দো_দিলে_জাহান #পর্বঃ২৫ #বর্ষা

1
407

#দো_দিলে_জাহান
#পর্বঃ২৫
#বর্ষা

সারিমের বিয়ের পর গত হয়েছে দুইদিন।এই দুইদিন আনন্দ মুখর কাটলেও আজকের ভোর যেন শহরের বুকে চাপা আর্তনাদের।তূর্যয়ের লাশ পাওয়া গেছে!তীব্র হতভাগ।সে তো জানতোই না তূর্যয়ের অবস্থান কোথায়।তাহলে কে মারলো তাকে?ছোট থেকেই তূর্যয়ের বেড়ে ওঠা তালুকদার বাড়িতে।এখন যেন শোকসভা চলছে সেখানে। অবশ্য সবার সন্দেহ নূরিয়ার ওপর পড়লেও কেউ কিছুই করতে পারছে না প্রমাণ বিহীন।মুখের বুলিতেই শুধু দোষারোপ করে চলেছে মায়া বেগম।

লাশ হস্তান্তরের ঘটনায় ফরেন্সিকে কাটাকাটির বিষয় পেরিয়ে তারপর বাড়ির মানুষের হাতে দেওয়ার নিয়ম বডি।তারপর না দাফন কার্য সম্পাদন করা হয়।তবে এরকম যেন কিছুই ঘটলো না এক্ষেত্রে। পুলিশের লোকেরা বডি দিয়ে গিয়েই যেন শান্ত।আর মিডিয়ার লোকেরা জেনেও যেন জানছে না তালুকদার বাড়ির খবর।যেই মিডিয়া সবসময় মুখিয়ে থাকে নতুন সংবাদের জন্য তারা নাকি শান্ত!

-“আমার পুলাডারে তুমি মারছো। তুমি আমার পোলার দোষী।একটু শাসন করতে দেও নাই।আজ শাসন করলে আমার পুলা আমারই থাকতো,জীবিত থাকতো”

গোলাম ফখরুলের কলার ধরে চিৎকার করে কাঁদছেন মায়া বেগম।নাড়ি ছেঁড়া ধনের এ দশা যেন তার সহ্যের বাইরে।অদূরেই নিরব অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে তানিয়া। তূর্যয়ের একমাত্র বড়বোন।তবে পরিবার তাকে ত্যাজ্য করেছে অনেক আগেই।কারণ ছিলো পড়াশোনার তাগিদে বিদেশ যেতে চাওয়া।শর্ত ছিলো হয় বিদেশ গিয়ে ত্যাজ্য হও নয়তো দেশে থেকে বিয়ে করে সংসার করে সুখী হও। ভাগ্যিস তানিয়ার সাহস ছিলো।তাইতো আজ সে মস্ত বড় বিজ্ঞানী।নাসাতে গবেষণা করছে।

-“মা তোমার ছেলে এই ইহকালে ভালো ছিলো না যে তার জন্য এভাবে কাঁদছো!ওর বউকে খবর দিয়েছো যে ওর স্বামী মারা গেছে?তোমার ছেলে খারাপ হলেও কারো স্বামী এখন সে।তাই খবর দেওয়া প্রয়োজন”

গোলাম ফখরুল মারতে আসেন তানিয়াকে।বরাবরই মেয়ে তার কাছে খেলার পুতুলের মতো।তাইতো প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ায় বড্ড অসন্তোষ ছিলেন তিনি।আর যখন বিদেশ গেলো তখন থেকে তো পুরোপুরি ঘৃণা করেন মেয়েকে। আধুনিক সভ্যতাতেও মানুষ ছেলে-মেয়েতে ভেদাভেদ করছে,শর্ত দিচ্ছে, ঘৃণা করছে!

-“ভুল করবেন না আংকেল।তানিয়া আপনার মেয়ে হতে পারে তবে এখন সে আমার স্ত্রী,আমার সন্তানদের মা।আমি তাকে আঘাত করতে দিবো না সে ওর বাবা কিংবা মা’ই হোক না কেন”

বিদেশী ধাঁচের ছেলেটার এতো সুন্দর বাংলা দেখে উপস্থিত সবাই চমকায়।এখানে কাঁদছে গুটিকয়েক মানুষ।আর সবার চোখে মুখে সমবেদনা ছাড়া আর কিছুই নেই।যা ঘৃণা ছিলো তা ভুলার চেষ্টা করছে।মা তো আর ঘৃণা করতে পারে না তাই এভাবে কাঁদছে।

তানিয়া মেহেরের কাছে আসে।মেহের যে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো তূর্যয়ের লাশের দিকে। চোখে মুখে তার অবাকতা।মেহের যখন বছর দশের তখন বাড়ি ছেড়েছিলো তানিয়া।তখন সে একুশ বছরের তরুণী।আর আজ দশবছর পর আবারো দেশে তানিয়া।

