আজ ওদের মন ভালো নেই ৯.

0
178

আজ ওদের মন ভালো নেই

৯.

চৈত্রের সকাল।
মিথির ঘুম ভাঙল গরমের আতিশয্যে। গায়ের পাতলা টি-শার্ট ঘামে ল্যাপ্টে আছে। চুলের গোড়া, কপাল, গাল, গলা চটচট করছে। ঘুম ভেঙে মিথির সর্বপ্রথম মনে হলো, এই বিচ্ছিরি চুলগুলো অতিশীঘ্রই ফেলে দেওয়া উচিত। ন্যাকা মেয়েরা কেন যে এতো চুল চুল করে আহ্লাদ করে কে জানে? গরম বাড়ানো ছাড়া এই চুলের কী আর কোনো কাজ আছে? মিথি চটজলদি বিছানা থেকে নেমে গেল। এই সকাল বেলাতেই বিছানাটা তাওয়ার মতো তেতে আছে। বরফ ঠান্ডা পানিতে লম্বা একটা গোসল নেওয়া গেলে আরাম হতো। কিন্তু বিধিবাম! বাথরুমে ঢুকা মাত্র জানা গেল, পানি নেই। মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গ্রামের বাড়িতে এই এক সমস্যা। বিশাল বাড়িতে চাকর-বাকর মিলিয়ে প্রায় অর্ধ-শত মানুষের বাস। সর্বক্ষণ মোটর চলছে। তারপরও বিদ্যুৎ যাওয়ার ঘন্টাখানেকের মধ্যে দেখা যাবে, পানির সংকট। পুরুষদের জন্য অবশ্য ‘পানি সংকট’ খুব বড় কোনো বিষয় না। দাদাজান তার রাজত্বে খুব শখ করে দুটো দিঘি কাটিয়েছেন। বাড়ির বাচ্চা ছেলেরা সারাদিন সেই পুকুরে দাপাদাপি করে। মিথি গলায় তোয়ালে আর মুখে মার্জনী নিয়ে নিচে কল তলায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সমস্ত বাড়িতে হৈ হৈ শোরগোল। কে কোথায় কী নিয়ে চেঁচামেচি করছে, বলা মুশকিল। মিথি দু’তলায় নামতেই বড় চাচার কণ্ঠ শুনতে পেল। বড় চাচা ভয়ংকর ক্ষেপে আছেন। তার প্যান্টের বেল্ট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বড় চাচার দৃঢ় ধারণা, বেল্টটা ছোট চাচ্চু সরিয়েছে। মিথির ছোট চাচা সচিবালয়ে চাকরি করেন। বেশ ভালো চাকরি। মাস শেষে মোটা অঙ্কের বেতন পেলেও তিনি অধিকাংশ সময় ভাইদের জামা-কাপড় পরে গর্বের সাথে ঘুরে বেড়ান। তার বোধহয় নিজের জামা-কাপড় পরতে খুব একটা ভালো লাগে না। বড় চাচা ধমক দিয়ে বললেন,

‘ আমি নিশ্চিত বেল্টটা শফিক সরিয়েছে। ওকে আমি ছেড়ে দেব ভেবেছ? ওর নামে আমি মামলা করব।’

প্রত্যুত্তরে বড় চাচির কণ্ঠ শোনা গেল। মিথির বড় চাচি চমৎকার রমণী। লন্ডন থেকে ডাক্তারি ডিগ্রি হাঁকিয়ে দিনরাত কাজ করছেন দাদাজানের গ্রামের হাসপাতালে। বড় চাচা আর চাচির বিয়েটাও দাদাজানের ‘আকস্মিক বিবাহ’ থিওরির একটা উদাহরণ। মিথি ভেবে আশ্চর্য হয়, দাদাজান কী করে এমন চমৎকার চমৎকার মানুষগুলোকে এই রকম আশ্চর্য বিয়ের মধ্যে বেঁধে ফেলেন? মিথি বড় চাচির উত্তর শোনার জন্য একটু দাঁড়াল। চাচির কথা বলার ভঙ্গিমা চমৎকার। কণ্ঠ শুনলেই ‘মধুকণ্ঠী’ শব্দটা মাথায় ঢপ খেয়ে বেড়ায়। ইশতিয়াকের মধ্যেও এই গুণটা প্রবল। বড় চাচি শান্ত স্বরে বললেন,

‘ তুমি সামান্য বেল্টের জন্য ছোট ভাইয়ের নামে মামলা করবে?’

