বিয়ে_থা #পর্ব-০৫ #তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

0
159

#বিয়ে_থা
#পর্ব-০৫
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

শরৎকাল। ঝিরঝির বৃষ্টিতে হাত বাড়িয়ে রেখেছে নিনীকা। মনটা তার বড়োই বিষন্ন। আজকাল কিছু ভালো লাগে না। এদেশের মাটিতে তার তিন মাস পূরণ হয়েছে। মনটা এখন একটু বেশিই বিষন্ন থাকে। বৃষ্টি এলে মনে পড়ে মা’কে। তার মা মিথিলা ভীষণ বৃষ্টি পছন্দ করতেন। মায়ের মুখে সে গল্প শুনেছে। তার বাবা আর মা তখন কিশোর বয়সের। ক্লাসমেইট হওয়ার দরুন তাদের টুকটাক কথা হতো। তার বাবা ক্লাসমেইট মিথিলার প্রেমে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। পড়াশোনা বিষয়ে আলাপ করতে এসে চোরা চোখে দেখে মন শান্ত করতেন। বৃষ্টিতে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতেন এক পলক দেখার জন্য। তখনকার দিনে সব কঠিন। নানু ভাই ছিলেন কঠিন মানুষ। দিনরাত তার মেয়ের জন্য কোনো ছেলে এখানে সেখানে দাড়িয়ে থাকছে তা তার কানে পৌঁছাতে সময় নিলো না। ছেলেটির ব্যাপারে খুঁজ নিলেন। সামান্য কিশোর হয়ে কি না তার ওমন সুন্দরী বাচ্চা মেয়েটাকে টাংকি মারতে চেষ্টা করছে। এ বড় আশ্চর্য ঘটনা। নানু ভাই ছিলেন আরও উপরে। তিনি ছেলেটাকে কিছু বললেন না। দিনের পর দিন রমজান মিথিলার প্রতি দূর্বল হতে থাকেন। এক পর্যায়ে মিথিলা ও দূর্বল হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে শুরু হয় একটি সম্পর্ক। প্রেয়সীকে দেখতে মানুষটা কখনো মাঝরাতে বাড়ির সামনে দাড়িয়ে থাকতো। কখনো বা স্কুল ছুটির পর। কলেজে উঠে দুজন যখন আলাদা প্রতিষ্ঠানে তখন রমজানের পাগল প্রায় অবস্থা। প্রেয়সীকে দেখতে না পেরে তার মন শরীর সব যেনো নেতিয়ে গেছে। কলেজের হোস্টেল থেকে লুকিয়ে চলে আসলেন এক পলক দেখার আশায়। মিথিলা তখন তার বাড়ির পাশেরই একটা কলেজে পড়েন। কলেজ ছুটির পর বেরিয়ে রাস্তার চায়ের দোকানের সামনে অ-পরিপাটি অগোছালো ছেলেটিকে দেখতে পেয়ে থমকান। মানুষটি এতো পাগল কেন? যে-ই রমজান শেখ এক কালে মিথিলার মধ্যে নিজের প্রাণ খুঁজে পেতেন, যাকে আগলে রাখতে সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করতেন। যার গায়ে সামান্য মশা বসলেও তিনি ব্যথা পেতেন, সেই তিনিই এক সময় প্রেয়সীর প্রতি অমানুষিক অত্যাচার শুরু করেন। কেন করেন? জানা নেই নিনীকার। মা কখনো বলেননি। সবসময়ই এড়িয়ে গেছেন। মিথিলা বড়ো শখ করে আহ্লাদ করে ডাকতেন। বলতেন,

‘ আমাকে এতো ভালোবাসো কেন গো শেখ বাবু? অতি ভালো বেসো না গো। নাহলে যে ভালোবাসা কমিয়ে দিলে আমি বড়োই কষ্ট পাবো। ‘

মিথিলার কথাটা লেগে গেছিলো হয়তো। তার শেখ বাবু তাকে ভালোবাসা কমিয়ে দিলো। পরিবর্তে ছুড়লো একের পর এক কাঁটার আঘাত।

‘ নিনীকা ইয়ার ’

নিনীকা ভাবনা ছেড়ে বের হলো। সুমিত্রা হাসি-হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে। হাতে একটি ব্যাগ। সে নিনীকার কাঁধ জড়িয়ে ধরলো।

‘ভালো কয়েকটা কাপড় গুছিয়ে নে, আমরা ঘুরতে যাবো। ফাস্ট।’

নিনীকা অবাক হলো।

‘হঠাৎ?

