#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_১৩
জাওয়াদ জামী জামী
ঘুমের মধ্যেই আশফি অনুভব করল ওর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ভারী কিছু ওর শরীরে চেপেছে। সেই সাথে বইছে ঝড়। বাতাস ওর চোখমুখে আছড়ে পড়ছে। ছটফট করতে করতে চোখ খুলল সে। প্রায় সাথে সাথেই বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে যায় চোখজোড়া। ওর খুব কাছে পুলককে দেখে চমকে উঠল। ওকে জাপ্টে ধরে রেখেছে সে। দু’জনের মুখের মাঝে এক ইঞ্চিও ফাঁক নেই। আশফি ঘুমের ঘোরে যাকে ঝড়ো বাতাস ভেবেছিল, আসলে সেটা পুলকের নিঃশ্বাস। ওরা দু’জনে এক বালিশে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিল!
আশফি পুলকের থেকে ছাড়া পেতে মোচড়ামুচড়ি করতে থাকে। অনেক চেষ্টার পরও আশফি পুলকের বাঁধন থেকে আধ ইঞ্চিও ছাড়া পেলোনা। বিরক্ত হয়ে আশফি পুলকের বুকে জোড়ে ধাক্কা দেয়।
বুকে ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভেঙে যায় পুলকের। ও চোখ রগরে উঠে বসল। ঢুলুঢুলু চোখে তাকায় আশফির দিকে।
” কি ব্যাপার এভাবে ধাক্কাধাক্কি করছ কেন! আমি ভালো করেই জানি তুমি বোবা নও। তো মুখ ব্যবহার না করে, হাতের এরূপ অপব্যবহার করছ কেন? নাকি আমাকে তোমার আলুর বস্তা মনে হয়? তুমি ধাক্কা দিয়ে বুকের খাঁচা ভাঙ্গবে আর আমি ব্যথা পাবোনা। ” ঘুম জড়ানো গলায় বলল পুলক।
পুলকের এহেন কথায় আশফি লজ্জায় মাথা নিচু করল। রাগের বশে ও একটু জোড়েই ধাক্কা দিয়েছিল লোকটার বুকে। নিজের দোষ ঢাকতে এবার মুখ খুলল আশফি।
” আপনি আমাকে চেপে ধরে ছিলেন কেন? আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এমন করে ধরে থাকলে ঘুমানো যায়? আমার ঘুমের চৌদ্দটা বাজিয়ে আবার আমাকেই কথা শোনাচ্ছেন? আপনার সাথে এক বিছানায় শোয়ার কোন ইচ্ছেই নেই আমার। কাল থেকে আপনি ঐখানে গিয়ে ঘুমাবেন। তবেই আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারব। ” আশফি ইশারায় ডিভান দেখিয়ে দিল।
আশফির কথা শুনে পুলকের ঘুম ছুটে গেল। এই মেয়ে বলছে কি! ওর রুমে এসে ওকেই বিছানা থেকে তাড়িয়ে দিতে তৎপর হয়েছে! ও বালিশের পাশে থাকা মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল রাত তিনটা পঁয়তাল্লিশ বাজে। হাঁই তুলে খাটে হেলান দিয়ে বসল। বালিশ রাখল কোলের ওপর।
” সরি। তোমার কথায় আমি বিছানা ছাড়তে পারবনা। গত সাতাশ বছর যাবৎ একা বিছানায় কাটিয়েছি। কোল বালিশই ছিল সুখ-দুঃখের ভাগীদার। এতদিনে ভাগ্য মুখ তুলে চেয়েছে। অবশেষে কপালে একটা বউ জুটেছে। এতদিন বউহীনতায় ভুগে আমার ভেতর বাহিরে ডিহাইড্রেশন সৃষ্টি হয়েছে। এই ডিহাইড্রেশনের কপালে জুতার বারি দিতে আমার বউকে প্রয়োজন। তাই আমি এখানেই থাকছি। বউয়ের থেকে জীবনিশক্তি নিয়েই আমি ডিহাইড্রেশনের সাথে যুদ্ধ করব। মনে রেখ, এবারের সংগ্রাম ডিহাইড্রেশন ভাগানোর সংগ্রাম। এবাবের সংগ্রাম প্রোডাশনের সংগ্রাম। ”
পুলকের কথা শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকে আশফি। ও পুলকের শেষের কথা বুঝতে পারেনি। অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারলনা। তাই দুম করে বলেই বসল,
