রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা #পার্ট_১৭ জাওয়াদ জামী জামী

0
25

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_১৭
জাওয়াদ জামী জামী

আশফির কথা শুনে পুলক অস্থির চিত্তে ওর বন্ধুমহলে ফোন করতে শুরু করল। কিন্তু কোথাও নেই শাহেদ। বাধ্য হয়ে পুলক ওকে খুঁজতে বেড়িয়ে গেল।

কয়েক জায়গায় খুঁজেও শাহেদকে না পেয়ে পুলক ঘাবড়ে যায়। ও নির্জন রাস্তায় বাইক দাঁড় করায়। চিন্তা করতে থাকল কোথায় যেতে পারে শাহেদ। ওর কি কোন কারনে মন খারাপ? নানান চিন্তার মাঝে উঠে দাঁড়ায় পুলক। শাহেদ কোথায় যেতে পারে সেটা বুঝে গেছে।

পাঁচ মিনিট পর কবরস্থানের কাছে এসে বাইক থামিয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখছে পুলক। ও জানে শাহেদ আশেপাশেই আছে। ওর কোন কারনেই মন খারাপ হলে কবরস্থানে এসে বাবা-মা’ র কবরের পাশে এসে বসে থাকে। এখন যেহেতু রাত সেহেতু কবরস্থানের গেইট বন্ধ আছে। তাই শাহেদ হয়ত ভেতরেও যায়নি। কবরস্থানের প্রাচীরের আশেপাশেই আছে। বাইক থেকে নেমে পুলক হাঁটতে শুরু করল। ফুপা-ফুপুর কবর যেদিকে আছে সেদিকেই হাঁটতে শুরু করল। মিনিট খানেক পরই শাহেদকে দেখতে পেল। ছেলেটা প্রাচির ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাবা-মা’ র কবরের দিকে।

পুলক ধীর পায়ে এগিয়ে যায় শাহেদের কাছে। হাত রাখল ছেলেটার কাঁধে।

” তুই এত রাতে এখানে কেন? ফুপা-ফুপুর জন্য খারাপ লাগলে দিনে আসতি, রাতে কেন? এই তোর কি ভয় লাগছেনা। ”

আচমকা পুলকের কথা শুনেও একটুও চমকায়না শাহেদ। যেন ও জানত পুলক এখানে আসবে। শাহেদ পুলকের কথা শুনেও চুপচাপ থাকল। তবে পুলকের অজান্তে চোখের পানি মুছে নিল। শাহেদকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আবারও কথা বলল পুলক।

” তোর কি কাণ্ডজ্ঞান কিছুই নেই, শাহেদ। বাসায় নতুন বউ রেখে কেউ এত রাতে কবরস্থানে এসে বসে থাকে? ওদিকে মেয়েটা চিন্তা করছে তোর জন্য। আশফিকে ফোন করে জানিয়েছে তুই বাসায় নেই। ”

” ভাই, আমি একটু পরই বাসায় যেতাম। তুমি কষ্ট করে আসতে গেলে কেন? ভাবিকে একা রেখে তুমিও এখানে এসে ঠিক করোনি। এবার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। ” শাহেদ মলিন হেসে বলল।

শাহেদের মুখের দিকে তাকিয়ে খটকা লাগলো পুলকের। ওর মনে হচ্ছে, কিছু একটা ঠিক নেই। দুই দিন থেকে শাহেদ যেন একটু অদ্ভুত আচরণ করছে। এই দুইদিন ও শাহেদকে হাসতে দেখেনি।

” শাহেদ, তুই আমাকে সত্যি করে বল, কি হয়েছে তোর? তুই আগেও ফুপা-ফুপু’র কাছে এসেছিস, কিন্তু সব সময়ই দিনে এসেছিস। আজকে রাতে আসলি কেন? তিয়াসা আর তোর মধ্যে সব ঠিকঠাক আছে তো? ”

পুলকের কথা শুনে চমকে উঠল শাহেদ। ও যে চরম বোকামি করেছে, এটা বেশ বুঝতে পারছে ও। নিজের বোকামি ঢাকতে শুকনো হাসল সে। যা-ই হয়ে যাক না কেন ওদের দাম্পত্য জীবনের গোপনীয়তা কারও সামনে উন্মোচন করা যাবেনা। তাছাড়া পুলক যদি এসব জানে তবে বিষয়টা ও সহজভাবে নিবেনা। এর প্রভাব শুধু তিয়াসার পরিবার নয় আশফির ওপরও পরতে পারে।

” ভাই, তুমি এত টেনশন করোনাতো। গত কয়েকদিন থেকেই বারবার আব্বু-আম্মুর কথা মনে হচ্ছে। কিছুতেই নিজের মনকে বুঝ দিতে পারছিনা। এই যে দেখ, বিয়ে করলাম অথচ আব্বু-আম্মুকে পাশে পেলামনা। মামীকে আম্মুর দ্বায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে । আমার সাথেই কেন এমন হলো বলতে পার ভাই? কেন অকালে আব্বু-আম্মুকে হারালাম? কেন প্রতিনিয়ত আব্বু-আম্মুকে মনে করে আমার কাঁদতে হয়? ” কথা বলতে বলতে হুহু করে কেঁদে উঠল শাহেদ। আজ সত্যি ও বাবা-মা’ র জন্য কষ্ট পাচ্ছে। কষ্ট পাচ্ছে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। তিয়াসা ওকে মেনে নেবেনা এটা ও বুঝতে পারছে। কিন্তু এই বিষয়টা সবাইকে জানাবে কিভাবে? আর সবাই জানলে তখন কি হবে?

