রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা #পার্ট_১৯ জাওয়াদ জামী জামী

0
176

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_১৯
জাওয়াদ জামী জামী

” বেয়াইন, আমরা আজকেই তিয়াসা, আশফিকে বাড়িতে নিতে চাই। ওরা জামাইসহ কয়েকদিন গ্রামে গিয়ে বেড়িয়ে আসুক। ” তিয়াসার বাবা তোফাজ্জল হোসেন মল্লিকা মির্জাকে বললেন।

” আমি আপানার জামাইদের জিজ্ঞেস করে দেখি ওরা কি বলে। ওদেরতো আবার হাজারো কাজ থাকে। আমি দেখি ওরা কি বলে। আপনারা মেয়ের বাড়ি ঘুরে দেখুন। এরপর শাহেদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসুন। আশফি মা, তুমি সবাইকে নিয়ে তোমার বাড়ি ঘুরে দেখাও। ” মল্লিকা মির্জা বাগানে গেলেন।

রিনা আক্তার আশফির শ্বশুর বাড়ি দেখে হা হয়ে গেছে। আফজাল হোসেন ভিষন খুশি। তিনি ভাবতেই পারছেননা তার মেয়ের এত বড় বাড়িতে বিয়ে হয়েছে।

” কি রে আশফি, তর তো দেখতাছি সোনায় বাঁন্ধানো কাপাল! সারাজীবন যেইগুলান পাসনি, এখনতো দেখতাছি সবই তর হাতের নাগালে আইছে! এখন তরে আর পায় কে। ” রিনা আক্তার আশফিকে বাঁকা গলায় বলল।

” কি আর করবে বল, রিনা? মা না থাকলে যা হয়। আশফির মা ছিলনা, তাই জীবনে অনেক কিছুই পায়নি, কোন শখ পূরণ করতে পারেনি। আল্লাহ এবার মুখ তুলে চেয়েছেন, অসহায় মেয়েটার এবার সুখী হবে। আল্লাহ চেয়েছেন আশফির এত বড় শ্বশুর বাড়ি হবে। মল্লিকা মির্জার মত শ্বাশুড়ি পাবে, পুলকের মত স্বামী পাবে। সেখানে কেউ বাঁধাও দিলেও কাজ হতোনা। তুমি আশফির চিন্তা না করে, তোমার ছেলেমেয়ের কথা চিন্তা কর। তোমার মেয়েরও বিয়ের বয়স হচ্ছে, ওর জন্য ভালো পাত্র দেখতে শুরু কর এখন থেকেই। আর আফজাল ভাই, আজকে জামাই-মেয়েদের সাথে কাউকে নিয়ে যেতে হবে তো। যেহেতু ওদের বিয়েতে অনুষ্ঠান হয়নি, এখান থেকে কেউ যায়সি, সেহেতু কিছু দ্বায়িত্ব আমাদেরও পালন করতে হবে। ” রিনা আক্তারকে থামিয়ে দিলেন তিয়াসার আম্মু রত্না পারভীন। এরপর তিনি আফজাল হোসেনকে উদ্দেশ্য করে বললেন।

” আপনি ঠিকই বলেছেন, ভাবী। আমি বেয়াইনের সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা বলব। আমরা বিয়েতে মেয়েদের শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়দের আপ্যায়ন করার সুযোগ পাইনি। যা করার এখনই করতে হবে। ” আফজাল হোসেনও ভাবীর কথায় সায় জানালেন।

” কি কও তুমি! এদের যত আত্মীয় দেখতেছি কারে রাইখা, কারে নিবা? কত খরচ হবে চিন্তা কইরা দেখছ? হুঁশ আছে না একবারেই গেছে? ” এবার আর সহ্য করতে পারলনা রিনা আক্তার। খেঁকিয়ে উঠল স্বামীর ওপর।

