রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা #পার্ট_১৬ জাওয়াদ জামী জামী

0
28

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_১৬
জাওয়াদ জামী জামী

” বউমা, ইনি তোমার চাচা শ্বশুর। তোমার শ্বশুরের চাচাতো ভাই। ভাইজান ঢাকা থাকেন।দ পরিবার নিয়ে। আজকেই এসেছেন তোমার রিসিপশনের জন্য। ” পঁয়ষট্টি-সত্তর বছরের ভদ্রলোককে আশফি সালাম দিল। তিনিও আশফির সাথে মনখুলেই কথা বললেন।

একসাথে খেতে বসেছে সবাই। নতুন বাড়ি, নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশে আশফি একটু ইতস্তত করছে। লজ্জায় সকাল থেকে একবারও পেট পুরে খায়নি। ওর এই এক সমস্যা। নতুন কোথাও গেলে, কিংবা বেশি মানুষজনের সামনে খেতে পারেনা।

রাতেও খাবার টেবিলে দুই-তিনবার খাবার মুখে দিয়ে আর খেতে পারলনা। শ্বাশুড়িকে বলে রুমে চলে গেল।

” এগুলো খেয়ে নাও। কিছুইতো খেলেনা দেখলাম। ” পুলক ট্রেতে করে খাবার নিয়ে আসল রুমে। ও সেন্টার টেবিলে ট্রে রেখে আশফিকে খেতে বলল।

” আপনি লক্ষ্য করছেন আমি খাইনি! ” আশফি সত্যিই অবাক হয়েছে পুলকের কাজে।

” তুমি আমার স্ত্রী। তোমার ভালোমন্দ, সুবিধা-অসুবিধা দেখার দ্বায়িত্ব আমার। সবার সাথে খেতে সমস্যা হলে আমাকে অথবা আম্মুকে বলবে। মনে রেখ, এটা তোমার নিজের বাড়ি। এখানে কোনরকম সমস্যা হলে আমাদের বলবে। অথবা নিজে থেকে সমাধানের চেষ্টা করবে। এখানে কেউ তোমার কোন কাজে বাঁধা দেবেনা। এখন এগুলো খেয়ে আম্মুর রুমে যাও। আমার বড় মামী, মামাতো বোন শপিংয়ে গেছে। তুমি রিসিপশনে কি ড্রেস পরবে সেগুলো বোধহয় কিনতে গেছে। আম্মু তাদের সাথে ভিডিও কলে কথা বলছে। তুমি গেলেই সব সিলেক্ট করবে। ”

” আমি এসবের কি বুঝি! জীবনে কখনো শপিংয়ে যাইনি, নিজের পছন্দমত একটা পোশাকও কিনিনি। সব সময়ই ভাইয়া কিনে দিত। ” মুখ ভার করে বলল আশফি।

” আগে করোনি, এখন করবে। ভুলে যাচ্ছ কেন, তোমার আগের জীবনের সাথে এখনকার জীবনের অনেক পার্থক্য। সেই জীবনে তুমি ছিলে কারও খেলার পুতুল। কিন্তু বর্তমান জীবনে তুমি আমার রানী। আমার বর্তমান, আমার ভবিষ্যৎ। মির্জা বাড়ির সম্মান তুমি। ”

আশফি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল পুলকের দিকে। কেউ কখনো ওকে এভাবে বলেনি। ছোটবেলা থেকেই ছোটমা ওর সাথে দুরদুর আচরণ করেছে, আব্বা অবহেলা করেছে। পৃথা, পিয়াস কারনে-অকারনে অপমান করেছে। একদিন হয়েছে এই বাড়িতে পা রেখেছে আশফি। কিন্তু এই একদিনেই যেন কতকালের জমে থাকা ভালোবাসা উগরে দিচ্ছে এরা। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা এখন আর এতটাও খারাপ মনে হচ্ছেনা। আবেগে চোখ ভিজে আসল আশফির।

” এই তুমি কি খাবে? নাকি আমার হাতে খেতে চাচ্ছ? মতলব কিন্তু খারাপ নয়। এসো খাইয়ে দেই। ” আশফিকে চুপ থাকতে দেখে আবারও কথা বলল পুলক।

” এই না, আমি একাই খেতে পারব। ” চমকে উঠল আশফি।

” উঁহু, সেটিতো আর হচ্ছেনা। একবার আমার মনে হয়েছে, তুমি আমার হাতে খেতে চাও, তাই এখন সেটাই হবে। এস এখানে বস। ” পুলক আশফির হাত ধরে বিছানার এক কোনে বসিয়ে দিল।

