপণ দৌঁড় লাগিয়ে চিৎকার করে বলে,
‘ নাহিইদ্দা! শালা! তোকে আমি খুন করব।’
এই অলস দুপুরের সকল আলস্য ভেঙে কৌতুহলী কিছু দৃষ্টি দেখতে পায়, অকস্মাৎ কোথায় যেন অদ্ভুত এক চাঞ্চল্য ঘটে গেল। রৌদ্র তপ্ত রাস্তা ধরে প্রাণপণে ছুটে চলেছে দুজন তরুণ। একজনের হাতে ক্রাচ। ক্রাচ হাতেই কী অবলীলায় ছুটে চলেছে সে। দু’জনই গলা ফাটিয়ে হাসছে। বিশ্রি গালিগালাজও বেরিয়ে আসছে সেই হাসির মূর্ছনার ফাঁকে ফাঁকে।
প্রাণপণ দৌঁড়ে মগবাজার ফ্লাইওভারের কাছে এসে থামল ওরা। সৌধ উবুড় হয়ে হাঁটুতে দু’হাতের ভর রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘ শালা! দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে কারওয়ান বাজার থেকে মগবাজারে নিয়ে চলে এসেছিস। এতোই যদি তোর স্ট্যামিনা। তাহলে তোর বিয়া পাগল দাদ্দুকে বলে একটা বিয়া করতে পারিস না? ভদ্রলোকের তো পাত্রী আর আগ্রহ কোনোটারই অভাব নাই।’
নাহিদ কয়েক হাত দূরে কোমরে হাত রেখে হাঁপাচ্ছিল। সৌধের কথায় ভীষণ চমকেছে এমন আশ্চর্য হয়ে বলল,
‘ ওয়ান্ডারফুল আইডিয়া দিয়েছিস তো! এ্যা রাতে এ্যা মৌসম… একটা রাতের পরি হলে জমে যায়। জীবন-যৌবন তো সব ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে।’
সৌধ সোজা হয়ে দাঁড়াল। কোমরে হাত রেখে বার কয়েক প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়ে আগ্রহ নিয়ে বলল,
‘ বন্ধু, আমার জন্যও একটা। আমার বাপের ভরসায় থাকলে জীবনেও আমার আর বিয়ে টিয়ে হবে না। তোর দাদ্দুকে বল, আমাকে মেয়েদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে।’
নাহিদ হেসে ফেলল। সৌধের কাঁধ হাত রেখে দুই বন্ধু হেলতে দুলতে এগিয়ে গেল সামনে। টাউজারের নিচে ব্যান্ডেজ করা পা’টা বোধহয় একটু রক্তাভ হয়ে উঠেছে। নাহিদ সেসব তোয়াক্কা না করে বলল,
‘ এই অবসরে তাহলে দুই তিনটা বিবাহই করে ফেলা যাক। কী বলিস?’
সৌধ মনে করিয়ে দিল,
‘ তিনটা পর্যন্ত এসে আটকাইস। ভাবী চার নম্বর বউ হতে রাজি হবে কি-না জিজ্ঞেস করে নেওয়া উচিত না?’
নাহিদ চোখ টিপে বলল,
‘ আরে, চার নাম্বার হতে রাজি না হলে পাঁচ নাম্বার হওয়ার সুযোগ করে দিব। অপশনস্ মাই ডিয়ার অপশনস্। ’
______________
আকাশে ধূসর গোধূলির হাতছানি। একটু পরই গাঢ় কালো পর্দার মতো নেমে আসবে সন্ধ্যা। মিথি দাঁড়িয়ে আছে গুলশানের একটা প্রকান্ড বাড়ির সামনে। বাড়িটা সাফাতের। সাফাতের সাথে তার এপয়েন্টমেন্ট ছিল দুপুর বারোটায়। সে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে সন্ধ্যা ছয়টায়। শুধু সাফাত কেন? দুনিয়ার কোনো মানুষই ছয় ঘন্টা অপেক্ষা করে বসে থাকার কথা না। মিথি জানে। তবুও এসেছে। দারোয়ান মিথিকে দেখেই ভুরু কুঁচকে ফেলল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘ এখানে কী চাই? এপয়েন্টমেন্ট আছে?’
