সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁 #পর্বঃ০৮ #লেখনীতেঃsuraiya_rafa

0
22

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্বঃ০৮
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
প্রাপ্ত মনস্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য।

অ্যা’লকোহল আর ব্যা’থা না’শকের সংমিশ্রণে তৈরি মলমটা হাঁটুর থেঁ’তলে যাওয়া ক্ষ’ত স্থানে লাগাতেই চোখ মুখ খিঁচে মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে অনু। ব্যাথা শিথিলের উদ্দেশ্যে, অরু মলম লাগাতে লাগাতে ঠোঁট উঁচিয়ে সেখানটায় আলতো করে ফু দিচ্ছে বারবার।

— হয়েছে অরু এই টুকুনি তো ব্যাথা আর মলম লাগাতে হবেনা।

অরু মুখের আদলে সিরিয়াস ভঙ্গিমা নিয়ে বলে,
— এই টুকুনি ব্যাথা?? দুই হাঁটু থেঁ’তলে যখ’ম হয়ে গিয়েছে। কি করে এমন হলো বলতো?

অরুর প্রশ্নে অনু নিজেও খানিকটা ভাবনায় ডুবে যায়,সত্যিই তো ব্যাথা এই টুকুনি হলেও আজকে সেভিয়রের মতো ওই লোকটা সময় মতো না এলে অনেক ভ’য়াবহ কিছু ঘটে যেতে পারতো। ফার্স্ট ক্লাস কান্ট্রি হওয়ার দরুন আমেরিকার যেমন অনেক অনেক ভালো দিক আছে, তেমনই ভালোর আড়ালে ঢাকা কুৎসিত দিকের ওও অভাব নেই। আজ তেমনই একটা কুৎসিত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে অনুকে।

সন্ধ্যা রাতে শিফট শেষ করে ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে অনু গিয়েছিল মায়ের কাছে হসপিটালে। মা ,আই সি ইউ তে ভর্তি, খুব একটা পাশে থাকতে হয়না,নার্সরাই খেয়াল রাখেন সর্বক্ষন। তাইতো পার্ট টাইম জবটা অফারটা পেয়েই লুফে নিয়েছিল অনু। কে জানতো সেই জবই কাল হয়ে এভাবে সামনে দাড়াবে ওর।

ক্যালিফোর্নিয়া আর সানফ্রান্সিসকোর মাঝামাঝি এই স্টেটে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেই বললেই চলে। এখানে পার্সোনাল গাড়ি বিহীন চলাফেরা বরই দূরহ ব্যাপার। ক্যাফেটেরিয়া থেকে হসপিটাল অবধি ছোটমোটো একটা বাস স্টপেজ থাকলেও ক্রীতিকের নিরবিচ্ছিন্ন জনমানবহীন বাড়ি অবধি হেঁটেই যেতে হয় অনুকে।
যদিও প্রতিদিন সকালে কোম্পানির বরাদ্দকৃত গাড়িতেই হসপিটালে যায় অনু কিন্তু বিকালে পার্টটাইমের কারনে আর গাড়ির ড্রাইভার কে অযথা ঝামেলা দেয়না ও। বাস ধরে আর বাকিটা পথ হেটে নিজেই বাড়িতে ফিরে যায়।

আজও লাস্ট বাস ধরে কেবলই ক্যাফেটেরিয়ার সামনের স্টপেজএএ নেমেছিল অনু। তখন সন্ধ্যা রাত মাত্র। তবুও পুরো রাস্তা জুড়ে শুনশান নিস্তব্দতা বিরাজমান । অদুরে কোন এক হাইওয়ে থেকে আসা শাঁই শাঁই করে কাবার্ড ভ্যানের শব্দ ছাড়া টুকরো পাতা ঝরে পরার টুপটাপ আওয়াজটা পর্যন্ত অনুপস্থিত।
চারিদিকে কেমন গা ছমছমে পরিবেশ।
অনু যত দ্রুত সম্ভব পা চালাচ্ছিল বাড়ির পথে।

ঠিক তখনই সামনে এসে দাঁড়ায় সেদিন ক্যাফেতে ঝামেলা করা গু’ন্ডামতো সেই লোকটা। আজ আর একজন নয় বরং কয়েকজন ছিল ওরা। সব গুলোই নে’শার ঘোরে বুদ হয়ে আছে। লোক গুলো কেমন লোভাতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চেয়ে আছে ওর পানে। সোডিয়ামের মৃদু আলোয় অনুর চোখে বড্ড বি’শ্রী লাগলো সেই চাহনী।ওদের আ’ক্রো’শ দেখে মনে হচ্ছে ওরা অনুকে ধরার জন্যই ফাঁ’দ পেতে বসে ছিল।
তাছাড়া ওদের ইংরেজি একসেন্ট ছিল পুরোপুরি অন্যরকম শুনেই বোঝা যাচ্ছিল এরা আমেরিকান না, হতে পারে ব্রিটিশ।

