#হৃদয়ে_লিখেছি_তোমারি_নাম
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৪৯
[কঠোর ভাবে প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উম্মুক্ত]
জাহিন আর অয়ন্তি মুখোমুখি বসে আসে বদ্ধ ঘরে। জাহিন বাড়িতে এসেই কিছু না বলে সকলের সামনে দিয়ে অয়ন্তির হাত ধরে নিজেদের ঘরে নিয়ে আসে। বাড়ির সকলে বোকার মতো সবটা চেয়ে দেখল। জোহরা বেগম পিছু ডাকলেও জাহিন ফিরে তাকায় নি। বাড়ির সবাই চিন্তিত হয়ে নিচে বসে আছে। আহানকে পাঠিয়েছিল জাহিনের ঘরে কিন্তু ভেতর থেকে দরজা লক হওয়াতে সকলে যেন আরো ভয়ে আছে। জোহরা বেগমের ভালো ঠেকছে না মায়ের মন কু ডাকছে। হঠাৎ ওনার শান্ত শিষ্ট ছেলেটা এমন ভয়াবহ আচরণ করছে কেন? আল্লাহর কাছে একটাই দোয়া করছে খারাপ কিছু যেন না ঘটে।
অয়ন্তি বেডের এক কোণে আর জাহিন সোফায় বসে আছে। জাহিন চোখে মুখে গম্ভীর ভাব নিয়ে স্থির চোখে অয়ন্তির দিকে তাকিয়ে আছে। জাহিনের এমন চাওনি অয়ন্তিকে ভেতর থেকে গুমরে দিচ্ছে। এই চাওনি যে তার কাছে বড্ড অচেনা লাগছে। কি হয়েছে হঠাৎ? জাহিন তার সাথে এমন আচরণ করছে কেন? জাহিন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে নিচ দিকে একবার দৃষ্টি ফেলে পুনরায় অয়ন্তির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে শান্ত গলায় বলল।
“তোমার কিছু বলার থাকলে আমাকে বলে দাও অয়ন্তি।”
অয়ন্তির চিত্ত কেঁপে উঠে জাহিনের কথা শুনে। এই স্বরে জাহিন আজ পর্যন্ত তার সাথে কথা বলে নি। আর কি কথা বলার কথা বলছে? জাহিন কি কোনো ভাবে লাবীবের কথা জেনে গেছে। যার জন্য এতটা অস্বাভাবিক হয়ে আছে। তাকে আবার ভুল বুঝে নি তো জাহিন। অয়ন্তিকে এমন নিশ্চুপ হয়ে থাকতে দেখে জাহিনের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গেচুরে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। এই একত্রিশ বছরের জীবনে জাহিন এতোটা অধৈর্যশীল কোনো বিষয়ে হয় নি যতটা আজ হচ্ছে অয়ন্তিকে মৌন থাকতে দেখে। জাহিন চোয়াল শক্ত করে কপট রাগ দেখিয়ে বলল।
“এভাবে চুপ করে থাকবে না অয়ন্তি। আমার কথার উত্তর দাও। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে দিচ্ছে তোমার এই চুপ থাকা। কি বলতে চেয়েছিলে আমাকে ওই দিন রাতের বেলা?”
অয়ন্তি শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে তটস্থ করে থেমে থেমে বলল, “আসলে ওই দিন শপিং মলে আমার সাথে লাবীবের দেখা হয়েছিল।”
জাহিন ভ্রু কুঁচকে নেয় তাহলে সত্যি কথা বলেছে ত্রিনভ। ছেলেটার নাম তাহলে লাবীব। জাহিন নিষ্প্রভ গলায় বলল, “কে লাবীব?”
“যার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।”
“শুধু কি দেখাই হয়েছিল নাকি আরো কিছু হয়েছিল?”
