#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৩
জাওয়াদ জামী জামী
” বেটা, ফ্রেশ হয়ে এস, একসাথে খাব। আমরা তোমার জন্য ওয়েট করছি। আজকে তোমার আব্বুও বাসায় আছে। ” পুলক বাসায় ঢুকতেই ওর মা মল্লিকা মির্জা ছেলেকে বললেন।
” আধাঘন্টা সময় দাও, আম্মু। সারাদিনের রোদ আর ধুলাবালিতে শরীর মাখামাখি। আধাঘন্টার বেশি এক সেকেন্ডও সময় নিবনা। ”
” ওকে, বেটা। যাও শাওয়ার নাও। ”
পুলক মাথা নাড়িয়ে সিঁড়িতে পা রাখল। মল্লিকা মির্জা অপলকভাবে তাকিয়ে থাকেন তার ছেলের দিকে। তার মতে মির্জাবংশে আজ পর্যন্ত তার ছেলের মত সুর্দশন কেউ জন্মায়নি। এজন্যই বোধহয় তার ছেলে সবার এত প্রিয়। ছেলের জন্য ভালোবাসায় আবেগে চোখে পানি আসে মল্লিকা মির্জার।
আধাঘন্টা পর মির্জা বাড়ির বিশাল ডাইনিং এরিয়ায় প্রবেশ করল পুলক মির্জা। বিশাল এই ডুপ্লেক্স বাড়িতে মাত্র পাঁচজনের বাস। আতিক মির্জা ও তার স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের সাথে এখানে থাকেন তার বড়ভাই কামরান মির্জা। যে এই এলাকার এমপি। তার স্ত্রী-ছেলেমেয়েরা দেশের বাহিরে থাকে। এই মুহূর্তে কামরান মির্জা ঢাকায় অবস্থান করছেন।
” আব্বু, বড় চাচ্চু কবে ফিরবে? ” চেয়ার টেনে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল পুলক।
” সেটাতো আমার থেকে তোমার ভালো জানার কথা। ভাই আমার, কিন্তু সে কখন, কোথায়, কি করছে সেসব তুমি আমার থেকে বেশি জানো। ” বাবার কথার মাঝে প্রচ্ছন্ন রাগ চাপা থাকলনা। পুলক কিছু না বলে আঁড়চোখে মল্লিকা মির্জার দিকে তাকায়।
” ছেলেটা সারাদিন পর বাসায় এসেছে, আর তুমি কিনা ওকে কটুকথা শোনাচ্ছ! তোমার কি ছেলেকে কথা না শুনিয়ে এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছা করেনা? ”
পুলক প্রস্তুত মা-বাবার যুদ্ধ দেখতে। এটাই হয়ে আসছে গত তিন বছর যাবৎ।
” তোমার আস্কারা পেয়েই এই ছেলেটা বখাটে হয়েছে। তাকে সুইজারল্যান্ড পাঠালাম পড়াশোনা করতে, কিন্তু সে পড়াশোনা না করেই সেখানে তিন বছর কাটিয়ে দিল। দেশে ফিরে আসল ঠিকই কিন্তু পড়াশোনা না করে বখাটেপনা শুরু করে দিল! প্রতিদিনই ওর নামে কিছুনা কিছু বিচার আসছেই। ”
বাবা’র অভিযোগের বহর দেখে পুলক হাসছে। পেটে ক্ষুধা থাকায় আপাতত কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নেয়।
” তুমি থামতো। নিজেও খাও আর ছেলেটাকেও খেতে দাও। পড়াশোনা না করলেও আর দশটা পড়াশোনা জানা ছেলের থেকে কম নয় আমার ছেলে। অনেকে শুধুই পড়াশোনা শিখে কিন্তু মানুষের মত মানুষ হয় কয়জন? আমার ছেলে কিন্তু আর পাঁচজনের মত নয়। ও ঠিকই মানুষের মত মানুষ হয়েছে। ” মল্লিকা মির্জা ছেলের নামে একটা বদনাম শুনতেও রাজি নন। তাই তিনি স্বামীর কথার প্রতিবাদ করলেন।
