#দো_দিলে_জাহান
#পর্বঃ১৮
#বর্ষা
৬০.
ছোট্ট পুকুরের কিনারায় বসে আছে মেহের।পুরো ভিজে আছে।হাতে হালকা আঁচড়।বোমটা পানিতে ফালার সাথে সাথেই ব্লাস্ট হয়েছে। আচ্ছা কত মিনিটের টাইমার ছিলো?মেহের বেশি ভাবে না।হয়তো অনেক কম ছিলো তবে ডেলিভারি ম্যানের দ্রুত ডেলিভারি দেওয়ায় সে সবাইকে বাঁচাতে পারলো।কিংবা এইটা কোনো ফাঁদ ছিলো।
-“বাহ, মেহের বাহ তুই তো সুপারভ”
তূর্যয়ের কন্ঠ মেহেরের পরিচিত।মুখ ঢাকা থাকলেও সে চিনবেই।কাজিন হয়।তার ওপর তাদের বাড়িতেই সব সময় পড়ে থেকেছে এক্ষেত্রে না চিনলেই বোধহয় খারাপ হতো।তূর্যয় আবারো বলে ওঠে,
-“তোর প্রাণভিক্ষা দিতে পারি।যদি তুই নিজেকে সপে দিস।”
মেহের মুষ্টিবদ্ধ করে নেয় হাত।খুবই গোপন ফোন বের করে ভিডিও অপশন অন করে নেয়।তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে মাসুম কন্ঠে বলে ওঠে,
-“তূর্যয় ভাই তুমি এগুলো কি বলছো?”
তূর্যয় যেন ঘাবড়ে যায়।দ্রুত নিজেকে আস্বস্ত করে বলে ওঠে,
-“কে তূর্যয়?আমি কোনো তূর্যয় নই।বাজে বকা বন্ধ করে আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাও”
মেহের বুঝে যায় এর সাথে এর মতো করেই ডিল করতে হবে। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়।তীব্রর মুখ ওর চোখে ভেসে ওঠে।ও ক্ষমা চায় ধির কন্ঠে।তারপর বলে ওঠে,
-“তূর্যয় আমি তো তোমায় ভালোবেসেছিলাম।তুমি যদি নিজের পরিচয় জানিয়ে আমাকে চাইতে আমি রাজিও হয়ে যেতাম।কেন নূরিয়াকে বিয়ে করলে ”
তূর্যয় যেন অবাক না হয়ে পারছে না।মেহের ওকে ভাই না ডেকে কথা বলছে।তাও কিসব!নিজেকে নিজে গালে চড় মেরে সিওর হয় মেহের কি সত্যি বলছে কিনা।মেহের কান্নার নাটক করছে।তূর্যয় এগিয়ে এসে ওর গালে হাত দিতে নিলে ও সরে যায়।তূর্যয় বলে ওঠে,
-“আরে কান্দিস না।আমিই তো তূর্যয় এই দেখ।বোকা মেয়ে আমিও তো তোকেই ভালোবাসি।আরে ওই নূরিয়া তো এক এমপির আত্মীয়।আমার কাজে লাগবো তাইতো বিয়ে করেছি”
মেহের বাঁকা হাসে।যা দরকার ছিলো তা পেয়েছে।মোবারক তালুকদারের রিয়াকশন দেখার অপেক্ষায় সে এখন।আহা,তার দাদার রিয়াকশন কেমন হবে ভেবেই হেসে কুটিকুটি হতে মন চাচ্ছে তার।এতদিন পর একটা যথাযোগ্য প্রমাণ পেলো সে।তবে ভেবে নিয়েছে আগে নিজের ভয়েজ চেঞ্জ করবে।নয়তো মোবারক তালুকদার এক্ষেত্রে তূর্যয়ের ভুল দেখবে না। বরং ওকেই দোষী ভাববেন।
-“তূর্যয় আমার খুব খারাপ লাগছে।দম দম দম বন্ধ লাগছে..”
নিঃশ্বাস ভারী করে এককথা তিন আওড়ে ভং ধরে মেহের।তূর্যয় গাড়ির কাছে ছুটে যায় পানি আনতে।একাই এসেছে সে। তাইতো এই ফাঁকে মেহের ছুটে নিজের আনা গাড়ির দিকে।কোনো মতে পালায় সেখান থেকে।
৬১.