“ব্রিটিশ”শব্দটা মাথায় ঘুরতেই অনুর শীড়দাড়া বেয়ে বয়ে যায় হীমধরা ঠান্ডা স্রোত ।ব্রিটিশরা সাভাবিকের তুলনায় অধীক উ’গ্র মেজাজের, আর প্র’তিশোধ পরায়ন হয়।

—তারমানে কি এরা রি’ভেঞ্জ নিতে এসেছে??

কথাটা ভেবেই অনু একপা দুপা করে পেছাতে শুরু করে, তারপর আর এক সেকেন্ডওও সময় নষ্ট না করে চোখ খিঁচে দৌড়াতে শুরু করে পথের উল্টো দিকে।
দু’একবার পেছনে তাকালে দেখতে পায় ওই বাজে লোক গুলো এখানো ওর পিছু ছাড়েনি, বরং স্ব গতিতে ওকে ধরার জন্য ধেয়ে আসছে।

পেছনে তাকিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে হুট করেই পায়ের স্যান্ডেল ছিড়ে সামনের শুকনো পিচ ঢালা কাঁচের মতো ধা’রালো রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পরে যায় ও। তৎক্ষনাৎ দুই’হাটুতে প্রচন্ত ব্যাথা পেয়ে মা’গো বলে আর্তনাদ করে ওঠে অনু।

হাঁটুর অবস্থা বেগতিক।
তবুও হাঁপাতে হাঁপাতে পেছনে ফিরে তাকিয়ে অনু দেখতে পায় লোক গুলো খুব কাছে চলে এসেছে আর দু’পা এগোলেই হয়তো ধরে ফেলবে ওকে। আর তারপর কি হবে?? অনু কি আর কখনো বেঁ’চে ফিরতে পারবে?

অজস্র দানাবাঁধা ভ’য়ের তোপে থরথর করে কাঁপছিল অনু।ঠিক তখনই ওর ডান হাতটা টেনে ধরে ওকে নিয়েই দৌড়াতো শুরু করলো কেউ। ওর পাঁচ আঙুলের ভাজে নিজের পাঁচ আঙুল ঢুকিয়ে সামনের দিকে দৌড়াচ্ছে লোকটা। অনু নিজেও তারসাথেই দৌড়াচ্ছে, তবে পায়ের ব্যাথার কারনে তালেতাল মেলাতে পারছে না।

— কাম অন, আমি কোন সিনেমার
হিরো নই যে ওদের সাথে একা ফা’ইট করে আপনাকে বাঁচাবো। আপাতত দুজনার সেইফটির জন্য আমাদের পালাতে হবে। পরে না হয় ওদের দেখে নেবো।

দৌড়াতে দৌড়াতে সামনে তাকিয়েই কথা বলছে লোকটা।
রোড লাইটের আলোয় ছুটতে থাকা লোকটাকে ভালো করে পরখ করলো অনু, মেরুন কালার শার্ট আর চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা পরিহিত ফর্সা গড়নের এই যুবককে ও চেনে। হ্যা সেদিন ক্যাফেতে এই লোকটাই ওকে বাঁচিয়েছিল ওই গড়ম কফিটার হাত থেকে। আর আজ আবারও বাঁচালো,
কে এই লোক?? কোনো এঞ্জেল নয়তো? না হলে বিপদের সময়ই কেন পাওয়া যায় তাকে??

হালকা বাদামি চুল ওয়ালা ক্লিন সেভ করা পাতলা গড়নের লোকটা দেখতে যতটা সুদর্শন,তার কন্ঠস্বরটা তার থেকেও বেশি আকর্ষনীয় আর ডিপ।
অনুর ভাবনার ছেদ ঘটে লোকটার হ্যাঁচকা টানে।
এই মূহুর্তে একটা উডেন হাউজের আড়ালে লুকিয়ে আছে ওরা। অল্প একটু যায়গায় দুজন খুব আঁটসাঁট বেধে দাড়িয়েছে। অনু চেষ্টা করছে লোকটার থেকে দুরত্ব বজায় রাখার কিন্তু লোকটা নিজের অজান্তেই শক্ত হাতে ওর কোমড় চেপে ধরে সতর্ক দৃষ্টিপাত করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর অনু তাকিয়ে আছে চশমার আড়ালে একজোড়া ধূসর মনির চোখের দিকে।
এভাবেই বিনাবাক্যে, শুধু শ্বাসপ্রশ্বাস আদান প্রদানে কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হয়, প্রত্যয় সস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
— চলে গিয়েছে ওরা।আর রি’স্ক নেই।

