আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে #লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো #প্রথম_পার্ট

0
331

ক্লাসে নতুন শিক্ষককে দেখামাত্র মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো কুহুর।বিষ্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে। তার মস্তিষ্কও তখন জানান দিলো, গড়গড় করে ইংলিশ বলা এটা সেই ফিরিঙ্গি লোকটা। যাকে সে ভুল ঠিকানায় পাঠিয়ে একপ্রকার নাস্তানাবুদ করেছিল।
আজ ক্লাসে এসে দেখে এই লোকটা তাদের ইংলিশ টিচার!

তাও যেন তেনো টিচার নয় রাগী বদমেজাজী টিচার। কারো বেয়াদবী বরদাস্ত করে না সে। সে যেমন লয়্যাল তার সঙ্গেও চলতে হবে ল্যায়ালভাবে। নয়তো বিপদ আসন্ন। গত সপ্তাহে
একটা ছেলে নাকি স্যার নিয়ে মজা করেছিল। এ কথা স্যার শুনতে পেতে তাকর পুরো কলেজ কান ধরিয়ে হাঁটিয়েছিল।
সবার সামনে সরি বলিয়েছিল। তারপর থেকে কেউ স্যারকে নিয়ে বাজে কথা বলে না। কিন্তু সে কি করে বোঝাবে সেদিন খুব রেগে গিয়েছিল। রিকশাওয়ালার সঙে খুব ঝগড়া করে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে ছিল। তার উপরে বড় রাস্তা পার হতে গিয়ে আটোর সঙ্গে বেঁধে গিয়েছিল। আটো ওয়ালাও তাকে যাচ্ছে তাই বলেছিল। রাগে দুঃখে বাসার গলির কাছে এসে দাঁড়াতেই এই বান্দা এসে হাজির। বান্দাকে তো তখন চিনত না। দেখে মনেও হয় ইনি কলেজের টিচার। দেখতে শুনতেও নায়কমার্কা। কলেজের স্যার হবে বড় ভুঁড়িওয়ালা, টাকলা, তবেই না শিক্ষক শিক্ষক ভাব আসবে। তাছাড়া ইনি তাকে
দেখে গড়গড় করে ইংলিশ বলছিল। যার আগা মাথা কিছুই বুঝি না সে। বড়লোকের বখাটে ছেলেরাও ইংলিশ বলে। মদ খেয়ে টাল হয়ে পাগলামি করে। মুভিতে তো তাই দেখেছিল।
কিন্তু এই ভদ্রলোকের ইংলিশ না বুঝলেও ভাবভঙ্গিতে এটা বুঝছিল, তিনি একটা ঠিকানা জানতে চাচ্ছে। এমন প্যাঁচ লাগানো অলিগলিতে অনেকক্ষণ ধরেই ঘুরছে। কিন্তু যাকে খুঁজছে তার নাম বললেও চিনতে পারছে না। তাছাড়া এই রাস্তায় মানুষের আনাগোনা খুব কম। যাকে ডেকে একটু
সাহায্য চাইবে। অবশেষে তাকে পেল, সে যেন সাহায্য করে।
লোকটি দেখতে খাঁটি বাঙালি অথচ ইংলিশ বলায় তার রাগ হলো। বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে নিলো। লোকটার আপাদমস্তক
পরখ করে মনে হলো লোক নয় উনাকে যুবক সম্মোধন করা উচিত। কারণ যুবকটি দারুণ স্মার্ট। কিন্তু সমস্যা হলো কেন জানি তাকে হাসি হাসি মুখে কথা বলতে দেখে তার দুষ্টু বুদ্ধি উদয় হলো। আর এটা বাংলাদেশ। এখানে অকারণে ইংলিশ বললে মনে করা হয়, ইংলিশ জানে বলে ভাব নিচ্ছে। তারও তখন এটাই মনে হচ্ছিল। এজন্য ভুল ঠিকানা দেখিয়ে ভুল বাসায় পাঠিয়েছিল। তখনো সে ভাবে নি এভাবে গ্যাড়াকলে পড়তে হবে। তাছাড়া এই লোকটার কথা ভুলেই গিয়েছিল। তাহলে হঠাৎ ভোজবাজীর মতো এ লোক উদয় হলো কোথা থেকে? তাও আবার তার ডিপার্টমেন্টের ইংলিশ টিচার হয়ে।
একে বুঝি বলে ফাঁটা কপাল। নয়তো পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে যত আকাম কুকাম সেই বা করে কেন? পরে তাকেই বা ফাঁসতে হয় কেন?