মাহিন এখন থেকে বিবাহিত পুরুষ। বাবা-মায়ের সাথে কথা বলেই মাহিন বিয়ে করেছে।মোয়াজ-তৃষ্ণা সাথে ছিলো। ওদের বিয়ের সময় আত্মীয় বলতে কেউই ছিলো না।তবে মাহিন আর মেহেরের বেলায় মোয়াজ ছিলো।
-“বাবা আমার মেয়েটা আমার বড় আদরের।তোমায় নাকি ভালোবাসে।আজই জানলাম।বাবা তোমায় আমার ভালো বলেই মনে হয়েছে।যতটুকু জানি তালুকদারদের নিয়ে ভয় আছে মানুষের মনে।আশা করবো আমার মেয়েকে তুমি আগলে রাখবে,এই ভয়গুলোকে বাস্তব করবে না”(মারিয়ামের বাবা)
-“আংকেল চিন্তা করবেন না।আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে ওকে আগলে রাখবো”(মাহিন)
মারিয়ামের বাবা হাসছেন মাহিনের কথায়।ছেলেটা এখনো তাকে আংকেল বলছে।মারিয়ামের বাবার তিন মেয়ে।মারিয়াম সবার ছোট,বড্ড আদরের।ছেলে না থাকায় তিনজনকেই আত্মনির্ভরশীল করতে চেয়েছিলেন ওনারা।তবে ভালো ছেলে দেখে আজ ছোট মেয়েরও বিয়ে দিয়ে দিলেন।
-“আংকেল চিন্তা করবেন না।আমার ভাইও ডাক্তার।ওরা দুজন ঠিক ভালো থাকবে।মনের মিল তো আগেই হয়েছে।আর আংকেল আমার ভাই একটু বোকা তো তাই শশুর আব্বু না বলে আংকেল ডেকেছে।তাই খারাপ ভাববেন না”(মোয়াজ)
মাহিন লজ্জা পায়।আর মারিয়ামের বাবা হেসে বলে ওঠে,
-“আরে না না বাবা আমি কিছু মনে করিনি।তবে তুমি মানুষের মন পড়তে পারো দেখছি”
আরো কিছুক্ষণ কথা বলে উনারা।অনেকটাই ফ্রি হয়ে গেছেন ইতিমধ্যে।মারিয়ামের বোনেরাও উপস্থিত।মারিয়ামকে অনেক কিছুই বোঝাচ্ছে আর ওর কাপড় গুছিয়ে দিচ্ছে।যদিও ওনারা চেয়েছিলেন অনুষ্ঠান করে মেয়ে তুলে দিবেন।তবে মাহিন জানিয়েছে ইসলামি তরিকায় অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ নাই।তাই অনুষ্ঠান করতে চাচ্ছি না।তবে ফ্যামিলি গেট টুগেদার হবে খুব শীঘ্রই।
-“আরে মারিয়াম ভাবী বিশ্রাম।এতো হাইপার হয়ে কাজ করছো কেন?তোমার বড় পালিয়ে যাবে না।”
তৃষ্ণার কথায় লজ্জা পায় মারিয়াম।বয়সে দু’জন সমবয়সী হবে।মারিয়াম তো ইন্টার্নে করছে।তাছাড়া মেডিকেলে এমনিতেও পাঁচবছর পড়াশোনার ঝামেলা।তারপর ডিগ্রি অর্জনে আবার পড়া। তৃষ্ণা তো উকিল।কম সময়েই লেগেছে তার।
তৃষ্ণার মা মাহিনের হাত ধরে অনেক কথাই বলেছেন।মেয়ে বিদায় দিচ্ছেন কষ্ট তো লাগবে।তাছাড়া আগে থেকে তো প্রস্তুতও ছিলেন না ওনারা।মারিয়াম ওনাদের বুঝিয়েছে।বলেছে ওর এক মিষ্টি ননদ আর দেবর আছে।ওরাই নাকি ওকে খুব ভালোবেসে আগলে রাখবে যদি কেউ ওকে কিছু বলে তখন।বিদায় নিয়েছে ওরা।গাড়িতে নিশ্চুপ সবাই। তৃষ্ণা মোয়াজ সামনে বসেছে।আর পেছনের সিটে মাহিন-মারিয়াম।মাহিন কিছুক্ষণ দূরত্ব বজায় রেখে মারিয়ামের হাত শক্ত করে ধরে নেয়।যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে কিংবা হারিয়ে যাবে।গাড়ির গ্লাসে মোয়াজ -তৃষ্ণা আড়চোখে তা দেখে মুচকি মুচকি হাসে।
৬২.