অয়ন্তি হতভম্ব হয়ে পড়ে জাহিনের কথা শুনে। কি হওয়ার কথা বলছে জাহিন? অয়ন্তি হতবিহ্বল হয়ে বলল, “মানে।”
“যেটা প্রশ্নটা করেছি তার উত্তর দাও। ওই দিন কি কি ঘটেছিল এ টু জেড বলো।”
জাহিনকে এই বিষয়ে এতোটা ডেসপারেট হতে থেকে অয়ন্তির ভয় লাগছে। অয়ন্তি অধর জোড়া জিভ দ্বারা ভিজিয়ে বলল, “আসলে জারা আর নুহাশ ভাই আমাকে রেখে নিচে চলে গিয়েছিল তখন আমি ওদের কাছে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে শাড়ির সাথে পা বাজিয়ে পড়ে যেতে নিলে লাবীব আমাকে কোথা থেকে এসে ধরে। আর আমি ওনাকে দেখার সাথে সাথে ওখানে থেকে চলে আসি একটা কথাও বলে নি। বিশ্বাস করুন আমি জানতাম না লাবীব যে ওই দিন শপিং মলে আসবে যদি জানতাম তাহলে কোনো দিনেই যেতাম না।”
জাহিন রাশভারি গলায় বলল, “এই কথাটা তুমি আমাকে ওই দিন বললে না কেন সাথে সাথে?”
“আমি মনে মনে অনেক ভয়ে ছিলাম যদি আপনি এই কথাটা শুনে আমাকে ভুল বুঝেন বা অবিশ্বাস করেন।”
জাহিন ব্যতিব্যস্ত গলায় বলল, ”জানো অয়ন্তি স্বামী স্ত্রীর মাঝে যদি বিশ্বাসের স্তরের মাটিটা নরম হয় তাহলে বিশ্বাসের শিকরটা তৃতীয় ব্যক্তিটা খুব সহজেই উপড়ে ফেলতে পারে। তুমি আমাকে এখনও বিশ্বাসেই করে উঠতে পারো নি।”
অয়ন্তি ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইল জাহিনের পানে। জাহিনের কথার ভাঁজে যে বুক ভরা এক ভয়াবহ যন্ত্রণা মিশে রয়েছে সেটা অয়ন্তি স্পষ্ট টের পারছে। জাহিন পুনরায় দৃঢ় কন্ঠে বলল।
“এই যে তুমি কথাটা বলেছো সেটা যদি তুমি আমাকে আগে বলে দিতে বিশ্বাস করো আমি একটুও কষ্ট পেতাম না বা তোমাকে অবিশ্বাসও করতাম না। কিন্তু যতোটা না কষ্ট আজকে পেয়েছি অন্য কারোর কাছ থেকে এটা শুনে।”
অয়ন্তি আঁতকে উঠে বলল, “অন্য কারোর কাছ থেকে শুনেছেন মানে? কে বলেছে লাবীব?”
“সেটা তোমার জেনে লাভ নেই। শুধু এই টুকু বুঝতে পারলাম আমার প্রতি তোমার এতটুকুও ভরসা কিংবা বিশ্বাস নেই। যদি থাকতো নির্দ্বিধায় কথাটা বলে দিতে কিন্তু তুমি বললে না ইভেন আজ সকালেও তোমাকে আমি জিঙ্গাসা করেছি কিন্তু তুমি সবটা এড়িয়ে গেলে। বিয়ের এতোগুলা মাস হয়ে গেল অথচ তুমি আমাকে বুঝে উঠতে পারলে না এখনও অয়ন্তি।”
অয়ন্তি বুঝতে পারল সে বড্ড ভুল করে ফেলেছে। তার আগেই বলে দেওয়া উচিত ছিলো জাহিনকে সবটা তাহলে আজ জাহিন এতোটা মানসিক ভাবে আহত হতো না। অয়ন্তি বসা থেকে উঠে জাহিনের কাছে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, “নেতা মশাই আমার কথাটা শুনুন।”
জাহিন বসা থেকে উঠে অয়ন্তিকে হাত দিয়ে থামিয়ে অভিমানী গলায় বলল, “কাছে আসবে না তুমি আমার।”
অয়ন্তির চোখ ভরে উঠছে নোনা জলে। ঠোঁট ভেঙ্গে কান্না আসছে তার। চোখের পলক ফেলতেই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনা জল। এই চোখের জল যেন জাহিনকে আজ নরম করলো না অন্য সময় গুলার মতো। অন্য সময়গুলাতে জাহিন অয়ন্তির চোখে জল দেখলে যেভাবে ছুটে এসে চোখের জল মুছে দিতো সেটা আজ জাহিন করল না। সে এক জায়াগতে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। অয়ন্তির হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হলো তাতে। কষ্টগুলা দলা পাকিয়ে বুকে চেপে বসল। নিজ হাতে আজ এই পরিস্থিতে ডেকে এনেছে। অয়ন্তি ধরা গলায় বলল।
