#দো_দিলে_জাহান
#পর্বঃ১৩
#বর্ষা
৪১.
ঈদের শুরুটা বাড়ির নারীদের সেই কাজ দিয়েই শুরু হয়েছে।সেমাই, পুডিং,নুডলস্,রোল আরো বিভিন্ন পদ তৈরির মাধ্যমেই ঈদকে ছোটদের জন্য উৎযাপন মুখর করে তুলেছে।বাড়ির কর্তী দু’জন এখনো সাজগোজ না করে রান্নাবান্নাতেই ব্যস্ত।বাড়ির পুরুষেরা হালকা পাতলা খেয়ে নামাজে গিয়েছে।ফিরে আসবে হয়তো কিছুক্ষণের মাঝেই।
মেহের বিরক্ত। প্রচন্ড বিরক্ত।তীব্র কালো বাদামির মিশ্রণে পাঞ্জাবি পড়েছে।তবে ওর কাছে কালো রঙের কোনো গাউন কিংবা থ্রী পিস নেই।ওয়ান পিস আছে তবে তার তো আবার ওরনা নেই।কি একটা ঝামেলা!এইবার ঈদে সে কিনে গাঢ় বেগুনি রঙের থ্রী পিস।একদেখায় ভালো লেগে যাওয়ায় কিনে নেওয়া।তখন তো আর সে বিয়ে নিয়ে কোনো ভাবনাই রাখেনি যে কাপল ড্রেস কিনবে।
-“ছুটকি?”
ছোটদা ভাইয়ের ডাক শুনে ছুটে গিয়ে দরজা খোলে মেহের।তবে মুখটা গোমড়া মুখো করে রেখেছে সে।বোনের মুখ দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ে মোয়াজ।বোনকে আদুরে গলায় বলে ওঠে,
-“আমার ছুটকির কি হয়েছে?ছুটকি কি ভাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাবে না?এখনো প্রস্তুত হয়নি কেন?”
-“আসসালামু আলাইকুম ছোটদা ভাই।ঈদ মোবারক “(মেহের)
-“এভাবে বললে হবে না তো।এই নে এই ব্যাগে আমার কেনা একটা জামা আছে।তোর জামাইয়ের সাথে অবশ্য ম্যাচিং হবে না।বিকেলে পড়িস।ছোটদা ভাইয়ের সাথে ম্যাচিং আছে”(মোয়াজ)
-“সত্যি ছোটদা ভাই!”(মেহের)
-“হুম।যা দ্রুত রেডি হয়ে আয়।নয়তো সালামি ক্যান্সেল”(মোয়াজ)
মোয়াজ চলে যেতেই মেহের দরজা লাগাতে নেবে।ওমনি ডাক শোনে মাহিনের।এই তিনদিন যাবৎ দুইভাই যদিও বোনের জন্য আনা গিফট দিতে চেয়েছিলো তবে দিতে পারেনি ব্যস্ততায়।ঈদের আগে ব্যস্ততা যেন বেড়ে যায় বহুগুণ।মাহিন তো এই সকালে বাড়ি ফিরলো অফিস শেষে।রাতে মেহেদী অনুষ্ঠান রেখেই বেচারাকে হসপিটালে ছুটতে হয়েছিলো।
-“বনু তৈরি হোসনি কেন এখনো?”(মাহিন)
-“বড়দা ভাই আসসালামু আলাইকুম।ঈদ মোবারক।সালামি দেও”(মেহের)
-“ওয়ালাইকুমুস সালাম বনু।ঈদ মোবারক।তবে সালামি এখন না।যা বড়দা ভাইয়ের দেওয়া এই থ্রী পিসটা পড়ে আয়তো একটু দেখি তোকে। তুই না বলেছিলি তোর কালো কোনো জামা নেই।এইবার আমি নিয়ে এসেছি”(মাহিন)
-“থ্যাংকস বড়দা ভাই।তুমি জানো না আমি কতটা খুশি হয়েছি।লাভ ইউ বড়দা ভাই। তুমি থাকো আমি এই যাবো আর আসবো”(মেহের)
-“আমি নিচে যাচ্ছি। তুই দ্রুত তৈরি হয়ে আয়”(মাহিন)
-“ওকে বড়দা ভাই “(মেহের)