বড় চাচা ক্ষ্যাপা স্বরে বললেন,

‘ অবশ্যই করব। স্কাউন্ড্রেলটার কত বড় সাহস! আমি বাবার কাছে একটা সিরিয়াস বিচার চেয়ে পোস্ট করেছি সে সেখানে হা-হা দিয়েছে!’

বড় চাচার উত্তরে হতবুদ্ধি হয়ে গেল মিথি। ধীরে ধীরে নেমে গেল নিচের তলায়। নিচের তলার অবস্থা আরও ভয়াবহ। ছোট ফুপু খুব চোটপাট করছেন। কে যেন তার সুটকেস থেকে টুথপেষ্ট সরিয়েছে। এই বাড়িতে টুথপেষ্ট একটা বড় ফ্যাক্ট। এই ‘বড় ফ্যাক্ট’-টিকে ছোট ফুপু শ্বশুর বাড়ি থেকে বয়ে এনেছিলেন। কিন্তু সকাল হতেই উধাও। বড় ফুপুর সমস্যা আবার ভিন্ন রকম। তার চায়ে চিনি বেশি হয়েছে। বড় ফুপুর ডায়েবিটিস আছে। তিনি খুব হল্লা করে প্রচার করছেন, এই চিনি ঘটিত ঘটনায় নিশ্চয় কারো গোপন অভিসন্ধি আছে। মিথি সকল ঘটন-অঘটন পাশ কাটিয়ে কল তলায় চলে গেল। হাতে-মুখে পানি ছিটাতেই কোথা থেকে উড়ে এলো ফরিদা খালা। মিথিকে দেখে খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠে বলল,

‘ আপামণি, আপনে নিচে আসছেন কেন? আমারে জানাইলে বালতি ভরা পানি নিয়া আমি ফরিদা চলে যেতাম তিন তলায়। দাদাজানের কঠিন হুকুম, নববধূকে আরাম আয়েশে রাখতে হবে। নববধূ কাজকাম করবে শ্বশুর বাড়ি গিয়া। বাপের বাড়ি তার আরামের জায়গা। এইখানে কাজকাম করা খারাপ দেখায়।’

মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলে এক নজর ফরিদা খালার দিকে তাকাল। এই বাড়ির আরও একটি আশ্চর্যের মধ্যে ফরিদা খালা হলেন উল্লেখযোগ্য। ফরিদা খালা লাফিয়ে এসে বললেন,

‘ আপামণি আপনি হাত-মুখ ধোন। আমি চাপ দিতেছি। আপনের নরম হাত দুক্কু করার দরকার কী?’

মিথি শান্ত কণ্ঠে বলল,

‘ দরকার নেই। আমি নিজের কাজ নিজে করতেই পছন্দ করি।’

ফরিদা খালা সেসবে কান না দিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। আগ্রহ নিয়ে বললেন,

‘ বিয়ের পর আপনার রূপ খুলছে আপামণি। রতনের আব্বার সঙ্গে আমার যখন বিয়া হল? দেখতে ছিলাম পেত্নীর মতন কালা। শ্বশুর বাড়িতে এক রাত কাটাইলাম। সকালে উইঠা দেখি কীসের কালা কীসের কী? ঝলমল করতেছে গায়ের রঙ।’

মিথি বিরক্তি নিয়ে তাকাল। এই ধরনের হালকা চালের গাল-গল্প তার খুবই অসহ্য আর নোংরা ঠেকে। মাঝেমধ্যে গা ঘিনঘিন করে। মিথি কঠিন কণ্ঠে এক কাপ চায়ের আদেশ দিয়ে দ্রুত নিজের ঘরে ফিরে এলো।

__________

মিথি ঘরের ভেতর পা রাখতেই শুনল ক্ষুধার্ত বাঘের মতো চিৎকার করছে মৌনি। চিৎকারটা মিথির প্রতি নয় সর্বসাকুল্যে,

‘ ফ্যান কে বন্ধ করেছে? হু ইজ দ্য কালপ্রিট? ফ্যান চালু করো। এক্ষণ চালু করো। আমি ঘুমালেই যত গজব পড়ে এই বাড়িতে।’

মিথি বিরক্ত চোখে বিছানায় গা-হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকা মৌনির দিকে তাকাল। মেয়েটার চোখ বন্ধ। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই সে সকলের গোষ্ঠী উদ্ধার করে ফেলছে।

‘ আমি কিন্তু সারা বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিব। ফ্যান দাও!’