“আমার ভুল হয়ে গেছে আর কোনো দিন এমনটা হবে না।”
“তুমি আমাকে ভীষণ ভাবে হার্ট করেছো অয়ন্তি। যেটার ক্ষত এতো সহজে ভালো হওয়ার নয়।”
অয়ন্তি জাহিনের কাছে এসে জাহিনের হাত দুটো ধরে অনবরত চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলল, “আর এমনটা হবে না আমি কথা দিচ্ছি। এবারের মতো ক্ষমা করে দিন আমি ভয়ে ছিলাম যার জন্য বলতে গিয়েও বলতে পারি নি।”
“আমার উপরে ভয়টাই তোমার অবিশ্বাসের কারণ অয়ন্তি। আমায় তুমি অবিশ্বাস করো দেখেই ভয়ে বলতে পারো নি তুমি কথাটা। যদি বিশ্বাস করতে তাহলে আজ অন্য কারোর কাছ থেকে এমন নোংরা ইঙ্গিতের মাধ্যমে কথাটা গুলা শুনতে হতো না আমাকে তার আগেই তাকে থামিয়ে দিতাম।”
“এমনটা আর কখন হবে না এখন থেকে সব কথা আপনাকে বলব কথা দিচ্ছি।”
জাহিন অয়ন্তির হাতটা নিজের হাত থেকে সরিয়ে দেয়। অয়ন্তি একবার হাতের দিকে চেয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে জাহিনের পানে তাকাল। জাহিন প্রচন্ড অভিমানী মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে চেয়ে বলে।
“চিন্তা করো না আমি এমন স্বামী নই যে আমার স্ত্রীকে আমি অবিশ্বাস করবো। তবে এতোটুকু আক্ষেপ আমার স্ত্রীর আমার উপরে বিন্দু পরিমাণ বিশ্বাস নেই। যেটা এই ঘটনার প্রেক্ষিতে জানতে পারলাম।”
বলেই জাহিন ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অয়ন্তি কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে জাহিনের পিছুপিছু গেল। ছেলেকে নিচে নামতে দেখে জোহরা বেগম বসা থেকে উঠে ছেলের কাছে এসে চিন্তিত গলায় বলল, “কি হয়েছে তোদের দুজনের মাঝে।”
জাহিন ভরাট গলায় বলল, “কিছু হয় নি মা।”
বলেই সদর দরজার দিকে অগ্রসর হলো। অয়ন্তি দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেতা মশাই নেতা মশাই বলে নামচ্ছে। সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার ভয় নেই আজ অয়ন্তির মনে সে অস্থির হয়ে ছুটে চলচ্ছে স্বামীর কাছে। বাড়ির সবাই জাহিন আর অয়ন্তির মান অভিমান গুলা অবাক চোখে দেখছে। অয়ন্তি সদর দরজা পেরিয়ে বাইরে আসলো ততক্ষণে জাহিন গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফেলেছে। গাড়ি চলতে শুরু করল। অয়ন্তি গাড়ির পিছু নিতে গিয়েও নিলো না ততক্ষণে গাড়ি যে তার নৈকট্যের বাইরে চলে গেছে। জাহিন গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে মনে মনে আওড়ালো।