খুশি খুশি মনে মেহের ওয়াশ রুমে প্রস্তুত হতে চলে যায়।গোসল করে হেয়ার ড্রায়ারে চুল শুকিয়ে বের হয় ও।ড্রেসিং রুম ওয়াশ রুমের ভেতরেই।একটা আলাদা কিক আছে ওর রুমের। একজন প্রিন্সেসের রুম থেকে কম না। অবশ্য বাড়ির অধিকাংশ রুমই এমন। শুধু গেস্ট রুমগুলো বাদে।
মেহেরকে বের হতে দেখে তীব্র বিছানায় শুয়ে চোখ টিপ মারে ওকে।তবে মেহের শুকনা চুল দেখে আফসোসের স্বরে বলে ওঠে,
-“মুভিতে দেখছি স্ত্রীর স্বামীর মন জয় করে ভেজা চুলে।আর তুমি শুকনা চুলে ঘুরছে”
-“মুভি আর বাস্তব জীবনে বিস্তার ফারাক তীব্র”(মেহের)
মেহের কি ভেবে যেন আবারো ওয়াশরুমে ঢুকে যায়।মিনিট পাঁচেক বাদে বেড়িয়ে আসে। সুন্দর করে হিজাব করে নিয়েছে।কালো থ্রী পিস হলেও গোল্ডেন কালারের জুরি বসানো তাতে।তাই হালকা গোল্ডেন কালারের হিজাব পড়েছে সে।
-“মাশাআল্লাহ বউজান।এখন তোমায় একদম তীব্রর লাগছে।ওয়েট অ্যা মিনিট আমাদের ম্যাচিং হয়ে গেছে।ও মাই আল্লাহ”(তীব্র)
হালকা হাসে মেহের।তবে তা তীব্রর চোখ এড়িয়ে যায় না কিন্তু।সেও আড়ালে হাসে।তার বউ খুশি তো সেও খুশি।তবে আংকেল ক্যানিয়নের সাথে কি কথা হয়েছে মেহেরের তা জানতে চায় ও।তবে জিজ্ঞেস করবে কি করবে না ভেবে আর জিজ্ঞেস করা হয়নি ওর।কালকে তীব্রর বাবা-মা বাংলাদেশে ল্যান্ড করেছে মধ্যরাতে।ফ্লাইট বাতিল হয়েছিলো অজানা এক কারণে।তাই দেরি হওয়া।সেখান থেকে ওনারা চলে গিয়েছেন ওনার বাবার বাড়ি অর্থাৎ তীব্রর দাদা বাড়িতে।
তীব্রর সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মেহের মিষ্টি হেসে বিছানায় বসে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হুট করে হাত আগিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
-“আসসালামু আলাইকুম হাজবেন্ড।ঈদ মোবারক”
বুঝেও না বোঝার ভান করে তীব্র সালামের জবাব দিয়ে ঈদ মোবারক বলে।মেহের গাল ফুলিয়ে বসে থাকে।ওদের হাবভাব এমন যেন প্রেম করে বিয়ে করে সুখের সংসার।বোঝাই যাচ্ছে না যে এটা শর্তের বিয়ে।অবশ্য কেউ কারো কাছে ভালোবাসার ইজহার না করলেও তো একে অপরকে অফুরন্ত ভালোবাসায় বাঁধতে চায় দুজনেই।
-“কি হইছে মেহের গাল ফুলিয়ে বসে আছো কেন?চলো নিচে যাই। এখন একটু পরিবারের সাথে থাকো।বিকেলে তো আবার ও বাড়ি যাবো।আব্বু,আম্মু আসছে”(তীব্র)
-“আমার সালামি”(মেহের)
-“সালামিও দিতে হবে?”(তীব্র)
-“লাগবে না।সরো”(মেহের)
-“আরো দাঁড়াও।বউ এতো রাগ করলে চলবে বলো?এই নেও তোমার জন্য।আর আরেকটা জিনিস উম্মাহ…”(তীব্র)
