দো_দিলে_জাহান #পর্বঃ১১ #বর্ষা

0
179

#দো_দিলে_জাহান
#পর্বঃ১১
#বর্ষা
৩৪.
রাত আটটার দিকে শপিং শেষে বাড়ি ফিরেছে মাহিনরা।সবাই বড্ড ক্লান্ত। শপিং শেষে ঘোরাঘুরি, খাওয়া দাওয়া তারপর না বাড়ি ফেরা।মাহিন-মোয়াজ আলাদা আলাদা ভাবে বোনের জন্য কিনেছে।বিশ্রাম নিয়েই বোনের ঘরে যাবে সেই সিদ্ধান্তে দুইজন নিজেদের ঘরে গিয়েছে।
রাত দশটার দিকে খাবার টেবিলে সবাই একত্রিত হয়েছে।মাহিন এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।মোয়াজ এখনো আসেনি।আর জায়িন সে তো আবার বেড়িয়েছিলো এখনো ফেরেনি।মাহিন আস্তে করে রাবেয়া বেগমকে জিজ্ঞেস করে,
-“আম্মু মেহের কোথায়?”
-“রুমেই তো সেই সকাল থেকে আছে।দুপুরেও তো খেতে এলো না।”(রাবেয়া বেগম)
-“কি বলছো তুমি আম্মু?ওতো অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে কিংবা ওর সাথে কিছু তো হতে পারে”(মাহিন)
-“মাহিন আগে খাবার খেয়ে নে।মেহেরের কিচ্ছু হয়নি তোর আব্বু ওর সাথে কথা বলেছে”(রাবেয়া বেগম)
-“কিন্তু আম্মু…”(মাহিন)
-“কোনো কিন্তু না। খেতে বস”(রাবেয়া বেগম)

মাহিন বসে রয়।মহাসিন তালুকদার ছেলের সাথে তার হসপিটাল নিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা করেন। ছেলের ওপর তার ভরসা আছে যে এই ছেলেই একদিন ওর বায়োলজিক্যাল বাবা-মায়ের হসপিটাল দেশসেরা পর্যায়ে পৌঁছে দেবে। দায়িত্ববোধ বড্ড বেশি এই ছেলের। পূর্ববর্তী বছর ছেলেটার মাঝে বিস্তার ফারাক আসলেও নিজের কর্তব্য থেকে সরে আসেনি।

-“আব্বু আমি ভাবছিলাম কি আমাদের উচিত ক্যাম্প করা।দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো অনেক মানুষ চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না।আমরা চাইলে ওনাদের সাহায্য করতে পারি ফান্ডের টাকা থেকে।”(মাহিন)
-“গুড আইডিয়া মাহিন।তুমি কাজে লেগে যাও।আর ফান্ডে শর্ট পড়লে জাস্ট আমায় জানাবা।”(মহাসিন)
-“দাদাকে জানাতে হবে না?”(মাহিন)
-“ওইটা তোমার হসপিটাল ছেলে।ওখানে তোমার যা করার করবা তা নিয়ে আবার দাদা জানানোর কি আছে”(মহাসিন)

দুইজন চুপ হয়ে যায়।খেতে থাকেন। মহাসিন তালুকদার খুব ভালো করেই জানেন ওনার বাবাকে যদি এই বিষয়ে জানানো হয় তবে এককথায় না বলতে তিনি প্রস্তুত আছেন।এর চেয়ে ওনাকে না জানানোই উত্তম।আর ছেলের বায়োলজিক্যাল বাবা-মায়ের হসপিটাল ওইটা সেখানে উনি মতামত দিতে পারেন তবে রুখতে পারবেন না।

-“আব্বু,আম্মু মেহের কোথায়?”