“সরি অয়ন্তি আমি চাইলেই তোমাকে বুকে টেনে নিতে পারতাম কিন্তু আমি চাই তুমি যেন সম্পর্কে বিশ্বাস থাকার মানেটা বুঝতে পারো। যেই সম্পর্কের মাঝে বিশ্বাস নেই সেই সম্পর্কের শিকরের মাটি যে খুব নরম হয়। আর আমি চাই না আমাদের সম্পর্কের শিকরের মাটি নরম হোক। এই জন্য তোমাকে ক্ষণিকের জন্য হলেও কষ্ট সইতে হবে, বুঝতে হবে একটা সম্পর্কের মাঝে বিশ্বাসের মর্যাদা কত টুকু। পরে না হয় তোমার এই ক্ষণিকের কষ্ট টুকু আমার ভালোবাসা দিয়ে মুছে দেবো। ততক্ষণ তুমি একটু কষ্ট পাও।”
জাহিনের গাড়ি মিলিয়ে যায়। জাহিন ইচ্ছে করেই বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। চোখের সামনে অয়ন্তির কান্না দেখতে পারবে না তাই এই প্রন্থা বেছে নিয়েছে। বাড়ির সবাই বের হয়ে আসলো। অয়ন্তি শাশুড়ি মায়ের কাছে এসে কান্নারত অবস্থায় চেঁচিয়ে বলল, “মা ওনি আমার উপরে রাগ করে চলে গেছেন মা। বিশ্বাস করুন মা আমি ওনাকে আঘাত করতে চাই নি কিন্তু কি করে কি করে যে হয়ে গেল এমনটা আমি সত্যি বুঝতে পারি নি।”
জোহরা বেগম অয়ন্তির মুখটা দু হাত দিয়ে ধরে মলিন গলায় বলল, “সব ঠিক হয়ে যাবে অয়ন্তি তুমি শান্ত হও।”
অয়ন্তি পাগলের ন্যায় বলল, “না মা ওনি আমার উপরে খুব রাগ করেছেন খুব। ওনি আমাকে আর আগের মতো ভালোবাসবেন না মা। ওনি আমাকে আর ওনার কাছে টেনে নিবেন। আমি ওনার অবহেলাগুলা সহ্য করতে পারব না।”
জোহরা বেগম পাগল প্রায় অয়ন্তিকে বুকের মাঝে চেপে ধরে বলে, “সব ঠিক হয়ে যাবে অয়ন্তি সব ঠিক হয়ে যাবে তুমি একটু শান্ত হও। আমি জাহিনকে বুঝাবো।”
অয়ন্তি এক নাগাড়ে শুধু একটা কথাই বলে যাচ্ছে, “ওনি আমার উপরে খুব রাগ করেছেন মা খুব। আর ভালোবাসবেন না ওনি আমাকে।”
বাড়ির সবাই অয়ন্তিকে বুঝাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। জাহিনকে একের পর এক কল করা হচ্ছে কিন্তু একটা কলও ধরলো না। হঠাৎ দুজনের মাঝে কি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হলো বুঝতে পারছে না কেউ। অয়ন্তিকর প্রশ্ন করলে অয়ন্তি কোনো উত্তর দেয় না। নুহাশকে কল করা হলে ও বলে এই বিষয়ে ও কিচ্ছু জানে না। নুহাশ ইচ্ছে করেই এই কথাটা বলেছে যাতে করে বাড়ির কেউ আবার বিষয়টা অন্য ভাবে না নেয় যেহেতু অয়ন্তি জাহিন কিচ্ছু বলছে না কাউকে। অয়ন্তি কান্না করতে করতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমে ঢুলে পড়ে। জোহরা বেগম অয়ন্তির চোখের কোণে জমে থাকা পানিটা মুছে দিয়ে গায়ে কম্বল টেনে দিয়ে একে একে সবাই রুম থেকে বের হয়। জোহরা বেগম সবার উদ্দেশ্যে বলে।
“ও ঘুমাক আর জাহিন আসুক তারপর ওর সাথে কথা হবে। কি হয়েছে দুজনের মাঝে যে মেয়েটা এভাবে পাগলের মতো কান্না করল।”
________
জাহিন আসলো রাত সাড়ে দশটার দিকে। কলিং বেল বাজার সাথে সাথে বাড়ির কাজের লোক দরজা খুলে দিল। জাহিন ভেতরে ঢুকে মাকে সোফায় বসে থাকতে দেখেও না দেখার ভান করে কিছু না বলে চলে যেতে নিবে তখনই জোহরা বেগম গুরুগম্ভীর গলায় বললেন, “দাঁড়া।”
জাহিন দাঁড়িয়ে পড়ে। জোহরা বেগম ছেলের মুখোমুখি হয়ে বলল, “কি হয়েছে তোদের মাঝে যে মেয়েটা এভাবে পাগলের মতো কান্না করল?”