চোখে চোখ পরতেই অনু ধরা পরে যাওয়া চোরের মতো ওর চোখ থেকে তৎক্ষনাৎ চোখ সরিয়ে নিলো,ব্যাপারটা ঠাওর করতে পেরে প্রত্যয় দুষ্ট হেসে, হিসহিসিয়ে বলে,

— হাউ সিনেমাটিক।

সেসব কথা ভেবে আবারও এক চিলতে লজ্জা মাখানো হাসি খেলে গেলো অনুর ঠোঁটে।
অনুর এমন উদ্ভট হাসির কারন খুঁজে পায়না অরু, তাই বিভ্রান্ত হয়ে বলে,
— এ্যাই আপা, পাগলের মতো হাসছিস কেন একা একা??

অনু ভ্রু কুঁচকে নিজের পা থেকে অরুর হাতটা সরিয়ে দিয়ে,কম্ফোর্টার মুড়ি দিতে দিতে বলে, —যা’তো ঘুমাবো।

অরু নিজের ঠোঁট উল্টে বলে,
— আশ্চর্য লজ্জা পাওয়ার কি হলো? আমি কি তোর শশুর না ভাসুর?
*****************************************

দেখতে দেখতে কখন যে ক্রীতিকের এই ছোট্ট ডুপ্লেক্স বাড়িটায় একটা মাস কাটিয়ে দিলো টেরই পায়নি অরু। সময় যে কেনো এতো তারাতারি চলে যায় কে জানে??
ডাক্তার বলেছে আজমেরী শেখের ওপেন হার্ট সা’র্জারীর প্রয়োজন।তবে এতোবড় সা’র্জারীর জন্য আজমেরী হক প্রস্তুত নন, দীর্ঘদিন সুচিকিৎসার অভাবে তার শরীরে বিভিন্ন জটিল সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেগুলোর ট্রিটমেন্ট চলাকালীন ওপেন হার্ট সা’র্জারী সম্ভব নয়।
অন্যান্য শারিরীক সমস্যার উন্নতি হলে তবেই বড় সা’র্জারী করানো হবে।তাই এই পুরো প্রসেসটায় একবছর বা তার বেশিও সময় লেগে যেতে পারে।
অনু আর অরুর কিছুই করার নেই, মাকে সুস্থ করতে হলে ধৈর্য ধরতে হবে। কারণ দুনিয়াতে মা ছাড়া ওদের সত্যিকারে আপন বলে কেউ নেই।

এরমাঝে অনু ক্রীতিক কে অনুরোধ করেছে অরুকে যাতে একটা ছোটখাটো ভার্সিটিতে এডমিশন করিয়ে দেয়, কারণ বছরের পর বছর তো আর পড়াশোনা বন্ধ করে রাখা সম্ভব নয়। অনু না হয় নিজের সখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছে,তাই বলে কি অরুকেও দিতে হবে??

অরু ভেবেছিল ক্রীতিক একবাক্যে না করে দেবে। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি, উল্টে ক্রীতিক আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, অরুর কোন চয়েস আছে কিনা।

গত একমাসে সব মিলিয়ে বড়জোর হলে দশদিনমতো অরুর আর ক্রীতিকের দেখা হয়েছে। ক্রীতিক বেশির ভাগ সময়ই বাড়ির বাইরে থাকে, কখন আসে কখন যায় সেটাও জানেনা অরুরা। ক্রীতিক যখন হলরুমে বসে গেইম খেলতো তখনই কেবল দু’একসময় বেখেয়ালে দেখা হয়ে যেতো।এছাড়া ক্রীতিকের দেখা খুব একটা পায়নি অরু। মোদ্দাকথা, একই বাড়িতে থাকা সত্বেও সম্পর্কের মতোই ওদের তিনজনার মাঝে ছিল বিশাল জড়তার প্রাচীর।

কিন্তু এই প্রাচীর কতদিন স্থীর থাকে কে জানে?
ক্রীতিকের মতো বেপরোয়া আর একরোখা সভাবের মানুষের জন্য এই প্রাচীর ভে’ঙে ফেলা খুব কঠিন কিছু নয় বৈকি ।

