দো_দিলে_জাহান #পর্বঃ১৬ #বর্ষা

0
166

#দো_দিলে_জাহান
#পর্বঃ১৬
#বর্ষা
৫১.
-“ম্যাম আপনি তো শুধু ট্রাক দুর্ঘটনার কথা বললেন।তবে স্যারের যে গুলি লেগেছে তার বিষয়ে?”

জুনিয়র অফিসার নোমানের কথায় মেহের অতীতে ফিরে যায়।তীব্র একদিন যাবৎ কোমায় আছে।তার ভিতরটা মনে হয় ছিঁড়ে যাচ্ছে তবুও মেহের নিজেকে সামলে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে।

সেদিন রাতে এম্বুলেন্স আসার আগে গোলাগুলি শুরু হয়েছিলো।আদৌ আদৌ জ্ঞান থাকা অবস্থাতেও তীব্র নিজের সর্বস্ব দিয়ে মেহেরকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। এম্বুলেন্সের শব্দে যদিও ওরা পালিয়ে গেছে তবে মেহের ওদের গাড়ির নাম্বার নোট করে রেখেছে তার মস্তিষ্কে।মেহেরের রাগ লাগছে নিজের ওপর।কেন সে ওই মাঝরাত্তিরে বের হয়ে এসেছিলো।যদি এমন না করতো তাহলে তার তীব্র আজ সুস্থ থাকতো।তার সাথে খুনসুটি করতো!

নোমানকে আর কিছু না বলে ওই কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে মেহের। রেদওয়ান বাড়ির আরো কয়েকজনকে ডাকা হয় ইন্টারোগেশনের জন্য।সারিমকে কোথাও দেখছে না মেহের।আজ সে সারিমকে দেখেনি।ফোন লাগালে কল যায় না।মেহেরের চিন্তা হয়। দুইভাই তো জনগণের হিতে কাজ করতো। অজান্তেই টাইকুন সাম্রাজ্যে জড়িয়ে ছিলো।তীব্রর পর যদি সারিমকে….?

মেহের দ্রুত ছুটে যায় নোমানের কাছে।তখন সে কিছু ভাবছিলো।রুমটা ফাঁকা ছিলো।হয়তো পরবর্তী জন এখনো আসেনি।মেহের আদেশের স্বরে বলে ওঠে,

-“নোমান দ্রুত সারিমের ফোনের লোকেশন ট্রেস করো।”

৫২.
সারিম রাগান্বিত হয়ে বন্দুক হাতে বাগান বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। আংকেল ক্যানিয়নের অবস্থান এখানেই।সারিম বন্দুকের গুলি শেষ করে ফেলেছে গেটের আশেপাশে থাকা গার্ডদের মারতে গিয়ে।নিচে মরে পড়ে থাকা গার্ডের বন্দুক উঠিয়ে নেয় সে।

-“আংকেল ক্যানিয়ন দরজা খুলুন।কেন করেছেন আপনি এরকম? সবকিছুর উত্তর চাই আমার। আংকেল ক্যানিয়ন”

কেউ আওয়াজ দেয় না।দরজায় জোরে এক লাথি দিতেই দরজা খুলে যায়। পঁচা গন্ধ ভেসে আসতে থাকে।কেমন বিদঘুটে গন্ধ।হয়তো কোনো লাশের গন্ধ।তখনই পুলিশের গাড়ির আওয়াজ হয়।সারিম বুঝে যায় ওকে ফোন দিয়ে সব বলা ছিলো আংকেল ক্যানিয়নের বিশাল ফাঁদ।তবে এখন কি করবে কিছুই বুঝতে পারেনা সে।

-“সারিম কিছু স্পর্শ না করে এখান দিয়ে আসো।দ্রুত”

মেহেরকে দেখে কোনো কিছুর বাছবিচার না করেই সারিম ছুটে যায় সেদিকে। ইতিমধ্যে সিসিটিভির রেকর্ডিং বক্স সে তার সাথে নিয়ে নিয়েছে।আর আগুন লাগিয়ে একটা কাপড় ভেতরে ছুড়ে মারতেই ফায়ার এর্লাম বেজে পানি ঝড়তে শুরু করেছে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট থাকলেও তা মিশে যাবে।

৫৩.
সারিম অবাক হয়ে মেহেরের কথা শুনছে।তার ঘৃণা হচ্ছে নিজের প্রতি, নিজের কাজের প্রতি। পৃথিবীতে সত্যিই প্রকৃত মানুষ চেনা দায়। আংকেল ক্যানিয়ন যাকে ওরা মনপ্রাণ উজার করে বিশ্বাস করেছিলো।সেই নাকি চোরাচালান,ড্রাগস ডিলিং, হিউম্যান ট্রাফিকিংয়ের সাথে জড়িত।