জাহিন ঠান্ডা গলায় বলল, “কিছু হয় নি মা।”
“কিছু হয় নি যখন তাহলে অয়ন্তি কি এমনি এমনি কান্না করেছে।”
“মা খুব ক্লান্ত লাগছে আমার আমি উপরে গেলাম।”
জাহিন পা বাড়াতে নিলে জোহরা বেগম বলেন, “অয়ন্তিকে রুমে নিয়ে যা।”
জাহিন মায়ের দিকে ফিরে বলল, “কোথায় ও?”
“আমার ঘরে ঘুমিয়ে আছে।”
জাহিন একটা টু শব্দ না করে মায়ের রুমে এসে ঘুমন্ত অয়ন্তিকে এক পলক দেখে পাজাকোলা তুলে নিয়ে মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে মাকে উদ্দেশ্যে করে বলল, “খেয়েছে ও?”
জোহরা বেগম রাগী গলায় বলল, “তোর কি মনে হয়?”
“কাউকে দিয়ে ওর খাবারটা উপরে পাঠাও।”
জাহিন অয়ন্তিকে নিয়ে নিজেদের ঘরে এসে অয়ন্তিকে ধীরে ধীরে বিছানায় শুইয়ে দেয়। এই মেয়ের তো আবার স্বভাব খারাপ অন্য জায়গা থেকে এনে আরেক জগায়াতে শুয়ালে ঘুম ভেঙ্গে যায়। জাহিন ঝুঁকে আছে অয়ন্তির দিকে। এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে বউয়ের দিকে। কান্না করার ফলে মুখের অবস্থা নাজেহাল বানিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। চোখের জলের সাথে কাজল মিশে একাকার হলে গালে কালো দাগ বসে গেছে। জাহিন অয়ন্তির গালে হাত রেখে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে চোখের কোণায় স্পর্শ করে নিচু হয়ে অয়ন্তির বন্ধ দু চোখের পাতায় চুমু বসায়। বুঝতে পারছে অতিরিক্ত কষ্ট দিয়ে ফেলেছে মেয়েটাকে। কিন্তু কিছু করার নেই অয়ন্তিকেও বুঝতে হবে। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা গাড়ির চাকার মতো চাকা দুটো যদি উঁচু নিচু হয়ে থাকে তাহলে সেই সম্পর্কটা ধসে পড়বে কখনই শক্ত হয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না। তাই দুজনের উপরেই সমান আস্থা রাখতে হবে।
জাহিন ফ্রেশ হয়ে অয়ন্তিকে আস্তে আস্তে ডাকে। রাত অনেক হয়েছে এবার খাওয়া দরকার। অতিরিক্ত কান্না করার ফলে হয়তো পেটের খাবার এতক্ষণে মজে গেছে। জাহিন অয়ন্তির দু গালে আলতো হাতে চাপড় মেরে বলল।
“অয়ন্তি উঠো এবার।”
অয়ন্তি পিটপিট চোখে তাকাল। চোখের সামনে জাহিনের প্রতিচ্ছবি দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে লাফিয়ে শুয়া থেকে উঠ বসে ভাঙ্গা গলায় বলল, “নেতা মশাই।”
জাহিন উঠে দাঁড়িয়ে অন্য দিকে ফিরে বলল, “ফ্রেশ হয়ে আসো যাও খেতে হবে।”
অয়ন্তির ঠোঁট ভেঙ্গে আসছে। এতো রাগ যে তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। কি এমন ভুল করেছে যে এতোটা রেগে থাকতে হবে তার প্রতি। আর এতো দরদ তাকাতে হবে না সে না খেলে তার কি? অয়ন্তির কোনো রেসপন্স না পেয়ে জাহিন অয়ন্তির দিকে ফিরে কপট রাগ দেখিয়ে বলে।