মিথি জানাল, এপয়েন্টমেন্ট আছে। কিন্তু কখন এপয়েন্টমেন্ট সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বলল,
‘ বিশ্বাস না হলে, আপনার স্যারকে টেলিফোন করে ক্রস চেইক করে নিতে পারেন। আমার কোনো সমস্যা নেই।’
মিথি ভেবেছিল, সাফাত টেলিফোন পেয়ে বিরাট হৈ-চৈ শুরু করবে। মিথিকে ভয়ংকর অপমান, অপদস্ত করে দূর করার নির্দেশ দিবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। দারোয়ান টেলিফোন রেখে গম্ভীর মুখে গেইট খুলে দিয়ে বলল,
‘ স্যার অপেক্ষা করছেন। ভেতরে চলে যান।’
মিথি এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় বিস্মিত হলো। বাড়ির হল রুমে ঢুকতেই পাখির মতো উড়ে এলো সাফাতের এসিস্ট্যান্ট। তার চোখ-মুখ শক্ত। মিথিকে যে সে দু’চোখে সহ্য করতে পারে না তা যেন গায়েবি উপায়ে কেউ তার চেহারায় খোদাই করে দিয়েছে। আলাদা করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এসিস্ট্যান্ট বিরক্ত মুখে বলল,
‘ আপনার এপয়েন্টমেন্ট কয়টায় ছিল?’
মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ বারোটায়।’
ভদ্রলোক খেঁকিয়ে উঠে বলল,
‘ তাহলে এতোক্ষণে আসছেন কোন আক্কেলে? আপনার ধারণা সবাই আপনার মতো মশা মারে? কাজকর্ম নেই? আশ্চর্য!’
মিথি শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ আপনার স্যার কী আমার সাথে দেখা করবেন? দেখা করলে আসতে বলুন নয়তো আমি চলে যাই। আমার শরীরটা আজ ভালো নেই। আপনার চেঁচামেচিতে মাথা ঘুরছে। চেতনা হারালে আবার আরেক সমস্যা। কাল নিউজপেপারে বেরুবে, অভিনেতা সাফাতের বাড়ি থেকে অবচেতন অবস্থায় পাওয়া গেল মোখলেসুর আলমের সহকারী পরিচালক মিথিলাকে। বিষয়টা কী ভালো দেখাবে?’
এসিস্ট্যান্ট থতমত খেয়ে গেল। মিথির দিকে ভয়ংকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গেল সাফাতকে ডাকতে। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিচে নামল সাফাত। থমথমে মুখে মিথির সামনের সোফায় বসল। মেঘস্বরে বলল,
‘ আপনি কী নিজেকে খুব বিশাল কোনো ব্যক্তিত্ব মনে করেন?’
মিথির আজ কী হয়েছে কে জানে? সে হেসে ফেলে বলল,
‘ এমনিতে মনে করি না। তবে আজ মনে হচ্ছে। জনপ্রিয় অভিনেতা সাফাত আমার একের পর এক দুঃসাহসকে ক্ষমা করে দিচ্ছেন। নিজেকে বিশাল না ভেবে উপায় আছে?’
সাফাতের মুখ আরও গম্ভীর হয়ে গেল। রূঢ় কণ্ঠে বলল,
‘ আপনাকে দুই মিনিট সময় দিচ্ছি। আপনার যা বলার আছে বলে বেরিয়ে যান। জাস্ট বেরিয়ে যান।’
মিথি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সাফাত খেয়াল করে দেখল, মেয়েটিকে আজ অন্যরকম লাগছে। একদম অন্যরকম। শুটিং সেটের গম্ভীর, মেকি হাসি, মেকি কথার মেয়েটির মতো নয়। নীল শাড়ি, ল্যাপ্টানো কাজল, এলোমেলো খোঁপায় একদম অন্যরকম কেউ। যার প্রতি হুট করে রেগে যাওয়া যায় না। এই পানপাতার মতো ঢলঢলে মুখের দিকে তাকিয়ে কেবল তরল হয়ে যাওয়া যায়। মিথি চোখ নামিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল। তারপর মুখ উঠিয়ে সরাসরি তাকাল সাফাতের দিকে। শীতল কণ্ঠে বলল,
‘ শুটিং সেটে যে মিসম্যানেজমেন্ট হয়েছে তার জন্য আমি দায়ী। তার জন্য আমি দুঃখিত। সেটা জাস্ট একটা এক্সেপশনাল ছিল। অনেকটা দুর্ঘটনাই বলা যায়। কিন্তু আপনি জেনে-বুঝে বিষয়টাকে যতটা বাড়িয়েছেন আমার কাছে মনে হচ্ছে, আপনার প্রতি আমার আর দুঃখিত হওয়া উচিত না। আমি দুঃখিত হয়েছি; সেটাই বরং আমার ভুল। একটা ভুলের জন্য আপনি আমার পুরো ক্যারেয়ার নষ্ট করে দিয়েছেন। শুধু আমার ক্যারিয়ারই নয় অন্য একজনকে টেনে এনে অপমানিত করেছেন। এটাকে আমার কেবল ক্ষমতার দম্ভ বলে মনে হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে দাম্ভিক মানুষ আমি খুবই অপছন্দ করি।’