-“মেহের তুই জানলি কি করে আমি এখানে?”(সারিম)
-“আমি এখানে এর আগেও দুইবার এসেছিলাম কেস তদন্তে।তবে অনেক আগে। কিন্তু যখন তোমার নাম্বারের লাস্ট লোকেশন এখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে দেখলাম। তখনই বুঝে গিয়েছিলাম তুমি এখানেই থাকবে।”(মেহের)
-“মেহের আংকেল ক্যানিয়ন কেন এরকম করছে?”(সারিম)
-“আংকেল ক্যানিয়ন? এখনো তাকে সম্মান দিচ্ছো।আমি থাকলে খুন করতাম।তবে আমার হাত বাঁধা।তাইতো তোমাদের বাচাচ্ছি।আগে আসল অপরাধী ধরা পড়বে তারপর তোমাদের শাস্তি হবে”(মেহের)
-“আমাদের শাস্তি?”(সারিম)
-“হুম তোমাদের শাস্তি।যেমনেই হোক হিউম্যান কিলিং এর সাথে তোমরাও জড়িত।তবে আমি এই কেস সলভের ক্রেডিট তোমাদের দুই ভাইয়ের ওপর দিবো যাতে তোমাদের অল্প দিনের শাস্তি হয়”(মেহের)
-“ঠিকই বলেছিস আমাদেরও শাস্তি পেতে হবে।শাস্তি না পেলে বুঝবো কি করে যে মানুষ বিশ্বাসের অযোগ্য “(সারিম)
-“সারিম মানুষ বিশ্বাসের অযোগ্য নয়। বরং তোমরা অযোগ্য কাউকে বিশ্বাস করেছো”(মেহের)

সারিম,মেহের চুপ থাকে। হাঁটা পায়েই এখান থেকে বের হতে হবে ওদের। জঙ্গলের পিছন সাইড দিয়েই একটা রাস্তা গিয়ে বড় রাস্তায় উঠেছে।মিনিট ত্রিশের মতো হাঁটা পথে হাঁটছে ওরা। আকাশে এতো রোদ তবে জঙ্গলের মাঝে যেন অন্ধকার।দুইজনই নিস্তব্ধ। হঠাৎ সারিমের মস্তিষ্কে প্রশ্নরা খেলতে শুরু করে।

-“তীব্র ভাইকে বিয়ে করার কারণ কি ক্যানিয়ন?”(সারিম)

মেহেরের হাঁটা থেমে যায়।পিছু ফিরে তাকায়। কাঁধের ব্যাগ কিছুটা ভারী।এই নিয়েই হাঁটছে। আর এই ছেলে ওকে প্রশ্ন করে এখন বিরক্ত করছে।মেহের উত্তর দেয়,

-“হুম..তবে তীব্র আমার ভালোবাসার মানুষ”

সারিম অবাক হয়।নির্ভীক হয়ে অকপটে কি করে নিজের ভালোবাসার কথা বলে দিলো এই মেয়ে!সারিমের ভয় হয় আদৌ তীব্র ভাইয়ের জ্ঞান ফিরবে তো! তীব্র কি আবার আগের মতো হতে পারবে।আর জারিন?জারিন সব জেনেও কি ওকে ভালোবাসবে!নাকি হারিয়ে যাবে অন্য কারো হয়ে।সারিমের হাত-পা কাঁপতে থাকে। হাঁটা শক্তির মনে হয় হ্রাস পেতে থাকে।

-“মেহের…”(সারিম)

সারিম বসে পড়ে।মেহের দ্রুত পিছিয়ে দেখে কি হয়েছে।ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে পানি খাওয়ায় ওকে।বসিয়ে রেখে পিঠে হাত বুলাতে থাকে। মিনিট পাঁচেক পর কিছুটা সুস্থ হয় সারিম। হেঁটে যেতে পারবে বলে জানায়।বাগান পেড়িয়ে বড় রাস্তার মোর থেকে বাসে উঠে পড়ে দু’জন।সারিমকে জানালার পাশে বসিয়ে সুইয়ে দেয় সে।

৫৪.
চারদিন অতিক্রান্ত।সব যেন স্বাভাবিক হয়েও স্বাভাবিক হয়নি।তীব্র?তার জ্ঞান ফিরেছে তবে একদম আলাদা মানুষ হয়ে।মধ্যকার দশ বছরের স্মৃতি তার মস্তিষ্কে নেই। অর্থাৎ সে ঊনিশ বছর বয়সী তরুণ মস্তিষ্কে আছে এখন।মেহেরের হাত ধরে ঘুরছে।বলছে ওকে স্কুলে দিয়ে আসবে।ওকে খাইয়ে দিবে।আর কখনো বিদেশ যাবে না।

মিসেস মিথিলা রেদওয়ান চোখের জল ফেলছেন ছেলের বাচ্চামো দেখে।ওনার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।মাথায় আঘাতের কারণেই মূলত এমন হওয়া।আদৌতে কখনো ওর স্মৃতি ফিরবে কিনা ডক্টররা সিওর না।মেহের যেন কাঁদতে কাঁদতেও হেসেছে আজ সকালে।হাসবে নাই বা কেন?আজ চারদিন পর যে কোমা থেকে জেগে উঠেছে ওর ভালোবাসার মানুষ।না থাকুক স্মৃতি,না থাকুক কবুল বলে নেওয়া দায়িত্বের কথা স্মরণ তবুও তো ভালোবাসি,ভালোবাসি বলছে।জেগেই তো মেহেরকে খুঁজেছে।হাত জড়িয়ে থেকেছে।বলেছে মেহের তুমি কেন বড় হয়ে গেলে এই দুই বছরে।আমার তো আমার আগের মেহেরই চাই।সতেরোতে দেশ ছাড়া তরুণ এখন ঊনিশে পা দিয়ে এখানে এমনটাই তীব্রর ধারণা।