ঋতি মেঝেতে বসে যোগ ব্যায়াম করছিল। মিথি যদিও আগে কখনও কাউকে এই গরমে, সূর্য মাথায় নিয়ে যোগ ব্যায়াম করতে দেখেনি। তারপরও কিছু বলার প্রয়োজনবোধ করল না। ঋতি ঘাড় ফিরিয়ে মৌনির দিকে তাকাল। বিরক্তি চেপে হাসি হাসিমুখে বলল,

‘ কেউ ফ্যান বন্ধ করেনি মৌপু। বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে। দুনিয়ার সবাই ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে তুমি এখনও উঠছ না কেন? আর কত ঘুমাতে হয়?’

ঋতির শেষ কথাটায় সূক্ষ্ম বিরক্তি প্রকাশ পেল। প্রায় সাথে সাথেই তার মুখের দিকে উড়ে এলো একটা কুশন। চোখ বন্ধ রেখেই কঠিন ধমক দিল মৌনি,

‘ উইদ রেসপেক্ট।’

ঋতি সাথে সাথেই দুই হাত জড়ো করে কৃত্রিম আদব নিয়ে বলল,

‘ উইদ রেসপেক্ট, আপনি প্লিজ এবার জেগে উঠুন মহারাণী?’

মৌনি জেগে উঠল না। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। মিথি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই সঙের বাড়িতে প্রতিবারই বিরক্তিতে দমবন্ধ হয়ে আসতে চায় তার। চারদিকে রঙিন সার্কাস। তার মধ্যে একটা ক্লাউন হলো স্বয়ং মৌনি। এই প্রচণ্ড বেপরোয়া মেয়েটিকে মাঝে মাঝে অসহ্য বলে বোধহয় মিথির। এমনিতে তাদের দেখা হয় কম। সবাই যার যার জীবন নিয়ে মগ্ন থাকে। কিন্তু তিন/চার মাস অন্তর একই জেনারেশনের ভাই-বোনেরা সব কাজ ফেলে নির্দিষ্ট একটা দিনে নাড়ির টানে ফিরে আসে বাড়ি। হৈ-হুল্লোড় করে দু-একদিন কাটিয়ে আবার হারিয়ে যায় নিজের কাজে। এই সময়গুলোতে একই ঘরে তিন থেকে চারজন করেও থাকতে হয় তাদের। মৌনি আর ঋতি থাকে মিথির ঘরে। মৌনি রাতে ঘুমায় না। ঘরের আলো জ্বালিয়ে বই পড়ে। লেখালেখি করে। কীসব আঁকাআঁকি করে। কখনও-বা হেডফোন লাগিয়ে নাচে। সবাইকে জ্বালিয়ে ঘুমুতে যায় ভোর রাতে। সে ঘুমালে আবার অন্য নিয়ম। কোথাও কোনো শব্দ সে বরদাস্ত করবে না। কেউ আলো জ্বালাতে পারবে না। জোরে কথা বলতে পারবে না। আশ্চর্যের বিষয়, আশেপাশের সকলে সেটা মেনেও নেয়। মৌনির জন্য কোনো নিয়ম নেই কিন্তু তার বেঁধে দেওয়া নিয়ম সকলে মেনে চলে অক্ষরে অক্ষরে। মৌনিকে কেউ ধমক দিবে, তার কথার উত্তরে বিরক্ত হবে এসব মৌনির পছন্দ না। মৌনি সেই ‘অপছন্দ’ মিথির মতো মনের ভেতর আটকে রাখে না। সকলকে ধমকাধমকি করে অস্থির করে তোলে জানায়, এসব সে বরদাস্ত করবে না। এবং আশ্চর্য! তাকে এসব বরদাস্ত করতেও হয় না। মৌনির সাথে সকলেই কথা বলে আহ্লাদ দিয়ে। ওর বাঁধভাঙা হাসিতে কেউ চোখ রাঙানোর সাহস পায় না। মৌনি ভীষণ অলস আবার মৌনিই প্রাণ চঞ্চল। যখন ইচ্ছে বিছানায় পড়ে থাকছে। যখন ইচ্ছে পাখির মতো উড়ে উড়ে একা হাতে সব কাজ করে ফেলছে। সবার সাথে তার সখ্যতা। যেকোনো উৎসবে সকলের সবার আগে মনে পড়ে মৌনির কথা। এতো এতো মানুষ এই বাড়িতে। অথচ মৌনি তাদের অন্যতম। যেন সে মহারাণী! মিথি চমকালো। আচমকা তার মনে হলো,

মৌনির রাণী হওয়ার অধিকার আছে। মৌনি বেঁচে থাকে আনন্দ নিয়ে। ভালোবাসাকে সে অধিকার মনে করে। দাবি রাখে উচ্চকণ্ঠে। কেউ অধিকার নিয়ে কিছু চাইলে তাকে কী ফিরিয়ে দেওয়া যায়?

