#দো_দিলে_জাহান
#পর্বঃ২২+২৩
#বর্ষা
দেখতে দেখতেই কি করে যেন দিনগুলো চলে যায়।আজ সারিমের গাঁয়ে হলুদ।তালুকদার বাড়ির সবাই আজ উপস্থিত। আত্মীয়-স্বজনে ভরপুর।অনেক হইচইয়ে মেতে আছে পুরো রেদওয়ান বাড়ি। কাঁচা ফুলে সাজানো হয়েছে বাড়ির পেছনের দিকটা। অসম্ভব সুন্দর লাগছে।আজ বেচারার বিয়ের আগের শেষ দিন।বিয়ের দিন থেকেই তো ফ্রাই হতে হবে তাই আজ হলুদ মাখিয়ে মেরিনেট করতে দেবে সবাই!হা হা
বন্ধুদল সারিমকে ক্ষেপাচ্ছে। কেননা এই ফাজিল তাদের বেলাতেও তাদের ক্ষেপিয়েছে। অবশ্য অবিবাহিত দুইবন্ধু ওরই সাপোর্টে কেননা নয়তো সারিম তাদের বিয়ের সময় তাদের ছাড় দেবে না।
-“দোস্ত মেরিনেট হওয়ার জন্য এতো সাজগোজের কি আছে।যা পাঞ্জাবি, পায়জামা খুলে লুঙ্গি,গামছা নিয়ে আয়।”(তুষার)
-“আরে বুঝিস না আমাদের মুরগি সরি মোরগের লজ্জা লাগছে।হাহাহা”(মুন)
-“শুধু মোরগ বলিস না।বর তো তাই বর মোরগ বল।নাহলে শুনতে খারাপ লাগে।হাহাহা”(ফারাজ)
-“এই তোরা থামবি নাকি আমি এখান থেকে চলে যাবো”(সারিম)
-“এখন তো আমাদের ভুলে যাবই বিয়ে করছিস।সত্যিই বিয়ে করলে বন্ধু পর হয়ে যায়”(মাহি)
-“তা আমাদের মেহের জানু কোথায় রে?”(নুসরাত)
ওরা সবাই কলেজ ফ্রেন্ড। সেই সূত্রে মেহেরের সাথেও পরিচিত।অন্যদিকে জারিন আর মেহেরের পরিচয়ই হয়েছে ভার্সিটিতে।তাই তো সারিমের বন্ধুদল চেনে না তাকে।এদিকে মেহের এসেও উপস্থিত হয়েছে বন্ধুদের কাছে।প্রায় দুইবছর পর দেখা। হঠাৎ হঠাৎ কথা বলা হলেও দেখা করা আর হয়নি কারো সাথে কারো।
-“কিরে বিয়াত্তা কি অবস্থা তোর?”(মুন)
-“হুম আমিই তো খালি বিবাহিত। তুই তো মেরিনেট করা মুরগি। তার বেলায়!”(মেহের)
-“কি বলিস?আমার মুন….”(তুষার,ফারাজ)
-“হ্যা আমাদের মুন এংগেজড উইথ আমাদের সেই সিনিয়র জুজু ভাই”(মেহের)
-“হোয়াট?”
বন্ধুদলের সবাই একে অপরের দিকে তাকায়। জুজু ভাই অর্থাৎ জুনায়েদ জায়িন ভাই।কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতো মুনের দিকে,তখন মুন বড্ড বিরক্তি নিয়ে তাকে তাড়া করতো।আর সেই জুজু ভাইয়ের সাথেই নাকি আমাদের মুন এংগেজড ভাবা যায়!
