সূচনা #রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা জাওয়াদ জামী জামী

0
51

” মামা, কতক্ষণ এভাবে রিক্সা দাঁড় করিয়ে রাখবেন? এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে আমাদের প্রথম ক্লাস মিস হয়ে যাবে। এদিকে সূর্য মামাও আজ বড্ড খেপেছে। আপনাদের দুই মামার প্যারায়, আমরা দুই অবুঝ ভাগ্নি সিদ্ধ হচ্ছি। শুনেছি মামারা নাকি আদুরে হয়। কিন্তু আপনাদের দেখে সেই ধারনা পাল্টে গেছে আজকে। ” ওড়নার কোনা দিয়ে বাতাস করার বৃথা চেষ্টা করছে আশফি। ঘামে ওর মুখ ভিজে গেছে। কপাল বেয়ে ঘামের সরু রেখা নেমে এসে ভ্রুতে মিশেছে। টিস্যু বের করে মুখ মুছল মেয়েটা।

” আমার কি দোষ কন? রাস্তায় জ্যাম বাঁধছে, তাই আমিও রিক্সা থামাইছি। কতক্ষণে জ্যাম ছুটবো হেইডাও তো জানিনা। ” রিক্সাওয়ালা গামছায় মুখ মুছে বিরক্ত হয়ে বলল।

” তিয়াসা, চল হেঁটেই যাই। হেঁটে গেলে কলেজে পৌঁছাতে দশ মিনিট লাগবে। প্রথম ক্লাস কিছুতেই মিস দেয়া যাবেনা। ” আশফি তাড়া দিচ্ছে।

” ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস তো? দুই মিনিট হাঁটার পর আমার পিন্ডি চটকাবিনাতো? তোর ভুলভাল সিদ্ধান্তে এর আগেও বহুৎ হ্যাপা পোহাতে হয়েছে। ” তিয়াসা কাটকাট গলায় বলল।

” আরে ধুর, সোজা কলেজে হেঁটে যাব, এতে ভেবে দেখার কি আছে! ” আশফি ততক্ষণে রিক্সা থেকে নেমে রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছে।

যানজটকে হাজারটা গালি দিতে দিতে হাঁটছে আশফি। ওর পাশেই ভুরু কুঁচকে বিরক্তিকর মুখে ভাবলেশহীন ভাবে হেঁটে চলেছে তিয়াসা। ও ভালো করেই জানে আশফির মনের ঠিক নেই। হুটহাট সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে ওস্তাদ মেয়েটা।

কিছুদূর যেতেই ওরা লক্ষ্য করল রাস্তার মাঝখানে বেশকিছু মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কিছু একটা দেখছে। এভাবে দাঁড়ানোর কারনেই যানজট বেঁধেছে।

” আর মা’র’বে’ন’না, ভাই। আমাকে ছেড়ে দেন। আমার ভুল হয়েছে। এরপর থেকে আপনাদের সব কথা মেনে চলব। ” রাস্তার মাঝে আট-দশজন ছেলে মিলে একজনকে বেধড়ক মা’র’ছে। ছেলেটির বাঁচার আকুতি ঐ আট-দশজনের মধ্যে কোনও প্রভাব ফেলছেনা। ওদের মধ্যে কেউ লাঠি দিয়ে মারছে , আবার কেউ কেউ লাথি আর কিল-ঘুষি অনবরত মেরেই চলেছে।

রাস্তায় রিতীমত জ্যাম বেঁধে গেছে। লোকজন ভীড় করে একজনকে মা র খেতে দেখছে। কিন্তু কেউই তাকে বাঁচাতে এগিয়ে গেলোনা। লোকটার বেঁচে থাকার আকুতি তাদের মন গলাতে পারেনি।

” এই তিয়াসা, চল গিয়ে দেখি কি হয়েছে। রাস্তা ব্লক করে কোন বাপের ব্যাটা সার্কাস দেখাচ্ছে, একটু দেখে আসি। ” আশফি তিয়াসার হাত ধরে টান দেয়।

