#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_ষোলো
তুমুল বৃষ্টি। ভেজা ছাদ। ছাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক বেখেয়ালী মেয়ে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ বন্ধ। শান্ত মন। ভেজা শরীর। আর তাকে অবলীলায় দেখে যাচ্ছে বুকে উত্তাল ঝড় তোলা এক বেপরোয়া প্রেমিক পুরুষ। বুকে দুই হাত গুঁজে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে রা শব্দ নেই। নড়চড় নেই। আছে শুধু চোখ জুড়ে একরাশ মুগ্ধতা। মায়া।
হঠাৎ মেঘ গর্জন করে উঠল। বজ্রধ্বণিতে কেঁপে উঠল মাটি। থেমে গেল
কোলাহল। গাছের ডালে আশ্রয় নেওয়া এক ঝাক পাখি উড়ে গেল প্রাণ হাতে নিয়ে। বৃষ্টি বাড়ছে। বাড়ছে সময়ের গতি। কুহু ঝপ করে চোখ খুলে তাকাল। সে ছাড়া কেউ নেই। ভয়ে শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। সে দৌড়ে এলো দরজার দিকে তখনই জ্বলে উঠল ছাদের লাইট৷ সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে বোকা বোকা হাসল। মনে মনে প্রস্তুত হলো রাম ধমক খাওয়ার। কিন্তু তাকে অবাক করে রিদওয়ান হাতে থাকা ফোনে সময়
বলল,
-‘ মাত্র পয়তাল্লিশ মিনিট হয়েছে এত তাড়াতাড়ি বৃষ্টি বিলাস শেষ? আপনি চাইলে আরো পয়তাল্লিশ মিনিট ভিজতে পারেন। আমি আছি আপনাকে পাহারা দিতে।’
রিদওয়ানের খোঁচা মারা কথা শুনে কুহু কিছু বলল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তবে মনে মনে তার গুষ্টি উদ্ধার করতেও কম করল না।
রিদওয়ান চেয়ে কুহুর ভেজা ঠোঁটের দিকে। চুল বেয়ে পানি গড়িয়ে তা গলা বেয়ে মিশে যাচ্ছে পরনের ড্রেসের সঙ্গে। সে ঢোক গিলল। নিজেকে সামলানো প্রায়স চালালো। বাতাস বইছে। বাতাসে কাঁপিয়ে দিচ্ছে কুহুর ভেজা শরীর। কুহু আচমকা এগিয়ে এলো। দাঁড়াল মুখোমুখি। রিদওয়ান তাকে এগোতে দেখে অবাক হলেও নড়লো না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল তার পথ আঁটকে। কুহু যাবে রিদওয়ান সাইড দিচ্ছে না। ইচ্ছে করেই করছে
তা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না। কুহু আড়চোখে রিদওয়ানের দিকে তাকিয়ে ওর মতি গতি বোঝার চেষ্টা করল। তারপর অপরাধীর সুরে বলল,
-‘সাইড দিন। আমি যাব।’
-‘যাও নিষেধ করেছে কে?’
-‘না সরলে যাব কিভাবে?’
-‘কেন ধাক্কা মেরে সরিয়ে চলে যাও।’
-‘ধাক্কা মারব?’
-‘হুম। ক্ষণে ক্ষণে কম ধাক্কা তো দিচ্ছো না।’
-‘আমি আবার ধাক্কা দিলাম কখন? কিসব ভুলভাল বকছেন আপনি?’
-‘ভুলভাল কাজ করতে পারবে আর আমি বললেই দোষ?’
-‘আমি আবার কি করলাম?’
-‘কি করতে বাকি রেখেছ?’
-‘রিদ ভাইয়া আপনি দ্রুত ডাক্তার দেখান। আপনার অবস্থা সুবিধার ঠেঁকছে না।’
-‘আমারও তাই মনে হচ্ছে। এবার বাসায় চলুন। বাকি কথা বাসায় গিয়ে বলি?’
-‘হুম! হুম! শীত লাগছে আমার। তাড়াতাড়ি চলুন।’
একথা শুনে রিদওয়ান সাইড দিলো না নিজেই সামনে হাঁটতে লাগল। আর কুহু একগাদা ভেজা কাপড় নিয়ে তার পেছন পেছন আসল। তারা দু’জন বাসায় ঢুকল। রিদওয়ান দরজা আঁটকে দিলো। কুহু ভেজা কাপড় মেলে দিয়ে রুমে চলে গেল। গোসল করল। পরনে আকাশি রঙা লেডিস টিশার্ট আর আকাশি ও সাদা সংমিশ্রনে লং স্কার্ট। বাসায় লং স্কার্ট বেশি পরে সে। তারপর ভেজাচুল ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নিয়ে বের এলো। তার ক্ষুধা লেগেছে। গোসলের পর ক্ষুধাটা মাথা চাড়া উঠেছে। এখন না খেলে হাত পা কাঁপতে শুরু করবে। সে গুনগুন করতে করতে খেতে গিয়ে বেশ খুশি হলো। রিদওয়ান খাবার বেড়ে বসে আছে। তা দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
-‘আমাদের ভাবি খুব লাকি।’
-‘কোন ভাবি?’
