#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#সপ্তম_পর্ব (বোনার্স পর্ব)
-‘রিসাত মামাও প্রচুর পড়াশোনা করত। ক্লাসের ফাস্ট বয় ছিল। কিন্তু পরীক্ষা দিতে গিয়েই গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেল। এর দ্বারায় বোঝা যায়, ‘পড়াশোনা করে যে গাড়ি চাপা মরে সে।’ তাই আমি মরবোও না, পড়বোও না।’
একথা বলে কুহু হনহন করে চলে গেল। রুমে গিয়ে স্বজোরে দরজা আঁটকে দিলো। কলেজে গিয়েও শান্তি দেয় না এখন বাসাতেও শুরু করবে জাঁদরেলগিরি। সব সময় পড়া, পড়া, আর পড়া। কেন এত পড়তে হবে? পড়ে কি হবে? আর সবাই
যদি পড়ে পড়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয় তবে ঘুঁটে কুড়ানি কে হবে? ঘুঁটে কুঁড়ানোর জন্যও কাউকে দরকার৷ কারণ ঘুঁটেও উপকারী জিনিস। ঘুঁটেকে মোটেও অবহেলা করা উচিত নয়। কারণ ঘুঁটেরও ইংলিশ নাম আছে। এই যেমন, dung cake, cowdung biscuits, buffalo chips. রিদওয়ান ইংলিশে ভালো বিধায় ইংলিশ টিচার হয়েছে। ঘুঁটেরও ইংলিশ নাম আছে। সে বা রিদওয়ানের থেকে কম কিসে? ইংলিশে যার নামডাক রয়েছে সে তুচ্ছ কিছু হতেই পারে। বরং রিদওয়ান স্যারের থেকেও মহৎ গুনের অধিকারী। মহৎ গুন যার তার থাকে না। ঘুঁটের আছে বলেই সে নিজেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাঁক করে অন্যকে রান্নার কাজে সাহায্য করে। ঘুঁটের গান গাইতে গাইতে আসল টপিকই ভুলে গেছে। কি যেন বলছিল, ওহ হ্যাঁ,
সে পড়তে চায় না। পড়াশোনা তার ভালোই লাগে না৷ পড়ার কথা শুনলে প্রচন্ড মাথা ব্যথা করে। মাথার পোকারাগুলো কিলবিলিয়ে উঠে কান দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। নেহাৎ এসএসসি পরীক্ষার সময় তার পাশে সেকেন্ড বয়ের সিট বসেছিল। যদিও অন্য স্কুলের। আর ছেলেটার উসিলায় সে এসএসসি পাশ করেছে। তাও 4.05 পয়েন্টে। বাসার সবাই জানে নিজ মেধায়, নিজ যোগ্যতায় ফোর পয়েন্ট তুলেছে।
তাছাড়া সে একদমই পড়ত না, এমনটাও না। পড়তো তবে
পরীক্ষার আগের দিন রাতে। ভদ্র মেয়ে হয়ে পড়তে বসে সে একমনে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে দেখত। তারপর পড়ার চাপ দেখে তার ঘুম ভীষণ ঘুম আসত। ঘুমের ভারে তাকাতে পারত না। অতঃপর একঘন্টা ঘুমিয়ে নেয় বলে যেই ঘুমাত, ঘুম ভেঙ্গে দেখে সকাল হয়ে গেছে। গুরুজনরা বলে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে খুব একটা পড়তে নেই। তাই সেই পড়ত না। এভাবেই দিন কাটত। কিন্তু এভাবে আগে যতটুকু পড়ত রিদওয়ানের কাছে তাও হবে না। আর পৃথিবীতে এত টিচার থাকতে রিদওয়ানই বা কেন? কেন তার কাছেই তাকে পড়তে হবে? সে কি মহাপন্ডিত? পড়াকে গুলিয়ে খাওয়াতে পারবে?
যদি পারত তাহলে দ্বিমত করত না সে। তাছাড়া সে আম্মুকে
কি করে বোঝাবে রিদওয়ান স্যার হিসেবে খারুস প্রজাতির।
ধিড়িঙ্গি মার্কা লোকটা খ্যাচখ্যাচ করতেই থাকে সবসময়।
আর খ্যাচখ্যাচ করা লোক কখনো ভালো টিচার হতে পারে না। মোদ্দাকথা, রিদওয়ান খুব মারে। তার মারগুলো খুবই কষ্টদায়ক। বাসায় পড়া না পারলেও হয়তো ওইরকমভাবে মারবে। সে কিছুতেই পড়বে না রিদওয়ানের কাছে। কিছুতেই না। বিরবির করে এই কথাগুলো বলতে বলতে কুহু মেঝেতে বসে ,হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে তার হেঁচকি উঠে গেল। কালকে মার আর ম্যাসেজে বলা কথার ধরণে রিদওয়ানকে তার সহ্য হচ্ছে না। চোখের সামনে তো দূর নাম শুনলেও রাগে গা কিড়মিড় করছে। মনে হচ্ছে যদি কাঁটা কম্প্যাস দিয়ে তার চোখ দুটো গেলে দিতে পারত, তবে কিছুটা শান্তি পেতো। নতুবা দুই ঠোঁটে ব্রুজ লাগিয়ে বলতে পারত, ‘বলুন আর মারবেন আমাকে? বকবেন আমাকে?’