” এইতো কিছুক্ষণ আগেই ক্লাস করবি, ক্লাস করবি বলে মাথা খারাপ করে দিচ্ছিলি। এখন আবার সার্কাস দেখতে যেতে চাইছিস, এতে ক্লাস মিস হবেনা? এত দেখাদেখির কিছু নেই। সোজা কলেজে চল। ”

” এমন করিস কেন? চলনা দেখে আসি। তুই না আমার কলিজার বইন। প্লিজ চল। ” আশফির বায়না শুনে তিয়াসার রাগ তড়তড় করে বাড়তে থাকে।

” ভালো করে চোখ মেলে দেখ পুরো রাস্তা পুরুষ মানুষে ভর্তি, মেয়ে হয়ে এতগুলো পুরুষের মাঝখানে যেতে তোর লজ্জা লাগবেনা? ”

” কৌতুহল জিনিসটা কি সেটা বুঝিস নিশ্চয়ই? তুই যেতে না চাইলে থাক। আমি গিয়ে দেখে আসি। এই যাব আর এই আসব। ” আশফি তিয়াসার বারণকে পাত্তা না দিয়ে পা বাড়ায় ভীড়ের দিকে।

” কু’ত্তা’র বাচ্চা পা ছাড়। তোরে যদি আজ শেষ না করছি তবে আমার নাম শাহেদ নয়। ” নিজেকে শাহেদ নামে পরিচয় দেয়া ছেলেটাকে একজন মুমূর্ষু ব্যক্তিকে লাথি দিতে দেখে আশফির পিলে চমকে যায়।

চোখের সামনে একজনকে মা’র’তে দেখে দিগবিদিক জ্ঞান হারায় আশফি। আশেপাশের কয়েকজনকে অনুরোধ করল ছেলেটাকে বাঁচাতে। কিন্তু কেউ ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে আগ্রহ নিয়ে মারপিট দেখতে থাকে।

ততক্ষণে শাহেদ নামের ছেলেটি হাত লাঠি নিয়েছে। যখনই সে লাঠি দিয়ে রাস্তায় পরে থাকা ব্যক্তিকে আঘাত করতে যাবে, ঠিক তখনই ও অনুভব করল ওর বাম গাল জ্বলছে। আ’গু’ন চোখে সামনে তাকাতেই দেখল একটা মেয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে রাগে ফুঁসছে। আর সেই মুহূর্তেই শাহেদ বুঝতে পারল সামনের মেয়েটা ওকে থাপ্পড় মেরেছে। রাগে পাগল হওয়ার দশা শাহেদ নামের ছেলেটির। ও লাঠি ফেলে হুংকার দিয়ে আশফির মুখোমুখি হয়। কিন্তু আশফি তাকে থোড়াই পাত্তা দিল!

” এই যে মিস্টার, কি ভেবেছেন নিজেকে?টপ টেরর নাকি গ্যাংস্টারের চ্যালা ভাবেন নিজেদের? রাস্তার মাঝখানে একটা মানুষকে মারছেন, আপনাদের আইনের প্রতি নূন্যতম সম্মান নেই? মানুষটার শরীরে যদি আরেকবার আঘাত করেন, তবে আপনাদের প্রত্যেককে থাপড়াব বলে দিলাম। আহারে কিভাবে মেরেছে! একটুও দয়ামায়া নেই এসব হিটলারের বংশধরদের। ” আশফি চারপাশে তাকাচ্ছে সাহায্যের আশায়।

” এই মেয়ে তোমার সাহস হয় কি করে আমাদের মাঝে এসে কথা বলার? ” শাহেদ আশফির হাত ধরতে গেলেই কারও ইশারায় থেমে যায়।

হকিস্টিক হাতে একজন এগিয়ে আসল আশফির কাছে। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে টি-শার্টের গলায় ঝুলিয়ে রাখল।