” ডিহাইড্রেশন ভাগাবেন কিভাবে? আর বিছানায় শুয়ে কিভাবে প্রোডাকশনই বা দেবেন? বেশি করে স্যালাইন খেলেই তবে ডিহাইড্রেশন যাবে। সেটা নাহয় বিছানায় বসেই খেলেন। কিন্তু বিছানায় শুয়ে প্রোডাকশন তো আর বিছানায় শুয়ে দিতে পারবেননা। আপনার মাথা ঠিক আছে? নাকি মাঝরাতে বুকে ধাক্কা খেয়ে মাথার তার ছিঁড়েছে! আপনার মাথার তার কি চায়না প্রোডাক্ট? ওয়ারেন্টি-গ্যারান্টি কি নেই? ”
আশফির কথা শুনে পুলক ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। ওর ঠোঁটগুলো ঈষৎ ফাঁকা হয়ে গেছে। এই মেয়ে বলছে কি! সত্যিই নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। এই মেয়ের সাথে বাকি জীবন কিভাবে কাটাবে, সেই চিন্তা ওকে পেয়ে বসল। তবে বেশিক্ষণ নিরুত্তর থাকলনা।
” এই প্রোডাকশন সেই প্রোডাকশন নয়, সুন্দরী। কিছু কিছু কাজ আছে যেগুলোর জন্য বিছানাই পারফেক্ট। কিন্তু কাহিনী কি বলতো? তুমি কি জেনেই নাদান সাজছ, আমার কাছ থেকে শোনার জন্য? নাকি জানোইনা? যদি জেনেও অবুঝ সাজ তবে আমি কি জিনিস সেটা তোমাকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে টের পাইয়ে দেব। আর না জানলে ভালোবেসে বুঝিয়ে দেব। এবার বল কোনটা চাও তুমি? অপশন আমার, চয়েস তোমার। ”
এবার আশফির হুঁশ ফিরল। ও চমকে দু হাতে মুখ চেপে ধরল। ঝোঁকের বশে কি বলে ফেলেছে এখন বুঝতে পারছে। তাই বলে এই অসভ্য লোকটা ওকে এভাবে শুনিয়ে দেবে? ছিহ্ কি লজ্জা। ও সিদ্ধান্ত নিল, এই লোকের সাথে আর কথা বলবেনা। পুলকের কোল থেকে বালিশ নিয়ে আশফি শুয়ে পরল। উত্তেজনার বশে খেয়ালও করলনা, ওর মাথার কাছে একটা বালিশ আছে।
” কি ব্যাপার নাদান বালিকা, আমার বালিশ নিচ্ছ কেন? এক মিনিট, তুমি কি তবে ইন্ডাইরেক্টলি চাইছ, আমরা আবারও এক বালিশে শুই? মাই গড, এর মানে প্রোডাকশন শুরু করতে আর কোন বাঁধা থাকবেনা! পুলক মির্জা, তুই তোর বউকে যা ভেবেছিলি, আদৌও সে তা নয়। ”
মনের আনন্দে পুলক গান গেয়ে উঠল,
” আজ রাত তোমাকে যেতে দেবনা,
তুলতুলে গদি আছে, আছে বিছানা। ”
এমনিতেই পুলকের কথা শুনে আশফির হাত-পা কাঁপছিল, তারওপর ওর গান শুনে ভয়ে আধমরা হওয়ার দশ। ও তড়িঘড়ি করে উঠে বসল। বালিশ ছুঁড়ে মারল পুলকের দিকে।
” অ..অসভ্য লোক একটা। একটা অচেনা মেয়ের সাথে কিভাবে কথা বলছে! লাজলজ্জা বলতে কিছুই নেই। ” পুলকের আনন্দে নিমেষেই জল ঢেলে বলল আশফি।
” তুমি আবার অচেনা হলে কবে! গত কয়েকমাস যাবৎ তোমাকে চিনি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আমার চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে। আর বিকেলে বান্ধবীদের সাথে কখনো বাগানে, কখনো পুকুর পাড়ে বেড়াতে। কখনোসখনো সন্ধ্যার পর বাহিরের উঠানে কিংবা চাচার বাড়ির ছাদে তিয়াসার সাথে খিলখিলাতে। যাকে সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, রাতে নিয়মকরে দেখতাম সে আবার অচেনা হয় কিভাবে? ”
পুলকের কথা শুনে আশফির মাথা ঘুরছে। এই লোক বলে কি!