রিদওয়ান ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে তাকে সরি বলত তখন সে বলল ছাড়ত। প্রাণখুলে বিশ্বর জয়ের হাসি হাসত। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। এটা তার আকাশ কুসুম ভাবনা। এসব ভেবে
সে মেজাজের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। সে আর বাসাতেই থাকবে না। যেইদিকে দু’চোখ যা চলে যাবে। সে যথেষ্ট বড় হয়েছে অথচ বাবা মা তাকে গোনায় ধরে না। উনারা রিদওয়ানকে টিচার হিসেবে ঠিক করল, উনাদের উচিত ছিল না একবার তাকে জিজ্ঞাসা করা। এই ব্যাপারে কিছু জানানো। মতামত নেওয়া। উনারা কেউই জিজ্ঞাসা করলেন না বরং ঠিকঠাক করে, তাকে বাসার এনে তারপর তাকে জানাচ্ছে। এতে খুব করে বোঝা যায় বাসায় তার গুরুত্বপূর্ণ ঠিক কতটুকু।
ওদিকে মেয়ের ব্যবহার দেখে ইসমত আরা বেগম ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। রিসাতের সঙ্গে তার তুলনা? হ্যাঁ, রিসাত পরীক্ষা দিতে গিয়েই মারা গেছে। তাই বলে এই কথার সঙ্গে এই যুক্তি? যুক্তি মিলাতেও মানুষের ভাবতে হয়, চিন্তা করতে হয়। এর তো সব সময় ঠোঁটে আগায় কথা থাকে। কেউ কিছু বললে টকাশ করে বেহুদা যুক্তি দেয় যে জবাবে কিছু বলাও যায় না।
মেয়ের কান্ডে উনি গরম খুন্তি হাতে তুলে নিলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। তবে উনার ইচ্ছে করল, চাপকে পিঠের ছাল তুলে দিতে। দিনকে দিন বড্ড বেয়াদব হচ্ছে। আদব লেহাজ ভুলে গিলে খাচ্ছে। এখানে রাগের কি হলো? রিদওয়ান কি খারাপ? সে তার কলেজেরই ইংলিশ টিচার। ইংলিশ চিটার হওয়া কি চারটেখানি কথা? নিজে তো ইংলিশের ‘ই’ লিখতে কলম ভাঙে। সে আবার দেমাগ দেখাচ্ছে ইংলিশ টিচারকে। পাঁজি কোথাকার!
পড়ব না বললেই হবে? ওই পড়বে না ওর বাপ পড়বে। তাও পড়তেই হবে। ছিঃ! ছিঃ! মুখের উপরে পড়ব না বলে চলে?
ছেলেটা কি ভাবল? এমনিতেই ছেলেটা এখানে আসতেই চাচ্ছিল না। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে এনেছেন। আর বেয়াদব মেয়ে বলে কি না পড়ব না। উনি রাগ গজগজ করে কোমল দৃষ্টিতে রিদওয়ানের দিকে তাকালেন। ছেলেটাকে দেখে খুব মায়া লাগে। গতকাল বিকেলে যখন রুপককে নিয়ে হোটেল গেলেন, গিয়ে দেখে ছেলেটা ক্লান্ত হয়ে কলেজ থেকে ফিরে শুয়ে পড়েছে। দুপুরের খাবার সেন্টার টেবিলের উপর ঢাকা। পরে জানা গেল, বাইরের খাবার তার সুট করে না। খুব পেট ব্যথা করে। এখানে এসে বাইরের খাবারই খাচ্ছে সে। আর যতটুকু খেতো খেতে না পারায় মুখটা শুকিয়ে গেছে। চোখ মুখ বসে গেছে। আহারে! উনাকে তাকাতে দেখে রিদওয়ান ভদ্রতাসূচক মুচকি হাসল। মাশাল্লাহ! মাশাল্লাহ! কি সুন্দর করে হাসে ছেলেটা। মুখটা মায়াতে ভরা। চোখদুটোতে যেন
প্রচ্ছন্নতা। উনাকে এভাবে তাকাতে দেখে রিদওয়ান সহজে উনার চোখের ভাষা পড়তে পারল। তার মাও ঠিক এমনই।
মায়েরা বুঝি এমনই হয়। তাই সে হাসি হাসি মুখে বলল,
-‘কুহু ছোটো মানুষ। ওর কথায় কিছু মনে করি নি আন্টি। রাগ কমলে নাহয় বুঝিয়ে বলবেন। ওকে না জানিয়ে টিচার ঠিক করেছেন তাই হয়তো রেগে গেছে। রাগ কমলে ঠিক হয়ে যাবে।’
