সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁 #পর্ব_৪ #লেখনীতে_suraiya_rafa

0
360

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্ব_৪
#লেখনীতে_suraiya_rafa।

ভে’ঙে গু’ড়িয়ে যাওয়া আশাহীন হৃদয়ের ছটফটানি আর তীব্র য’ন্ত্রনা নিয়ে,যা হোক কেবলই ঘরের দুয়ারে পা রেখেছিল অরু।ঠিক তখনই অনাকাঙ্ক্ষিত চ’ড়ে’র আ’ঘা’তে নিস্তব্ধ হয়ে আটকে যায় ওর পা দুটো, পাঁচ আঙুলের শক্ত ছাপ লেগে যায় নরম তুলতুলে আদুরে গালে।র’ক্ত জমে ফর্সা গালটা মূহুর্তেই ধারন করে কালচে বেগুনী রঙ।

গালটা বড্ড জ্বা’লা করছে, তবে সেদিকে হুশ নেই অরুর।মাথার মধ্যে কুন্ডলী পাকাঁনো হাজারো চিন্তাদের পাছে ফেলে দিয়ে শুধু একটা প্রশ্নই বারবার উগরে দিচ্ছে ওর মস্তিস্কটা
— কি করেছি আমি??

অরু যে এতোটা ব্যাথা পেয়েছে, নিজ গালে হাত দিয়ে ছলছলে নয়নে এভাবে বোকাদের মতো তাকিয়ে আছে,তার কোনোটাতেই আপাতত ধ্যান নেই অনুর। রা’গের তোপে এখনো শরীরটা রিরি করছে ওর। ইচ্ছে তো করছে অন্য গালে আরও একটা চ”ড় বসিয়ে দিতে।
অনু রা’গে ফোসফাস করছে দেখে, অরু কেঁ’দেই ফেললো, ঠোঁট উল্টে অস্পষ্ট সুরে বললো,
–কি করেছি আমি? এভাবে মা’র’লি কেন? পৃথিবীতে কি মা’র খাওয়ার জন্যই জন্ম হয়েছে আমার?

অনু দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
–আমি ছাড়া আর কে মা’রে তোকে?

অরু বলতে চাইলো, কে আবার?এবাড়ির ছোট কর্তা।দেশে থাকতে তো সকাল সন্ধ্যা গা’য়ে হা’ত তুলতো,।যদিও সে বহু অতীতের কথা সে কারনে অরু সেসব ভাবতে চায়না,তাই মুখ ফুটে বললো,

–অযথা কারন ছাড়া কেন মা’রবি আমাকে?? কই কখনো তো কারন ছাড়া ভালোবাসিস না, সারাক্ষণ ঝা’ড়ির উপর রাখিস, আমিকি তোর সৎ বোন আপা??

অনুর রা’গের অ’ঙ্গারে যেন একটু একটু ঘি ঢালছে এই মেয়ে, ক্রমশ মেজাজ খারাপটা বেড়েই যাচ্ছে, অনু কিরমিরিয়ে বললো,
,– এমদম পাঁকামি করবি না অরু, আচ্ছা তোর কি মায়ের জন্য আদৌ কোনো চিন্তা আছে বলতো আমায়? নেই তাইনা?

–এভাবে কেন বলছিস আপা?

–বলছি কারণ তুই একটা হাঁদারাম, আর আমি কিনা তোর উপর ভরসা করে এতোবড় একটা দায়িত্ব দিয়েছি।

–কি করেছি,প্লিজ খুলে বলবি,
চেঁচিয়ে ওঠে অরু।

অনু এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে ল্যাপটপ টা এনে ওর হাতে তুলে দেয়,
–নিজের চোখেই দেখে নে।

ল্যাপটপের ফ্রন্ট স্ক্রীনে ইমেইলের ইনবক্স ভাসছে সেই সাথে কতগুলো নতুন মেইল সব গুলোই আমেরিকা থেকে এসেছে, যা দেখে অরুর কান্নাভেজা চোখ দুটো খুশিতে চিকচিক করে ওঠে, ও কাঁ’দতে কাঁ’দতে বলে,
–আপা কোম্পানি থেকে মেইল এসেছে, ওরা মাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ইউএসএ নিয়ে যাবে । এটাতো খুশির খবর।