সালামি ধরিয়ে কিসি দিয়ে তীব্র দিয়েছে দৌড়।মেহের তো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বেচারী এই কিসের আশা করেনি।মিনিট দুয়েক দাঁড়িয়ে থেকে লাফ দিয়েছে তিনটা।তারপর নিজের এক্সাইটমেন্ট কমিয়ে নিচে নেমেছে।একে একে সবাইকে সালাম করে বড়ো অংকের টাকাও সালামি পেয়েছে।তোয়া শান্তশিষ্ট মেয়ে কারো কাছে চায়নি। চুপচাপ সালাম করে চলে এসেছে।তবে বড় ভাইয়েরা,বাবা,চাচা দিয়ে তাকে।
জায়িন আফসোস করছে বসে বসে।মেহের ওর থেকে সালামি নিয়েছে।সব ক্ষেত্রে পাওয়ার দেখায় ও বড় বলে।আর আজ বলেছে সালামি দেওয়ার ক্ষেত্রে নাকি সব ভাইয়েরা বড়। বোনেরা ছোট হয়ে যায়।এর কোনো যুক্তি পায়নি ও।তাইতো আফসোস করছে।আর মেহের ঘুরে ঘুরে টাকার বাতাস খাচ্ছে।
-“কিগো ননদীনি টাকার বাতাস যে গরম তো বেশি লাগবে।”(তৃষ্ণা)
-“আহা ভাবী তুমি বুঝবে না।আমি তো জায়িনকে জ্বালাচ্ছি।বেচারার টাকা মেরেছি বলে কথা”(মেহের)
-“তা ছুটকির কি ভাবীর থেকেও সালামি লাগবে?”(তৃষ্ণা)
-“লাগবে তো বটে।তবে সালামি হিসেবে একটা টাইট হাগ দেও তো”(মেহের)
তৃষ্ণা টাইটলি হাগ করে মেহেরকে।মেয়ে এমনই।কখন যে কিভাবে কার মন জয় করতে হয় খুব ভালো জানে।তবে নওশিনের সাথে এসেছে পর থেকেই ঝগড়া বাঁধিয়ে রেখেছে।কেন যে এমন করছে তৃষ্ণা বোঝে না।একটা কারণ খুঁজে বের করেছিলো তবে তা যে হবার নয় তা সে ভালোই জানে।
বৈঠক ঘরে বাড়ির পুরুষেরা বসেছে।বাইরে লোকজন গরু সাইজ করছে। কোরবানি দেওয়া হয়ে গেছে।আর পাশেই খিচুড়ি রান্নাও হয়েছে।যারা কাজ করবে তারা যেন অভুক্ত হয়ে কাজ না করে তাই।মাহিন,মোয়াজ ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করছে।বড়রাও সায় দিয়েছে।তবে তার মাঝে তীব্র বলে ওঠে,
-“মাহিন তোরা এবার একাই যাবি।আমার বউ কিন্তু যাচ্ছে না।”
-“কেন?কি হইছে? আমাদের বনু/ছুটকি কি অসুস্থ?”(মাহিন,মোয়াজ)
-“আরে না।তোরা দুইটাও না!আজ বিকালে মেহের ওর শশুরবাড়ি যাবে তীব্রর সাথে।”(মহাসিন তালুকদার)
-“হুম।ইশ মেয়ে দুটো কোন সময় যে বড় হয়ে গেলো!আজ এক মেয়ে শ্বশুরবাড়ি ঈদে যাচ্ছে।আর কাল আরেক মেয়ে বিয়ে করে শশুরবাড়ি চলে যাবে!”(জুনায়েদ তালুকদার)
-“ভাই মেয়েরা বড় হলে তো পর হয়েই যায়।এটাই তো নিয়ম।তবে ওরা তো এই বাড়ির মেয়েই থাকবে।ভাইয়েরা ঠিক থাকলে ওদের আসা যাওয়াও থাকবে আমার মতো”(মায়া বেগম)
মায়া বেগমদের কোরবানি হবে নিজ ভবনে।তিন রেডি হয়ে বের হওয়ার পথে বললেন।ওনার স্বামী,ছেলে,বউ চলে গিয়েছে অনেক আগেই।এখন উনি যাবেন।সঙ্গে খাবার দাবার নিয়েছেন। কাঁটাকাটি করে বিলাতেও তো সময় লাগবে নাকি! ততক্ষণে রান্নাবান্না করতে যে দেরি হয়ে যাবে।তাই এই উপায় কাজে লাগানো।
৪২.
ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মাঝেই ছাতা মাথায় হেঁটে চলেছে দুই কপোত-কপোতী।ইচ্ছেটা আজ ছুঁয়ে দেওয়ার। পাশাপাশি দীর্ঘক্ষণ হাঁটার।হাত ধরে মোয়াজ হাঁটতে থাকে তৃষ্ণার। ভালোবাসাটা যেন ক্ষণে ক্ষণে বেড়েই চলেছে।এইতো আর দুইমাস তারপর একবছরে পা রাখবে ওদের সম্পর্ক।এই দশমাসে ওদের একদিনও মনে হয়নি যে না আমরা ভুল করেছি।ঝগড়া সব সংসারেই হয়।তবে ঝগড়ার সময় একপক্ষ চুপ থাকলে সেই ঝগড়াটা বাড়তে পারে না। তৃষ্ণা -মোয়াজ এভাবেই তাদের ঝগড়া কখনো বাড়তে দেয়নি।
-“তৃষ্ণা আমি কি কোনো অন্যায় করেছি? তুমি এতো চুপচাপ কেন?”(মোয়াজ)
-“আমার প্রাউড হয় তোমায় নিয়ে জানো”(তৃষ্ণা)
-“কেন?”(মোয়াজ)
-“কারণ তুমি পৃথিবীর সেরা ভাই,সেরা স্বামী এবং একজন সেরা মানুষ “(তৃষ্ণা)
-“স্ত্রীর চোখে সেরা হতে পেরে আমি ধন্য।কতজনই বা পারে তার সহধর্মিণীর চোখে সেরা হতে!তবে সেরা স্বামী হতে কিন্তু সেরা বউটাই সাহায্য করে তানিজার আম্মু”(মোয়াজ)
-“তানিজা?”(তৃষ্ণা)
-“আমাদের যখন বেবি হবে তখন আমি আমাদের মেয়ের নাম তানিজা রাখবো। সুন্দর না?”(মোয়াজ)
-“হুম।তবে শুধু মেয়ের নামই রাখবা?আমার ছেলে কি দোষ করছে!দেখো আমি আমার ছেলেকে এই নিয়ে বলে দিবো “(তৃষ্ণা)
৪৩.
“শশুরবাড়ি মধুর হাড়ি”কথাটা হয়তো অন্যরকম শোনায়।তবে ছেলেদের ক্ষেত্রেই প্রচলিত হয় এই কথাটা।যা একেবারেই ভুল প্রমাণ করেছে রেদওয়ান পরিবার।মেহেরকে সেই যে খাওয়াতে বসিয়েছে!একের পর এক খাবার সামনে রাখছে।শেষও হতে দিচ্ছে না। বেচারি খাবার খাওয়াকে এখন মিষ্টি মধুর অত্যাচার ভাবছে।আর তীব্র?সে তো মেহেরের অবস্থা দেখে হেসে কুটিকুটি।
-“আরে মা খাচ্ছিস না কেন?মজা হয়নি!অনেকবছর ধরে তো তেমন আইটেম করি না।তাই হয়তো মজা হয়নি।বিদেশে তো আর এতসব করার সময় হতো না।তবে এবার চিন্তা নেই একেবারে চলে এসেছি।”(মিসেস মিথিলা)
-“মামনি অনেক মজা হয়েছে।তবে পেটে তো আর জায়গা নেই খাবো কি করে!”(মেহের)
-“পেট ভরে গেছে বললেই তো হবে না।যে হারে চিকন হইচ্ছিস!দুইবছর আগের তুই আর এখনকার তুই কত ফারাক!(সারিমের মা)
সবার আদর যত্ন ভালোবাসা পেয়ে মন ভরে গেছে মেহেরের।সাফিন বাবাই,সাজিদ বাবাই ওকে সালামি দিয়েছে।সারিমের থেকেও সালামি আদায় করে নিয়েছে ও।সাদিয়া আপাই,তার জামাইয়ের থেকেও সালামি আদায় করেছে ও।তবে দিনশেষে গিয়ে সালামি দিয়েছে সাদিয়া আপাইয়ের পুচকু রুহানকে।কি মিষ্টি বাচ্চা।সারাটা বিকেল মামী,মামী বলে ওর সাথে সাথে ঘুরেছে।মেহেরের তো ইচ্ছে হয়েছিলো টুকুস করে কয়েকটা চুমু খেতে।তবে যদি কান্না করে দেয় সেই ভয়ে আর দেয়নি।বাচ্চা সামলানোর অভিজ্ঞতা ওর নেই বললেই চলে।
চলবে কি?
বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া-আপুরা। ভুল-ত্রুটিগুলো মার্জনার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকবো।ঈদ মোবারক সবাইকে