পেটে ক্ষুধা থাকায় আশফি কোন উচ্চবাচ্য করলনা। তৃপ্তিসহ খেতে থাকল। মাঝেমধ্যে চোরা চোখে তাকিয়ে দেখছে এই গুণ্ডা ছেলেটাকে। এই ছেলেটার নামে নাকি এলাকা কাঁপে! অথচ সেই মানুষটাই ওকে পরম ভালোবেসে খাইয়ে দিচ্ছে! এই মানুষটাকে এখন ওর মোটেও ভয় লাগছেনা। মা’য়ের মৃ’ত্যু’র পর এত ভালোবাসা ওর কপালে জোটেনি।

” এভাবে তাকিওনা। প্রেমে পরে যাবে। আর একবার আমার প্রেমে পরলে দুনিয়াকে তুচ্ছ মনে হবে। এক মুহূর্তও আমাকে না দেখে থাকতে পারবেনা। আর আমাকে সব কাজ ফেলে তোমার সামনে বসে থাকতে হবে। আর একটামাত্র বউয়ের আবদার কখনোই ফেলতে পারবনা আমি। ”

পুলকের কথা শুনে আশফি লজ্জা পেল। মাথা নিচু করে হাসল বেশ খানিকক্ষণ।

খাবার শেষ করে আশফি যায় মল্লিকা মির্জার রুমে। সেখানে গিয়ে দেখল পুষ্পিতা আর মল্লিকা মির্জা ফোনের স্ক্রীনে চোখ রেখে কিছু একটা মনযোগ দিয়ে দেখছে। আশফিকে দেখে মল্লিকা মির্জা হাত বাড়িয়ে কাছে ডেকে নিলেন। আশফিও তার পাশে গিয়ে বসল।

” নিলাশা, এই যে দেখ আমার বউমাকে। দেখ কি মিষ্টি দেখতে আমার বউমা। ” নিলাশা মল্লিকা মির্জার ভাইয়ের মেয়ে।

নিলাশা বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল আশফির সাথে।

” এই এখন গল্প বাদ দিয়ে আমার বউমাকে লেহেঙ্গা, শাড়ী দেখাও। আশফি, তুমি পছন্দ করে বল কোনগুলো নিবে। ”

” মা, আজকেই তো পুষ্পিতা আপু অনেকগুলো শাড়ি এনেছে আমার জন্য। আবার কেন? ”

” ঐগুলো তো আর রিসিপশনে পরার জন্য আনেনি। অল্প সময়ের মধ্যে যেহেতু আমি আমি ঢাকা যেতে পারিনি, তাই এই ব্যবস্থা। তুমি পছন্দ কর। ”

” আমি এসব সম্পর্কে কিছু জানিনা, মা। আপনিই পছন্দ করুন। জীবনে কখনো শপিংয়ে যাইনি। ”

মল্লিকা মির্জা দুঃখী চোখে তাকালেন এই মা মরা মেয়েটার দিকে। একদিনেই তিনি বুঝতে পারছেন মেয়েটা একটু বেশিই সরল। কোন কথা লুকাতে জানেনা। কিংবা সত্য বলতে একটুও দ্বিধা করেনা।

” আজকের পর থেকে তোমার প্রয়োজনীয় সবকিছু তুমি নিজে পছন্দ করে কিনবে। নিজের পছন্দ, মতামত সবার সামনে প্রকাশ করবে। নিজেকে সমাজের সামনে যোগ্য বলে প্রমান করবে। আর সেজন্য যা যা করতে হবে, তোমাকে সব শিখিয়ে দেব। সব সময়ই আমাদের তোমার পাশে পাবে। ”

আশফি বুঝতে পারছে এই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষই ভালো। এরা কেউই ওর সাথে নতুন বউয়ের মত আচরণ করছেনা। বরং ওকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে।

আশফি তিয়াসার রিসিপশনের শাড়ী, লেহেঙ্গা, জুতা, থ্রীপিসসহ আরও জিনিসপত্র এবং পুলক ,শাহেদের জন্য স্যুটসহ প্রয়োজনীয় সকল কিছু পছন্দ করলেন মল্লিকা মির্জা, পুষ্পিতা। আশফি চেয়ে চেয়ে দেখল এত শপিং করেও এদের যেন সাধ মিটছেনা।