অনু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে,রাগ মিশ্রিত গলায় বলে,
— হ্যা এটা খুশির খবর কিন্তু এই মেইলটা আরও একমাস আগে এসেছে,ওরা ভিসা টিকিট সব পাঠিয়ে দিয়েছিলো, এই সপ্তাহেই ফ্লাইট।আজ কৌতুহল বসত আমি যদি মেইলের ইনবক্স না চেক করতাম তাহলে এই টিকিট আর ভিসা আমাদের কোনো কাজেই আসতো না, কারন গত একটা বছর ধরে তুই শুধু রোবটের মতো মেইলই পাঠিয়ে গেছিস,কখনো ইনবক্স কিংবা আদারবক্স চেক করেও দেখিস নি। যদি আমি এটা আরও এক সপ্তাহ পরে চেক করতাম তাহলে আমাদের মায়ের চিকিৎসার কি হতো, বল আমাকেএএ??

অনুর রু’ষ্ট চিৎ’কার শুনে কেঁপে ওঠে অরু।
ওর এই মূহুর্তে কিছু বলার নেই। প্রথম প্রথম কয়েকমাস ইনবক্স চেক করেও কোন লাভ হয়নি,তাই ও ধরেই নিয়েছিল এই ইমেইলের কোনরূপ প্রতিক্রিয়া আর আসবে না, অতএব প্রতিদিন ইনবক্স দেখে দেখে আশাতীত হওয়ার কোন মানেই হয়না, এতে ক’ষ্টটা দিগুণ হয়ে হৃদয়ে জেঁকে বসে। কিন্তু সকল চিন্তা ভাবনার উর্ধে গিয়ে এমন কিছু হবে সেটা অরু কল্পনাতেও ভাবেনি। ও আরও একবার সচকিত চোখে ল্যাপটপের মেইলটায় চোখ বোলালো, সকল নিয়ম নীতি হলফ করার শেষে একেবারে নিচে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা,
মি. প্রতয় এহসান
সি এফ ও, অফ
জে.কে গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি।
অরু নামটা দ্বিতীয় বার আওরায়
–প্রত্যয় এহসান,ইনি কে আপা?
অনু ঠোঁট উল্টে বলে,
–হবে হয়তো কোম্পানির দায়িত্বরত কেউ।

অরু একেএকে সবগুলো টিকেট চেক করলো, তার মধ্যে অরোরা শেখ নামের ওও একটা টিকেট রয়েছে।
অনু পাশে এসে বলে,
–আমি বুঝলাম না অরু তোর জন্যওও টিকিট পাঠানো হয়েছে, তুই অবশ্য না গেলেও হতো।

অরু আশ্চর্য হয়ে পেছনে চাইলো,
–কি বলছিস আপা?? তোরা অতদূর চলে যাবি, আর আমি এই ফাঁকা ক্রীতিক কুঞ্জে একা একা থাকবো?? ভুতেরা আমাকে আস্ত রাখবে বলে তোর মনে হয়??তুই এটা বলতে পারলি?আমি নির্ঘাত তোর সৎ বোন।

–হয়েছে, ড্রামা বন্ধ কর, আমি কেন বলছি সেটা শুধু আমিই জানি।

–কেন বলছিস??

–যতই উন্নত চিকিৎসা হোকনা কেন, মায়ের কাছাকাছি সবসময়ই আমাকে থাকতে হবেরে, তাহলে বিদেশের বাড়ি তোকে আমি কার কাছে রেখে যাবো বল? তারউপর ক্রীতিক ভাইয়া মানুষটা সুবিধার না।

অরু মৃদু হেসে অনুকে আস্বাস দিয়ে বলে, –আমি কি আর ছোট আছিরে আপা? আমি ঠিক সব পরিস্থিতি ম্যানেজ করে নেবো তুই দেখিস, তাছাড়া এতোগুলো বছর পর তিনি নিশ্চয়ই আগের মতো নেই, হতে পারে এতোদিনে বিয়েশাদি করে আমাদের জন্য বিদেশিনী ভাবি রেডি করে রেখেছে।

