আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে #লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো #পর্ব_ঊনিশ

0
179

#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_ঊনিশ

-‘ কিছুদিনের জন্য গেস্ট টিচার হয়ে এসেছিল। কাজ শেষ তাই রিজাইন করেছেন।’
-‘আর কখনোই আসবে না উনি?’
-‘না। তাছাড়া উনি প্রফেশনাল টিচার নন উনার পেশা অন্যকিছু। আমি সঠিকটা জানি না যদিও। তবে শুনেছি আর কি! তবে উনাকে কলেজ থেকে অফার করা হয়েছিল থেকে যাওয়ার জন্য। কিন্তু উনি থাকেন নি। কিছুক্ষণ আগে শুনলাম দেশ ছাড়ছেন। আগামীকালকে সন্ধ্যায় ফ্লাইটে চলে যাচ্ছেন।’
-‘কোথায় যাচ্ছে?’
-‘যেখান থেকে এসেছিল, সম্ভবত সেখানে।’

মোবারক স্যারের কথা শুনে কুহু অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ সে ভেবে হিসাব মেলাতে পারছে না। সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা। মন দিয়ে সবই শুনল কিন্তু সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগল। সকাল থেকে কি সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। বলা নেই, কওয়া নেই, রিদওয়ান কোথায় চলে গেল, গতকালকে বিকেলে নাকি বৃষ্টিই হয় নি। রিকশাওয়ালা তখন তাইই বলল, অথচ সে
বৃষ্টিতে ভিজেছে। ছাদে গিয়ে ইচ্ছেমতো ভিজেছে। কলেজে আসার পর কি হলো? নিকিতা তার গলার তিলটাই খুঁজে পেল না। অথচ এই তিলের জন্য রিদওয়ান তাকে পছন্দ করে। বলা বাহুল্য ভীষণ পছন্দ করে৷ কত কি বলে প্রশংসা করে।সে এ কয়েকদিনের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু তেমন কিছুই স্মরণে এলো না৷ শুধু মনে হলো রিদওয়ান গতকাল তাকে সারাজীবনের দায়িত্ব নিতে বলেছিল। সে সরাসরি নাকচ করেছে। আর? আর কিছু কি ঘটেছিল.. করেছিল…অথবা বলেছিল? সম্ভবত না! কি আশ্চর্য! আজকাল কি সে কথা মনে রাখতে পারছে না। তারচেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে সে ভাবছে, প্রচুর ভাবছে। তার ভাবনায় শেষ হচ্ছে না। আর ভাবতে ভাবতে তার নিজস্ব ভাবনার জগৎ তৈরি হচ্ছে। যেখানে সে ভাবনা জমা করে। গুছিয়ে রাখে। সেখানে শুধু তার অধিপতি। তার কথা বিরাজমান। এ মুহূর্তেও সে ভাবছে আর ভাবছে বলে এখন ডাউট হচ্ছে রিদওয়ান সত্যিই কি তাকে সারাজীবনের দায়িত্ব নিতে বলেছিল? নাকি এটাও তার ভাবনার একটা অংশ ছিল? নাকি অপছন্দের মানুষটাকেও
ভাবনা রাজ্যের বাসিন্দা করে ফেলেছে। যেগুলো ঘটে নি সেগুলোকেও বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত করে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে? একথা ভেবে এবার তার নিজের মাথা ঘুরতে লাগল। আসলেই কি তাই? আদৌ সম্ভব এটা? কি বিরক্ত! কি জ্বালা! এমন হয় নাকি? আজকাল সে বাস্তব জীবন আর ভাবনার জগৎ আলাদা করতে পারছে না। ভাবনার জগতের চিন্তা-ভাবনা, কথোপকথন, সবই বাস্তব জীবনের সঙ্গে গুলিতে ফেলছে।
মাঝে মাঝে ভাবনার জগতকে ওর বাস্তব বলে মনে হচ্ছে আবার কখনো কখনো বাস্তবকে তার মনে হচ্ছে মামুলি কোনো ভাবনা।