নিজের পাশে কারও অস্তিত্ব টের পেয়ে আশফি ঘুরে তাকালো সেদিকে। লম্বামত একটা ছেলেকে হকিস্টিক হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয়ে ঢোক গিলল। এতক্ষণে ও বুঝতে পারছে, ঝোঁকের মাথায় এভাবে এখানে আসা ঠিক হয়নি। তবে এই মুহূর্তে এদের সামনে ভয় প্রকাশ করার ইচ্ছে মোটেও নেই আশফির। চারপাশে চোখ বুলিয়ে বুঝল এই ছেলেটাই পালের গোদা। গলা পরিষ্কার করে ছেলেটার মুখোমুখি হলো সে।

” এই যে, কি নাম যেন আপনার? হোয়াট এভার যে নামই হোকনা কেন, আপনার নাম জানার কোনও আগ্রহ আমার নেই। আপনি শুধু বলুন, মানুষটাকে এভাবে মা’র’ছে’ন কেন? চেহারা দেখে তো ভদ্রঘরের ছেলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু আচরণ টো’কা’ই’য়ে’র মত কেন? ”

আশফির কথা শুনে দলের বাকি সদস্যরা হৈ হৈ করে এগিয়ে আসতেই ছেলেটা হাতের ইশারায় ওদের থামতে বলল। আর সাথে সাথেই ওরা থেমে যায়।

” তো এবার আমাকে কি করতে হবে, ম্যাম? ” ছেলেটা ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল। তার চোখ এক মুহূর্তের জন্যও আশফির দিক থেকে সরে যায়নি।

” এই মুহুর্তে ইনাকে নিয়ে ডক্টর কাছে যাবেন। অবশ্য আমিও যাব আপনাদের সাথে। আপনাদের বিশ্বাস নেই। দেখা যাবে মাঝ রাস্তায়ই ইনাকে ফেলে আপনারা কেটে পরবেন। ” সবকিছু নিজের ইচ্ছেমত হওয়ায় আশফির মনোবল বেড়ে গেছে।

” আপনি ভুল করছেন, ম্যাম। যাকে সাহায্য করতে এসেছেন, সে ততটাও ভালো নয়। ”

” ভালো হোক আর খারাপ হোক সে তো মানুষ। চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার তার আছে। অবশ্য আপনার মত রাস্তার পাতি মাস্তানের সাথে এই বিষয়ে কথা বলাই ঠিক নয়। ” আশফি মুখ ঝামটা দিয়ে বলল।

” শাহেদ, গাড়ি দেখ। ইনার ইনাকে ডক্টরের কাছে নিতে হবে। ” ছেলেটা বলামাত্রই কয়েকজন গাড়ির খোঁজে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে যায়।

এতক্ষণ তিয়াসা দূর থেকে সব দেখছিল। আশফির এমন কাণ্ডে ও যারপরনাই বিরক্ত। ও আশেপাশের মানুষের দিকে লক্ষ্য করে বুঝে গেছে এরা কোনও সাধারণ গুন্ডা নয়। এদের দিকে কেউ সরাসরি তাকাচ্ছেনা। ও ধীর পায়ে এগিয়ে যায় আশফির দিকে।

” আশফি, চল আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। এই ভাইয়ারাই ইনাকে হসপিটালে নিয়ে যাবে। ” তিয়াসা আশফিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

” তুই কি রে, তিয়াসা! একজন মৃতপ্রায় মানুষ রেখে এভাবে চলে যাব! মানবতা আজ কোথায়! ”

” মানবতা বর্তমানে মানুষের পকেটে বাস করে। এবার তুই চল, বইন। ” তিয়াসা পারলে কেঁদে ফেলবে।

” দুঃখিত বইন, এভাবে কোন মুমূর্ষু মানুষকে ফেলে আমি কোথাও যেতে পারবনা। আগে ইনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করব, তারপর কলেজে যাব। ”

” ভাই, গাড়ি এনেছি। ” শাহেদ এসে দলনেতা ছেলেটাকে জানাল।

” চলুন ম্যাম, আপনার ইনাকে নিয়ে কোথায় যাবেন? মর্গ, শ্মশান কিংবা গোরস্থান যেখানে খুশি সেখানেই যেতে পারেন। ”