” আপনি আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতেন! এতদিন জেনেছি, আপনি গুণ্ডা। কিন্তু এখনতো দেখছি, আপনি চোর। হায় আল্লাহ, শেষ পর্যন্ত আমার চোরের সাথে বিয়ে হল! ” কপাল চাপড়ে বিলাপ করতে থাকে আশফি।
” এই মেয়ে, থামবে? তোমাকে ভালোবাসি তাই লুকিয়ে দেখতে যেতাম। তাই বলে আমি চোর হয়ে গেলাম? এই তুমি ঘুমাও। তুমি যতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকবে, ততক্ষণ আমার ব্রেইন ঠান্ডা থাকবে। ” রাগে পুলক ধমক দেয় আশফিকে। এরপর বালিশ মুখের ওপর রেখে সটান হয়ে শুয়ে পরল।
আশফি পুলকের ধমকে ভয় পায়। মনে মনে ভাবতে থাকে, কি এমন বলল যে বদ লোকটা এভাবে ধমক দিল। বিরবির করে কয়েকটা গালি দিল পুলককে।
” গালি দেয়া শেষ হলে ঘুমাও। নয়তো ঘুম না হওয়ার অপরাধে আমাকে কাঠগড়ায় তুলবে। ” মুখ থেকে বালিশ সরিয়ে বলল পুলক।
পুলকের কথায় আবারও চমকালো আশফি। ও ভাবল, এই বদ লোক কি মনের কথাও শুনতে পায়! এর সামনে থাকলে মনে মনেও কিছু বলা যাবেনা। সাংঘাতিক বদ লোক একটা।
” কি এত চিন্তা করছ? এত ভাবলে কূল পাবেনা। তোমার মনের সব কথাই আমি শুনতে পাই। এমনকি কি স্বপ্ন দেখ সেটাও আমি জানতে পারি। তাই এত না ভেবে ঘুমিয়ে পর। ”
পুলকের কথা শুনে এবার আশফির মাথা ঘুরে উঠল। বুকে হাত দিয়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। পুলকের কথামত বালিশে মাথা ঠেকাল। ঠিক তখনই ফজরের আজানের চারপাশ মুখরিত হয়। আশফির আর শোয়া হলোনা। বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমের দিকে যায়।
***
সকালে ঘুম ভাঙ্গলে নিজের পাশে শাহেদকে শুয়ে থাকতে দেখে ঝটপট উঠে বসল তিয়াসা। রাতে দেরি করে ঘুমানোয় আজ ফজরের নামাজ কাযা হয়ে গেছে। খুব সাবধানে শাহেদকে পাশ কাটিয়ে বিছানা থেকে নামল তিয়াসা।
কাযা নামায আদায় করে গুটিগুটি পায়ে বাহিরে যায় তিয়াসা। দরজা খুলে উঁকি দেয় চারপাশে।
” কিছু লাগবো, আম্মা? ” কারও আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠল তিয়াসা। পাশে তাকিয়ে দেখল গত কালকের সেই মাঝবয়েসী মহিলা।
” দাদুর রুম কোনটা? ” মৃদু গলায় বলল মেয়েটা।
” আসেন আমার সাথে। ”
খাদিজার সাথে নিচে যায় তিয়াসা। খাদিজা জানায়, দাদু নিচেই থাকেন। তার পায়ে সমস্যা থাকার জন্য ওপর-নিচ করতে পারেননা। অনেক বছর পর তিনি গতরাতে ওপরে গিয়েছিলেন।
দাদুর রুমে ঢুকে তাকে সালাম দিল তিয়াসা।
” আসসালামু আলাইকুম, দাদু। ”
তিয়াসার গলা পেয়ে বৃদ্ধ ওর দিকে তাকায়। কিন্তু ওকে চিনতে পারার কোন লক্ষ্মণ দেখা যায়না তারমধ্যে। তবুও তিনি সালামের উত্তর দিলেন।
” খাদিজা, এই মেয়েটা কে? একে কখনো দেখেছি বলে মনে হয়না। কি চায় মেয়েটা? ”
দাদুর কথা শুনে অবাক হয় তিয়াসা।
” আব্বা, এইডা আমাগো শাহেদ বাবার বউ। কাইলকা না শাহেদ বাবার বিয়া হইল? আপনে নতুন আম্মারে কতডি গয়না দিলেন। কাইল রাইতের কতা আজকাই ভুইলা বইসা রইছেন? ” খাদিজা বৃদ্ধকে মনে করানোর চেষ্টা করল।
অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বৃদ্ধ হাসিমুখে নিজের কাছে ডাকলেন তিয়াসাকে।
” নাতবউ, তুমি ঐখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমার কাছে এসে বস। খাদিজা, তুমি আমাদের জন্য নাস্তা নিয়ে এস। আমি ভোরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন থেকে তিনবেলাই নাত বউয়ের সাথে খাব। ” দাদুর কথায় হাসল তিয়াসা। এগিয়ে গেল বৃদ্ধের কাছে।
” আন্টি, আপনি টেবিলে আমাদের খাবার দিন। আমি দাদুকে নিয়ে যাচ্ছি। কষ্ট করে এখানে খাবার নিয়ে আসতে হবেনা। ”
তিয়াস দাদুকে ধরে নিয়ে ডাইনিং এরিয়ায় যায়।
” নাতবউ, শাহেদ ওঠেনি? ও আসলে আমরা একসাথে খেতে পারতাম। ”
শাহেদের কথা উঠতেই চুপ হয়ে যায় তিয়াসা। ও আসলে শাহেদের থেকে দূরে থাকতেই দাদুর কাছে এসেছে। কিন্তু সেই দাদুই তার নাতির কথা জানতে চাইছেন।
” উনি ঘুমাচ্ছেন। আপনি বরং এখন খেয়ে নিন। দুপুরে উনার সাথে খাবেন। ”
দাদু মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
চলবে…