মোয়াজের চিৎকার চেঁচামেচিতে বিরক্ত হোন মহাসিন তালুকদার।এই ছেলেটা যে ওনার এইটা ওনার বিশ্বাস হতে চায়না।সবসময় চিৎকার চেঁচামেচি করতেই থাকে।কার মতো অভ্যাস পেয়েছে আল্লাহ জানে।আর মেহেরের কথা জিজ্ঞেস করছে কেন?জেনে গেছে কি মেহের ঘরে নেই!মোয়াজকে কাম ডাউন করতে তৃষ্ণা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। মোবারক তালুকদার ঘুমাচ্ছেন ঘুমের ঔষধ খেয়ে।তাও মিনিট বিশেক হবে।

-“মোয়াজ শান্ত হও।চিৎকার চেঁচামেচি করছো কেন?”(তৃষ্ণা)
-“তৃষ্ণা তুমি সরো।আপাতত আমাকে আমার বোন সম্পর্কে জানতে দেও”(মোয়াজ)
-“মোয়াজ চিৎকার চেঁচামেচি করিস না।আম্মু তো বললো বনু ঘরে আছে”(মাহিন)
-“বড়দা ভাই তোমাকে মিথ্যে বলেছে আম্মু।মেহের ঘরে নেই।এমনকি পুরো বাড়িতেই ও নেই”(মোয়াজ)
-“হোয়াট”(মাহিন)

খাবার টেবিল ছেড়ে দাঁড়িয়ে যায় মাহিন।ফোন দিতে থাকে বোনকে।নট রিচেবল বলছে। মুহুর্তেই মাথা বিগড়ে যায় দুই ভাইয়ের।টানা ফোন দেওয়া সাথে পুরো ড্রয়িংরুম পায়চারি করা তো আছেই।মহাসিন তালুকদার চিন্তিত হতে চেয়েও পারেন না।তিনি জানেন মেয়ের প্রফেশন। শারীরিক ভাবে ফিট এবং মানসিক ভাবে প্রচন্ড বুদ্ধিমতী হওয়ায় আঠারোতেই স্পেশাল ইউনিটে মেয়ে যে চান্স পেয়েছে এই সুখবর পেয়েছিলেন তিনি।তবে তার কথাতেই এই কথা গোপন রাখে মেহের।মেয়ে যে বিগত দুই বছরের অনেক তরক্কি করেছে এটাও ওনার অজানা নয়। সারা দুনিয়ার কাছেই গোপনীয় এই বিষয়।তবে আজ হয়তো খুলাসা করতেই হবে ওনার।

৩৫.
ভোর হয়েছে অনেকক্ষণ।সূর্য মামা তার তেজস্ক্রিয়তা আজ ছড়াতে পারেনি।মেঘেরা পুরো আকাশে রাজস্ব করেছে।জঙ্গলের মাঝে একটা খালের পাশে বসে আছে মেহের।তার পাশেই দাড়িয়ে আছে তীব্র। মেহের যে স্পেশাল ইউনিটের সদস্য তা শুনে স্থির হয়ে গেছে তীব্র।কি বলবে এখন ও মেহের কে?সে তো চাইলেই বলতে পারেনা যে সে কে!সে তো স্বীকার করতে পারেনা সে কে!আসলে সে এখন পুরোপুরি অক্ষম।সে না পারবে স্বীকার করে নিজেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে হস্তান্তরিত হতে আর না পারবে প্রেয়সীকে মিথ্যে বলতে।

-“পুরো বারো ঘন্টা হয়ে গেলো তীব্র। তুমি আমায় জবাব দিলে না।কে তুমি? টাইকুনের বস কে?”(মেহের)

মেহেরের কথা শুনে না শোনার ভান করে তীব্র।সে পারবে না প্রেয়সীকে মিথ্যে বলতে।এর চেয়ে চুপ থাকা উত্তম তার কাছে। মেহের বার কয়েক একই প্রশ্ন করে।তবে তীব্র উত্তর দেয়না।স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে খালের দিকে।

-“তীব্র আই নিড মাই আনসার্স”(মেহের)
-“মেহের বাড়ি যা।বারো ঘন্টা পেরিয়েছে তুই আমার সাথে।সবাই চিন্তা করবে বাড়ি যা”(তীব্র)
-“আমাকে এড়িয়ে যেতে পারো না তুমি তীব্র।আমার উত্তর চাই মানে চাই।”(মেহের)