-“নূরিয়াকে কল দেওয়া উচিত”(তানিয়া)

-“জি আপু।আমি এক্ষুনি জানাচ্ছি”(মেহের)

মেহের সেখানে দাঁড়িয়েই ফোন দিতে নেয় নূরিয়াকে।তবে ওপাশ থেকেই ফোন আসে।খবর দেয় কিছু।তাদের থেকে পাওয়া খবর শুনে হতবাক হয়ে যায় সে।নূরিয়া প্রেগন্যান্ট। ছয়মাসের সংসার ছিলো নূরিয়া-তূর্যয়ের।যার একমাসই তূর্যয় পলাতক ছিলো।আর নূরিয়া তিন মাসের প্রেগন্যান্ট এখন। অর্থাৎ বাচ্চাটা তূর্যয়ের।আজকেই টেস্ট করিয়েছিলো সে।কাউকে ফোনে না পেয়ে শেষমেশ মেহেরকে কল দিয়েছে।

-“আই হ্যাভ অ্যা নিউজ ফর ইউ অলসো”(মেহের)

-“আমার সংবাদের থেকে ভালো সংবাদ নিশ্চয়ই না।আমার তূর্যয় জানতে পারলে নিশ্চিত বাকিদের ভুলে আমার কাছে ফিরে আসবে”(নূরিয়া)

মেহের শেষ কয়দিন উপলব্ধি করেছিলো তূর্যয়কে নূরিয়া ছাড়া কেউ ভালোবাসতে পারবে না।ওর মতো ঠেটা মেয়েই পারবে তূর্যয়কে ঠিক রাখতে।তবে এর মাঝেই কি থেকে যে কি হয়ে গেলো কিছুই মাথায় আসছে না মেহেরের।কিভাবে জানাবে সে ওকে!ওকে জানানো তো ঠিক না এই অবস্থায়।

-“ভাবী আপনার পাশে বড় কেউ থাকলে একটু ফোনটা দিবেন”(মেহের)

-“কেন কি হয়েছে?আমার তূর্যয় ঠিক আছে তো?”(নূরিয়া)

-“প্লিজ একটু বড় কাউকে দিন।কথা ছিলো”(মেহের

-“এই নেও মাম্মামের সাথে কথা বলো”(নূরিয়া)

নূরিয়ার মা হাইকোর্টের উকিল।পাওয়ার আছে আলাদা।তবে মেয়ের মতো পাওয়ারের অপব্যবহার করেননি তিনি।মেয়েকে ঠিকঠাক সময় দিতে পারেননি কখনো।কাজের লোকদের হাতেই বড় হওয়া নূরিয়া আর নওশিনের। তাইতো বখে গেছে দুইজনেই।তূর্যয়ের অবস্থা বলতে নূরিয়ার মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে ওঠেন,

-“নূরিয়া আসবে।হ্যাঁ,নূরিয়া আসবে।ওর শাশুড়িকে আগে শান্ত করো।আমার মেয়েকে যেন উত্তেজিত না করে।জানো তো নূরিয়ার হেল্থ কন্ডিশন”

মেহের কল রেখে তানিয়াকে সব বলে।তানিয়ার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ ফুটে ওঠে।দূরে দাঁড়ানো আরিয়ানের দিকে তাকায়। তাদের মেয়েরা আনিশা,আনায়া দুইজনেই বাবার কোলে।তানিয়ার হঠাৎ করে খারাপ লাগতে লাগে।তার ভাইটা নিজের ভবিষ্যৎ সন্তান না দেখেই পরলোক গমন করলো!

৮২.
তীব্রর সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেহের।আজকের কিছু রহস্যজনক ঘটনা সে উপস্থাপন করছে ওরই সামনে।তীব্র মন দিয়ে শুনছে।তার আগে থেকেই সন্দেহ ছিলো মাহিনের বাবা সেজে আসা লোকটার ওপর।তাইতো খোঁজ লাগিয়েছিলো এই লোকের অতীত জানতে।অতীতের কালা কিসসাও সামনে এসেছে অকপটে।

আজ মেহের দেখেছিলো মুবাস্সির আদনানকে কারো সাথে কথা বলতে।রেকর্ডিং অন করে রেখে সে সটকে পড়েছিলো সেখান থেকে‌। অবশ্য পরে সে তার মোবাইল ভাঙা অবস্থায় পেয়েছে।এতোটুকু সিওর হয়েছে লোকটা জেনে গেছে ওর সন্দেহ সম্পর্কে।

-“আচ্ছা তীব্র আপনি কিভাবে এই লোককে মুবাস্সির আংকেল ভেবে আনলেন?”(মেহের)

-“আরে আমি কি জানতাম নাকি উনি মুবাস্সির আংকেল”(তীব্র)

-“তাহলে একে পেলেন কই?”(মেহের)