সবকথার এক কথা রিদওয়ানের জায়গায় এখন মোবারক স্যারকে তার পছন্দ হচ্ছে না। ক্লাসে মন বসছে না। কান আর মাথার মধ্যে অদ্ভুতস্বরে
পোঁ পোঁ শব্দ হচ্ছে। খুব বিরক্ত লাগছে। স্যারের অযথা বকবকগুলো ওর মস্তিষ্কে বারি খেতে খাচ্ছে। খুব অসহ্য লাগছে মোবারক স্যারকে। এই যে অকারণেই হাসা। আজাইরা বকবক। সবকিছুই বিরক্তিকর। স্যার হওয়া উচিত রিদওয়ানের মতো। ক্লাস থাকা মানেই সিংহের মতো ভাব বজায় রাখা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সবার দিকে নজর দেওয়া। তার পছন্দমতো কিছু না হলেই শাস্তি। নিজের শাস্তি নিজের চুজ করার অপ্রিয় নিয়ম জারি।এসব
কিছুতেই যেন আলাদা কিছু মিশে আছো। জড়িয়ে আছে। না, তার আর ভালো লাগছে না। কেন জানি শূন্য শূন্য লাগছে। সে এবার দাঁড়িয়ে গেল।
স্যারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিনয়ীভাবে স্যারকে জানাল, তার হঠাৎ খুবই শরীর খারাপ করছে। ক্লাস করা তার পক্ষে সম্ভব নয়৷ এই মুহূর্তে বাইরে যেতে চায়। নয়তো বমি করে ক্লাস ভাসিয়ে দেবে আর নয়তো সে জ্ঞান হারাবে। একথা শুনে মোবারক স্যার পারমিশন দিতেই সে ছুটে বেরিয়ে গেল। কলেজে থেকে বেরিয়ে সোজা গেল, নন্দনপার্কে। তেমন কেউ নেই এখানে। বিকেলের দিকে একটু আধটু ভিড় হয়। মন খারাপের মতো এক বিশ্রী অনুভূতি নিয়ে বাসায় ফিরতেও ইচ্ছে করছে না। তারচেয়ে এখানে বসে কিছুক্ষণ সময় কাটাক। ভাবনার দুয়ার খুলে বসুক।