সারিমকে ভালো মতো বুঝিয়ে বলেছে যাতে তীব্রর সামনে কখনো আংকেল ক্যানিয়নের নাম না নেয় ও। কেননা যদি ওর সব মনে পড়ে তাহলে হয়তো ও পরিবারের সবাইকে চিনবে,ভালোবাসবে।তবে ভেতর থেকে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।একদম শেষ হয়ে যাবে।

-“পুতুল বউ তুই কতো বড় হয়ে গেছিস।আমায় এখন খাইয়ে দিচ্ছিস।আচ্ছা চলনা আমরা বিয়ে করে নেই।তারপর একসাথে থাকবো।তুই আমায় প্রতিদিন খাইয়ে দিবি,গল্প করবি।”

বিছানায় শুয়ে শুয়ে খাবার খাচ্ছে আর কথা বলছে তীব্র।তরুণ মস্তিষ্কের কথা শুনে যেমন ওর হাসি পাচ্ছে তেমনি প্রচন্ড কান্নাও পাচ্ছে। শুধু আফসোস হচ্ছে কেন যে সে সেদিন বেড়িয়ে আসলো!সে কখনোই ওই বাড়ি ফিরবে না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো।তারপর ভাবলো আমি না গেলে ওই নূরিয়া দাদার কান আরো ভাঙাবে।সে যাবে।

৫৫.
আংকেল ক্যানিয়ন চিন্তায় যদিও ছিলেন তবে এখন চিন্তামুক্ত। চিকিৎসকের সাথে কথা বলে জেনেছেন তীব্রর স্মৃতি ফেরার সম্ভাবনা ষাট শতাংশ।যতোই হোক বিপরীত পক্ষ।তবুও তো দশটা বছর যাবৎ ওনার হয়ে কাজ করেছে।ভালোবাসায় মুড়ে রেখেছে।তাই হয়তো আর মারার চেষ্টা করবেন না।হয়তো।

মানুষ মায়ায় আটকে যায়।একবার ছিন্নভিন্ন করতে না পারলে দ্বিতীয় চেষ্টা করে না।ক্যানিয়নও তেমনি।এই ছেলের ওপর নির্ভর করে নাম কামিয়েছেন তিনি।নয়তো কেউ কি আদৌতে তাকে চিনতো!হয়তো আবার হয়তো না।

-“তীব্র আই লাই ইউর এটিটিউড।বাট তুমি আমার জন্য রিস্ক।তাই তোমার স্মৃতি না ফেরাই মঙ্গল জনক।আর সারিম?ও কোথায়!”

আংকেল ক্যানিয়ন সারিমের কোনো খোঁজ পাননি।এই ছেলেকে ধরার জন্য ওইদিন নিজের কেনা পুলিশ অফিসারদের পাঠিয়েছিলেন তিনি।তবে সেখানে নাকি ফায়ার এর্লামের কারণে কোনো প্রমাণই মেলেনি।একটা বন্দুক পাওয়া গিয়েছিলো।যাও কেউ চুরি করে নিয়েছে।

ফোন বেজে ওঠায় রিসিভ করে সে।তূর্যয় ফোন করেছে।এই ছেলে বুদ্ধির দিকে কম হলেও কাজের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে।রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে এইটাই তো এই পেশার মানুষের প্রয়োজন।তূর্যয় বলে ওঠে,
-“আংকেল সারিম যেন লাপাত্তা হয়ে গেছে কোথাও।আমি আজ তীব্রকে দেখতে ও বাড়ি গিয়েছিলাম। কিন্তু সারিমের খোঁজ পাইনি।”

-“মিস হাইডের খোঁজ করো।আমি নিশ্চিত উনি কিছু হলেও জানবে।আর মেহের?মেহেরকে উড়িয়ে দেও।আমার বিষয়ে জেনে গেছে”(ক্যানিয়ন)

-“কিন্তু ও তো বাড়ি থেকে বেরই হয়না। তাহলে?”(তূর্যয়)

-“পুরো বাড়িই উড়িয়ে দেও”(ক্যানিয়ন)

তূর্যয়ের চোখ বড় বড় হয়ে যায়।যেমনই হোক বোন তো ওকে মারবে কি করে!আর কোনো বোম ব্লাস্ট করাও তো যাবে না। কেননা আতংকবাদী হামলা হলেও নিরিবিলি ভবনগুলোর এখানে হবে নাকি!আর চোর/ডাকাত ওরা এলে তো খুন করবে। কিন্তু এতোজনকে এক এক করে মারতে গেলেই তো ধরা পরে যেতে হবে!তাহলে কি করবে সে?

চলবে কি?

বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া-আপুরা। ভুল-ত্রুটিগুলো মার্জনার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকবো।হ্যাপি রিডিং

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here