***

আশফি রুমে এসে দেখল পুলক বিছানায় শুয়ে ফোন টিপছে। এদিকে ও হাঁসফাঁস করছে তিয়াসার সাথে কথা বলার জন্য। ওদের জন্য এত শপিং করেছে কিন্তু এই কথা তিয়াসাকে বলতে পারবেনা এটা কিছুতেই হয়না।

” একটু রুম বাহিরে যাননা। আমি তিয়াসার সাথে কথা বলব। ” আশফি পুলককে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলল।

” তোমার কথার সাথে আমার বাহিরে যাওয়ার সম্পর্ক কি! কথা বল তুমি। ”

” উঁহু আপনার সামনে বলা যাবেনা। ”

” এজন্যই বোধহয় আমার ছোট মামা বলত, বিয়ে করলে পুরুষদের নিজের বলতে কিছুই থাকেনা। বছরের পর বছর যে রুমকে নিজের ভাবত তারা, বিয়ের পর সেই রুমের মালিকানাও বউয়ের কাছে হস্তান্তর করতে হয়। আজ ছোট মামার কথার সত্যতা প্রমান পেলাম। পুলক মির্জা আজ থেকে তোর রুমের মালিকানা বউয়ের কাছে হস্তান্তর কর। ”

” আপনি সব সময়ই এভাবে কথা বলেন কেন! মনে হয় আপনি নিঃস্ব, দুঃখী। কয়েক মিনিটের জন্য শুধু রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছি। চিরদিনের জন্যতো বলিনি! ”

” আমি নিঃস্বই বুঝলে, সুন্দরী? যেখানে মনই তোমাকে দিয়েছি, সেখানে আমার নিজের বলে আর কি আছে? আজকে রুমের মালিকানা হস্তান্তর করলাম। আজ থেকে আমি ইন্টারন্যাশনাল নিঃস্ব কমিটির সভাপতি। তবে এই নিঃস্ব অবস্থা থেকে তুমিই আমাকে ফেরাতে পার। নিজেকে আমার ভালোবাসার কাছে সমর্পন করলেই আমি আবার পূর্ণ হয়ে যাব। ” কথাগুলো বলেই পুলক রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

আশফি মুখ বাঁকা করে ফোন হাতে তুলে নিল।

***

তিয়াসা বেলকনিতে বসে আছে। শাহেদ সেই সকালে বাসা থেকে বেরিয়েছে, এখন পর্যন্ত আসেনি। দাদু কয়েকবার তার কথা জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু কোন সদুত্তর দিতে পারেনি তিয়াসা। কিন্তু একটু চিন্তা ওর হচ্ছে। যদিওবা শাহেদের বিষয়ে মাথাব্যথা ওর নেই। কিন্তু দাদু চিন্তা করছিলেন। সে নাকি কখনোই রাত দশটার পর বাসার বাহিরে থাকেনা। আর এখন রাত বারোটার কাছাকাছি। তাই দাদুর চিন্তা সংক্রমিত হয়েছে তিয়াসার মধ্যে। এর বেশি কিছু নয়।

রুম থেকে ফোনের আওয়াজ ভেসে আসছে। এত রাতে কে ফোন দিল! তড়িঘড়ি করে রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে দেখল আশফির নাম ভাসছে স্ত্রীনে। এতরাতে আশফির ফোন আসায় চিন্তায় পরে যায় তিয়াসা। ও কাঁপাকাঁপা হাতে রিসিভ করে গলায় উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

” আশফি, তুই এত রাতে ফোন দিয়েছিস কেন? কিছু হয়েছে? ”

” তিয়ুরে, এই বাসায় এসে কতকিছুই দেখছি আর অবাক হচ্ছি। ”

” কি হয়েছে? কি দেখেছিস? তুই ভালো আছিসতো? ”

” আমি জব্বর আছি। তোর সাথে কথা বলব জন্য বদ লোকটাকে রুম থেকে বের করে দিয়েছি। এখন মন খুলে তোর সাথে কথা বলব। জানিস, আমাদের রিসিপশনের জন্য কতগুলো শপিং করিয়েছে আমার শ্বাশুড়ি? আমার মনে হয় আগামী পাঁচ বছর আমার কোন নতুন পোশাক লাগবেনা। তোরও তাই। এখান থেকে ভিডিও কলে আমার শ্বাশুড়ি,ননদ সব পছন্দ করেছে। রিসিপশনের দিন আমরা দু’জন একই ড্রেস পরব। জানিসতো, আমাদের বাড়ির সবার জন্যঃ শপিং করেছে। এরা আসলেই অনেক ভালো। আমাকে বুঝতেই দিচ্ছেনা, আমি নতুন বউ। ”