” বাহ্ তোমার বিবেচনা দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি! কোথায় ছেলেকে শাসন করবে, সেটা না করে তুমি ওর পক্ষ নিচ্ছ? যেদিন তোমার নারী কল্যান সমিতি এই বখাটের নামে বিচার নিয়ে আসবে, সেদিন কি করবে? সেদিনও কি বলবে, আমার ছেলে লাখে এক? ”
” অবজেকশন আব্বু, তোমার ছেলে বখাটে, অশিক্ষিত হতে পারে কিন্তু সে নারীদের সম্মান দেয়। ” খাওয়ার মাঝেই বাম হাত তুলে নিজের স্বপক্ষে যুক্তি দিল পুলক। আতিক মির্জা ঠান্ডা চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে পুলক আবারও কথা বলল,
” এবার বলুন মির্জা সাহেব, রিসেন্ট কি কি অভিযোগ এসেছে আমার নামে? আমি সেগুলো খন্ডন করতে প্রস্তুত। ”
” গতকাল যাকে বেধড়ক পিটিয়েছ সে আমার প্রতিপক্ষ দলের সদস্য। তারা সারা শহর রটিয়েছে, নির্বাচনে জিততেই আমি তোমাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছি। ”
” ঐ শালা একটা রেপিস্ট। সেজন্যই ওকে ক্যালাতে হয়েছে। এরসাথে নির্বাচনের কোন সম্পর্ক নেই। ” পুলক বামহাতে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলল।
” ছোট মির্জা, তুমি ভুলে যেওনা আমি তোমার বাবা। আমার সামনে তুমি কাউকে গালি দিয়ে কথা বলতে পারোনা। এই শিক্ষা তোমাকে দেইনি। ”
” সরি, মির্জা সাহেব। আর কোন অভিযোগ আছে? ”
” তুমি নাকি আজ সারাদিন এন জি কলেজের সামনে আড্ডা দিয়েছ? সেখানে মেয়েদের উত্যক্ত করেছ? ”
” তুমি ভালো করেই জানো, আমি মেয়েদের সম্মান করি। তাদের উত্যক্ত করিনা। হ্যাঁ, আজ সারাদিন আমি সেখানেই ছিলাম। তবে কাউকে উত্যক্ত করতে নয়। নিজের ভবিষ্যৎ বউকে দেখে রাখতে। আমার একমাত্র বাবা হিসেবে তোমার জানা উচিত, ছোট থেকেই আমি নিজের জিনিসের ভাগ কাউকে দেইনি। এবং দিতে পছন্দও করিনা। তাই ভবিষ্যৎ বউকে সিকিউরিটি দিতে এখন থেকে বেশিরভাগ সময় সেখানেই কাটাব। ”
ছেলের কথা শুনে আতিক মির্জার গলায় ভাত আটকে গেছে। তিনি পুলকের দিতে তাকিয়ে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছেন।
” বেটা, তুমি সত্যি বলছ! আমার জন্য বউমা খুঁজে পেয়েছ? ও মাই গড! আমার বাসায় নতুন বউ আসবে, আমি দিদুন হব। পুষ্পিতা ফুফি হবে। এর থেকে ভালো নিউজ আর কি হতে পারে! বেটা, বউমার ছবি আছে তোমার কাছে? ” মল্লিকা মির্জা আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন।
” তুমি থামবে প্লিজ। যেদিন তোমার ভবিষ্যৎ ছেলের বউ, তোমার ছেলের নামে হ্যারাসমেন্টের কেস দিবে সেদিন কি করবে? নাকি সেদিন ছেলেকে মেয়ে হিসেবে পরিচয় করাবে জাতির কাছে? বলবে নাকি, আমার ছেলে কোন মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকায়না, সে চেহারায় ছেলে হলেও, মনের দিক থেকে মেয়ে? ”