মিথির ভাবনার মাঝেই ফরিদা খালা এলো চা নিয়ে। মিথি চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে দাঁড়াল ব্যালকণিতে। কাপখানা রেলিঙের উপর রেখে চুলগুলো চুড়ো খোঁপা করে তাকাল বাড়ির সম্মুখে। সেখানে খুব হৈ হৈ করে বিয়ের প্যান্ডেল সাজানো হচ্ছে। দাদাজান নিজের সন্তানদের বিয়েতে কখনও কোনো আয়োজন করেন না। কিন্তু বছরে দুই বার ধুমধাম আয়োজন করে এতিম, দুস্থ মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। খরচ করেন অকাতরে। আজ সেই মেয়েদের গায়ে হলুদ। একটু পরই সারি সারি মেয়েরা যাবে পুকুর ঘাটে। তাদের গায়ে থাকবে একই সাজ। নিজের বিয়ের গান তারা নিজেরাই গাইবে আনন্দ নিয়ে। মিথি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তাকাল বাগানের দক্ষিণ দিকে। সেখানে আছে প্রকাণ্ড এক শিরিশ গাছ। তার ছায়ায় জলচৌকি বিছিয়ে কয়েকজন বাদক বাবরি দুলিয়ে বাজনা বাজাচ্ছে। একজন কালো মতোন ছেলে বাঁশিতে সুর তুলেছে। সুরটা মিথির পরিচিত। গানটা তার পেটের ভেতর গুড়গুড় করছে কিন্তু মুখে আসছে না। মিথি গানটা মনে করার প্রাণপণ চেষ্টা করল। এর মধ্যেই ভেতর থেকে চেঁচিয়ে উঠল মৌনি। বাদ্যবাজনায় তার ঘুমের অসুবিধা হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ফরিদা খালাকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। বাদ্যবাদকদের নিচু কণ্ঠে কিছু বলতেই থেমে গেল সব। বাজনা থামলেও মিথির মনে হলো, সুরটা তার মাথায় গেঁথে গেছে। গানের লাইনটা মনে না পড়া পর্যন্ত আর শান্তি পাওয়া যাবে না৷

___________

মৌনির ঘুম ভাঙল দ্বিপ্রহরে। মাথার উপর তখন শাঁ শাঁ করে ফ্যান ঘুরছে৷ ফ্যানের বাতাসে মৌনির আরাম হচ্ছে না। বরং মাথার ভেতর সূক্ষ্ম একটা যন্ত্রণা হচ্ছে। ভালো ঘুম নাহলে এরকম যন্ত্র হয়। মৌনি বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বাগানের দক্ষিণে প্রকাণ্ড শিরিশ গাছের নিচে যেন মেলা বসেছে। গেরুয়া রঙের কাপড় পরে কয়েকটা লোক খুব আমোদ নিয়ে বাদ্য বাজাচ্ছে। বাড়ির বাচ্চাকাচ্চারা তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। মৌনির মাথায় কয়েকদিন যাবৎ নতুন এক উপন্যাস ঘুরঘুর করছে। এ পর্যন্ত তার কোনো উপন্যাসই সমাপ্তির পৃষ্ঠা ছুঁতে পারেনি। মৌনির ধারণা, এইবারের উপন্যাসটা সমাপ্তির দোর ছুঁবে। তার জন্য প্রয়োজন নানান রকম অভিজ্ঞতা। দুঃখের বিষয়, মৌনির অভিজ্ঞতার খাতা শূন্য। দারুণ কিছু লিখে সকলকে চমকে দেওয়ার প্রয়াস মৌনির নেই। সে চায় পাঠকদের সম্মোহন করতে। এমন কিছু লিখে ফেলতে চায় যা বাস্তব, সত্য। যার লাইনে লাইনে গভীর বিস্ময় নিয়ে ঘুরে বেড়াবে পাঠক। চট করে বেরিয়ে আসতে পারবে না। মৌনি গলায় তোয়ালে আর হাতে ব্রাশ নিয়েই বেরিয়ে এলো বাইরে। এই বাদ্য-বাদকদের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করা যাক। অভিজ্ঞতার প্রথম পাতায় থাকুক বাদ্য-বাদকদের নাম। মৌনি হেঁটে গিয়ে শিরিশ গাছের নিচে দাঁড়াতেই বাচ্চারা সব হৈ-হৈ করে ওঠল। মৌনি তাদের সবার প্রিয়। চারপাশে বিয়ে বিয়ে গন্ধ, আনন্দ, বাচ্চাদের হৈ-চৈ দেখে মৌনির হঠাৎ করেই মন ভালো হয়ে গেল। অভিজ্ঞতা লাভের পরিকল্পনায় বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাচ্চাদের সাথে মুহূর্তেই বাচ্চা বনে গেল। বাদ্য-বাদকদের বলল,