অনু অরুকে জড়িয়ে ধরে ওর গালে আলতো চুমু খেয়ে বলে,
–সরি সোনা। জানিস আমার অনেক খুশি লেগেছিল যখন মেইল গুলো দেখছিলাম, কিন্তু রা’গটা তখনই হয়,যখন ভাবলাম এই মেইল একসপ্তাহ পর পেলে আমাদের টিকেট ক্যান্সেল হয়ে যেতো,আমাদের মাকে আরও ভুগতে হতো।

অরু মুখ কালো করে,মাথা নুইয়ে বলে,
–তুই না আপা,আমিই সরি,আমিই তো খামখেয়ালি করে কিছুই চেক করতাম না। আমাকে ক্ষমা করে দে প্লিজ।

–হ্যা দেবো, তবে একটা শর্ত আছে।

–কি শর্ত?
–এখন এই মূহুর্তে আমার সাথে মার্কেটে যাবি, অনেক প্রয়োজনীয় শপিং করতে হবে, এই সপ্তাহেই ফ্লাইট।

অরু নিজের হাতের বাঁধন শক্ত করে, অনুর গলা জড়িয়ে ধরে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বলে, –আপা!! আই লাভ শপিং, কতদিন নতুন জিনিসের গন্ধ পাইনা।
তারপর আনমনেই বলে,
–এবার আমি নিখিল ভাইকে ঠিক খুজে বের করবো।
***************************************
আজ রোববার, প্রতিদিনের মতো আজও পরন্ত বিকেলে তীর্যক সূর্য কীরন হানা দিয়েছে খোলা আঙিনার ন্যায় মহলের বিস্তার ছাঁদ জুড়ে। বসন্তের দক্ষিণা বাতাসে পতপত করে উড়ছে রশিতে শুকাতে দেওয়া সারিসারি জামাকাপড়। সেগুলোই নিতে এসেছে অরু। তবে ছাঁদে পা রাখতেই মনটা কেমন উদাসীন হয়ে গেলো ওর।পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসে পরলো শ্যাওলা পরা চ্যাপ্টা রেলিংএর উপর। বসার দরুন হাটু অবধি খোলা চুল গুলো ধুলো ময়লা জমা মেঝেতে গিয়ে ঠেকলো। গোধূলী বেলার মেঘ ভেজা বাতাসের তালে তালে হাঁপড়ে একটা চাঁপা নিঃশ্বাস বেড়িয়ে এলো ওর বুক চিড়ে।
আজমেরী শেখকে ইতিমধ্যে এমারজেন্সি ফ্লাইটে তুলে দিয়ে এসেছে ওরা দু’বোন,ওদের ফ্লাইট রাতে। আর কয়েক মূহুর্ত মাত্র তারপর এই মহল, বাগান বিলাশে ঘেরা বিশাল বাড়ি, বাড়ির পেছনের সুপারি বাগান, সামনের বিশাল গেইট সব কিছু মানবশূন্য হয়ে পরবে। প্রিয় ক্যাম্পাস, প্রিয় বান্ধবী, আর সব চেয়ে প্রিয় নিখিল ভাই,সবাইকে ছেড়ে বহুদূরে পারি জমাবে অরু।অচেনা দেশে, সব অচেনা মানুষের ভীরে সাদামাটা বাঙালী অরুর জন্য কি অপেক্ষা করছে কে জানে?
কেবল ভরসা একটাই মায়ের সুস্থতা, আর মন গহীনের অযাচিত এক অদম্য ইচ্ছা,নিখিল ভাইকে খুঁজে বের করা। অরু জানে কাজটা এতোটাও সহজ নয়, তবে ও চেষ্টা করবে।পৃথিবীটা তো গোলকার,তার উপর একই দেশে থাকবে ওরা, ইন্টারনেটের যুগে অতোটাও কষ্টকর হবে না ব্যাপারটা,ভাবতেই বিষন্ন মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠলো অরুর।