“কি হলো এভাবে বসে আছো কেন? যদি ভেবে থাকো না খেয়ে তুমি নিজের শরীর খারাপ করবে। তাহলে এই চিন্তা মাথা থেকে ছেড়ে ফেলে দাও কারণ আমি আমার কাজকর্ম ছেড়ে তোমাকে নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে দৌঁড়াতে পারব না অয়ন্তি।”
অয়ন্তি মুখ ঘুরিয়ে বলল, “আমার খিদে নেই খাবো না আমি।”
কিন্তু অয়ন্তির পেটে ইঁদুর দৌঁড়াচ্ছে। দুপুরে খেয়েছিল এরপর আর কিচ্ছু খাওয়া হয় নি পানি ছাড়া। জাহিন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। এই মেয়ে তো উল্টো তার উপরে ছু’রি ঘুরাচ্ছে। জাহিন অয়ন্তিকে পাজাকোলা তুলে নিয়ে কঠিন গলায় বলল।
“ফ্রেশ হওয়ার দরকার নেই এভাবেই খাবে তুমি।”
অয়ন্তি ছটফট করতে করতে বলল, “বলছি তো আমি খাবো না।”
জাহিন অয়ন্তিকে এনে সোফায় বসিয়ে খাবারে প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও খাওয়া শুরু করো।”
অয়ন্তি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। যার অর্থ সে খাবে না। জাহিন তা দেখে বলল, “কি হলো খাওয়া শুরু করো।”
“বলছি তো আমি খাবো না।”
জাহিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “একদম নাটক করবে না অয়ন্তি চুপচাপ খাও।”
অয়ন্তি চেঁচিয়ে বলল, “আমি না খেলে আপনার তাতে কি?”
জাহিন টি-শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত তুলে থমথমে গলায় বলল, “তুমি খাবে তোমার ঘাড়ও খাবে ওয়েট।”
জাহিন নিজেই ভাত মাখিয়ে বা হাত দিয়ে অয়ন্তির মুখ চেপে ধরে জোর করে এক লোকমা খাবার খাইয়ে দেয় অয়ন্তিকে। এরপর অয়ন্তি আর একটা টু শব্দ করলো না চুপচাপ জাহিনের হাতে খেয়ে নিল। অয়ন্তি জাহিনকে জিঙ্গাসা করল জাহিন খেয়েছে কিনা কিন্তু জাহিন উত্তর দিলো না। জাহিন তো জোর করে তাকে খাইয়ে দিয়েছে এবার কি জাহিনকে তার সাথে কথা বলানোর জন্য সাড়াশি দিয়ে জাহিনের মুখ খুলতে হবে।
________
জাহিন আর অয়ন্তি শুয়ে আছে তাদের মাঝে এক হাত দূরত্ব। জাহিন পাশ ফিরে শুয়ে আছে। অয়ন্তি বার বার জাহিনের দিকে তাকাচ্ছে যদি একবার তার দিকে ফিরে এই আশায়। কিন্তু আফসোস জাহিন একটি বারের জন্য ফিরল না। অয়ন্তির বুক ভার হয়ে আসছে। এতো অভিমান এতো রাগ। মানছে সে একটা ভুল করে ফেলেছে তা বলে এভাবে মুখ ঘুরিয়ে থাকবে। অয়ন্তির চোখের কোণা ভিজে উঠেছে। বেরিয়ে আসলো দীর্ঘ নিঃশ্বাস। কান্না করতেও পারছে না প্রাণ খুলে। অয়ন্তির নাক টানার শব্দ শুনে জাহিন চোখ মেলে তাকায়। বুঝতে পারল অয়ন্তি নিঃশব্দে কান্না করছে। মেয়েটাকে এবার থামানো দরকার অনেক কান্না করেছে আর না। জাহিন অয়ন্তির দিকে ফিরে নরম গলায় বলল।
“কি হয়েছে এভাবে কান্না করছো কেন না ঘুমিয়ে?”