আশফির কথা শুনে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল তিয়াসার।

” কি বললি! তুই পুলক ভাইয়াকে রুম থেকে বের করে দিয়েছিস! খুব খারাপ কাজ করেছিস। সে কিছু বললনা? রাগ করেনি? ” আপাতত শপিংয়ের কথা বাদ দিয়ে পুলকের কথা জিজ্ঞেস করল তিয়াসা।

” নাহ কিছুই বলেনি। সুরসুর করে বেরিয়ে গেল। জানিসতো, বদ লোকটাকে যতটা বদ ভেবেছিলাম, আসলে ততটা বদ সে নয়। একটু ভালোও আছে। তুইতো জানিস, আমি নতুন কোথাও গেলে খেতে পারিনা। তাই সকাল থেকে পেট পুরে খেতে পারিনি। রাতে বদ লোকটা সেটা খেয়াল করে রুমে খাবার এনে আমাকে খাইয়ে দিয়েছে। ”

” তারপরও তুই ভাইয়াকে বদ লোক বলছিস? ” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করল তিয়াসা।

” আগের অভ্যাস রয়েই গেছে। আচ্ছা ভাইয়া কোথায় রে? তোরা ভালো আছিস তো? ”

” হুম ভালো আছি। সে বাসায় ফেরেনি এখনও। ”

” কি বলছিস! মা যে বলল, ভাইয়ার এখানে কোন বন্ধু নেই। সে শুধু এই বদ লোকের সাথে থাকে। আগে কখনো এখানে একমাসও থাকেনি। শুধু নাকি বাবা-মা’ র করব দেখতে মাঝেমধ্যে আসত। সে জন্মের পর থেকে বেশিরভাগ সময় ঢাকায় থেকেছে। আর সেজন্যই এখানের কাউকে চেনেনা। আজ সারাদিন ভাইয়া এখানেও আসেনি। তবে কোথায় গেছে সে? ”

আশফির কথা শুনে তিয়াসার এবার সত্যিই চিন্তা হচ্ছে। সেই সাথে ভয়ও হচ্ছে। ওর কোন ভুল পদক্ষেপে রিফাতের ক্ষতি হবেনাতো!

” তুই একটু ভাইয়াকে বলে দেখবি? উনার পরিচিত কাউকে একটু ফোন দিতে বল। দেখনা কোথায় আছে? তারও ফোনও বন্ধ। ” উদগ্রীব হয়ে বলল তিয়াসা।

” তুই চিন্তা করিসনা। আমি উনাকে বলছি। ভাইয়ার খোঁজ পেলেই তোকে আমি জানাব। ”

আশফি ফোন কেটে রুমের বাহিরে এসে উঁকিঝুঁকি মেরে পুলককে খোঁজার চেষ্টা করল। কিন্তু ছায়া পর্যন্ত দেখলনা আশেপাশে। তাই বাধ্য হয়ে তাকে ফোন দিল। সকালেই নিজের ফোন নম্বর আশফির ফোনে সেইভ করেছিল পুলক।

***

ছাদে বসে বন্ধুদের সাথে চ্যাট করতে ব্যস্ত পুলক।তখনই ফোন বেজে উঠল। আশফির নম্বর দেখে হেসে রিসিভ করল,

” কি ব্যাপার বউ বুঝি আমাকে মিস করছিল? ”

” রাখেন আপনার মিস। কোথায় আছেন? বেরিয়ে গেছেন নাকি বাসা থেকে? ”

” পাগল হয়েছ! আমি এতরাতে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করি! তখন সবাইকে বোঝাতে বোঝাতে একমাস লেগে যাবে যে, বউ আমাকে বউ রুম থেকে বের করে দেয়নি। এত বোকা আমি নই।”

” বকবকানি বাদ দিয়ে রুমে আসেন। ” ফোন কেটে দেয় আশফি।

পুলক দুই মিনিটের মাথায রুমে আসল।

” বল এত জরুরী তলব কেন? নাকি আমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারছনা? ”

” বদ লোক, এত বেশি বোঝেন কেন? শাহেদ ভাইয়া নাকি এখনো বাসায় ফেরেনি। তিয়াসা চিন্তা করছে। আপনি একটু দেখুননা।”

আশফির কথা শুনে পুলকের কপালে চিন্তার সরু রেখা দেখা দিল। ও দ্রুতই ফোন করল শাহেদকে। ওকে না পেয়ে কয়েক জায়গায় ফোন করল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here