— আমি আসছি নিখিল ভাই। ঠিক খুঁজে বের করে নেবো আপনাকে।

অরুর দিবাস্বপ্নতে টান পরে নিচ থেকে অনুর বাঁজ খাই আওয়াজে,
— কিরে অরু হাওয়া হয়ে গেলি নাকি, নিচে নাম নয়তো আমি ব্যাগ গুছিয়ে এয়ারপোর্ট চললাম।
*************************************
টাইম ফ্লাইস, ইয়েস ইট ইজ……
এই যেমন চব্বিশ ঘন্টা আগেও অরু পুরান ঢাকার নাম করা বাড়ি ক্রীতিক কুঞ্জের ছাঁদের কোনে দাড়িয়ে ঝিরঝির হাওয়া খাচ্ছিলো। আর এখন এই মূহুর্তে মোটা পশমি লেদার জ্যাকেট পরেও হু হু বাতাসে থরথর করে শীতে কাঁপছে।
এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে উঠে কাঁপাকাঁপি একটু কমেছে দু’বোনের তবে লম্বা জার্নিতে বড্ড কাহিল হয়ে গিয়েছে শরীরটা। অনুর চেয়েও অরুর অবস্থা বেগতিক কারণ পুরো ফ্লাইটে কিচ্ছু খেতে পারেনি ও।অরুর যে মা’রা’ত্মক রকমের ফ্লাইট ফো’বিয়া আছে, সেটা এই প্রথমবারই জানলো অনু। ভাগ্যিস কোম্পানি থেকে গাড়ি পাঠিয়ে ওদেরকে পিক করা হয়েছে নয়তো এই অচেনা শহরে অরুকে নিয়ে নির্ঘাত বিপ’দে পরতে হতো অনুর।

অনু অরুকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করলেও, অরুর মনে অন্য কিছু চলছিল, ওও ভাবছে, তিথি আর নিলীমার কথা, সেদিন অযাচিত কিছু কথা মুখ ফুটে বলে দেবার পর আর মুখোমুখি হয়নি ওদের। নিজের আত্মগ্লানিই ওকে আটকে রেখেছিল,যাদের সামনে সবসময় নিজের নির্ভীক ব্যাক্তিত্বটা ধারণ করে এসেছে সবসময় তারাই কিনা ওকে নিচু চোখে দেখবে, ফ্র’ট ভাববে এসব ভাবতেই লজ্জায় চোখ মুখ বুজে আসে অরুর।যার যের ধরে এতো দূর চলে এসেছে তবুও নিজের বান্ধবীদের একটাবার জানায়নি পর্যন্ত বরং অরুর মনে হচ্ছিলো দেশ ছেড়ে চলে গেলেই ভালো হবে,তিথি আর নিলীমার মুখোমুখি হতে হবেনা আর। ও বেঁচে যাবে।
********************************
সানফ্রান্সিসকোর শহুরে পরিবেশ ছাড়িয়ে আরও প্রায় ঘন্টা খানিক গাড়ি চললো। নির্জন হাইওয়ে রাস্তায় মাঝেমধ্যে দু’একটা প্রাইভেট কার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না ওদের, কিছুদূর পর পর রাস্তার কোল ঘেঁষে দু’একটা ওয়ালমার্ট আর ম্যাক ডোনাল্টস এর ক্যাফেটেরিয়া দেখা গেলো।তবে সেগুলো ও জনমানবশূন্য। এছাড়া রাস্তার দু’পাশে যা চোখে পরে তা হলো উঁচু নিচু পাহাড় আর সারিসারি উইল্ডমিল।
তবে চারিদিকের পরিবেশ প্রান জুড়িয়ে দেবার মতোই সুন্দর। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা গুলো পরিষ্কার তকতকে দেখে মনে হচ্ছে আজই পিচ ঢালা হয়েছে এতে। অথচ বাংলাদেশ হলে মানুষের গিজগিজ আর ময়লা আবর্জনায় রাস্তার মুখ খানা পর্যন্ত দেখার উপায় নেই।
যেতে যেতেই অরু বোধ করলো, এদেশের মানুষ যতটা শৌখিন ঠিক ততটাই পরিশ্রমী।