” মির্জা সাহেব হয় তুমি স্বীকার কর তুমি পাগল, নয়তো আমার ভাগ্য দেখে জেলাস হচ্ছ এটা মেনে নাও। তবুও অযথাই আমার নামে উল্টাপাল্টা দুর্নাম ছড়াবেনা। কাকে মেয়ে বলছ তুমি? একবার বিয়ে করিয়েই দেখাওনা। নয়মাস পরেই তোমাকে নাতি-নাতনি উপহার দেব। ” আতিক মির্জার দিকে তাকিয়ে গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বলল পুলক।
” মল্লিকা, আজকের পর থেকে তোমার এই অসভ্য ছেলেকে আমার সাথে খেতে দিবেনা। লেখাপড়া বাদ দিয়ে যেমন উচ্ছনে গেছে, মিশেও তেমনি লাফাঙ্গাদের সাথে। তেমনি তার মুখের ভাষাও হয়েছে টোকাইদের মত। ”
” ভুল কি বলেছে আমার ছেলে! তুমি বাবা হয়ে যদি নিজের ছেলেকে মেয়ের উপাধি দিতে পার, তবে আমার ছেলেও পারে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার প্রমান দিতে। ”
” মাফ চাই তোমাদের কাছে। তোমরা মা-ছেলে যা খুশি কর। আমি তোমাদের সাথে নেই। ” আতিক মির্জা রেগে গেছেন।
” মেয়র স্যার, জেলা অডিটোরিয়ামে কালকে তোমার প্রোগ্রাম আছে বোধহয়? আমি সকালের দিকে যেতে পারবনা। তবে আমার ছেলেরা সকাল থেকে সেখানে থাকবে। প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে আমি যাব। সাবধানে থাকবে। তোমার প্রতিপক্ষ দলের লোকজন আগামী নির্বাচনে তোমাকে মেয়র হিসেবে চাইছেনা। স্বার্থের জন্য তারা যেকোন কিছু করতে পারে। নিজের সিকিউরিটি বাড়াও। আগেই বলেছি, দুইটা গানম্যান রাখ। ”
” শোন পুলক, আমি সহিংস রাজনীতি ঘৃণা করি। আমার আব্বাও কিন্তু মেয়র ছিলেন। তার কখনোই গানম্যানের প্রয়োজন পরেনি। তেমনি আমারও পরবেনা। ”
” আব্বু, দাদুর সেসব প্রয়োজন পরেনি জন্য তোমারও যে প্রয়োজন পরবেনা এমনটা কিন্তু নয়। দিন পাল্টেছে। তুমি সহিংসতা পছন্দ করনা বলেই যে অন্যরাও করবেনা তেমনটা নয়। তোমার বড় ভাইকে দেখে শিখ। চাচ্চুরও কিন্তু গানম্যান আছে। এবং সেটা থাকা দরকার। অযথাই জিদ করোনা। আমি রাতেই কথা বলে রাখব এই বিষয়ে। সকালে তুমি গানম্যান পেয়ে যাবে। ”
” মল্লিকা, তোমার ছেলে কি বলল শুনেছ? রাতেই সে গানম্যান নিয়োগ দিবে! তুমি এখনও বলবে, তোমার ছেলে মানুষ হয়েছে? ”
” আমাকে যা খুশি বল। আই ডোন্ট কেয়ার। আমার কাছে তুমি আগে। তাই তোমাকে নিরাপত্তা দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। আরেকটা কথা, তোমার বংশের সবাই তো উচ্চ শিক্ষিত। আমি নাহয় অশিক্ষিত হয়ে রইলাম। লেখাপড়া যদি মানুষের চরিত্র কিংবা শিক্ষার মাপকাঠি হত, তবে দেশের হাজারো অশিক্ষিত মানুষেরা দেশের জন্য প্রান দিতনা। লেখাপড়ার আগে মানুষের মনুষ্যত্ব যাচাই করতে শিখ, মাই ডিয়ার আব্বু। ”
এরপর আর কোন কথা হয়না। যে যার মত নীরবে খেয়ে উঠল।