আজ পনেরোদিন পর খুশিতে নাচতে নাচতে কলেজে এসে শুনল, রাকিব স্যারের পরিবর্তে একজন স্যার এসেছে। তিনি তাদের ইংলিশ ক্লাস নিচ্ছে।স্যার বাঙালি, বিদেশে থাকতেন। দীর্ঘদিন সেখানে থেকে স্টাডি কমপ্লিট করেছে। দেখতে পুরো
আগুন। কলেজে যখন আসে মনে হয় হিরো এন্ট্রি নিচ্ছে।কি যেন একটা আছে তার মধ্যে। তার হাঁটা-চলা, স্মার্টনেস,কথা বলার ভঙ্গিমা, পোশাকের ধরণ, ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে তাকানোয় যেন আভিজাত্য ঝরে পড়ে। ড্রেস সেন্স চমৎকার। ওহ উনার
নাম রিদওয়ান চৌধুরী। ডাকনাম রিদ। বাসার মানুষ ব্যাতীত রিদ নামে ডাকার পারমিশন কারো নেই। গত সপ্তাহে ইংলিশ টিচার পদে জয়েন্ট করেছে। এসেই কলেজের রুলসগুলোও
পরিবর্তন করে ফেলছে। ভীষণ কড়া তিনি। কলেজে এতদিন
যাতা অবস্থা থাকলেও এখন আর নেই৷ আশ্চর্যজনক কথা
হচ্ছে, স্যার চমৎকার করে হাসে। হাসির সময় সীমা কয়েক সেকেন্ডের। এই কয়েক সেকেন্ডেই দিল ঘায়েল করার জন্য যথেষ্ট। হুটোপুটি গ্যাং অর্থাৎ কুহুর ফ্রেন্ডদের থেকে এসব শুনেও কুহু গুরুত্ব দেয় নি। নিকিতা, মোনালি, চন্দ্রার কাছে একটু সুন্দর ছেলে মানেই আগুন মনে হয়।তাদের মাত্রারিক্ত প্রশংসার প্রমাণও সে পেয়েছে অহরহ। তাই ব্যাপারটা তেমন আমলে না নিয়ে ক্লাসে এসে বসেছে। গল্প করছে আর ভাজা
বাদাম খাচ্ছে। কড়া করে ভাজা বাদাম, খেতেও খুবই মজা।
তখন তাদের আড্ডা চলছে পুরো দমে। হঠাৎই স্যার আসছে রব শুনে দ্রুত যে যার বেঞ্চে গিয়ে বসল। স্যার ক্লাসে প্রবেশ করতেই সকলে দাঁড়াল। সেও দাঁড়িয়েছে। নতুন স্যার কেমন দেখবে বলে উঁকি মারতেই তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
সেও চট করে নিজেকে আড়াল করে ফেলে। দাঁত দিয়ে নখ কাঁটতে কাঁটতে থাকে। এই কোন মসিবতে পড়ল! স্যার যদি চিনে ফেলে? পানিশমেন্ট দেবে কনফার্ম। ইস! কিছুক্ষণের জন্য স্যারের স্মৃতি হারিয়ে গেলে বড্ড উপকার হতো। কিন্তু এটা তো সম্ভব নয়। এই রুমটাতে পেছনে দরজা নেই নয়তো এতক্ষণে দৌড়ে পালাত।