অয়ন্তি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল চোখের উপরে হাত রেখে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল। জাহিন তৎক্ষণাৎ অয়ন্তির ছোট্ট দেহটা টেনে এনে নিজের বুকে ফেলে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কোমল কন্ঠে বলল, “হয়েছে তো আর কান্না করতে হবে না অনেক কান্না করেছো এবার থামো।”
অয়ন্তি কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আপনি আমার উপরে খুব রেগে আছেন তাই না?”
“কে বলেছে আমি রেগে আছি তোমার উপরে?”
“আপনার ব্যবহারেই বলে দিচ্ছে।”
জাহিন অয়ন্তিকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে বেডে শুইয়ে দিয়ে অল্প ঝুঁকে অয়ন্তির কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলল, “তা আমার এই ব্যবহারটা কি বলছে এখন?”
“বিশ্বাস করুন ওই লাবীবের সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই ওই দিনের পর থেকে।”
“হুম বুঝেছি।”
“আর সত্যি আমার উপরে রেগে নেই তো আপনি।”
“উমমম রেগে ছিলাম কিন্তু পরে ভাবলাম স্বামীদের বেশি রেগে থাকতে নেই বউয়ের উপরে তাতে মহব্বত কমে যায়।”
অয়ন্তি জাহিনকে নিজের উপর থেকে সরিয়ে বসে মলিন গলায় বলল, “আপনি একজন বাজে স্বামী যে শুধু বউকে কষ্ট দেয়।”
জাহিন নৈঃশব্দে হেসে অয়ন্তির কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের কোলে এনে বসিয়ে মিহি স্বরে বলল, “শুধু কষ্ট দেওয়াটা চোখে পড়লো ভালোবাসাটা চোখে পড়লো না।”
“ভালোবাসলে এভাবে ছেড়ে চলে যেতেন না।”
“গেলাম কোথায় সেই তো ঘুরেফিরে তোমার কাছেই ফিরে আসলাম।”
অয়ন্তি নিজেকে জাহিনের কাছে থেকে ছাড়ানোর প্রয়াস চালিয়ে বলল, “ছাড়ুন আমাকে জুতা মেরে এখন গরু দান করতে হবে না।”
জাহিন ছাড়ল না বরং অয়ন্তিকে শক্ত করে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। অয়ন্তি ক্রমাগত জাহিনের বাহুডোর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। তাকে কষ্ট দিয়ে এখন এসেছে মলম লাগানোর জন্য। লাগবে না তার মলম।
“অয়ন্তি।”
জাহিনের কোমল কন্ঠে গাঢ় ডাক শুনে অয়ন্তি শান্ত হয়ে পড়ে। শরীরের বয়ে যায় এক শীতল টেউ। জাহিনের এই ডাক অয়ন্তির সাধ্য নেই উপেক্ষা করা তাই আনমনেই বলে, “হু।”
“আমার কিছু চাওয়ার আছে তোমার কাছ থেকে অয়ন্তি।”
“আপনাকে দেওয়ার মতো আমার কাছে এমন কিছু নেই নেতা মশাই ?”
“আছে, তোমার কাছেই আছে যেই চাওয়াটা তুমিই আমার পূরণ করতে পারবে।”
“কি সেটা?”