সুমিত্রা ভেংচি দিলো,

‘তোর যে ভালো লাগে না আমি কি জানি না? ঘুরলে মন ফ্রেশ হবে বুঝেছিস? তাছাড়া এখন তো আপাতত কিছু নেই। পূজার বন্ধ। সুতরাং ফ্রি আছি যখন তখন ঘুরে আসি না প্রব্লেম কি? ‘

নিনীকা অবাক হলো না। মেয়েটা তার এতো খেয়াল রাখে। নিনীকার নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয়। নিনীকা রেডি হয়ে নিলো। সুমিত্রা নিজেই ওর কাপড় গুছিয়ে নিয়েছে। দুজন যখন হোস্টেল থেকে বের হলো তখন নিনীকা প্রশ্ন করলো,

‘ কোথায় ঘুরতে যাচ্ছি? ‘

‘দার্জিলিং।’

‘শুধু আমরাই?’

‘না, আমার দুজন ক্লাসমেইট আছে। তারা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে।’

‘কতোদিনের ট্রিপ?’

‘তিনদিনের।’

নিনীকা লম্বা শ্বাস ফেললো। মেয়ে টা তাকে আগে থেকে কিছু না জানিয়ে হুট করে চমকে দিলো। তার স্বপ্ন গুলো কিভাবে পূরণ করে দিচ্ছে। সে দার্জিলিং যাচ্ছে সেটা তার বিশ্বাসই হচ্ছে না।

শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যেতে আড়াই ঘন্টা লাগে। তারা টেক্সিতে চেপে বসলো। যেতে যেতে নিনীকা পরিচিত হয়ে নিলো সুমিত্রার ক্লাসমেইট এর সাথে।


শৈল শহরের রানী নামে পরিচিত দার্জিলিং (Darjeeling) ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। দার্জিলিং তার ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, চা ও দার্জিলিং হিমালয় রেলওয়ের জন্য বিখ্যাত। দার্জিলিং এর জনপ্রিয়তা ব্রিটিশ রাজের সময় থেকেই বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে এটি যখন তাদের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসাবে গড়ে উঠেছিল। পূর্বে দার্জিলিং ছিল প্রাচীন গোর্খা রাজধানী। পরে সিকিমের মহারাজা ব্রিটিশদের দার্জিলিং উপহার করেন। দার্জিলিং তার অনাবিল সৌন্দর্য এবং মনোরম জলবায়ুর কারণে ভারতের একটি জনপ্রিয় ছুটির গন্তব্য হয়ে আসছে। পর্যটন ছাড়াও, দার্জিলিং তার বিভিন্ন ব্রিটিশ শৈলীযুক্ত বেসরকারি বিদ্যালয় গুলির জন্য জনপ্রিয়, যা ভারত জুড়ে এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশগুলি থেকেও ছাত্র-ছাত্রীদের আকর্ষণ করে।

দার্জিলিং এর স্থানীয় মানুষেরা গোমাংস এবং মসুর দিয়ে ভাত খেতে পছন্দ করেন। অন্যান্য জনপ্রিয় স্থানীয় খাবার হল মম (মাংস বা সবজি দিয়ে পিঠার মত খাবার), থুপকা (মাংস এবং নুডলস দিয়ে তৈরি একটি ঘন স্যুপ), গানড্রাক (গাঁজানো সরিষা পাতা) এবং চ্যাং (স্থানীযবিয়ার)।

দার্জিলিং পরিভ্রমণের সেরা সময় হল বসন্ত ও শরৎকাল। দার্জিলিং-এ বসন্তকাল মার্চ থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত বিরাজ করে, অন্যদিকে শরৎকাল সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত স্থিত হয়।

ছোট বড় মিলিয়ে বেড়ানোর জন্য প্রায় ১৭টি আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে দার্জিলিং জুড়ে।

পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত রেলওয়ে স্টেশন ঘুম।
আছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০,০০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে অপূর্ব সুন্দর সূর্যোদয় দেখা।
পৃথিবীর বিখ্যাত প্রার্থনা স্থান ঘুম মোনাস্ট্রি।
ছবির মতো অপূর্ব সুন্দর স্মৃতিসৌধ বাতাসিয়া লুপ বিলুপ্ত প্রায় পাহাড়ি বাঘ Snow Lupard খ্যাত দার্জিলিং চিড়িয়াখানা।
পাহাড়ে অভিযান শিক্ষাকেন্দ্র হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট।
সর্বপ্রথম এভারেস্ট বিজয়ী তেনজিং-রক- এর স্মৃতিস্তম্ভ।

নিনীকারা পৌছে গেলো। সে মুখে হাত দিয়ে আশপাশ দেখছে। দূরে উঁচু উঁচু পাহাড় দেখা যাচ্ছে। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। পাহাড়ের বুকে যেনো আকাশ মিশে রযেছে। নিনীকা যদি পাহাড়ের চূড়ায় উঠে তাহলে কি সে আকাশ ছুতে পারবে?’