আহা! কলিজা ঠান্ডা করা কি সুন্দর বিনয়ী ব্যবহার। ইসমত আরা বেগম এ কথা শুনে ভীষণ খুশি হলেন। মনের অন্তস্থল থেকে দোয়াও করলেন। এই রকম ছেলে যেন ঘরে ঘরে হয়।
এমন আক্কেল জ্ঞান যেন উনার ছেলে মেয়ের মধ্যেও উদয় হয়। কথায় বলে, ‘সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।’ কিন্তু রিদওয়ান তো খাঁটি সোনা। এখন ‘সোনার সঙ্গে স্বর্গবাস না সর্বনাশ’ হয় এটাই দেখার পালা। ইসমত আরা বেগম গরম গরম পরোটা ভেজে রিদওয়ানের খাবার সাজিয়ে দিলেন। সঙ্গে দিলেন, ঘন ডাল, সিদ্ধ দুটো ডিম, মুরগির ঝাল মাংস, আলুর ভাজি,
অরেঞ্জ জুস আর রসগোল্লা। সকালবেলা খাবারের এতসব আইটেম দেখে রিদওয়ান আশেপাশে রুপককে খুঁজল। কিন্তু রুপক নেই। সে নাক ডেকে ভসভস করে ঘুমাচ্ছে। তার এই মহিষমার্কা ঘুম দুপুরের আগে ভাঙবে বলে মনেও হচ্ছে না। কিন্তু সে পড়েছে মহাবিপাকে। বিগত ছয়মাসে সকালেবেলা এত পরিমাণের এত খাবার খায় নি সে। খাওয়া সম্ভবও,নয়।
কিন্তু এখন কি করবে?কিছুক্ষণ আগেই ইসমত আরা বেগম তার অনেক প্রশংসা করলেন। যতটুকু জানে এই মহিলা খুব ডেঞ্জারাস টাইপের।রুপক নিজেই বলেছে। কিছুক্ষণ আগের কতশত প্রশংসার পাহাড় ‘খাবে না’ বলায় বেলন দিয়ে মেরে বসবে না তো? এই বয়সে মার খেতে তার খুব একটা কষ্ট না হলেও ভীষণ লজ্জা লাগবে। তাছাড়া কুহু খুব মজা নিবে। না এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। সে পরোটা ছিঁড়ে কেবল মুখে পুরতে যাবে তখন কুহু উপস্থিত হলো। কুহু একেবারে
কলেজ ড্রেস পরে রেডি হয়ে এসেছে। কোনো কথা না বলে সেও নাস্তা করতে চেয়ার টেনে বসল। নিজে খাবার তুলে নিয়ে খেতে শুরু করল। আড়চোখে খেয়ালও করল সামনে বসা রিদওয়ানের দিকে। তারপর রান্নাঘরে ব্যস্ত হাতে পরোটা বেলতে থাকা ইসমত আরাকে চেঁচিয়ে বলল,
-‘আম্মু, স্যারের নাকি মুরগির মাংস ভীষণ প্রিয়। তোমার রান্নার তো জবাব নেই। স্যার বোধহয় আরো নিবে মাংস, পরোটা। লজ্জায় কিছু বলতে পারছে না। তুমি আর পাঁচটা পরোটা আনো। স্যার না, না, করলেও শুনো না জোর করে খাওয়াও। অনিয়ম করায় স্যার অনেকটাই শুকিয়ে গেছে।’
রিদওয়ান হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মিটিমিটি হাসতে থাকা কুহুর দিকে। সে এখনো পরোটা ছিঁড়ে মুখেই দিতে পারে নি। আর এই বিচ্ছু মেয়ে বলে কি না….! কুহুর কথা শুনে ইসমত আরা বেগম আরো দুটো পরোটা দিয়ে গেল রিদওয়ানের প্লেট। এগুলো খেতে বলল। উনি আরো এনে দিচ্ছে। রিদওয়ানের মুখটা এবার দেখার মতো হলো। কুহু কোনোমতে হাসি আঁটকে মিউমিউ করে বলল, ‘স্যার।’
রিদওয়ান তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। মিউমিউ সুরের ডাক
শুনে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাল। তখন কুহু বলল,
-‘স্যার এটাকেই বলে মাইকার চিপা। তা চিপায় পড়ে কেমন লাগছে? অনুভূতিটা আমার সঙ্গে শেয়ার করুন, প্লিজ।’
To be continue………!!
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/