-‘আপনার বউ আর আমার ভাবি!’
-‘লাকি? কেমন লাকি?’
-‘এই যে ভদ্র মানুষের মতো খাবার বেড়ে টেড়ে বসে আছেন। এমন কাজ কি সব স্বামীরা করে? করে না।’
-‘ওহ। আমি তো তোমার জন্য করলাম তাহলে কি আমার তোমার স্বামী। স্বামী রুপে মানছো আমাকে?’
-‘ না, না, আমি তা বলি নি।’
-‘কি বললে শুনলামই তো।’
কুহু জবাব না পেয়ে মুখ লটকে বসে রইল। কি বোঝাতে চাইল আর কি বুঝে বসে রইল এই লোক। মাথা মোটা। কুহুর শরীর থেকে সদ্য গোসল করা আসায় সাবান শ্যাম্পুর সুগন্ধ ভেসে আসছে। নাকে বারি খাচ্ছে তা।
সঙ্গে রিদওয়ানের মতো যুবকের সর্বাঙ্গেও একটু একটু নিষিদ্ধ অনুভূতি এসে জড়ো হচ্ছে। মন দুলছে দোলা চালে। বিবেক আর মস্তিষ্কের মাঝে
চলছে নীরব দ্বন্দ। একজন সাবধানী সুরে বলছে রিদওয়ান তোমার ভুল সিদ্ধান্ত তোমাকে চরম ভোগাবে। সে তোমার বন্ধুর বোন। বন্ধুর বিশ্বাস ভেঙ্গো না। সাবধান হও। নিজেকে সামলাও।আর আরেকজন বিশ্রীভাবে
উস্কে দিচ্ছে, যাকে ভালোবাসো তাকে জানাতে বাঁধা নেই। তাকে ছুঁয়ে দাও। স্পর্শ দিয়ে বোঝাও তুমি তাকে পছন্দ করো। মেয়ে মানুষকে কাবু করতে পুরুষের জোরালো স্পর্শই যথেষ্ট। বাইরে বৃষ্টি। ফাঁকা বাসা। এই সুযোগ মনের কথা খুলে বলার।
রিদওয়ান চুপ করে আছে। গলা দিয়ে খাবার নামছে না। কিসব ভাবছে।
কুহু আর বসে না থেকে ভাত বেড়ে খেতে লাগল। পাবদা মাছের ঝোল নিয়ে একটু একটু করে খেতে লাগল। রান্নাটা এত মজা৷ হয়েছে। ভীষণ
ক্ষুধা লাগায় ভদ্রতা দেখাতে পারল না। ঝটপট খেতে লাগল। যেন কত দিনের অভুক্ত সে। এমনিতে সে মাছ খায় না। কিন্তু পেটে ক্ষুধা থাকায় সব অমৃত মনে হচ্ছে। তাকে এভাবে খেতে দেখে রিদওয়ান মৃদু হাসল।
সে রান্না না করলে কি হতো? এমনিতেই এই মেয়ের মাথা গরম খেতে না পেয়ে কী করতো। সেও এবার খাওয়া শুরু করল। ঝাল করে আলু ভর্তা দিয়ে মুখে ভাত দিলো। তেঁতো হয়ে আছে পুরো মুখ। জ্বরটা বাড়ছে তা অনুভব করছে। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। একজন তৃপ্তি করে খাচ্ছে আর আরেকজন হাত উড়িয়ে বসে আছে। বাইরে বৃষ্টি ঝরছে। তবে গতি কিছুটা কমে এসেছে। আজ বৃষ্টি থামবে কি না কে জানে। তখন কুহু মুখ খুলল,
-‘রান্নাটা খুব মজা হয়েছে?’
-‘(নিশ্চুপ)’
-‘আপনি কি এখনো রেগে আছেন?’
-‘(নিশ্চুপ)’
-‘রিদ ভাইয়া!’
-‘(নিশ্চুপ)’
-‘আপনি অনুমতি দিলে আমি কিছু কথা বলতাম। বলি?’
-‘(নিশ্চুপ)’
-‘ আপনি নিশ্চুপ থাকলে কিভাবে বলব?’
-‘(নিশ্চুপ)’
-‘তখন ‘না’ বলাতে কি আপনি রেগে আছেন? ভাবছেন আপনাকে রিজেক্ট করেছি? আসলে ব্যাপারটা তেমন নয়। আমি মানে, আমি কিছু কারণে না করছি। ভেবে দেখলাম যে..!’