ফোন বেজে ওঠায় সেখান থেকে একটু সরে আসে মেহের।ওদিকে মুন বেচারি পড়েছে প্যারায়।আর মুনকে প্যারা দিয়ে আমাদের মেহের কেটে পড়েছে।
বাড়ির সামনের দিকটায় মানুষের চলাচল এখন কম। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়েছে অনেকক্ষণ।একটু পরই ওরা কয়েকজন বের হবে কন্যেকে হলুদ দিয়ে আসতে।বন্ধু মহলই যাবে।আর যাবে সারিমের মামাতো দুই বোন রিয়ানা,লিয়ানা আর সাদিয়ার আপুর ছেলে রুহান।
-“এদিকটায় আমি দেখছি।না,না ওরা আমায় সন্দেহ করেনি।আর সন্দেহ করলে কি তীব্রর মতো মানুষ আমায় ওর শশুরবাড়িতে ঠাঁই দিতো!আমার চিন্তা হয় না।ওই ক্যানিয়নকে যেমন….”
হঠাৎ কারো কন্ঠস্বর শুনে সেদিকে ফিরে তাকায় মেহের।পেছন থেকে শুধু অবয়ব দেখা যাচ্ছে।মানুষটা কে জানার জন্য একটু আগাতে গিয়েও সে থেমে যায়। পিলারের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।অবাক হয়ে যায় মুবাস্সির আদনানকে দেখে।এর মানে কে এই লোক,কি তার মোটিভ?
খচরমচর শব্দে সতর্ক হয়ে যায় মুবাস্সির আদনান।ফোন কেটে দ্রুত কেটে পড়েন সেখান থেকে।আর মেহের?সে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ক্যাটারিং এর দিকে ছোটে।সেদিকেই আছে।
মেহেরকে ক্যাটারিং এর এখানে দেখে চমকায় তীব্র।মেহেরের অস্থিরতা দেখে বুঝে যায় হয়তো মেয়েটা কিছু বলতে চায় তাকে।এগিয়ে আসার পূর্বেই গুটি কয়েক অতিথি ঘিরে ধরে তাকে।অন্যদিকে মিসেস মিথিলা মেহেরকে সঙ্গে নিয়ে যান কয়েক মহিলার কাছে।
-“হেরে এতোক্ষণ তো তোরা আমার পূত্রবধু দেখতে চাইছিলি।এই যে দেখ।আমার পূত্রবধু কম মেয়ে বেশি জাফরান মেহের তালুকদার।”(মিসেস মিথিলা)
-“বাহ রে তোর বউমা তো বেশ সুন্দর। মাশাআল্লাহ।তা ছেলেকে বিয়ে করালি জানালিনা অব্দি!”(একজন)
-“তা মেয়ে কিসে পড়ে? বিশেষ গুণটুন আছে নাকি রুপ দেখেই এনেছিস?”(অপরজন)
মেহের ভদ্রতার খাতিরে পারছে না কিছু বলতে।কিছু মানুষের প্রশ্নের কারণে সংসারে শান্তি নষ্ট হয়।এই যে এই আন্টি জিজ্ঞেস করলো কোনো গুণটুন আছে কিনা!এই কথাটাকে কেন্দ্র করে প্রথমত শাশুড়ির মনে ওর জন্য প্রশ্ন তৈরি হবে।আদৌ আমার বউমার গুণ আছে কি!যদিও থাকে না কেন তখন তিনি তা উপলব্ধি করতে পারবেন না।এর ফলে তিনি বউমার ওপর অকারণেই রাগ দেখাবেন এবং দেখা যাবে সইতে না পেরে হয়তো বউমাও রাগ দেখাবে।তারপর সংসারের শুরু হবে সাপ-নেউলের যুদ্ধ।
-“এতো কিছু জানি না।তবে আমার মেয়েটার বিশেষ গুণ আছে।বিপদেও একদম ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে পারে।আর পরিবারের বাঁধনের সুতাটা আগলে রাখতে জানে।”
-“এ আর নতুন কি?এতো সব বউদের মাঝেই আছে”(আরেকজন আন্টি)
সবার কথা শুনে মেহেরের মুখের হাসি মলিন হয়।মিসেস মিথিলা বিষয়টা বুঝতে পারেন।তাইতো বান্ধুবীদের বলে নিয়ে আসেন মেহেরকে।গালে হাত রেখে বলে ওঠেন,
-“এই মেয়ে একদম ওদের কথায় কান দেবে না।তুমি কিন্তু আমার মেয়ে হয়েই থাকবে।আর আমি তুমি মিলেই কিন্তু তোমার শশুর আর তীব্র জ্বালাবো।মনে থাকে যেন”