আশফি রুমে বসে দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। আজকে কলেজে গিয়ে ও যথেষ্টই লজ্জা পেয়েছে। গতকাল পর্যন্তও যেই টিচার ওকে ধমকাত আজ সেই চিটারই ওকে হুজুর হুজুর করেছে। এভাবে কতদিন চলবে? আশফি আর কিছু ভাবতে পারছেনা। নিজের করা বোকামির জন্য নিজের গালেই থাপড়াতে ইচ্ছে করছে।
” কি রে জাতির ভাবী, কি ভাবছিস এত? ” আশফির ভাবনার মাঝেই তিয়াসা রুমে আসল।
” বইন, তুইও শুরু করে দিসনা। এমনিতেই সারাদিন যথেষ্ট প্যারা সহ্য করেছি। এরকম চলতে থাকলে আমি সাতদিনেই পাগল হয়ে পাবনা যাব। ”
” কেন আর সমাজসেবা করবিনা? এখনতো সমাজসেবা করতে তোর জন্য সুবিধা হবে। নেতার ছেলের নজর আছে তোর ওপর। আর কয়েকদিন পর দেখবি তুই ফেমাস হয়ে গেছিস। ভাগ্য ভালো হলে মঞ্চে উঠে লেকচারও দিতে পারবি। ” তিয়াসা আশফির বোকামিতে সত্যিই রেগে গেছে।
” আমাকে বাঁচা, বইন। ঐ সাদা মুলাকে দেখলেই আমার রাগ হচ্ছে। কোনদিন না ওর কানের নিচেই দুইটা লাগিয়ে দিব। ” আশফির কথা শুনে তিয়াসা ওর দিকে তাকিয়ে থাকল।
” সাদা মুলা! মানেটা কি? ”
” ঐ যে পুলক মির্জা। ঐটাই সাদা মুলা। পোলা মানুষের এত ফর্সা হতে হবে কেন! ফর্সা হবে মেয়েরা। দেশে আমার মত কত শ্যামলা চেহারার মেয়ে আছে, গায়ের রং চাপা জন্য যাদের বিয়ে হচ্ছেনা। ঐ সাদা মুলার গায়ের রং চাপা হলে খুব কি দোষের হত? ”
” আশফির বাচ্চা। তুই এখনও শোধরাবিনা? বিপদ থেকে কিভাবে উদ্ধার হবি সেই চিন্তা না করে তুই অন্যের গায়ের রং নিয়ে গবেষণা করছিস? এরপর নতুনভাবে কোন বিপদে পরলে আমি তোর পাশে থাকবনা বলে দিলাম। ”
আশফি নিজের বোকামিতে কপাল চাপড়ায়। যতই ভাবে বোকামি করবেনা, ততই বোকা বোকা কাজ করে ফেলে।
” রাগ করিসনা, কলিজার বইন। আর এমন কথা বলবনা। তুই শুধু আমাকে এই বিপদ থেকে বাঁচার পথ বলে দে। ”
” শোন ওরা যতই তোকে বিরক্ত করুক, তুই কোন প্রতিক্রিয়া দেখাবিনা। মনে থাকবে? ”
” থাকবে। ”
গভীর রাত। পুরো শহর ঘুমে আচ্ছন্ন। পুরো ধরাধাম স্তব্ধ হয়ে রাতের কোলে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। আকাশে থালার মত চাঁদ রুপোলী আলো বিলাচ্ছে। তারকারাজি মিটিমিটি জ্বলছে।
খোলা বারান্দায় বসে একদৃষ্টিতে অন্তরিক্ষ পানে তাকিয়ে আছে পুলক। ওর চিন্তায় চেতনায়, সমস্ত সত্তা জুড়ে বিরাজ করছে এক শ্যামাঙ্গীনি। যার হাসি পুলকের হৃদয়ে প্রেমোহিল্লোল তুলেছে। যার বাঁকা চাহনির মায়ায় নিজেকে হারিয়েছে সে। সে এক মুহূর্তের জন্যও সেই চঞ্চলা পাখীকে ভুলতে পারছেনা। আজকে রাত যেন ফুরোবার নয়। পুলক সকালের অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত। কখন সকাল হবে আর কখন সে দেখবে তার শ্যামাঙ্গীনিকে। মৃদুমন্দ বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে পুলকের শরীর। এলোমেলো করে দিচ্ছে ওর মসৃন চুল। বাতাসে যেন ভাসছে এক শ্যামাঙ্গীনির হাসির ঝংকার। সেই ঝংকারে উতলা হচ্ছে পুলকের হিয়া।
চলবে…