‘ চাচা, একটা আমুদে বাজনা বাজান তো? বাচ্চাদের সঙ্গে একটু নাচানাচি করি।’

একজন বলল,

‘ পোলাপানের মেল দেখে খুব আমুদ লাগছে। একটা পাহাড়ি গান গাইলে চলব?’

মৌনি বিশাল হাসি দিয়ে বলল,

‘ চলবে চাচা। সব চলবে। আপনি গান।’

বিয়ের বাজনা চোখের পলকে সুর পাল্টাল। চারদিকে ঝমঝম করে উঠল নতুন সুর। গমগমে কণ্ঠ গেয়ে ওঠল,

‘ এ মালতি?
মেলায় যাবি?’

কণ্ঠে ঝংকার। গানের কথায় নয় সুরের দ্যোতনাতেই লাফিয়ে উঠল শিশুরা। ঢোলক বাজল, বাঁশি বাজল। সবগুলো কণ্ঠ থেকে থেকে ধুয়া দিয়ে উঠল,

‘চল সাঁন্ঝে মেলায় যাব
ধামছা মাদল সঙ্গে লুব
তোয়ার লেশায় মাতাল হবে মন…’

নেচে উঠল মৌনি। মৌনিকে নাচতে দেখে অধিক উৎসাহে হর্ষধ্বনি করে উঠল বাচ্চারা। মৌনির আশেপাশে লাফাতে লাগল আনন্দে। সকলে কাজ থামিয়ে অবাক বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইল। দু’তলা-তিন তলার বারান্দায় ভিড় জমে গেল। ভেতর বাড়িতে খবর চলে গেল মৌনি নাচছে। ভেতর বাড়ি থেকে বয়স্ক মহল হা-রে-রে করে ছুটে আসার আগেই সেখানে এসে জুটল আরেক বাঁদর, নাহিদ। গতকাল বিকেলে কাজিন মহলে বাড়ি ফেরার নোটিশ জারি হলেও নাহিদ এসে পৌঁছেছে আজ। বাড়িতে আজ পনেরো জন দরিদ্র, এতিম মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। এতোগুলো মেয়ে চোখের সামনে দিয়ে অন্য পুরুষের বউ হয়ে যাবে, ভাবতেই তো খারাপ লাগে। নাহিদ গভীর কষ্ট নিয়ে লিখেছিল, সে আসবে না। পনেরোজন সুন্দরীর বিয়ে দেখার থেকে তার মৃত্যুও ভালো। তার মৃত্যু দেখতে না চাইলে ডেইট পাল্টে দেওয়া হোক। নিষ্ঠুর ভাই-বোন তার। সবগুলো তার মৃত্যুই চাইল। মৌনি তো একেবারে নাচানাচি করে বলল,

‘ তুই প্লিজ আয়। আমরা বিয়ে দেখতে দেখতে ক্লান্ত। তোর মৃত্যু দেখলে আমাদের ভালো লাগবে। তুই প্লিজ এসে মরে যা।’

মৌনির বার্তায় পড়ল এগারোটা লাভ রিয়েক্ট। একমাত্র সুইট মিথি আপা কোনো রিয়েক্ট ফিয়েক্ট দেয়নি। যদিও সে জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত কোথাও কোনো রিয়েক্ট দিয়েছে কি-না সন্দেহ। তারপরও নাহিদ মনে মনে ভেবে নিয়েছে, মিথি আপা তার মৃত্যু চায় না। এই খুশিতে আপ্লুত হয়ে সে বীর উদ্যমে মরতে চলে এসেছে। পনেরো জন নারীর জন্য নাহয় নাহিদ দিয়ে দিল তার পূতপবিত্র প্রাণ। কীই বা এসে যায় তাতে? গভীর দুঃখ নিয়ে বাড়ির গেইটে এসে নামলেও বাদ্য বাজনার শব্দে বিরহ ভুলে গেল নাহিদ। ব্যাগটা কাজের লোকের হাতের ধরিয়ে দিয়ে হৈ হৈ করে চলে গেল ঢোলের কাছে। ক্রেচ হাতেই মৌনির সাথে তাল মেলাল। সুরের শ্রাদ্ধ ঘটিয়ে বাদকদের সাথে গলাও মেলাল। তাতে অবশ্য আসরের সুর কাটল না। বরং জমে উঠল মজলিশ,