***************************************
ক্যালিফোর্নিয়ার এদিকে মাঘের আর পৌষের শীত বলে কিছু নেই, হাতে গোনা দুই তিনটে মাস ছাড়া বাকি সময়টাই শীতকাল এখানে। তারমধ্যে কখনো কখনো শীতকালকে সর্বেসর্বা হটিয়ে বর্ষাকাল নেমে আসে ধরনী জুড়ে। তখন শীত বর্ষা দু’টোর মিশ্রনে রাত দিন সমান হয়ে যায় এদেশে।
আজ তেমনই একটা দিন, গতরাত থেকেই বাইরে বর্ষাকাল শুরু হয়ে গিয়েছে, খানিক বাদে বাদে পশ্চিম আকাশে গুড়গুড়িয়ে মেঘ ডাকছে, আর দফায় দফায় একপশলা বৃষ্টি। সূর্য না ওঠার দরুন ঠান্ডারাও যেন জেঁকে বসেছে একদম।

এই আলো আধারি আবহাওয়ার মাঝেও অরুর মনটা আজ ভীষণ ভালো। কেনইবা ভালো থাকবে না, সানফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন হয়েছে ওর। আগামী কাল থেকে আবারও নতুন করে পড়াশোনার অধ্যায় শুরু হবে ওর জীবনে।নাহ নিজের জীবনের উপর যতটা অভিযোগ করেছিল ততটাও খারাপ নয় জীবন টা।

সেই খুশিতেই, সকাল সকাল রান্না চড়িয়ে কিচেন কাউটারের উপর বা দুলিয়ে বসে, বিশাল লম্বা বেনিটাকে হাতে নিয়ে নাড়তে নাড়তে , গুনগুনিয়ে গাইছে অরু,

“এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে নাতো মন
কবে যাবো,কবে পাবো ওগো তোমার নিমন্ত্রণ ”

ব্যাস এতোটুকুই গেয়েছিল ও তখনই বাইরের কলিং বেলটা বাঁজখাই আওয়াজ তুলে বেজে ওঠে।
অরু লাফ দিয়ে কাউন্টার থেকে নেমে তারাহুরো করে গিয়ে দরজা খুলে দেখে বাইরে কেউ নেই, তবে ফ্রন্ট ইয়ার্ডে যে বেঞ্চিটা রয়েছে তারউপর কিছু একটা রাখা।

দরজার সামনে থেকে ছাতাটা কুড়িয়ে,সেটা নিয়েই অরু বেঞ্চির কাছে এগিয়ে গেলো,গিয়ে দেখলো তাজা টকটকে লাল গোলাপের একটা বুকে। তার মাঝখানে উইশ কার্ড। ফোঁটাফোঁটা বারিধারা জমে ফুল গুলোকে আরও বেশি সতেজ দেখাচ্ছে।
প্রথমে তাজা গোলাপে মুখ ডুবিয়ে প্রান ভরে শ্বাস নিলো অরু, তারপর উইশ কার্ডটা খুলে পড়তে শুরু করলো, যেখানে গুটিগুটি ইংরেজি অক্ষরে লেখা,

​​—- ​Many Many happy returns of the day JK Sir.
from:”S”
ব্যাস এতোটুকুই।
উইশ কার্ডডা পড়ে ভ্রু কুঁচকে ডুপ্লেক্স বাড়িটার দোতলার কর্নারের রুমটায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অরু, যেখানে এই মূহুর্তে ক্রীতিক ঘুমিয়ে আছে।

প্রায় দুইদিন পর কাল মাঝরাতে বাড়ি ফিরেছিলো ক্রীতিক। রাতে যখন অরু পানি পান করতে নিচে নেমে আসে, তখনই দেখতে পায় ক্রীতিককে। অন্ধকার রুমে কাউচের উপর বসে মোবাইলের ফ্ল্যাস জ্বালিয়ে নিজের পায়ে নিজেই ব্যান্ডেজ করছে সে।
ব্যান্ডেজ করা হয়ে গেলে গায়ের জামাকাপড় গুলো ওখানেই ছু’ড়ে ফেলে দিয়ে খোঁ’ড়াতে খোঁ’ড়াতে নিজের রুমে চলে যায় ক্রীতিক।