আসলে এখানে অরুর কোন দোষ নেই, প্রথম পরিচিতিতে মানুষের ভালো দিক গুলোই বেশি নজরে আসে।
*************************************
অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একটা ছোটমোটো ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে গিয়ে থামলো গাড়িটা, এতোক্ষন সব কিছু ঠিকঠাক লাগলেও হুট করেই নার্ভাস লাগতে শুরু করেছে অরুর, হাত পা গুলো যেন অবস হয়ে এসেছে, সেই সাথে ব’মিব’মি ভাব। মনে হচ্ছে কিছু একটা গলায় আঁটকে আছে। কিছুক্ষন বাড়িটার দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দিলো ও। ততক্ষণে অনু নেমে ওপাশ থেকে বারবার তাড়া দিচ্ছে।

— কি হলো নাম, তোকে রেখে আমি হসপিটালে যাবো, ইমার্জেন্সী কল এসেছে।

গাড়ির সাউন্ড প্রুভ কাঁচ গলিয়ে সে কথা অরুর কানে গেলোনা, ও আস্তে ধীরে সময় নিয়ে নামলো। বাইরে প্রচন্ত বাতাস আর গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে ঠান্ডায় জমে যাওয়ার উপক্রম।

অরু নামলে, ড্রাইভার মতো লোকটা একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বললো,
–দিস ইজ হাউজ পাসওয়ার্ড।

অরু মাথা কাত করে কার্ডটা নিলো।
অনু এগিয়ে এসে অরুকে বললো,
–তারাতারি চল জমে যাবো নইলে।

অরু এখনো নিশ্চুপ, শুধু উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।
কিন্তু অনুর আর বাড়ির ভেতরে ঢোকা হলো না, তার আগেই ওর ফোনটা বেজে ওঠে, ফোন রিসিভ করে অনু কি কি বললো সেসব কিছুই কানে যায়নি অরুর।
তবে তার পরপরই ওর শরীর জমে হীম হয়ে গিয়েছে। বাইরের খারাপ ওয়েদার এই শীতলতার কাছে কিছুই নয়। কারন এবার ওর শরীর নয় বরং ক’লিজা জমে এসেছে। একটু আগে ফোনে কথা শেষ করে, অনু এসে জানায়,

— আমাকে এক্ষুনি হসপিটালে যেতে হবে অরু, অনেক ফর্মালিটিস বাকি,আর সব কাগজ পত্র আমার ব্যাগে, এগুলো না পূরন করলে ওরা মাকে ভর্তি করাতে পারবে না,মায়ের শরীর আরও খা’রাপ হয়ে যাবে। তুই পাসওয়ার্ড দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে বিশ্রাম কর, আমি যত তারাতাড়ি সম্ভব চলে আসবো।

অরু চমকায়, হকচকিয়ে বলে,
— নানা আমি একা একা ভেতরে যেতে পারবো না, যদি কেউ থাকে, তার চেয়ে বরং আমি তোর সাথে যাবো।

— পাগলামি করিস না অরু,বাইরের অবস্থা দেখেছিস?? আমি সিওর রাত হলে ঝ’ড় আসবে, তাছাড়া তুইনা বলেছিস,আমার কথা শুনবি।
অরু ঠোঁট উল্টে কাঁদও কাঁদও হয়ে বলে,
— আমার ভ’য় করছে আপা, যদি ভেতরে কেউ থাকে??
— আমি যতদূর জানি কেউ বাড়িতে নেই, নয়তো ড্রাইভার পাসওয়ার্ড দিতোনা, আর যদি থেকেও থাকে তুই নিজের পরিচয় দিবি,কোনো বোকামি করিস না, কেমন??