‘ গতরে যৌবন জ্বালা
তোয়ার সঙ্গে পিরিত খিলা
ভালোবেসে মরবো রে দু’জন…’

ভালোবেসে মরার আগেই ভেতর বাড়ি থেকে ফরমান জারি হয়ে গেল। মৌনির মা পারলে লাঠি নিয়ে ছুটে আসেন মেয়ের কাছে। এই মেয়ে এতো বেয়ারা! হাজী বাড়ির মেয়ে হয়ে কি-না নাচানাচি করে এক গ্রাম লোকের সামনে! দাদাজানের এসিস্ট্যান্ট মিস্টার জহিরুল্লাহ মৌনির কাছে এসে নিচু গলায় বলল,

‘ আম্মাজান? ভেতর থেকে আপনার নাচানাচি বন্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। আমি ওয়ান টু থ্রি বলার সাথে সাথে না থামলে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মৌনি ওয়ান, টু, থ্রী বলার আগেই থেমে গেল। অনেকক্ষণ লাফালাফি করে সে ক্লান্ত। ততক্ষণে হৈ-হুল্লোড় করে নিচে নেমে এসেছে ইশতিয়াক, মৈয়ন, আরিফ। তাদের হাত-পা ছুড়াছুড়ি করা নৃত্যের দিকে এক পলক তাকিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে মিস্টার জহিরুল্লাহর দিকে তাকাল মৌনি। ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,

‘ শুধু আমার জন্যই এই ফরমান? ছেলেরা যে নাচছে তার বেলা?’

মিস্টার জহিরুল্লাহ নিচু কণ্ঠে বললেন,

‘ তারা চাইলেই নৃত্য করতে পারে। তাদের পাস আছে। পাস দিয়েছেন স্বয়ং খোদা তা’য়ালা। তাদেরকে তিনি বানিয়েছেন পুরুষ মানুষ করে। পুরুষ মানুষদের উপর ফরমানের ধকল কম।’

মৌনি রুষ্ট চোখে তাকাল। তোয়ালেতে কপালের ঘাম মুছে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে শুধাল,

‘ ভেতরের ঘটনা কেমন? আমাকে কী কঠিন শাস্তি দেওয়ার সম্ভবনা আছে?’

মিস্টার জহিরুল্লাহ অমায়িক হেসে বলল,

‘ জি আম্মাজান, সম্ভবনা আছে।’

মৌনি ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,

‘ এটা তো স্বৈরাশাসন। নিজের ইচ্ছেয় যেখানে একটু নাচানাচিও করা যায় না। সেই শাসন তো বেশিদিন টিকতে পারে না। বলুন, পারে?’

‘ জি না। পারার তো কথা না।’

‘ এই বয়সে নাচব না তো কোন বয়সে নাচব, উত্তর দিন। এই বয়সে আপনি নাচেননি? দাদাভাই নাচেন নাই?’

মিস্টার জহিরুল্লাহ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘ মনে হচ্ছে, নেচেছে।’

মৌনি রুষ্ট কণ্ঠে বলল,

‘ নিজে নাচন করে এখন আমার নাচনে হরতাল! আজ একটা বিদ্রোহ হয়ে যাবে মিস্টার জহিরুল্লাহ। কঠিন বিদ্রোহ।’

মুখে বললেও মনে মনে ভয়ে কাহিল হয়ে পড়ল মৌনি। দাদাজান কঠিন লোক। নির্বিকারমুখে ভয়ংকর সব সৃজনশীল শাস্তি সৃজন করে ফেলা তার জন্য রীতিমতো দুধভাত। কে জানে মৌনির কপালে দাদাজানের ঠিক কোন আবিষ্কারটি শনি হয়ে ঘুরছে?