মিথি আবারও চোখ নামিয়ে হাত ঘড়িতে সময় দেখল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ আপনার বেঁধে দেওয়া সময়ের এখনও এক মিনিট বাকি আছে। এই এক মিনিট আমার প্রয়োজন নেই। আপনি দাম্ভিক হলেও আজকের বিনয়ের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। আসছি।’
সাফাত কোনো প্রত্যুত্তর না করে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। সে ভেবেছিল, মিথি বোধহয় তার কাছে ক্ষমা চাইবে। বিভিন্ন রকম এক্সপ্লেনেশন দিবে। রিকুয়েষ্ট করবে। কিন্তু একি! সাফাত বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেল না। শুটিং সেটের মেয়েটি কখনও এই রকম কড়া করে কথা বলে না। ফরমাল, মেকি মেকি কথা বলে। সবকিছুতে মানিয়ে নেওয়ার নিদারুণ প্রচেষ্টা থাকে। সেই প্রচেষ্টা আজ তা কোথায় গেল? সাফাত অনেকটা সময় স্তব্ধ হয়ে বসে থেকে পাশে দাঁড়ান এসিস্ট্যান্টকে বলল,
‘ আশরাফ? খবর নাও তো। এই মেয়েটি কী সত্যিই সেই মেয়ে? নাকি তার কোনো জমজ বোন? স্ট্রেঞ্জ! ভেরি স্ট্রেঞ্জ!’
_________________
চারদিকে যখন আজানের মোহনীয় ধ্বনি বেজে উঠল তখন মৌনি রাস্তা ধরে হাঁটছে। সেই সকালে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এই এতোক্ষণে ঘরে ফিরছে ভেবেই বিরক্তিতে নাড়িভুড়ি উল্টে আসছে মৌনির। সারারাত না ঘুমিয়ে মৌনি ভেবেছিল হাতের কাজটা অফিসে জমা দিয়ে বাড়ি ফিরে সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমাবে। কিন্তু সেই মধুর স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে তাকে জোর করে তিনটা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে বসিয়ে রেখেছে মিষ্টি। মৌনির মেজাজ আবারও বিগড়াতে শুরু করল। সে আরামপ্রিয় মানুষ। কেবল তার আরাম নষ্ট হবে ভেবে গ্রাজুয়েশনের পড়া পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখে না সে। এই দুই দিনের জীবনে নিষ্পাপ আত্মাকে অকারণ কষ্ট দেওয়ার পক্ষপাতি সে না। খেয়ে পরে বাঁচতে হয় বিধায় খবরের কাগজে টুকটাক লেখা পাঠানো, কার্টুনের কাজগুলো হৃদয়ে পাথর রেখে করে মৌনি। নয়তো সারাদিন সে কেবল বই পড়ত আর ঘুমাত। জীবন হতো জান্নাতের মতো আরামের। কিন্তু সেই আরামের জান্নাতে সবটা সময় ইবলিশ হয়ে আবির্ভূত হয় মিষ্টি। জোর করে ধরে নিয়ে যায় ভার্সিটির নানান রকম ইভেন্টে। এসবে নাকি স্কিল ডেভেলপ হবে। আরে বাপ! মৌনির ঘুম ডেভেলপ না হলে সে স্কিল দিয়ে করবে কী? মূর্খ রমণী। নাহিদ এক মূর্খ। পছন্দ করেছে আরেক মূর্খ। রাগে গজগজ করতে করতে বাড়ি ফিরে মৌনি। নিজের ঘরে পৌঁছে বিছানায় চার হাত-পা চারদিকে মেলে দিতেই মাথার ভেতর কুটকুট করে কমড়াতে থাকে সারাদিনের চিন্তাটা, আজ শাওনের জন্মদিন। মৌনির বিগড়ানো মেজাজ এবার বিস্ফোরণ দাবী করে। এমনিতে তো কোনো ডেট ফেট মনে থাকে না। আজ যখন চিন্তা করেছে, শাওনকে উইশ করবে না। একটা মানবিক দায়িত্ব পালন করবে। তখনই স্মৃতিশক্তিরা হাউমাউ করে উঠেছে। কিছুতেই তারা ভুলে যেতে দিবে না। আজ শাওনের জন্মদিন ভিত্তিক একটা উপন্যাস লিখে ফেলতে পারলে তারা আরও আমোদিত হয়। মৌনির এতো রাগ দেখে ভেতরের আত্মা যেন বাকশক্তি প্রাপ্ত হলো। বলল,
‘ কেন এতো রাগ করছিস? একটা ভালো বন্ধুর জন্মদিনে আরেকজন ভালো বন্ধু শুভেচ্ছা জানাবে সেটাই কী স্বাভাবিক না? শাওন কী ভাবল না ভাবল তাতে তোর কী? তুই স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিস। তারপরও সে আশায় বুক বাঁধলে তোর দায় কোথায়? তার জন্য তুই কেন বন্ধুত্বের দায়িত্ব এড়িয়ে যাবি?’