,,,,পরদিন,,,,
তালুকদার বাড়িতে আগের রাতে যায়নি মোয়াজরা।গিয়েছিলো মাহিনের নানাবাড়িতে।অনেক আপ্যায়ন করে তারপরই ছেড়েছে আজ বিকালে।মোয়াজ তো অনেক ফাজলামো করেছে ছোটো ছোটো মামাতো ভাই-বোনদের সাথে।তবে কারো কারো আবার মন ভেঙেছে।মালিহার মন ভেঙেছে মাহিনের বিয়েতে।ভাঙারই কথা। পছন্দ করতো।তবে তা আর জানায়নি।না জানিয়ে আদর আপ্যায়ন করেছে বেচারি। কখনো হয়তো আর জানাবেও না।
-“বড়দা ভাই দ্রুত বাড়ি আসো বড় ভাবীকে নিয়ে।আমি তালুকদার বাড়ি যাচ্ছি।”
মেহেরের ম্যাসেজ দেখে মাহিন আরো দ্রুত ড্রাইভ করতে থাকে।মিনিট ত্রিশ আগের ম্যাসেজ।এতোক্ষণে হয়তো ও পৌঁছে গেছে।আর এদিকে মাহিনের আরো দশ বিশ মিনিট লাগবে।
-“ভাই কি হইছে এতো দ্রুত ড্রাইভ করছো কেন?”
মোয়াজের প্রশ্ন শুনে মাহিন বলে,-“সারারাত তো না ঘুমিয়ে ফাজলামো করেছিস।এখন ঘুমা।দ্রুত বাড়ি যেতে হবে।মেহের ডেকেছে”
মোয়াজ ঘুম বাদ দিয়ে। তড়িৎ করে ভাইয়ের দিকে তাকায়।সোজা হয়ে বসে জিজ্ঞেস করে,
-“ভাই কি হয়েছে?মেহের ঠিক আছে তো!”
-“জানি না।ত্রিশ মিনিট আগে ম্যাসেজ দিছিলো। তাড়াতাড়ি যেতে হবে”
দুইভাই চুপ হয়ে যায়।যাওয়ার তাড়া অনেক।দুইভাই সামনে বসেছে।পেছনে মেয়ে দুজনই ঘুমাচ্ছে।কাল কাজিনদের সাথে থাকায় আড্ডায় আড্ডায় রাত কেটেছে।তবে পরে অবশ্য মাহিন কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলো।
তালুকদার বাড়িতে মেহেরের উপস্থিতিতে সবাই চমকায়।এই পাঁচদিন মেহের এমুখী হয়নি।তীব্রর হাতের গুলি ছুঁয়ে গিয়েছিলো শুধু।তাইতো হাতের ব্যান্ডেজ খুলে দিয়েছে।হিল হয়েছে অনেকটাই।তবে সাবধানে থাকতে বলেছে।আজ সকালেই খুলে দিয়েছে।
-“মেহের এনে নাটক করার কি হইছে?এই সাঝসন্ধ্যায় তালুকদার বাড়িতে কাম কি তোর?”