সে পার্কে প্রবেশ করে সফেদা গাছের নিচে চুপ করে বসল। গলায় হাত বুলিয়ে থম মেরে রইল। সেলফি নিলো। সেলফি জুম করে গলা দেখল।
তার গলায় তিল নেই। অথচ রিদওয়ান বলেছিল তিলের জন্য নাকি সে খুব ভালোবাসে। তিলটা দেখলে রিদওয়ানের পাগল পাগল লাগে। বড্ড কষ্ট হয় তার নিজেকে সামলাতে। গতরাতেও সে পাগলামি করল। অথচ
এখন দেখে তিলই নেই।তাহলে কে সত্যি, তিল? রিদওয়ানের বলা কথা? নাকি ওর চোখে দেখা? সবকিছু জট পাকিয়ে তার মাথা এলেমেলো হয়ে গেল। সে দুই হাঁটুর উপর থুতনী ঠেঁকিয়ে কাঁদতে লাগল। কি হচ্ছে এসব?
মাঝে মাঝে তার মনে হয় জীবনটা ভীষণ সুন্দর। আবার ক্ষণিকেই মনে হয় জীবনের মতো গোলমেলে জিনিস আর কিছুই নেই। জীবনের কথা বাদ। কিন্তু মেয়ে হওয়া যেন আরো বড় পাপ। এই যেমন, সে খুব ভালো করে বুঝে রিদওয়ান তাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে বাসে। আবার মাঝে মাঝে এমন ব্যবহার করে যেন তাকে সে চেনে না। পছন্দ করে না। একটু
এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে। এ কেমন ব্যবহার রিদওয়ানের? মানুষ এত দু’মুখো হয়ে কি করে? সে আর ভাবতে পারল না চোখের সামনে চরকির মতো রিদওয়ানের মুখ, রুপকের মুখ, বাবা, মা, আর তাদের সবার সঙ্গে কাটানো সুখের মুহূর্তের দৃশ্যগুলো ঘুরতে লাগল। সে এবার নিজেকে খুব অসহায় বোধ করল। ঘামতে লাগল। হাত-পা সহ সর্বাঙ্গ কাঁপতে লাগল থরথর করে। এখন বাসায় যাবে কিভাবে? বাসার পথটা বা কোনদিকে?
কোন দিক দিয়ে এসেছিল?
তাকে এই অসহায় অবস্থায় থেকে উদ্ধার করল রুপক। আধাঘন্টা আগে
সে পিয়াসের ম্যাসেজ পেয়েই ছুঁটে এসেছিল। হন্ন হয়ে বোনকে খুঁজতে খুঁজতে পনেরো মিনিট আগে এখানে পৌঁছেছে। এতক্ষণ অদূরে দাঁড়িয়ে সে তাকিয়ে দেখছিল অসহায় কুহুর কান্না। বোনের কান্না তার বুকে যেন শূলের মতো বিঁধছিল। কিছু করতে না পেরে অসহায় হয়ে বোনের দিকে তাকিয়েছিল। রিদওয়ান তো ঠিকই চলে গেল। কিন্তু সে কি করবে? কিছু করার আছে কি তার? সে ভাই! বড় ভাই! বড় ভাইদের অনেকক দায়িত্ব। আর দায়িত্বশীল ভাইয়েরা কখনো বোনদের দায়িত্ব এড়াতে পারে না। সে পারার কথা চিন্তাও করে না। সে ভালোবাসে, প্রচন্ড ভালোবাসে তার এই
ছোটো বোনকে। কারণ তাদের এক্সিডেন্টের পর থেকে বোনটা শারীরিক দিক থেকে ফিট হলেও মানসিক দিক দিয়ে ভীষণই সিক। সে দাঁড়াল না। এগিয়ে গেল কুহুর কাছে। বোনের মাথায় হাত রাখল। কারো স্পর্শ পেয়ে কুহু মাথা তুলে অশ্রুভেজা ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখল। আর এ মুহূর্তে ভাইকে পেয়ে সে অসহায়ের মতো আকঁড়ে ধরল ভাইয়ের হাত। ভাইয়া! বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। রুপক কাঁদল না। হাসলও না। শুধু রক্ত বর্ণ চোখ নিয়ে বোনকে স্নেহডোরে বুকে আগলে নিলো। মাথায় আলতো করে হাত বুলাতে বুলাতে ভেজা কন্ঠে বলতে লাগল, ‘বনু কাঁদছিস কেন? তোর ভাইয়া আছে না? কাঁদিস না। আমি আছি। তোর ভাইয়া সব সময়
তোর পাশে আছে। সারাজীবন থাকবে।’
কুহু জবাব দিলো না। অসহায় হয়ে ভাইয়ের বুকেই পড়ে রইল। এটা আর নতুন কি! বিগত কয়েক বছর ধরে রুপক এভাবে ই আগলে রাখছে তার কলিজার টুকরো বোনটাকে। আমরণ আগলে রাখবে। কেন রাখবে না? ছোটো বোন হয়ে যদি ভাইকে বাঁচাতে চলন্ত বাসের সামনে থেকে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে পারে। তাহলে সে কেন সারাজীবন অসুস্থ বোনটাকে আগলে রাখতে পারবে না? সে পারবে।অবশ্যই পারবে। কারণ বড় ভাইরা সব পারে।