-“খুব থাকবে”
মেহের জড়িয়ে ধরে মিসেস মিথিলাকে। শাশুড়ি কি এতো ভালো হয়?হয়তো হয়।যদি স্বামী সবসময় স্ত্রীর ঢাল হয়ে দাঁড়াতে পারে তাহলে সব মানুষই ভালো হয়।তীব্র তো মেহেরের ঢাল।আর সেই ঢাল অতিক্রম করে হালকা আঘাত কেউ করতে পারলেও শেষ করতে পারবে না। তীব্র তা হতে দেবে না।
বাসে হইচই করে সবাই যাবে কন্যে বাড়ি। উদ্দেশ্য হলুদ দেওয়া।সারিমও তো বাসে উঠে বসেছিলো।তীব্র কান ধরে বাস থেকে নামিয়েছে ওকে। আত্মীয় স্বজন অনেকেই অনেক কথা বলেছিলো বাড়ির বউ ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে কন্যে বাড়ি যাওয়ায়।তারা কথা এতো আত্মীয়-স্বজন রেখে বউ কেন মজা করবে!তীব্র জোর করে মেহেরকে যেতে বলেছে।এবং নিজেও উঠে বসেছে বাসে।সারিমকে দায়িত্ব দিয়ে এসেছে নিজের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান নিজে সামলানোর।
কন্যে বাড়িতে প্রবেশ করার পথে চিরুনি,ফুল,চকলেট,ওয়েলকাম ড্রিংকস দিয়ে অ্যাপায়ন করা হয় ওদের।যেমনি করে ওরা করেছিলো কন্যে পক্ষের লোকদের।ওরা তো আগে ছেলের গায়ে হলুদ শেষ করেছে তারপর আধা ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছে।
স্টেজে চুপচাপ নিচু মস্তিষ্কে বসেছিলো জারিন।বেচারির কিছুই ভালো লাগছে না। ওর চাচাতো,ফুফাতো ভাই-বোন সব এসেছে। কিন্তু সবগুলোই নিজেদের মতো খাওয়া-দাওয়া ঘুরা ঘুরি করছে।একটাও ওর দিকে ফিরেও তাকায়নি।বাহ রে এতো রাত হয়েছে মেয়েটা খেয়েছে কিনা খোঁজ নেবে না?
-“কিরে শাকচুন্নী তোরে এতো সুন্দর লাগে কেমনে?”
মেহেরের কন্ঠে পেতেই মলিন মুখে হাসির রেখা ফুটে।জড়িয়ে ধরে পাশে বসা বেষ্টুকে সে। অভিমানী কন্ঠে জারিন বলে ওঠে,
-“জানিস কতটা বোর হচ্ছিলাম!একটা কেউ আসেনি।আম্মু-আব্বু সবাই তো অতিথি নিয়েই ব্যস্ত।ইশ কেন যে আমার নিজের ভাই-বোন নাই!”
-“এতো দূর থেকে আসলাম।আর এই মেয়ে তার ভাই-বোনের আফসোস করে।তাহলে আমি যাই।কি বলিস?”(মেহের)
-“এতো নটাংকি করিস না বইন।আধা ঘন্টার রাস্তা আসতে নয়টা বাজাইছোস।”(জারিন)
-“মেহেরের বাচ্চা তুই আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দে”(ফারাজ)
মেহের পাশে দাঁড়ানো ওর কলেজ লাইফের ফাজিল বন্ধুগুলো। এতক্ষণ অপেক্ষায় ছিলো মেহের হয়তো নিজ থেকেই পরিচয় করিয়ে দেবে। কিন্তু না এই ফাজিলে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে তাদের কথা ভুলেই গেছে।তাইতো ফারাজ নিজেদের অস্তিত্বের টের পাইয়ে দিলো ওকে।
জারিন অবাক হয়ে বাকি পাঁচজনকে দেখছে।আগে কখনো দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না ওর। মেহের জারিনের কৌতুহল মেটাতে হাত দিয়ে ইশারা করে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকে সকলের সাথে।মাহি তো জারিনকে দেখেই মৃদু চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
-“তুমি তো এই ফাজিলের বেষ্ট ফেন্ড তাইনা?কি মিল বাহ বাহ।তোমরা দেখছি জা হয়ে গেলে!”