-“একদিন মনে আছে এক লোককে বাঁচাতে গিয়ে প্রায় গাড়ির সামনে পড়তে নিয়েছিলে?এই সেই লোক। অর্থাৎ বর্তমান মুবাস্সির আদনান।আমি যখন খবর পেলাম লোকটার ওপর রাগ লাগলো প্রচন্ড। সিসিটিভি ফুটেজ খুঁজে লোকটার প্রচ্ছদ দেখলাম।খুব চেনা লাগলো।মাহিন আংকেলের সাথে ওর ছোটবেলার ছবি দেখিয়েছিলো।তারপর চিনে ফেললাম।খবর নিয়ে জানলাম পাগলা গারদ থেকে পালিয়েছে। অনেক বছর ধরেই নাকি ওখানে ছিলো।পরে আমি নিয়ে আসলাম। চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে তারপর সামনে আনলাম।”(তীব্র)

-“তোমার সন্দেহ হইনি এই যে হুট করে সে আমার সামনে আসলো,আমি তাকে বাচালাম।আবার তোমার চোখের সামনে এতো সহজেই সে চলে আসলো।এতো বছর পাগলা গারদে থাকলেও চেহারায় তার পরিবর্তন নেই।অবাকতার বিষয় না এগুলো?”(মেহের)

মেহের-তীব্র ভাবে।সত্যিই তো খুবই অবাক করা বিষয়
তীব্রর মনে প্রশ্ন জাগে এগুলো কি তবে আগে থেকেই প্রিপ্ল্যান্ড ছিলো নাকি?প্রিপ্ল্যান্ড না হলে এসবের মানে কি?তাহলে কি এই লোককে তালুকদারদের এখানে এনে ভুল করলো তীব্র!

৮৩.
তূর্যয়ের কবরের পাশে একাধারে কাঁদছে নূরিয়া।মেয়েটা গোলুমোলু হয়েছে কিঞ্চিত।বিগত এক মাসেই!বেচারীকে শেষ দেখাও দেখতে দেয়নি মায়া বেগম আর গোলাম ফখরুল।অনেকেই বুঝিয়েছিলো তাদের যে তূর্যয়ের ওপর ওর স্ত্রীর হক আছে।সে দেখতে পারবে তার স্বামীর মৃতদেহ।তবে নূরিয়ার ভাগ্য বড্ড হতাশাজনক তাইতো পারলো না ভালোবাসার মানুষটিকে শেষবার ছুঁয়ে দিতে,দেখতে।

-“তূর্যয় কেনো তুমি এতো খারাপ মানুষ হলে?কেন তুমি আমাকে, আমাদের ভবিষ্যৎ বেবিকে একা রেখে পালিয়ে গেলে?আচ্ছা তূর্যয় আমার আচরণ কি এতোই উগ্রো ছিলো যে তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারোনি!তবে কি আমার ভালোবাসায় খাদ ছিলো যে তুমি আমার হয়েই আমার হয়ে রইলে না!”

দূর থেকে নূরিয়ার মা ওর কান্না দেখছেন।তিনি জানতেন এমনটা একদিন হবে।তিনি মেয়েকে সাবধান করেছিলেন এই ছেলের থেকে দূরে থাকতে।এই ছেলের হয়েই একবার লড়েছিলেন তিনি।অন্যায়কেও অন্যায় না বলে প্রমাণ করেছিলেন।আর তার শাস্তি হয়তো তিনি মেয়ের এই দুঃখের মাধ্যমে পেলেন!

-“নূরিয়া ভাবী এতো কেঁদো না।তোমার তো তোমার বাবুর কথাও ভাবতে হবে।তূর্যয় ভাইয়া যাই করুক না কেন এখন তো তোমায় তোমার বেবির কথা চিন্তা করে বাঁচতে হবে।তূর্যয় ভাইয়া না থাকলেও এখন তোমায় তোমার বেবিকে নিয়ে বাঁচতে শিখতে হবে”

তৃষ্ণার কথায় নূরিয়া ওপরে তাকায়।মারিয়ামও আরেকপাশ দিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখে।এ যেন হঠাৎ আসা ভরসার হাত।মৃদু কেঁপে ওঠে নূরিয়া।মেয়েটা ওদের দুজনকে দুই বাহুতে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।মাহিন-মোয়াজ দূর থেকে দেখে।ওরাই পাঠিয়েছে তৃষ্ণা আর মারিয়ামকে।স্বামী হারা নারী হিসেবে দেখছে ওরা নূরিয়াকে।তাইতো সহানুভূতি দেখাচ্ছে।নয়তো ও যেরকম আচরণ করেছে ওর দিকে কেউ ফিরেও তাকাতো না।

চলবে কি?

আসসালামুয়ালাইকুম ভাইয়া-আপুরা। ভুল-ত্রুটিগুলো মার্জনার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।হ্যাপি রিডিং।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here