আবারও সেই কথা উঠানোয় রিদওয়ানের রাগটা তরতর করে বাড়ল।
চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইল কুহুর দিকে। মুখে উপর না বলে এখন সাফার গাওয়া হচ্ছে। কে শুনতে চেয়েছে তার সস্তা সাফায়? রিদওয়ান এবার বেশ হেয়ালি সুরে জবাব দিলো,
-‘তুমি ভাবো? ভাবতে পারো? ভাবনা বলে কিছু তোমার মধ্যে আছে? তা কি ভাবলে? বলো শুনি। আমিও দেখি তোমার ভাবনা দৌড় কতদূর।’
-‘এভাবে কথা বলছেন কেন?’
-‘আমি এভাবেই কথা বলি। না পোষালে বলিও না আমার সঙ্গে কথা।’
-‘না মানে..! ‘
-‘মানে, আসলে, বাদে কথা থাকলে বলো নয়তো উঠলাম আমি।’
-‘আমার উপর রাগ করে সত্যিই চলে যাবেন আপনি?’
-‘এর কৌফিয়ত তোমাকে দিতে বাধ্য নই।’
-‘আপনি আমার স্যার। ভাইয়ার বন্ধু। আমি কিভাবে…!’
-‘তারপর?’
-‘রাগ না করে আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করুন। আমি আপনার যোগ্য না। তাছাড়া আমি ভাইয়াকে কষ্ট দিতে পারব না।’
-‘এই তোমার ভাবনা?’
-‘হুম। এজন্যই আমি না করছি। এছাড়া কিছু না। ঝড় আসবে জেনে যদি সাবধান না হই তাহলে নিঃশেষ হতে সময় লাগবে না।’
একথা শুনে রিদওয়ান রেগে চট করে দাঁড়িয়ে কুহুর হাত ধরে টেনে দাঁড় করাল। কুহুর হাত পিছ মোড়া করে ধরে হিসহিসিয়ে বলল,
-‘তোমাকে নিঃশেষ এমনিও হতে হবে। আমি করব নিঃশ্বাস। আমার সব শান্তিটুকু কেড়ে নিয়ে এখন মিঠা মিঠা সাফায় গাওয়া হচ্ছে? কি ভেবেছ এসব শুনে মেনে নেবো? তোমার ভাইকে আমি ভয় পাই? ওর ভয়ে মুখ লুকিয়ে পালাব আমি? আমাকে কাপুরষ মনে হয়?’
-‘লাগছে আমার। হাত টা ছাড়ুন। ভালো না বাসলে জোর করে বাসাবেন নাকি? জোর করে ভালোবাসা হয়?’
-‘ধরে নাও তাই। ‘
-‘আপনি পাগল হয়েছে গেছেন। জ্বর আপনার মাথা আউলে দিয়েছে। যান রুমে গিয়ে ঘুম দিন। নয়তো আমি ভাইয়াকে বলে দেবো আপনি কিসব বলছেন।’
একথা শুনে রিদওয়ান তাকে ছেড়ে দিলো। হাত ধুয়ে হনহন করে রুমে চলে গেল। কুহুও রেগে সব ঠিকঠাক করে রুমে চলে গেল। রিদওয়ানের হাবভাব ভালো লাগছে না তার কাছে। এখন রুমে ঢুকে আর বেরই হবে না সে। যতই হোক সে ভাইয়ের বন্ধু। ভাই নয়। তাছাড়া নিজের সেফটি নিজের কাছে। রিদওয়ান যা পাগলামি শুরু করেছে তাকে সায় দেওয়ার মানে হয় না। বরং সায় দিলে এর বিপরীত কিছু ঘটতে পারে। মনে মনে এসব ভেবে সে রুমের দরজা আঁটকে হাত মুখ ধুয়ে চুলে বিনুনি গাঁথলো।
তারপর ড্রিম লাইট অন করে পেছনে ঘুরতেই ধাক্কা খেলো কারো বুকের
সঙ্গে। সে ভয়ে চিৎকার করার আগে তাকে চেপে ধরা হলো দেওয়ালের সাথে। চেপে ধরা হলো মুখ। দুরত্ব কমাতে সে এগিয়ে এলো আরেক পা। তখনই পুরুষালি শক্ত বুকে ঠেঁকল তার বক্ষভিজাজন। চমকে উঠল সে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল রিদওয়ানের দিকে। চোখে চোখ। ঠোঁট ছুঁইছুঁই অবস্থা। তার দৃষ্টি অদ্ভুত। সে ছটফট করে উঠল। শক্তি খাঁটিয়েও লাভ হলো না। তখন রিদওয়ান দুই হাতে মুখটা উঁচু করে ঠোঁটে বৃদ্ধাঙ্গুল
বুলাতে বুলাতে বলল,
-‘খারাপ যখন হতেই হবে কিছু না করে খারাপ হবো কেন? বরং খারাপ কিছু ঘটিয়ে খারাপ হই। এতে নিজের কাছে লয়্যাল থাকতে পারব।’
To be continue…….!!
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/