____________

দ্বিপ্রহরের রোদ্দুর কিছু কমে আসতেই ধীরে ধীরে বিয়ের অতিথিতে ভরে গেল দাদাজানের বিশাল ভিটে। বরযাত্রী, কনেপক্ষ, সাজসজ্জা, দাদাজানের পরিচিত হোমরা-চোমরা বন্ধু-বান্ধবদের ভিড়ে বিয়েটা যে আপাত দুস্থ, অসহায় মেয়েদের সে রকম কোনো ছাপ রইল না। বড় চাচা থেকে শুরু করে বাচ্চারা পর্যন্ত সেজেগুজে তৈয়ার। সবাই বাড়ির মেয়ের বিয়ের মতোই আনন্দ করছে। মিথিদের এই বাড়িতে ভাই বোনদের গ্রুপ হলো চারটি। এক নাম্বার জেনারেশনের সকলেই বিবাহিত। মিথি, মৌনি, নাহিদ, ঋতি, ইশতিয়াক এরা আছে দুই নম্বর জেনারেশনে। আজ তাদের মিলনমেলা। আনন্দও তাদের সর্বাধিক। সকলে সেজেগুজে প্রজাপতির মতো ঘুরছে। সবাই আসলে দাদাভাইয়ের নজর এড়িয়ে তক্কে তক্কে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সকলের চিন্তা একই, কী করে ফার্স্ট ব্যাচে খেতে বসে যাওয়া যায়। মিথিদের এই যে কয়েক মাস অন্তর বাড়ি ফেরা? এই ফেরাতে নাড়ির টান যতটা না আছে। তারচেয়েও আছে খাবারের টান। দাদাজান ভোজনবিলাসী মানুষ। বাড়ির প্রতিদিনের রান্না-বান্নার জন্যই রেখেছেন গ্রাম প্রসিদ্ধ বাবুর্চি। আর এই বিয়েগুলোতে তিনি যে উচ্চমার্গীয় বাবুর্চির ব্যবস্থা করেন তার হাতের রান্নায় থাকে জান্নাতের খুশবু। দিনের পর দিন জীবনযুদ্ধে ক্লিষ্ট ছেলেমেয়েদের মধ্যে সেই খাবার নিয়ে আছে ‘ছেলেবেলার মিঠাই’ পাওয়ার মতো উচ্ছ্বাস। মিথি বিয়ের স্টেজ থেকে কিছুদূরে একলা দাঁড়িয়ে ছিল। মনটা কেমন ভার ভার লাগছে। সাফাতকে মনে আটকে থাকা কথাগুলো বলে ফেলে যে ভারহীন লাগছিল? সে অনুভূতিটা ক্রমশ কমে আসছে। মিথিকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছুটে এলো মৌনি। কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলল,

‘ এতো দূরে দাঁড়িয়ে আছ কেন মিথি আপা? একটু এগিয়ে দাঁড়াও। আমরা প্রথম ব্যাচেই খেতে বসে পড়ব। ঋতি খবর এনেছে, এখনই খাবার দিয়ে দেওয়া হবে। নাহিদ ছিটি বাজানো মাত্র ওর সামনের টেবিলে গিয়ে বসে পড়ব আমরা। পরিকল্পনা একেবারে তৈরি। প্রচুর খাবার চুরি করা হবে। বুড়ো পড়বে একটা ফ্যাসাদে।’

কথাটা বলে খিকখিক করে হাসল মৌনি। মিথি তার হাসিতে যোগ দিতে পারল না। দাদাজানকে তারা কেউই বিশেষ পছন্দ করে না। নিজেদের জীবনের এই ‘শুটকি ভর্তা’ অবস্থার জন্য দায়ী দাদাজানকে ফ্যাসাদে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা তাদের মধ্যে প্রবল। কিন্তু দাদাজান যেন বটবৃক্ষের মতো। সর্বত্র ছড়িয়ে থাকে তার শাখা। বৃষ্টি ফোঁটা যেমন চাইলেই তার ভারী পল্লবাচ্ছাদন ভেদ করে মাটি ছুঁতে পারে না। তেমনই তাদের সৃষ্ট পলকা ফ্যাসাদ দাদাজানের ফরসা কপালে একটা ভাঁজও ফেলতে পারে না। মিথি দাদাজানের আসন্ন ফ্যাসাদ নিয়ে চিন্তিত হলো না। সে মৌনির দিকে তাকিয়ে শুধাল,

‘ মৌনি, তোর কখনও মন খারাপ হয় না?’

মিথির প্রশ্নে খুব আশ্চর্য হয়ে তাকাল মৌনি। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,

‘ হঠাৎ মন খারাপ হবে কেন?’

মিথি মৌনির দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল। আজ ঘরের বাহিরে তার উদ্দাম নাচ-গানের পর দাদাজানের ফরমান জারি হয়েছে। বিয়েটা কেটে গেলে সন্ধ্যার পরপরই জানানো হবে বিচারের রায়। মিথি বলল,

‘ দাদাজানের শাস্তির কথা ভেবে দুশ্চিন্তা হচ্ছে না?’