” বালাই ষাট। ঐসব অজায়গায় যাব কেন! আপনি মেডিকেলে নিয়ে চলুন। আয় তিয়াসা, বলাতো যায়না আমরা না গেলে এরা ইনাকে মেরেও ফেলতে পারে। ”

মেডিকেলের ইমারজেন্সির ডক্টর মনোযোগ দিয়ে রুগীকে দেখছেন। রুগীর অবস্থা খুব একটা ভালো নয়।

” কিভাবে হলো? এর অবস্থা ভালো বুঝছিনা। ” দলনেতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ডক্টর।

” আমরা একে কেলিয়েছি, ডক্টর। আপনি দেখে বলুন এর কয়টা হাড় ভেঙেছে। এর মিডিলস্ট্যাম্প গেছে না ঠিকঠাক আছে? ”

লোকটার এমন কথা শুনে আশফি বিস্ময়ের চূড়ায় অবস্থান করছে।

” আচ্ছা মানুষ তো আপনি! একে তো মানুষটাকে মে রে ভর্তা করেছেন, তারওপর এমন আজেবাজে কথা বলছেন? আপনাকে পুলিশে দেয়া দরকার। নেহাৎই আমার কাছে পুলিশের নম্বর নেই। এই যে ডক্টর, পুলিশের নম্বর আছে? আমাকে দিন। আজই এর একটা ব্যবস্থা করছি। ”

” হ্যালো ম্যাম, আমার কাছে পুলিশের নম্বর আছে। নিবেন? আজকে আপনার ইচ্ছে পূরনের দিন। আপনার সব ইচ্ছে পূরণ করেই দিই কি বলেন? ”

নিজেদের দলনেতার এমন শান্ত রূপ দেখে অভ্যস্ত নয় তার দলের কেউই। তারা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তাদের ভাইয়ের দিকে।

” ডক্টর, সাহস দেখেছেন লোকটার! সে-ই মে রে সে-ই আবার পুলিশের নম্বর দিতে চাইছে! কি দিন আসলো! ”

প্রবীন ডক্টর বুঝলেন কোথাও কোন ঘাপলা আছে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন যুবকটিকে কেউকেটা ধরনের বলেই মনে হচ্ছে। দীর্ঘ চাকরি জীবনে অনেক অভিজ্ঞতাই তিনি অর্জন করেছেন। তাই এই বোকাসোকা মেয়েটার কথায় এই বয়সে বিপদে জড়াতে চাননা তিনি। তাই বুদ্ধি খাটিয়ে সুদর্শন যুবকটিকে জিজ্ঞেস করলেন,

” কি হয়েছিল আমি কি জানতে পারি? কেন মে রে ছ ছেলেটাকে? ”

” এই বেজন্মা কীট কলেজের একটা মেয়েকে রেপ করতে গিয়েছিল। আমার ছেলেরা ওকে হাতেনাতে ধরেছে। নয়তো এতক্ষন মেয়েটা সমাজে কলঙ্কিনী উপাধি পেত। ”

ছেলেটার কথা শুনে আশফি ছিটকে দুইহাত পেছনে যায়। ভয়ে ভয়ে তাকায় সামনের ছেলেগুলোর দিকে।

ডক্টর যা বোঝার বুঝে গেলেন। তার সন্দেহই ঠিক। তবে তিনি যুবকটির পরিচয় পেতে মরিয়া।

” তোমার পরিচয় জানতে পারি? ”

” পুলক মির্জা আমার নাম। ”

ডক্টরসহ ইমারজেন্সী রুমে দাঁড়ানো সবাই তার পরিচয় পেয়ে হকচকিয়ে গেল। তিয়াসা দু-হাত দিয়ে চেপে ধরল আশফিকে। কারন ওরা জানে পুলক মির্জা এখানকার মেয়র আতিক মির্জার ছেলে। যে এলাকার ত্রাস। যার নামে বাঘে-মহিষে একঘাটে পানি খায়।

#সূচনা
#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
জাওয়াদ জামী জামী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here