স্যার রোল কল করলেন। নিকিতা, কুহু আর চন্দ্র এক বেঞ্চে বসেছে। কুহুর তার বিপদের কথা তাদের জানিয়ে দিয়েছে।
এখন তিনজন বসে চিন্তা করছে। এছাড়া তো উপায়ও নেই।
কুহু মুখ কিঞ্চিৎ আড়াল করে বসে আছে। ঘাড় ব্যথা করছে, ঘাড় কুঁজো হয়ে বসে থাকতে থাকতে। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ বসে থাকবে? এমনিতে ইংলিশ ক্লাস করে না। প্রায় দিন ক্লাস মিস করে। ইংলিশে তার বড্ড এলার্জি। সব সাবজেক্টেই তার এলার্জি কিন্তু ইংলিশে একটু বেশিই। আর ইংলিশ ক্লাস এসে
ফেঁসে গেছে। আর গতসপ্তাহ থেকে ইংলিশকেই ফাস্ট ক্লাস করা হয়েছে। কারণ খেয়াল করে দেখা হয়েছে বাংলা ক্লাসে স্টুডেন্টদের উপস্থিতি নজরে পড়ার মতো। উপচে পড়ে যেন। অথচ ইংলিশ ক্লাসে তাদের উপস্থিত থাকে হাতে গোনা বিশ পঁচিশজন জন। বাদবাকি উধাও। এতেই স্পষ্ট বোঝা যায়, স্টুডেন্টরা আসে খাতায় নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্য। আর পেশেন্ট দিয়ে সব গায়েব। ঠিক কুহুর মতোই।
স্টুডেন্টরা চালাকি করলে টিচার্সদেরও চালাক হতেই হয়। এজন্য ইংলিশ ক্লাসকে ফাস্ট ক্লাস করা হয়েছে। এখন যার যার উপস্থিতি জানান দিতে হলে ইংলিশ ক্লাস করতেই হবে।
পরে অবশ্য জানা গেছে রিদওয়ান স্যারের বুদ্ধিতে কাজটি করা হয়ছে। ফলস্বরূপ তাকেও ক্লাসে উপস্থিত হতে হয়েছে।
কিন্তু স্যার তো প্রতিদিন ক্লাস নিবে। আজ অথবা কাল তাকে ধরা পড়তেই হবে। ধরা পড়লে…পানিশমেন্ট। এসব ভাবতে ভাবতে একটা পুরুষালি কন্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘ মিডিলে বসা ব্লু স্কার্ফ স্ট্যান্ড আপ।’

যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। শেষ রক্ষা হলো না। ফিরিঙ্গি নজরে পড়েই গেল সে। কুহু ধীরে সুস্থ উঠে দাঁড়াল। মিষ্টি করে হাসল। তারপর এমনভাবে তাকাল যেন পৃথিবীতে
সবচেয়ে নিষ্পাপ মেয়ে। যার মনে কুটিলতা নেই। অহংকার নেই। ছলচাতুরী নেই। তাকে দাঁড়াতে দেখে স্যার ঘসঘস করে ওয়াইট বোর্ডে কি যেন লিখল। তারপর তাকে বলল ইংলিশে
অনুবাদ করতে। সে বোর্ডে তাকিয়ে দেখল খুব সুন্দর করে লেখা, ‘গতকাল মেয়েটি আমাকে সাহায্য করে নি। কারণ সে অকৃতজ্ঞ।’
কুহু অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুঝতে সুবিধা হলো না স্যার তাকে চিনে ফেলেছে। চিনে এখন বাঁশ দিচ্ছে। যত বড় বাক্য লিখেছে সে জীবনে পারবে কি না সন্দেহ। তবুও সে ভাবল। এমন ভাব করল যেন পারব। যতই ভং ধরুক সে পারবে না একথা তার বান্ধবী নিকিতা ঠিকই জানে। সে হাতের চিমটি কেটে আস্তে করে বলে দিলো, কিন্তু কুহু শুনতেই পেলো না। আবার বলল। এবার শুনতে পেয়ে মনে পড়েছে এমন একটা ভাণ করে বলার আগে স্যার একটু এগিয়ে এসে নিকিতাকে দাঁড়াতে বলল। তারপর নিকিতাকে আরো কঠিন প্রশ্ন করল।
বেচারা নিকিতা পারল না। থতমত খেয়ে বোকা বোকা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল। আর সে দাঁত দিয়ে নখ কাটতে লাগল। এটা দেখে স্যার বলল,
-‘আগামীকাল হোমওয়ার্ক দিয়েছিলাম, করেছেন?
-‘জি না স্যার।’
-‘কেন?’
-‘গত পনেরোদিন কলেজে আসি নি তাই জানতাম না।’
-‘পনেরো দিন! তা কেন আসেন নি?’
-‘আমার জীবনে বসন্ত এসেছিল। আমি..।’
-‘ওয়েট! ওয়েট! আমি আপনার লাভ স্টোরি শুনতে ইচ্ছুক নই। তাছাড়া এটা ক্লাস রুম আপনার বাসার ড্রয়িংরুম নয়।’
-‘আপনি ভুল বুঝছেন স্যার। বসন্ত আমার প্রেমিক নয়।’
-‘ওহ, তাহলে কে সে?’
-‘বাংলা ভাষায় সে গুঁটি বসন্ত আর ইংলিশ ভাষায় পক্স। ”
-‘ওহ আচ্ছা। এবার বোর্ডের লেখাটা ট্যান্সেসলেট করুন।’
-‘পারব না স্যার।’
-‘পড়া পারেন না। ক্লাসে ফিসফাস করে। অভদ্রের মতো ক্লাস নোংরা করেন। স্যার ক্লাসে এসে বসতে বলার আগেই বসে পড়েন। আপনার কি মনে হচ্ছে না এগুলো অন্যায়। আপনি স্বেচ্ছায় অন্যায় করেছেন?’
-‘জি স্যার হচ্ছে।’
-‘অন্যায় করলে সাজা পেতে হয়ে এটা জানা আছে নিশ্চয়ই?’
-‘জি স্যার।’
-‘গুড। এবার আপনি নিজে নিজেকে উপযুক্ত সাজা দিন।’
-‘জি?’
-‘আপনার পানিশমেন্ট আপনি নিজেই ঠিক করুন। ক্লাসের
লেট হচ্ছে হ্যারি আপ।’

কুহু বুঝে গেল কোনোভাবেই তার নিস্তার নেই। তাই সে পুরো ক্লাসটা দাঁড়িয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। থাকলও তাই। পাক্কা পঁয়তাল্লিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে তার কোমর ব্যথা, পা ব্যথা হয়ে গেছে। মনে মনে ফুঁসছে। গালি দিচ্ছে। রিদওয়ান সময় নিয়ে পড়া নিয়ে নতুন পড়া দিলো। সঙ্গে দিলো হোমওয়ার্ক।
যার যার সমস্যা থাকবে সেটা নোট করে রাখতে বলল। কাল এসে সমস্যা সমাধান করে দেবে। তারপর সে ক্লাস শেষ করে বের হওয়ার আগে কুহুকে বলল,
-‘আর এই যে আপনি পড়া পারেন নি। তাই আগামীকাল শুধু আপনার হোমওয়ার্ক থাকল, অকৃতজ্ঞ’ এর ইংলিশ জেনে এটা নিয়ে একটা প্যারাগ্রাফ লিখে আনা। আগামীকাল যদি প্যারাগ্রাফ লিখে না আনেন অথবা ক্লাস মিস করেন, তাহলে শাস্তিস্বরুপ এর পরেরদিন আমার ক্লাসটা আপনি করাবেন। ক্লাস করানোর ভয় যদি কলেজে আসায় বন্ধ করে দেন তাহলে গার্ডিয়ান কল করা হবে।’

একথা বলে সে প্রস্থান করল। আর কুহু ধপ করে বেঞ্চে বসে পড়ল। তার সুখের দিন বুঝি ফুরিয়ে এলো।

To be continue…..!!

#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#প্রথম_পার্ট

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here