কথা সত্য! মৌনি চট করে উঠে বসল। দ্বিতীয়বার কোনো ভাবনা না ভেবে সরাসরি ফোন লাগাল শাওনকে। শাওনের কাছে যখন ফোনটা গেল তখন সে সুদূর চট্টগ্রাম শহরের ভাটিয়ারীতে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে বৈমানিকের প্রাথমিক প্রশিক্ষণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রকৃতিতে তখন সন্ধ্যার আয়োজন। তেজী সূর্য কোনো এক রসিকতায় নববধূর মতো মুখ লুকাচ্ছে আকাশের বুকে। শাওন বাইরে দাঁড়িয়ে একজন সিনিয়রের সাথে কথা বলছিল। তার মধ্যে ফোনটা বেজে উঠে শাওনকে তীব্র এক অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিল। দ্রুত পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কেটে দিতে নিয়েও কলার আইডির দিকে তাকিয়ে থমকে গেল তার হৃদয়। এই মেয়েটির কল কেটে দেওয়ার, তাকে সেকেন্ডের জন্য প্রত্যাখান করার ক্ষমতাও শাওনের নেই। শাওন শেষমেশ নিজের ক্যারিয়ারে রেড লাইট জ্বালিয়ে সিনিয়রকে এক্সকিউজ করে জায়গা থেকে সরে এলো। সিনিয়র কী মনে করবে, বিষয়টা কোথায় কী দাঁড়াবে এসবের দুশ্চিন্তার মাঝেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো উচ্ছল, রিনরিনে কণ্ঠস্বর,
‘ শাওন! শাওন! শাওন!’
শাওনের মস্তিষ্ক মুহূর্তের জন্য ফাঁকা হয়ে গেল। সিনিয়র, ক্যারিয়ার, দুশ্চিন্তা সব ভুলে তার হৃৎস্পন্দন যেন থমকে গেল। হেসে বলল,
‘ ইয়েস, ম্যাডাম। বলুন। হঠাৎ এতো খুশি? ঘটনা কী?’
মৌনি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,
‘ হ্যাপি বার্থডে শাওন!’
শাওন চমকাল। মনে মনে মৌনির শুভেচ্ছা পেতে চাইলেও, তার চনমনে কণ্ঠ শোনার দুর্বার ইচ্ছে হলেও সে ভাবতে পারেনি মৌনির তার জন্মদিনের কথা মনে থাকবে। এই অপ্রত্যাশিত আনন্দে শাওনের মনে হলো তার বুকের ভেতর শীতল একটা ঢেউ বয়ে গেল। মৌনি তার সহজাত স্বভাবে কলকল করে বলল,
‘ এখন একদম বলবা না যে আমি লেইট। আমি একদম সঠিক সময়ে উইশ করেছি। খালামনিকে তুমি জিজ্ঞেস করে দেখো, তুমি আজকের তারিখে ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় জন্মেছ। এর আগে যারা উইশ করেছে তারা সবাই রং। শুধু আমারটা ঠিক। মৌনি অলওয়েজ রাইট।’
শাওন হেসে ফেলল। মৌনিকে এই মুহূর্তে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু তা সম্ভব না। এই বাইশ বছরের জীবনে, বোধশক্তি হওয়ার পর, মৌনির হাত ধরার সাহসও শাওনের হয়নি। আচ্ছা? মৌনি কী কখনও, কোনো একদিন নিজে থেকে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে না? একদিন নাহয় সব নিয়ম ভেঙে ঝাপিয়ে পড়ল? এক মিনিট? অথবা এক সেকেন্ডের জন্য? তারপর নাহয় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেল? শাওনের মৃত্যু হলো? তাতেই বা কী এসে যায়? কিচ্ছু এসে যায় না শাওনের। মৌনি এক সেকেন্ডের জন্য তাকে ভালোবাসলে। শাওন সেই এক সেকেন্ডের জন্য হাসিমুখে বিসর্জন দিবে তার প্রাণ। শাওন নিজের উত্তেজনা চেপে রেখে হাসিমুখে বলল,
‘ ইয়েস, ইউ আর রাইট। ইউ আর অলওয়েজ রাইট মন।’
চলবে…
নৌশিন আহমেদ রোদেলা