-“থাক দোস্ত আফসোস করিস না।মেহের হয়তো কথা রাখে নাই।মুনও রাখে নাই।তাই তুই আর আমি এক বাসায় দুই ছেলের সাথে বিয়ে করে সারাজীবন একসাথে থাকমু।”(নুসরাত)
-“হুম আর তোদের ননদেরকে পটিয়ে আমাদের গলায় ঝুলিয়ে দিস,তাইনা ফারাজ “(তুষার)
-“একদম ঠিক।তা ভাবী কি আমাদের উপস্থিতিতে অস্বস্তি বোধ করছেন?”(ফারাজ)
-“এই একদম আমার ভাবীকে ডিস্টার্ব করবি না।যা তো যা।”(মুন)
মেহের চুপচাপ ওদের ফাজলামো দেখছে আর হাসছে।ভাবতেই অবাক লাগছে ভার্সিটিতে পড়লেও বাচ্চামোটা এখনো রয়েছে ওদের মাঝে।মেহেরের নিজের মাঝেও তো আছে।আর জারিন ভাবছে কত বন্ধুসুলভ সারিম-মেহেরের বন্ধুরা।ওরা নিচে চলে যায়।মেহেরও নিচে গিয়ে জারিনের জন্য খাবার নিয়ে আসে।জারিন অবাক হয়। মেহের চোখে দিয়ে আস্বস্ত করে বোঝায় সে বুঝতে পেরেছে জারিন অভুক্ত।চোখ মুখ ঢুকে গেছে।নিজ হাতেই খাইয়ে দেয় ওকে।
মেহেরের কন্যেকে এভাবে যত্ন নিতে দেখে একজন অতিথি তো পুরাই ইমপ্রেস।কারো থেকে হয়তো জেনেছেন মেহের ছেলেপক্ষের।তাইতো নিজের ছেলের জন্য প্রস্তাব দেওয়ার জন্য ছেলেপক্ষের মানুষ খুঁজছেন।
-“এইযে বাবা তুমি কি ছেলে পক্ষ?”(মহিলাটি)
-“জি আন্টি “(তীব্র)
স্টেজের দিকে ইশারা করে মেহেরকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেন,
-“ওই মেয়েটার পরিবারের নাম্বার দিতে পারবে?”
-“আমিই ওর পরিবারের সদস্য।আমাকে বলুন কোনো সমস্যা?”(তীব্র)
-“ওহ…তাহলে তুমি ওর ভাই”(মহিলাটি)
তীব্র ভুল ভাঙাতে আগে কিছু বলবে তার আগেই মহিলাটি আবারো বলে ওঠেন,
-“তোমার বোনটাকে আমার বেশ মনে ধরেছে।বিয়ে দিবেনা?আমার ছেলে একজন কেডার। সুপাত্র বলতে পারো”
তীব্র বেচারা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না।তার বউয়ের বিয়ের প্রস্তাব আসছে।আবার তাও কিনা তারই কাছে!বাহ কি কপাল তার।কপাল চাপড়াতে মন চাচ্ছে তার।কোনো মতে সে বলে,
-“আন্টি ওই যে মেয়েটাকে দেখালেন..ওই মেয়েটা আসলে আমারই স্ত্রী।আর আমি তার ভাই নই বরং হতভাগা স্বামী যার কাছে তারই স্ত্রীর বিয়ের প্রস্তাব আসছে ”
চলবে কি?
বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া-আপুরা। ভুল-ত্রুটিগুলো মার্জনার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।হ্যাপি রিডিং