” আমি আগেই বলেছি, তোমার এতসব চিন্তা করতে হবেনা, রিনা। এখান থেকে যদি আমার মেয়েদের সাথে পঞ্চাশ জনও যায় তাদের আপ্যায়ন আমিই করব। তোমার স্বামীর এক টাকাও খরচ করতে হবেনা। তুমি বরং নিজের ছেলেমেয়ের জন্য টাকা গোছাও। সতীনের সন্তানের চিন্তা তোমার করার দরকার নেই। তাদের কথা ভেবে অযথাই নিজের শরীর-স্বাস্থ্য নষ্ট করোনা। ওদের কথা ভাববার জন্য আমিই আছি। ” এবারেও রত্না পারভীন প্রতিবাদ করলেন।

বড় জায়ের ঝাঁঝালো কণ্ঠের কথা শুনে মিইয়ে যায় রিনা আক্তার। মাঝেমধ্যেই বড় জা এভাবেই তাকে কথা শোনায়। সে কিছু বলতেও পারেনা। তার বড় জা ধনী ঘরের মেয়ে, তার বড় ভাসুরের অবস্থা তাদের থেকেও ভালো, তার ছেলেরা ভালো চাকরি করে। মোটকথা সবদিক থেকেই তারা আফজাল হোসেনের পরিবার থেকে ভালো অবস্থানে আছে। তাই সবকিছু ভেবে চুপচাপ থাকে রিনা আক্তার। আজকেও তাই থাকল।

আশফি নীরবে চোখের পানি ফেলছে। ওর বিয়ে হওয়ার পরও আম্মা এমনভাবে কথা বলবে ও সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। তা-ও আবার ওর শ্বশুর বাড়িতেই এভাবে বলছে! তিয়াসার হাতের স্পর্শে ওর দিকে তাকিয়ে হাসার বৃথা চেষ্টা করল মেয়েটা। কিন্তু পারলনা। সকলের সামনেই ঝরঝর করে চোখের পানি ঝরালো।

***

মল্লিকা মির্জা পুলক, শাহেদের সাথে কথা বললেন। পুলক আম্মুর কথা শুনে শ্বশুর বাড়ি যেতে রাজি হয়। কিন্তু শাহেদ প্রথমে নিমরাজি হলেও মামীর জোড়াজুড়িতে। মল্লিকা মির্জা আফজাল হোসেনকে মেয়ে-জামাইয়দের নেয়ার কথা বললে, আফজাল হোসেন জানান, তিনি চান এখান থেকে কয়েকজনও যাক ওদের সাথে। এতেই বেঁধে গেল বিপত্তি। মল্লিকা মির্জা কাকে রেখে কাকে পাঠাবেন? তিনি যদি বড় কাউকে পাঠান, তবে কাকে পাঠাবেন কিংবা শুধু যদি পুষ্পিতাকে পাঠান তবে ওর বাকি কাজিনরা মন খারাপ করবে। অনেক চিন্তা করে তিনি কথাটা তুললেন আফজাল হোসেন ও তিয়াসার আম্মুর কাছে।

” বেয়াই, আপনারা আজ শুধু আপনাদের মেয়ে-জামাইদের সাথে করে নিয়ে যান৷ পরে আমরা সময় করে আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে আপনাদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসব। ”

” এ কথা কেন বলছেন, বেয়াইন! বিয়েতে এখান থেকে কেউ যেতে পারেনি, আজ অন্তত সাথে কেউ যাক। ” আফজাল হোসেন চাইছেন সাথে কাউকে নিয়ে যেতে।

” সত্যি কথা বলতে কি, আমার ভাইদের ছেলেমেয়ে আছে। বোনদের মধ্য আমি ছাড়া কারও কোন ছেলে নেই। তাই স্বভাবতই পুলককে সবাই বেশি ভালোবাসে। তাই আমার ছেলের বিয়ের পর কাকে রেখে কাকে আপনাদের বাড়িতে পাঠাব সেটা বুঝতে পারছিনা। যদি আমার ভাইয়ের বউদের মধ্যে কোন একজনকে পাঠাই, তবে অন্যরা যদি কষ্ট পায় কিংবা ভাইয়ের বউদের রেখে বোনদের পাঠাব সেটাও খারাপ দেখায়। আবার আমার শ্বশুর বাড়ির দিকের অনেকেই আছে যাদের আমি ফেলতে পারিনা। আবার সবাইকে বাদ দিয়ে যদি শুধু পুষ্পিতাকে পাঠাই তবে ওর বাকি কাজিনরা মন খারাপ করবে। এছাড়াও শাহেদের অনেক আত্মীয়-স্বজনই আছে। এবার বুঝেছেন তো আমার সমস্যা? তারচেয়ে বরং আপনারা শুধু ওদেরকেই নিয়ে যান। আমরা পরে কোনদিন সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যাব বেয়াই বাড়িতে। ”