শাহেদের কান্না দেখে ওকে বুকে টেনে নিল পুলক। শান্তনা দিচ্ছে তার এতিম ভাইকে।

” কাঁদছিস কেন পাগল ছেলে! ফুপা-ফুপু নেইতো কি হয়েছে! আমরা আছি তো? আম্মু-আব্বু তোকে কত ভালোবাসে সেটা তুই জানিসনা? তুই যে রাত-বিরেতে বাইরে এসেছিস, এটা যদি আম্মু শোনে তাহলে কষ্ট পাবেনা বল? তোর মত এমন অনেকেই আছে যাদের বাবা-মা নেই। তাই বলে কি তাদের জীবন থমকে গেছে? তারা কি নিজেদের মত জীবনকে এগিয়ে নিচ্ছেনা? তুই তো আমার মত গবেট নয়। পড়াশোনা শেষ করেছিস, জবও হয়ে গেছে। ফরজ কাজও সেড়ে নিয়েছিস। এবার মন দিয়ে সংসার কর। মনে রাখিস, সংসারের সুখ-দুঃখের চাবিকাঠি তোর কাছে। তুই চাইলেই তিয়াসাকে সুখী করতে পারবি। এই যে এত রাতে বাহিরে এসেছিস, এটা কি তিয়াসার ভালো লাগবে? তোর ওপর ওর বিরূপ ধারণা জন্মাতে কতক্ষণ? ”

” সরি ভাই, আর এমন বোকামি করবনা। চল আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে তুমিও বাসায় যাও। নয়তো দেখবে ভাবী তোমার মাথার একটা চুলও রাখবেনা। বোকা ভাবী আমার তোমার ওপর ভালোই ফাঁপর নেয়। আর আমার ভাইও কেমন চুপচাপ সহ্য করে। ” শাহেদের কথা শুনে পুলক মাথা চুলকে হাঁসল। শাহেদ মন্দ কিছু বলেনি।

শাহেদকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে পুলক নিজের বাসায় চলে যায়।

***

শাহেদ রুমে ঢুকে দেখল তিয়াসা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। শাহেদকে দেখে তিয়াসা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিছানায় যায়। বিছানার একপাশে গিয়ে গুটুসুটি মেরে শুয়ে পরল।

শাহেদ কাবার্ড থেকে টি-শার্ট, ট্রাউজার বের করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। যাবার আগে তিয়াসার উদ্দেশ্যে বলল,

” দরজা লাগিয়ে নিন। আমি আজ থেকে স্টাডি রুমে থাকব। ”

শাহেদের কথা শুনে লাফ দিয়ে উঠে বসল তিয়াসা।

” কেন? ”

” ভুল যখন করেছি, তার মাশুলতো দিতে হবে। আপনি নিশ্চিন্তে এই রুমে থাকতে পারেন। আমার দ্বারা আপনার কোন ক্ষতি হবেনা। ”

শাহেদ রুম থেকে বেরিয়ে গেলে তিয়াসা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। এরপর উঠে দরজা বন্ধ করল।

বিছানায় বসে চিন্তা করছে ভবিষ্যতে কি হতে চলেছে? কি হতে চলেছে দু’জনের সম্পর্কের সমীকরণ? আর কিছু ভাবতে পারছেনা তিয়াসা। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

***

পুলক রুমে এসে দেখল আশফি বিছানার কিনারায় বসে ঘুমে ঢুলছে। ও দরজা বন্ধ করে পা টিপে এগিয়ে যায় আশফির কাছে। আশফির মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা বসে বসেই ঘুমাচ্ছে। ও হেসে ঘুমন্ত আশফির মুখে ফুঁ দেয়।

হঠাৎ মুখে বাতাস লাগায় চমকে উঠল আশফি।

” জানালা কে খুলল রে? বাতাস এসে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ” ওর খুব কাছে পুলককে ঝুঁকে থাকতে দেখে ভিষণ চমকায় আশফি। চোখের পলকে বুকে ফুঁ দিয়ে বলে উঠল,

” এভাবে ভূতের মত দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আমি ভয় পেয়েছি। বদ লোক মানুষকে ভয় পাইয়ে মজা নেয়! ”