মৌনি হেসে বলল,

‘ সেটা তো সেই সন্ধ্যার পর। সন্ধ্যার কথা চিন্তা করে এই বিকেলে মন খারাপ কেন করব বলো তো? দুইদিনের পৃথিবীতে আত্মাকে এতো কষ্ট দেওয়ার কী দরকার? আমার ওসব মন টন খারাপ করতে ভালো লাগে না।’

মিথি ম্লান হেসে বলল,

‘ মন খারাপ বুঝি তোর ভালো লাগা না-লাগার উপর নির্ভর করে হবে? সে তো এই বাড়ির কোনো সদস্য নয় মৌনি। যাকে তুই ধমক দিয়ে বসিয়ে রাখবি আর সে চুপটি করে বসে থাকবে?’

মিথির কণ্ঠে চাপা ক্ষোভের আভাস পেয়ে মৌনি দু’চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে মিথির দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গভীর স্বরে বলল,

‘ মিথি আপা? এই পৃথিবীটা একটা নিরপেক্ষ দন্ডের মতো। তুমি তাকে যা দিবে ঢপ খাওয়া বলের মতো সে তোমাকে তাই ফিরিয়ে দিবে। সবাই আমাকে ভালোবাসবে, দৈবিক উপায়ে আমার মন ভালো হবে, খারাপ হবে এসব আসলে কাল্পনিক কথা। কে তোমাকে কতটা ভালোবাসবে তার মাপকাঠিটা কিন্তু থাকে তোমার হাতেই। আশেপাশের মানুষ তোমাকে সেভাবেই দেখবে যেভাবে তুমি তাদের দেখাবে। তুমি যদি দেখাও, তুমি বড় অসহায়। তারা তোমাকে দয়া করবে। অসহায়ত্বের ফয়দা লুটবে। কেউ হয়ত সমব্যথী হবে। কিন্তু কেউ ভালোবাসবে না। কারণ তুমি তাদের চোখে নিজের জন্য ভালোবাসা দেখতেই চাওনি। তুমি তোমাকে কীভাবে দেখতে চাও সেটাই জীবনের সবথেকে বড় ক্লাইম্যাক্স। তোমার ধারণা, আমি সবার উপর জোর খাটাই বলে সবাই আমাকে প্রশ্রয় দেয়? একদম না। তারা আমাকে প্রশ্রয় দেয় কারণ, আমি নিজেকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। আমার আমি ছাড়া এই পৃথিবীর আর কোনোকিছুতেই আগ্রহ নেই। আমি নিজের একবিন্দু খুশির জন্যও স্ট্যান্ড নিতে জানি। নিজেকে নিজে খুশি রাখার জন্য এই যে আমার এতো প্রচেষ্টা? এই প্রচেষ্টা সামনের মানুষকেও বোধহয় প্রভাবিত করে। তারা বিশ্বাস করে ফেলে, এই পৃথিবীতে খুশি থাকা আমার অধিকার। তাদের কাউকে কিন্তু আমি ভালোবাসতে বলি না। তারা আজ আমাকে ভালোবাসা বন্ধ করে দিলেও আমার কিচ্ছু যাবে আসবে না। তারপরও তারা আমাকে ভালোবাসবে। কারণ আমি চাই তারা আমাকে ভালোবাসুক। আমাকে ভালোবাসতে তারা বাধ্য।’

মৌনি একটু থেমে মিথির দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল। মৌনির বড় বড় চোখদুটো যেন হেসে উঠল। বলল,

‘ মিথি আপা, জীবনের ইচ এন্ড এভ্রিথিং দারুণ ইঞ্জয়েবল। তুমি নিজেকে মনে মনে খুব দুঃখী বলে ভেবে নিয়েছ। এজন্য আশেপাশে সব কিছু দেখো বিষণ্ণ চোখে। তোমার ভাবনা মতো আমরাও বিশ্বাস করে নিয়েছি, তুমি আসলে খুব দুঃখী। সত্য বলতে, তোমার জীবনে খুব দুঃখ করার মতো কিছু নেই।’

মিথি মৌনির থেকে মুখ ফিরিয়ে বিয়ে বাড়ির নানান রকম আত্মীয় স্বজনের দিকে তাকিয়ে রইল। মৌনির সাথে এই রকম করে কথা বলা তার আজই প্রথম। মৌনির মতো আত্ম-অহংকারী, চঞ্চল মেয়ে এমন গুছিয়ে কথা বলতে পারে ভাবতেই বিস্ময় হলো মিথির। সেই সাথে বুকের ভেতর নাড়িয়ে দিল একটা প্রশ্ন, সত্যিই কী তার খুব দুঃখ করার মতো কিছু নেই?

#চলবে…

নৌশিন আহমেদ রোদেলা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here