সেদিনের পর থেকে রিদওয়ানের সঙ্গে আর কারোই যোগাযোগ হয় নি।
তবে সে সত্যিই দেশে ছেড়েছে। কুহুদের বাসা থেকে বেরিয়ে সে দুইদিন হোটেলে থেকে ফিরে গেছে অচিন পুরীতে। তার কর্মস্থলে। আর কখনো আসবে কি না তাও জানে না কেউ। রুপকও আর যোগাযোগ করে নি। বন্ধু হয়েছে তাতে কি! সবাই ভালো থাকুক সবার মতো। সবারই ভালো থাকার অধিকার আছে। সেদিন ইসমত আরা বাসায় ফিরে সব শুনে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। নীরবে কেঁদেছিলেন। কেন কেঁদেছিলেন তা জানেন না তবে খুব কেঁদেছিলেন। এরপর আবারও পূর্বের মতো দিনগুলো কাটতে
লাগল। এরমধ্যে রুপক কুহুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নি। কারণ কুহুর একটাই কথা সে অসুস্থ না। সে যাবে না। আর তার এই যেতে না চাওয়াটাও সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ।
সিজোফ্রেনিয়া হলো এক ধরনের মানসিক রোগ। এই রোগে ব্যক্তিদের মধ্যে বাস্তব চিন্তা একদম কমে যায়, বিভ্রম বা হ্যালুসিনেশন হয়, গায়েবি আওয়াজ শুনতে পায়, যা ঘটেনি বা যা নেই এমন জিনিসে বিশ্বাস করে। এটি মূলত সাইকোটিক ডিজঅর্ডার। এই রোগীরা মানতেও চায় না তারা কোনো রোগে ভুগছে। এজন্য চিকিৎসকের কাছেও তারা যেতে চায় না। কুহুর এই সমস্যাটা দেখা দিয়েছি এক্সিডেন্টের ছয়মাস পর থেকে৷ এবং
সেটা চিকিৎসার মাধ্যমে আয়ত্তে ছিল। কিন্তু হঠাৎ সেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইরোটোম্যানিয়ার রোগের কিছু কিছু উপসর্গ।
এটা আবার অদ্ভুত রোগ। এই রোগের ব্যক্তিরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন উচ্চ অবস্থানে থাকা কোনো ব্যক্তি তাঁর প্রেমে পড়েছে ৷ তাকে খুব কাছে পেতে চাচ্ছে। তার প্রতি অধিকার খাটাচ্ছে। আর এটাই ঘটেছে কুহু আর রিদওয়ানের সঙ্গে। নয়তো রিদওয়ান জানে তার সীমাবদ্ধতা। তবুও সে কেন রাতেব বেলা কুহুর রুমে যাবে? অযাচিত স্পর্শ করবে? তাছাড়া কুহু নিজেই ভেতর থেকে তার রুমের দরজা আঁটকে দিয়েছিল (১৬ নং পর্বে উল্লেখ করা আছে)। বন্ধ রুমে সে কিভাবে রুমে ঢুকবে? কিভাবেই বা কুহুর উপর নিজের অধিকার খাটাবে? তাছাড়া যতই বেপরোয়া হোক
যেচে পড়ে কেন বন্ধুত্ব নষ্ট করতে যাবে। সে অবুজ নয়। বরং খুব ভালো করেই জানে একাজ করলে তাদের বন্ধুত্বে টান পড়বে।

এইদিকে,
রুপকও জানে তার বোন অসুস্থ। বন্ধু আর বোন বাসায়। তবুও সে কেন হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? কোনো ভাই বসে থাকতে পারে? বসে থাকা সম্ভব? যতই বন্ধু হোক। চিন্তা হওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়? রিদওয়ানের
বন্ধু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে একজন বড় ভাই। বোন আছে অথচ চিন্তা হবে না এটা ভাবা বোকামি। আর চিন্তার বশেই ফাইল তৈরির অজুহাতে বন্ধুর সঙ্গে সময় পার করেছে। অজুহাত দাঁড় করিয়েছে অন্যকিছুর। ব্যক্তিসম্পূর্ণ রিদওয়ানও একজন ভাইয়ের চিন্তা বুঝেও না জানার ভাণ করেছে। কারণ সেও কারো ভাই। সেও জানে এই পরিস্থিতিতে একজন ভাইয়ের চিন্তা কেন হতে পারে। কেমন হতে পারে!

To be continue………!!

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here