“আমার বাচ্চা চাই। আমি বাবা হতে চাই অয়ন্তি।”
অয়ন্তির সমস্ত কায়া কেঁপে উঠে। লজ্জায় মাথা নুইয়ে নেয়। গলার স্বর কাঁপছে। অয়ন্তির শরীরের কম্পন বুঝতে পেরে জাহিন মৃদু হেসে বলল, “কিছু বলবে না তুমি?”
অয়ন্তি নিচু গলায় বলল, “কি বলব?”
“তুমিই তো বলবে। তুমি চাও না আমাদের কোল আলো করে একটা ছোট্ট প্রাণ আসুক। যেই প্রাণটা আমাদের চোখের সামনে বেড়ে উঠবে ধীরে ধীরে।”
অয়ন্তি নিচু গলায় বলল, “হুম চাই।”
“তাহলে চলো একটা ছোট্ট প্রাণ তোমার দেহের মাঝে আনার ব্যবস্থা করি।”
অয়ন্তি আঁকড়ে ধরে নিজের পরিহিত শাড়ির কোণা। ধীর গলায় বলল, “পারবো তো এই দায়িত্ব পালন করতে।”
জাহিন অয়ন্তিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে অয়ন্তির মুখটা নিজের শক্তপোক্ত হাতের মুঠোতে নিয়ে মজার ছলে বলল, “বুড়ো হয়ে যাচ্ছি তো আমি। এখন যদি বাপ ডাক না শুনি তাহলে কখন শুনবো?”
অয়ন্তি ফিক করে হেসে বলল, “আপনি বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন কে বলল?”
“আমি বলেছি। কেন চোখে পড়ছে না আমি যে বুড়ো হয়ে যাচ্ছি?”
অয়ন্তি জাহিনের মাথার চুল গুলা এলোমেলো করে দিয়ে বলল, “একদমেই না। আপনি আমার চোখে একজন সুদর্শন পুরুষ মানুষ।”
জাহিন অয়ন্তির নাকের সাথে নাক ছুঁয়ে মোহনীয় গলায় বলল, “তাহলে তোমার চোখে দেখা এই সুর্দশন পুরুষ মানুষটির ইচ্ছেটা পূরণ করো।”
বলেই জাহিন অয়ন্তিকে বেডে শুইয়ে দেয়। অয়ন্তি খামচে ধরল জাহিনের টি-শার্ট। জাহিন অয়ন্তির কপালে সশব্দে গভীর এক চুম্বন বসায়। পরপর চোখের পাতায়, দু গালে, চিবুকে। জাহিন মুখ ডুবিয়ে দেয় অয়ন্তি গালার ভাঁজে একে একে ভালোবাসার গভীর ছোঁয়া বয়ে যাচ্ছে অয়ন্তির গলা জুড়ে। জাহিনের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি অয়ন্তির নরম দেহে স্পর্শ করলে অয়ন্তি মৃদু আওয়াজ করলো। মুখ তুলে তাকায় জাহিন চোখে ভেসে উঠে প্রিয়তমার রক্তিম মুখখানা। জাহিন মুচকি হেসে এগিয়ে যায় অয়ন্তির অধর জোড়ার দিকে। অয়ন্তির এক হাত জাহিনের পিঠে আরেক হাত দিয়ে জাহিনের চুল খামচে ধরল। সময়ের পাল্লার সাথে জাহিনের অবাধ্য হাতের বিচরণ বইতে শুধু করলো নিজের একান্ত প্রিয় নারীটির দেহে। নারীটিও তার প্রিয় মানুষটির গভীর পুরুষালি আদরে ভরা হাতের পরশ পেয়ে ক্ষণে ক্ষণে নিজের সমস্ত কায়া কেঁপে উঠছে। দুটো মানব মানবী এক মাদকতায় ভরা জোয়ারে ভেসে চলছে রাতের গভীর মাত্রায়।
#চলবে