” আমি যদি বদ হই, তাহলে দুনিয়ায় ভালো কেউ নেই বুঝলে, বউ? চোখের সামনে জলজ্যান্ত বউ হেঁটে বেড়াচ্ছে, কাপড় এলোমেলো করে ঘুমাচ্ছে, অথচ সেসব দেখেও আমি নিউট্রাল আছি। এতকিছুর পরও আমাকে বদ লোক মনে হয় তোমার! কিছু না করে বদ হওয়ার থেকে কিছু করে বদ হওয়া কি ভালো নয়? কি স্টার্ট করব বদ লোক হওয়ার প্রথম মিশন? ”

পুলকের কথা শুনে ভয় পেয়ে বিছানার একপাশে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পরল আশফি। মাঝখানে রাখল কোলবালিশ।

” খবরদার এই বর্ডার ক্রস করার চেষ্টা করবেননা। ক্রস করেছেন তো দাঁত হারিয়েছেন। ”

পুলক প্রায় সাথে সাথেই কোলবালিশ ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে।

” অসুবিধা নেই। হারাকনা দুই-একটা দাঁত। মাংস চিবিয়ে খেতে পারবনা তো কি হয়েছে! তুমি নাহয় চিবিয়েই দিবে। আর আমি খাব। তবুও আমি বউকে না জড়িয়ে ঘুমাতে পারবনা। দশটা না পাঁচটা না, একটামাত্র বউ আমার। এত সাধের বউকে দূরে রাখতে যাব কোন দুঃখে! আর এখন থেকেই তোমাকে বুঝে নিতে হবে আমার সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। নয়তো পরে বলবে তোমার জামাই কিছুই করতে জানেনা। এটা মানবোনা।”

পুলক এক টানে আশফিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে পরল। আশফি হাজার চেষ্টা করেও নিজেকে ছাড়াতে পারলনা পুলকের শক্ত বাঁধন থেকে। বাধ্য হয়ে আশফি মটকা মেরে শুয়ে থাকল পুলকের বুকে। এবং এক সময় ঘুমিয়েও পরল।

***

মল্লিকা মির্জা তিয়াসাকে নিজের বাসায় নিয়ে আসলেন। তিয়াসার সাথে শাহেদের দাদুসহ ঐ বাসার মেইডরা সকলেই এসেছে। আগামীকাল ওদের রিসিপশন পার্টি এখানেই হবে। শাহেদ আসবে পরেে। ও সকাল হতেই বাহিরে চলে গেছে। নাস্তা না করেই বেরিয়ে গেছে।

তিয়াসাকে দেখে দৌড়ে ওর দিকে যায় আশফি। খুশিতে চিৎকার করে উঠল। মল্লিকা মির্জা আশফির কর্মকাণ্ডে হাসলেন।

” তিয়ু রে, কেমন আছিস বইন? কতদিন পর তোকে দেখলাম! কেমন আছিস তুই? ”

” আস্তে আশফি, আস্তে। এটা আমাদের গ্রামের বাড়ি নয়। ”

” এটা তোমাদের গ্রামের বাড়ি নয় ঠিক আছে। ঐটাতো তোমাদের বাবার বাড়ি। আর এটা তোমাদের নিজের বাড়ি। তাই এখানে যখন যা করতে মন চাইবে সেটাই করবে। তিয়াসা তুমি লজ্জা পাবেনা কিন্তু। মনে রেখ, এটা শাহানারও বাবার বাড়ি। সে হিসেবে এই বাড়িতে শাহেদের পুরো অধিকার আছে। আর শাহেদের বউ হিসেবে তোমারও অধিকার আছে। ” মল্লিকা মির্জা হাসিমুখে বললেন।

পুষ্পিতা দৌড়ে এসে তিয়াসাকে জড়িয়ে ধরে বকবকানি শুরু করল। এরপর এই বাসায় শাহেদের নির্ধারিত রুমে নিয়ে গেল।

সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই পুলকের তিন মামা, মামী, মামাতো ভাইবোন, খালা, খালু খালাতো ভাইবোনেরা সবাই হাজির হয়েছে মির্জামহলে। এছাড়াও শাহেদর আত্নীয় স্বজনসহ আতিক মির্জার দূরের, কাছের সকল আত্নীয় স্বজনরা এসেছেন। অতিথিদের জন্য তিনি নিজেদের বন্ধ তিনটা ফ্ল্যাট খুলে পরিষ্কার করে রেখেছেন। এতগুলো মেহমানদের ঘুমানোর জায়গা এই বাসায় হবেনা। তারা সারাদিন মির্জামহলে আনন্দ করে রাতে ঘুমাবে ফ্ল্যাটে গিয়ে।

বিঃদ্রঃ আমার ফোন নষ্ট হওয়ায় গল্প আসতে লেইট হয়েছে। আজকে ফোন হাতে পাওয়ার পরই লিখতে শুরু করেছি। অনিচ্ছাকৃত এই দেরি করার জন্য সবার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here