সুমিত্রা নিজেও মুগ্ধ। যদিও সে আগে দু’বার এসেছে। কিন্তু বারবারই মুগ্ধ হতে হয় তাকে।

ট্যুরিস্ট এরিয়া হওয়াতে এখানে বিভিন্ন রেঞ্জের হোমস্টে, আবাসিক হোটেল, রেস্ট হাউজ আছে। দার্জিলিংয়ে ক্লক টাওয়ার ও মল রোডের আশেপাশে অনেক হোটেল আছে, দরদাম করে উঠতে হয়। পিক সিজনে মানে এপ্রিল-জুন ও অক্টোবর-ডিসেম্বরে রুম রেন্ট একটু বেশি নিতে পারে। তবে আগে থেকে বুকিং না করে গেলেও থাকার জায়গা নিয়ে কোনো সমস্যা হলো না।

নিনীকারা মল রোডের আশপাশ হোটেল গুলোর একটিতে গেলো। দুটো রুম নিলো চারজন মিলে। একটাতে নিনীকা ও সুমিত্রা, আরেকটাতে বাকি দুজন।

তারা যখন রুমের চাবি নিয়ে হোটেল রুমের দিকে যাচ্ছিল তখনই মল রোডের সেই হোটেলের সামনে এসে থামলো সেনাবাহিনীর জিপ। সেটা থেকে নেমে এলো সেনবাহিনীর প্যান্ট পড়া কিন্তু মাটিয়া রঙের টিশার্ট পরিহিত এক যুবক। চোখে কালো চশমা। হাতের পেশিগুলো ফুলে পেঁপে উঠেছে। চারিদিকের অনেক রমনীই তার দিকে তাকিয়ে আছে। দীর্ঘদেহী পুরুষটি বুট জুতার শব্দ তুলে রিসিপশনের সামনে এসে থামলো। রুম বুকিং করার জন্য রিসেপশনিস্ট তার নাম জিজ্ঞেস করলেন। সে হাস্কি স্বরে ঠোট নাড়িয়ে নিজের নাম উচ্চারণ করলো,

‘ মেজর ধ্রুব মাহবুব। ’

রিসেপশনিস্ট চমকে গেলেন হয়তো। হিন্দি নাকি উর্দু বললো ধ্রুব জানে না। প্রশ্ন ছুড়লেন,

‘আপ সেনাবাহিনী কা মেজর হ্যা জনাব? আইয়ে হামারি হোটেল মে আপকা সোয়াগাত হ্যাঁ জি। বলিয়ে কোন সি রুম লাগে গা? ‘

ধ্রুব চোখের চশমা খুলে নিলো। বলল,

‘পাকিস্তান?’

‘নেহি জি হামারি হিন্দি তোরাতোরা আতি হে সো মেরি উর্দু ওর হিন্দি গুলাই যা তা হে তো..

ধ্রুব গম্ভীর স্বরে ধমক দিলো।

‘আপনার ভাষা আপনার কাছেই রাখুন। আমাকে একটি রুম বুক করে দিন।’

রিসেপশনিস্ট চুপসে গেলেন। কথা না বাড়িয়ে একটি রুমের চাবি বাড়িয়ে দিলেন।

ধ্রুব চোখে চশমা পড়ে নিলো। নিচে রাখা ট্রলি ব্যাগটি টেনে নিয়ে যেতে লাগলো তার পালিয়ে যাওয়া বউয়ের পাশের রুমে। যেতে যেতে বিরবির করলো,

‘মেজর ধ্রুব মাহবুবের সাথে সংসার করতে প্রস্তুত হও নিনীকা শেখ। তোমাকে সারাজীবন মেজরের অলীক কন্যা হয়েই থাকতে হবে। সাথে করতে হবে পালিয়ে আসার প্রায়শ্চিত্ত।’

বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে দার্জিলিংয়ের পাহাড় পর্বত। ধ্রুব চশমার কোণ দিয়ে থাই গ্লাস ভেদ করে বাহিরে তাকালো। মুগ্ধতা ভর করলো দু’চোখে।

(চলবে)

[ সবাই চার লাইনের গঠন মূলক মন্তব্য করতে চেষ্টা করবেন। ]

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here