অরু ঘার কাত করে সায় জানালো।

— অনু পুনরায় গাড়িতে উঠে পরে, যেতে যেতে বলে সাবধানে থাকবি, প্রয়োজন হলে ফোন করবি।
— কিভাবে ফোন করবো আমার কাছেতো সীম কার্ডই নেই। মাথা নিচু করে বিরবিরিয়ে কথাটা বললো অরু।

অচেনা দেশ,অচেনা শহর, অচেনা একটা বাড়ি,এখন আপাও চলে গেলো, এর চেয়ে অসহায় বোধ হয় এই আঠারো বছরের জীবনে আর কোনোদিন লাগেনি অরুর।
চারিদিকের অবস্থা বেগতিক, আকাশটা কালও মেঘে ঢেকে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে, এখানে আর দাড়িয়ে থাকার উপায় নেই, তাইতো দুরুদুরু বুকে ফ্রেন্স গেটটা খুলে ফ্রন্ট ইয়ার্ড থেকে পা টিপে টিপে সদরদরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় অরু, তারপর কার্ডে টুকে দেওয়া পাসওয়ার্ড দিয়ে দরজা খোলে ও। আশ্চর্য হলেও সত্যি পাসওয়ার্ডটা ছিল খুবই কঠিন। কে এতো বুদ্ধি খাঁটিয়ে কৌশলী পাসওয়ার্ড সেট করেছে সেটাই আপাতত ভাবছে অরু। তবে ওর ভাবনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা তার আগেই সদর দরজা খুলে গেলো।

ভেতরে প্রবেশ করে চারিদিকে একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিলো অরু,কেউ নেই বাড়িতে। লোকালয় ছাড়িয়ে অনেকটা নির্জন পরিবেশে ছোট্ট একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি। নিচ তলার পুরোটা জুড়ে বিশাল হল রুম, তার একপাশে আধুনিক ধাঁচের কিচেন কাউন্টার, কাউন্টারের সামনে সেট করা দুটো বারস্টুল কিচেন আর হলের মাঝে কোন দেওয়াল নেই,বরং কিচেন কাউন্টারের সামনেই গোলাকার ডাইনিং। হলে রুমের ঠিক অন্যমাথায় কিছু আধুনিক কারুকাজ করা নড়ম সোফা আর ডিভান। ডিভানের উপর এবরো থেবরো হয়ে পরে আছে একটা কুমড়ো সাইজের কালো রঙের হেলমেট।তারসামনে বিশাল মনিটর।
–টিভি হবে হয়তো, কিন্তু এতো বড় টিভি কে দেখে ভাই? ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো অরুর।

সামনের দিকে ভালো করে পর্বেক্ষন করে পেছনে চাইলো ও, দেখলো দক্ষিণ দিকের দেওয়ালটা পুরোটাই কাঁচের।
অরু ঠোঁট উল্টে মিনমিনিয়ে বললো,
— বোরিং, প্রয়োজনের বাইরে কোনো জিনিসই নেই, এতো সুন্দর বাড়িটা আমার হলে আমি মন ভরে সাজাতাম।

আপাতত আর কিছুই দেখার ইচ্ছে নেই ওর, শরীরটা বড্ড ক্লান্ত। বাড়িতে কেউ নেই ব্যাপারটা বুঝে উঠতেই কাঁচুমাচু ভাবটা কমে গিয়ে ঝরঝরয়ি দিগুণ ক্লান্তি নেমে এসেছে শরীর জুড়ে, কাঁচের চকচকে সিরি বেয়ে উপরে উঠে কোনমতে ভারি জামাকাপড় পাল্টে, প্লাজো আর টিশার্ট গায়ে চড়িয়ে, শরীরটাকে ছেড়ে দিলো নরম বিছানা আর কম্ফোর্টারের ভাজে।
*************************************
অরু, এই অরু, অরুউউউ
সুন্দর ভেলভেটের ন্যায় নড়ম বিছানার মধ্যে থেকেই নরেচরে উঠলো ঘুম কাতুরে অরু।

–অরুউউ,
অনেক দুর থেকে আপার আওয়াজ ভেসে আসছে, মনে হয় সকাল হয়েছে তাইতো প্রতিদিনের মতোই এতো ডাকাডাকি।
কিন্তু আজ ঘুমটা বড্ড ভারী লাগছে, চোখ খোলাই যাচ্ছে না, এতো নরম কেন লাগছে বিছানাটা।মনে হচ্ছে শরীরটা টানছে নিজের দিকে।
অনু আবারও ডাকে শব্দ করে,
–অরু ওওওঠ!!
ঘুমের মাঝেই অরু বলে ওঠে,
–ঘুমাতে দে না আপা, এই বিছানাটা অনেক নরম আর এই কুশনের এর গন্ধটা চন্দন কাঠের মতো, এই বলে কুশনে নাক ডুবিয়ে আবারও লম্বা শ্বাস টানে অরু।