মেহের দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে তীব্র।বলে ওঠে,
-“উত্তর আমি দিবো না।কি করবি তুই?বল কি করবি?”
-“তীব্র আমায় ছাড়ো।আমার লাগছে।”(মেহের)
-“যদি না ছাড়ি?তোকে আমি ছাড়তে চাই না।মেহের তুই আমার সম্পর্কে জানতে চাস না।ফিরে যা।”(তীব্র)
-“কেন তুমি পালিয়ে বেড়াচ্ছো তীব্র?তুমি কি অন্যায়ের সাথে জড়িত?”(মেহের)
-“তুই আইনের লোক।তোর কাছে আইনেতে যা অন্যায় তা অন্যায়।তবে কাগজে কলমের সনদ ছাড়াও জীবনটা আরো বৃহৎ।সেখানে আমার কাজ একদম সঠিক।”(তীব্র)
-“তুমি টাইকুনের সদস্য তাই না?নাবিনের খাৎমাতেও তোমার হাত আছে তাইনা?”(মেহের)
-“কি করবি এতো সব জেনে?প্রমাণ তো কিছুই নেই।না পারবি গ্রেফতার করতে।শুধু শুধু আনসলভড কেসের বোঝা মাথায় নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরতে চাস কেন?”(তীব্র)

নিরবতা ঘিরে ধরে দু’জনকে।অনেক প্রশ্ন করার থাকলেও আর একটা প্রশ্নও করেনা মেহের।তীব্র ওকে বুঝতে পারেনি।না বোঝাই ভালো।মেহের তো টাইকুনের লোকদের সাথে আলোচনা করতে চেয়েছিলো।পরিচিতো হতে চেয়েছিলো।আর সবচেয়ে বড় কথা ……!তবে তীব্র ওর কথা তো শুনলোই না।বুঝবে কি করে!

-“তীব্র আমি জানি তুমি টাইকুনের সদস্যদের কাউকে না কাউকে চেনো।এমনও হতে পারে তুমি টাইকুনের সদস্য।আমি আংকেল ক্যানিয়নের সাথে দেখা করতে চাই।”(মেহের)

আংকেলের নাম মেহেরের মুখে শুনে তীব্রের বুঝতে বাকি নেই ডিআইজি থেকে নিয়োগ প্রাপ্ত নতুন ইনভেস্টিগেশন অফিসার মিস.হাইড মেহের।তবে এতো অল্প বয়সে কিভাবে কি কিছুই বোঝে না সে।বোঝার ইচ্ছে করে বটে তবে কিছু জানতে চায় না সে।জানতে চাইলেই হয়তো উত্তর চাইবে। তারচেয়ে নিজ থেকে ভেবে নেওয়াকে উত্তম ভাবে সে।

৩৬.
সকাল যদিও এখন বলা যায় না তবে দুপুর বলা যায়।এগারোটা চল্লিশ বাজে।কাজী অফিস থেকে তীব্র-মেহের মাত্রই বেড়িয়েছে।আজ থেকে দুজনে দুজনার নামে লিখিত হয়েছে।জড়িত হয়েছে অদৃশ্য এক শক্ত বন্ধনে।মেহেরের এখনো মনে পড়ছে তীব্রের দেওয়া শর্তের কথা।তীব্র আংকেল ক্যানিয়নের সাথে কথা বলিয়ে দিতে রাজি হলেও সাথে জুড়ে দিয়েছিলো শর্ত। তার হয়তো মেহেরের প্রতি সন্দেহ ছিলো যে হয়তো আংকেলের লোকেশন ট্রেস করে তাকে ধরে তীব্রকেও ছাড়বে না মেহের।তাইতো শর্ত দিয়ে বসলো,
“মেহের চল বিয়ে করে নেই।তারপর চাইলে তুই আমার সব সত্য জানতে পারিস।দেখা করতে পারিস আংকেল ক্যানিয়নের সাথে।তবে জোর নেই।তোর ইচ্ছা”

মেহেরের সামনে মাহিন আর মোয়াজ দাঁড়িয়ে। ভাইদের ওই ডেকে এনেছে। মহাসিন তালুকদার ছেলেদের সামনে উদ্ঘাটন করেননি যে ওদের বোনের আরো একটা অস্তিত্ব আছে।সারারাত চিন্তায় চিন্তায় আর মহাসিন তালুকদারের মিথ্যে গল্পকে সত্যি ভেবে পার করেছে ওরা।সকাল সকাল মেহেরের ফোনে এখানে ছুটে এসেছে প্রায় দুই ঘন্টা।মাহিন-মোয়াজ যদিও অবাক হয়েছে ওদের হুটহাট বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ায়।তবে তূর্যয়ের সাথে ধুমধাম করে বিয়ের দিন যে ফারা গেলো তা মনে করতেই দুই ভাই কোন কথা না বলেই সাক্ষী দিয়ে বোনকে তুলে দিয়েছে তীব্রর হাতে।