মোবারক তালুকদারের কথায় বাঁকা হাসে মেহের।মনে মনে বলতে থাকে,আহারে দাদা যখন তোমার পেয়ারা নাতির কার্যকলাপ দেখবা তখন না জানি কেমনে টিকবা! ততক্ষণে মাহিন-মারিয়াম,মোয়াজ-তৃষ্ণা উপস্থিত হয়েছে।দুইভাই প্রথমে এসেই বোনের খবর নিয়েছে।মহাসিন তালুকদার মারিয়ামকে দেখে জাস্ট মুচকি হাসে।মারিয়ামও হাসে।রাবেয়া বেগম কিছু বলেন না। শুধু চোখে চোখে তৃষ্ণাকে বোঝান মারিয়ামকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসতে।ওনারা দুজন ছেলের বিয়ে নিয়ে জানেন।
-“একটু সবর করো সবাই।তাহলে না আসল সত্যটা জানবে। অবশ্য তোমাদেরকে সত্যটা দেখিয়ে আমায় আবার শশুরবাড়ি যেতে হবে।প্রজেক্টর নিয়ে আসো মুহিব ভাইয়া”
মুহিবকে দেখে চমকায় সবাই।সে আসলো কবে?মুহিব আসলে মেহেরের কলিগ। দু’জন একই কর্মে নিয়োজিত থাকলেও আশেপাশের মানুষদের সামনে নিজেদের অচেনা হিসেবেই প্রিটেন্ট করতো। কিন্তু যখন জানলে মেহের তার ভালোবাসার মানুষটার বোন।তখন যেন তার খুশি বাঁধ হারা। কেননা মেহের ছিলো এককথায় ওর প্রতিদ্বন্দ্বি।তবে দুইজন তাদের সৎ মোটিভের জন্য অনেক বার একসাথে কাজ করেছে।এবারও করছে।
ভিডিও অন হতেই প্রজেক্টরে ভেসে ওঠে ঝাপসা ঝাপসা করে তূর্যয়ের দৃশ্য।সাউন্ড বক্সে কালকের বলা প্রতিটা কথা শুনতে থাকে বাড়ির প্রতিটা মানুষ।নূরিয়া ইতিমধ্যে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বাড়ির মানুষদেরকে হুমকি ধামকি দিয়ে নওশিনের সাথে বেরিয়ে গেছে।কাউকে ছাড়বে না এও জানিয়েছে।আর মোবারক তালুকদার?তিনি বুকে হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়েছেন।মায়া বেগম মুখ লুকাচ্ছেন।তার ছেলে এতোটা জঘন্য! মানুষ করতে পারেননি তিনি।যেমন বাপ তার তেমন ছেলে। গালি আসছে ওনার এখন।তবে কাঁদতে কাঁদতে তিনি ফোন দেন গোলাম ফখরুলকে।বিশ্রী গালি দিয়ে বলে ওঠেন,
-” ****** তোর ছেলেরে তো তুই তোর শিক্ষা দিছোস।ভাবছিলাম তুই খারাপ অন্তত আমার ছেলেটা মানুষ হইবো।না ভুলছিলাম তোর রক্তই তো বইতাছে।তাইতো ঘরে বউ রাইখা অন্য মেয়েদের দিকে তাকায়।জঘন্য চিন্তা ভাবনা পোষন করে”
গোলাম ফখরুল কিছু বুঝতে পারেননা।তার ছেলে তো তার সামনেই বসে এখন প্রেজেন্টেশন প্লে করছে। তাহলে তার ছেলে করলোটা কি!ভাবতে ভাবতে ফোন কেটে দেন তিনি।
৬৩.
সারিম মাঝবয়সী এক লোককে শান্ত করছে।লোকটা বড্ড অস্থির।বারবার কার যেন নাম আওড়াচ্ছেন।আর বলছেন তাকে দিয়ে আসতে।কোথায় দিয়ে আসবে তাকে?কেউ বুঝতে পারছে না। কেয়ারটেকাররা ব্যর্থ হয়েই তো সারিমকে ডাকলো।
লোকটা একটু শান্ত করে।রুটি ছিঁড়ে ওনার মুখে পুরে দিয়ে ফোনে কারো ছবি দেখিয়ে সারিম বলছে,
-“আংকেল আপনার ছোট্ট ছানা বড় হয়েছে।এই যে দেখুন।এই তো আপনার ছেলে।আপনার সন্তান”
লোকটা একদৃষ্টিতে সেই ছবির দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ হু হু করে কেঁদে ওঠেন।সে কি কান্না!সারিমের আফসোস হয় লোকটার জন্য। ইশ্ এতো সহায় সম্পত্তি রেখে নাকি লোকটা এতদিন পাগলা গারদে পচছিলো!ভাগ্য ভালো নয়তো কি লোকটা সেখান থেকে পালাতো?না পালালে তো কেউ ওনার খোজটাই পেতো না।লোকটা আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বিড়বিড় করে বলে উঠেছেন,
-“মাই চ্যাম…আমার চ্যাম বড় হয়ে গেছে।কত বড় হয়ে গেছে।আমি আমার সন্তানের বড় হওয়া দেখতে পারলাম না।বউ আমাদের সন্তান কত বড় হয়েছে দেখছো তুমি?”
চলবে কি?
আসসালামুয়ালাইকুম ভাইয়া-আপুরা। ভুল-ত্রুটিগুলো মার্জনার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।গল্পটা ক্রমানুসারে আগাচ্ছে।কেউ কেউ হয়তো না পেয়ে কনফিউজড হয়েছেন। আপনার মতামতের অপেক্ষায় থাকবো। হ্যাপি রিডিং