” তা কি করে হয়? আমরা মেয়ের বাড়ি থেকে আগেই জামাইয়ের বাড়িতে আসলাম কিন্তু আপনারা এখান থেকে কেউ যাবেননা এটা ভালো দেখায়না। এক কাজ করলে কেমন হয়, আজকে পুষ্পিতাসহ ওরা সব বোনেরা আমাদের সাথে যাক। দুইদিন পর আপনারা সবাই গিয়ে ওদের নিয়ে আসবেন। ” তোফাজ্জল হোসেন মল্লিকা মির্জাকে প্রস্তাব দিলেন। তার প্রস্তাব রিনা আক্তার ছাড়া সবারই মনে ধরেছে।

” আচ্ছা, আমি তাহলে আমার ভাসুর আর পুলকের বাবার সাথে কথা বলে দেখি। তারা যে সিদ্ধান্ত দেয় সেটাই হবে। ” মল্লিকা মির্জা বেরিয়ে গেলেন তার অভিভাবকদের সাথে কথা বলতে।

” বড় ভাই, আপনে কি পাগল হইছেন? এখন এই বাড়ি থাইকা সব আত্মীয়-স্বজন গেলে কত খরচ হবে সেই চিন্তা একবার করছেন? আপনার নাহয় অনেক টাকা আছে তাই হিসাব কইরা কথা কননা, কিন্তু কিন্তু আপনের ভাইয়ের তো এত টাকা নাই। ” রিনা আক্তার খেঁকিয়ে উঠল তার ভাসুরের ওপর।

” আমি আগেই বলেছি, এসব নিয়ে তোমাকে এত চিন্তা করতে হবেনা। আমার স্বামী পাগল কি না সেটা আমি বুঝব। তোমার এত না বুঝলেও চলবে। তুমি নিজের চরকায় আজীবন তেল দিয়েছ, এবারও তাই কর। খরচের বিষয়ে আমরাই দেখব। এতদিন গ্রামের মানুষের কাছে সম্মান খুঁইয়েছ এবার কি নতুন আত্নীয়দের বাড়িতে এসে সম্মান বিলাতে চাও? অবশ্য যার কোন সম্মান নেই, তাকে সম্মানের কথা বলা মানে অরন্যে রোদন বৈ কিছুই নয়। তবুও বলব, দয়া করে নিজের মুখ বন্ধ রাখ। তোমার সম্মান না থাকতে পারে কিন্তু আমাদের আছে। ” রত্না পারভীন এবার সরাসরি রিনা আক্তারকে কথা শোনালেন।

রিনা আক্তার আর কিছু বলার সাহস পেলোনা।

কিছুক্ষণ পর মল্লিকা মির্জা এসে জানালেন আজকে পুষ্পিতারা যাবে পুলকদের সাথে। কালকের পরদিন এখান থেকে কয়েকজন গিয়ে ওদের নিয়ে আসবে।

***

কাজিন মহল হৈ হৈ করতে করতে রওনা দিল।

গ্রামে পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। ওরা রওনা দিয়েছিল সন্ধ্যার পর। তবে রাতে আর রত্না পারভীনের রান্নার ঝামেলা করতে হলোনা। মল্লিকা মির্জা খাবার বেঁধে দিয়েছিলেন। রত্না পারভীন নিতে না চাইলেও তিনি জোড় করেই দিয়েছেন। তবুও রত্না পারভীন বাড়িতে ফোন করে তাদের কাজের মেয়েকে রান্নার জোগাড় করতে বললেন। এবং তিনি বাড়িতে এসেই লেগে গেলেন রান্নার কাজে।

” ভাবী, তোমাদের বাড়িতো হেব্বি। কত বড় বাড়ি! শহুরে যে-কোন হাই ক্লাস বাড়িকে হারা মানাবে তোমাদের বাড়ি। কি চমৎকার পরিবেশ! ”
নিলাশা ওদের বাড়ি দেখে মুগ্ধ হয়ে বলল।