এদিকে অরুর কান্ডে অনুর লজ্জায় জা’ন যায় যায় অবস্থা। ও চোখ খিচে অস্পষ্ট সুরে বলে,
–অরুউউ ওঠ, এটা তোর রুম নয়, আর না তুই বাংলাদেশে আছিস।আমরা আজ সন্ধায়ই আমেরিকা এসেছি ভুলে গেছিস, আর এই মূহুর্তে তুই অন্য কারও রুমে ঘুমিয়ে আছিস।

অনুর শেষ কথাটা একেবারে ছক্কা লাগার মতোই অরুর মস্তিস্কে গিয়ে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে ধরফরিয়ে উঠে বসলো অরু, মুখের কোনে জমে যাওয়া লালাটুকু মুছে শুষ্ক ঢোক গিলে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
–কি বলিস আপা কার রুমে আমি?

অনু আড় চোখে দরজার দিকে দেখালো, অরু ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকেই চাইলো,দেখলো ফুল স্লিভ সাদা টিশার্ট আর আর ব্ল্যাক ট্রাউজার পরিহিত লম্বা মতো লোক, অরু এক পলকেই এই সুদর্শন পরিচিত মুখটা ধরতে পেরেছে, এটা অন্য কেউ নয় সয়ং জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী।
অরুর মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে, কি করেছে ও এটা? কার বিছানায় এতোক্ষণ ধরে ঘুমিয়েছে??
এই মূহুর্তে দরজার বাইরে থেকে ওর দিকেই অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লোকটা, নিস্প্রভ,শীতল চাউনি, কিন্তু বরফ কেঁ’টে ফেলার মতোই ধা’রালো তার তীক্ষ্ণতা চোখ দুটোতে। কি আছে ওই চোখে? রাগ, বিরক্তি, কৌতূহল নাকি অন্য কিছু?? ধরতে পারলো না অরু, পাছে শুধু আস্তে করে ভয়ার্ত ঢোক গিললো।

— তারাতারি চল আমাদের রুম অন্য পাশে, অনু তাড়া দিতেই অরু তরিঘরি করে উঠে অনুর পেছন পেছন চলে যায়, যাওয়ার সময় খুব সতর্কে আরও একবার পেছনে তাকায় ও,
পেছনে তাকাতেই, হুটকরে চোখাচোখি হয়ে যায় ওই রহস্যে ঘেরা চোখ দুটোর সাথে। সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়টা কেঁপে ওঠে ওর, করিডোরের মাঝ বরাবর পকেটে হাত গুঁজে দাড়িয়ে এখনো একই ভাবে তাকিয়ে আছে ক্রীতিক।

অরু আর তাকানোর সাহস পেলোনা, দাঁত দিয়ে নখ কা’ম’ড়াতে কা’ম’ড়াতে দ্রুত অন্য রুমে ঢুকে পরলো ও।
ওরা চলে গেলে ক্রীতিক ও নিজের রুমে পা বাড়ায়, রুমে ঢুকতেই ফ্লোরে পরে থাকা মেয়েদের কাপড় চোপড়ে পা আটকে যায় ওর। সেগুলো একপ্রকার ইগনোর করেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো ও, কুশনটা এখনো অরুর লালায় ভিজে আছে, তারঠিক পাশে সুতোর মতো আঁটকে আছে একটা লম্বা চুল।
ক্রীতিক চুলটা হাতে তুলে ধরে, সাভাবিকের চেয়েও বেশ লম্বা চুলটা।
খানিকক্ষণ ওটাকে উল্টে পাল্টে নিয়ে ভ্রুকুটি করে ক্রীতিক বলে,
–এতো বড় কবে হয়ে গেলো??
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here