তালুকদার বাড়িতে যাওয়ার পালা এবার।তীব্র-মেহেরের কথা হয়নি বিয়ের পর থেকে আর।একদম সাদামাটাভাবে কালকের পোশাকেই দুজনার বিয়ে হয়ে গেলো।না ছিলো লাল বেনারসি,না ছিলো বিয়ের খাবার।একদম পালিয়ে বিয়ে যাকে বলে তেমন ছিলো।

-“হুটহাট এই বিয়ের মানে কি?আমগো কইলে কি আমরা তুমগো বিয়া দিতাম না নাকি?দেখছোস মহাসিন আমি তোরে বলছিলাম মাইয়া শাসনে রাখ নয়তো পোলা নিয়া পালাইয়া বিয়া করবো।দেখছোস আমগো মান আর রাখলো না।তা পোলা কোনখানের কোন বান্দা আমারেও দেখাও”(মোবারক তালুকদার)

মেহের-তীব্র আলাদা গাড়িতে থাকায় এখনো এসে পৌঁছায়নি। তালুকদার বাড়িতে ইতিমধ্যে যা ঝড় ওঠার উঠে গেছে।এখন ঝড়টা বহমান থাকবে কিছুক্ষণ এই যা।মেহের তীব্রের উপস্থিতিতে কি হবে আল্লাহ ভালো জানে। মোবারক তালুকদারের খুশি হবারই কথা কেননা তীব্র তো আবার ওনার বন্ধুর নাতি।বন্ধুর নাতির সাথে নাতনির বিয়ে মন্দ না।

৩৭.
সারিম হা করে তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে। ইতিমধ্যে ওর পিঠে চার ঘা পড়েছে।মেহের নিজেই মেরেছে।ছোটবেলার বন্ধু,স্কুল-কলেজ জীবনের সিনিয়র ভাই,তীব্রর চাচাতো ছোটভাই সারিম।জারিন তো খুশি বান্ধুবীর বিয়ে তাও আবার সারিমের চাচাতো ভাইয়ের সাথে। দুই বান্ধবী জা হবে কি যে আনন্দ তার!

-“দোস্ত বলে বোঝাতে পারবো না আজ আমি দুইটা ভালো কাজ করলাম।প্রথমত তোর আর সারিমের দেখা করালাম।আর দ্বিতীয়ত আমি বাসায় সারিমের কথা বলে দিছি।”(জারিন)
-“ভাই এই তারছিড়া তোর সেই সারিম জানলে আমি তোরে আগেই না করতাম।এই বলদে তো নিজের হেফাজত নিজে করতে পারেনা তোরটা করবো কেমনে?”(মেহের)
-“বউজান তুমি আমার ভাইকে নিয়ে এভাবে বলো না।তোমার ছোট্ট দেবর বলে কথা।দুষ্টামি করার অনেক জায়গা পাইবা তাই বলে “(তীব্র)

কাশি উঠে যায় মেহেরের।তীব্রের আকস্মিক এমন আচরণ ওর সহ্য হচ্ছে না।তবে যেই কাজের জন্য এই সম্পর্কে জড়ানো সেই কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব তো তারই। তবে এর জন্য তো আর তার আশেপাশের মানুষদের জীবন অস্বাভাবিক হতে দিতে পারেনা সে।তাইতো স্বাভাবিক আচরণ।তবে সারিমের এতোটা নিশ্চুপ্পিতা ওকে ভাবাচ্ছে।মেহের মনে মনে ভাবছে,

-“তীব্রর আকস্মিক এতো পরিবর্তন আর এতোদিন সারিমের আমার থেকে পালিয়ে পালিয়ে থাকার পেছনে কি কোনো যোগসূত্র আছে?আর থাকলেই বা কি হতে পারে? আংকেল ক্যানিয়ন!”

চলবে কি?

বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া-আপুরা। ভুল ত্রুটিগুলো মার্জনার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকবো।অগ্রিম ধন্যবাদ এবং হ্যাপি রিডিং

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here