নিলাশার সাথে বাকি সবাি তাল মেলাল।

আশফি ভয়ে ভয়ে আছে। না জানি আম্মা কখন কোন ভুল ধরে ওকে সবার সামনে হেনস্তা করে। ও ননদদের সাথে কথা বলছে ঠিকই কিন্তু ওর ভয় কাটছেনা কিছুতেই।

রত্না পারভীন নাস্তা দিয়ে গেলেন। সবারাই পেট ভরা থাকায় কেউই তেমন কিছু খেলোনা। নাস্তার পর সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে। তিয়াসা, আশফি রত্না পারভীনকে রান্নায় সাহায্য করছে। ওরা সবাই তিয়াসার রুমেই বসে আছে।

পুলক ওর কাজিন মহলের ওপর রেগে আছে। দুপুরে এদেরকেই দেড় লাখ টাকা দিতে হয়েছে মনে হলেই রাগে ফেটে পরতে মন চাইছে। নেহাৎই বউ জড়িত ছিল বিষয়টার সাথে, নয়তো এক একজনকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখত।
রাগে মাঝেমধ্যেই বোনেদের দিকে তাকাচ্ছে পুলক। বিষয়টা ওরাও বুঝতে পারছে। কিন্তু শ্বশুর বাড়ি হওয়ায় পুলক যে কিছুই করতে পারবেনা এটা ওরা ভালো করেই জানে। তাই আপাতত ওর রাগকে পাত্তা দিচ্ছেনা।
ফোনের আওয়াজ পেয়ে পুলক ওদের থেকে চোখ সরিয়ে আনল। আম্মুর নম্বর দেখে রিসিভ করল ফোন।

” বল, আম্মু। কেমন আছো? মনে হচ্ছে কতদিন তোমাকে দেখিনি। তোমাকে খুব মিস করছি। ”

” ফাজিল ছেলে, শ্বশুর বাড়িতে গেছো দুই ঘন্টাও হয়নি, এরইমধ্যে আমাকে মিস করছ? অথচ বাসায় থাকলে এমনও দিন আছে তোমার সাথে বারো ঘন্টা পরও দেখা হয়। তখন কি আমাকে মিস করোনা? ”

” এটা শ্বশুর বাড়ি, আম্মু। শ্বশুর বাড়িতে থাকলে বোধহয় ছেলেমেয়েরা বাবা-মা’কে বেশি মিস করে। ”

” চুপ করো ফাজিল ছেলে। এবার আমি যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শোন। বিয়ের পর প্রথম শ্বশুর বাড়িতে গেলে শ্বাশুড়িকে বাজার করে দিতে হয়। কাল সকালে তুমি আর শাহেদ মিলে বাজারে গিয়ে মাছ-মাংস, শাকসবজি ফলমূলসহ সব ধরনের বাজার করবে। বউমারা যেন সেখানে বড় মুখ করে বলতে পারে তাদের স্বামীরা দ্বায়িত্বশীল। আর সেই সাথে ঐ বাড়ির সবার জন্য শপিং করবে।

” যথাআজ্ঞা মা জননী। কিন্তু একটা কথা, আমি সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারিনা এটা তুমি জানো। দুপুরে বাজার করলে হয়না? ”

” নাহ্, সকালেই যাবে। সকাল আটটার মধ্যে তুমি বাজারে থাকবে। এবং সেই সাথে সবার জন্য শপিংও করবে। মনে থাকবে। কারও জন্য কোন কিছু কিনতে যেন ভুল না হয়। ”

” মা জননী, আমার শ্বশুরের জন্য আন্ডারওয়্যারও কিনব নাকি? শাহেদকেও কি বলব ওর শ্বশুরের জন্য আন্ডারওয়্যার কিনতে? ” পুলকের কথায় রুমে হাসির রোল পরে যায়।

শাহেদ আশেপাশে তাকিয়ে দেখছে তিয়াসা অথবা আশফি আছে কিনা। ওরা পুলকের এমন কথা শুনলে লজ্জায় পরে যাবে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here