পরে অবশ্য অরু নিজেই ক্রীতিকের জামা কাপড় গুলো লন্ড্রীতে দিয়েছিল। কিন্তু ক্ষ’ত কি করে হলো সেটা আর জিজ্ঞেস করার আর সাহস হয়ে ওঠেনি। দেখা গেলো জিজ্ঞেস করতে গেলে উল্টে থা’প্প’ড় মে’রে গাল লাল করে দিলো। যেচে পরে মানসম্মান খোয়ানোর ইচ্ছে নেই অরুর । তারউপর কথায় কথায় যে অ’পমান সহ্য করে সেই ঢের।
মনে মনে কথাগুলো ভেবে নিয়ে বুকে সমেত ঘরে চলে গেলো অরু।
*******************************************
বেলা তখন দশটা কি এগারোটা, বাইরে বৃষ্টি নেই তবে কালো মেঘে ছেয়ে আছে চারিপাশ।

তখনই একেবারে তৈরি হয়ে একটা ব্ল্যাক বেল্টের ঘড়ি হাতে পেঁচাতে পেঁচাতে নিচে নামলো ক্রীতিক। দেখেই মনে হচ্ছে বাইরে যাবে।
তবে যাওয়ার আগে বাঁধ সাধে অরু।

তাজা গোলাপের বুকে টা সামনে বাড়িয়ে দিয়ে একগাল হেঁসে বলে,
— হ্যাপি বার্থডে ভা..ভাইয়া।
ভাইয়া শব্দটা উচ্চারণ করতে অরুর একটু কষ্টই হলো বৈকি।

ক্রীতিক কোন প্রতিক্রিয়া করতে পারলো না, তার আগেই একেরপর একের গগন কাঁপানো হাঁচি দিতে শুরু করলো ও।
ক্রীতিক একাধারে হাঁচি দিয়েই যাচ্ছে, হাঁচি দিতে দিতে ওর নাকের ডগা লাল বর্ন ধারন করেছে, হুট করেই ক্রীতিকের এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় অরু একটু ভরকে যায়, ব্যাস্ত ভঙ্গিতে বলে,
— ককি হয়েছে আপনার?ঠিক আছেন?

ক্রীতিক হাঁচির মাঝখানে জবাব দেয়,
— ইডিয়ট ওটাকে সরা,রোজে আমার এলার্জি আছে।
এগেইন……..হাঁচ্চু।

প্রায় মিনিট দশেক পর একটু স্বাভাবিক হয়ে ক্রীতিক যখন আবারও বাইরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়, তখনই দ্বিতীয় বারের মতো পিছু ডেকে ওঠে অরু।
ক্রীতিক বিরক্ত হয়ে দাঁতেদাঁত চেপে বলে,
–হোয়াট হ্যাপেন্ড অরু,কি চাইছিস তুই?

— না মানে কোথাও যাচ্ছেন?

— ভার্সিটিতে যাচ্ছি, এক্সাম আছে।আর কিছু?

— এমা আপনিতো থার্টি প্লাস এখনো পড়াশোনা শেষ করতে পারেন নি?

—আমার নয় , আমার স্টুডেন্টদের এক্সাম আছে।এন্ড তুইকি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে আমাকে বয়সের খোঁটা দিলি??

অরু সচকিত হয়ে এদিক ওদিক মাথা নাড়ালো। তবে এটা বুঝতে পারলো না, এতো ধনসম্পদ প্রতিপত্তি থাকা সত্বেও কিসের অভাবে ক্রীতিক বিজনেস ছেড়ে দিয়ে চাকরি করে।

— শুনে রাখ, যদি দিয়েও থাকিস আমার লস নেই, বরং তোরই লস, দেখবি দিন শেষে তোর কপালেও একটা বুড়ো বর জুটবে।

অরু মুখ কাচুমাচু করে বললো,
–এভাবে কেন অভি’শা’প দিচ্ছেন, কি ক্ষ’তি করেছি আপনার?

ক্রীতিক একটু ব্যাথাতুর হাসি হাসলো, অতঃপর বললো,
—সিরিয়াসলি?? আমার এইজের কাউকে বিয়ে করাটা তোর কাছে অভিশা’পের মতো??

অরু মনে মনে বললো,
—অবশ্যই, আমিতো নিখিল ভাইয়ের মতো ইমিডিয়েট সিনিয়র কাউকে বিয়ে করবো।

অরু চুপ হয়ে গিয়েছে দেখে, ক্রীতিক ঘড়িতে নজর দিয়ে দ্রুত হাটা দিলো।
তখন আবারও দৌড়ে ওর সামনে গিয়ে দাড়ালো অরু।
অরুর বলা একটু আগের কথায় ক্রীতিকের মেজাজ এমনিতেই তু’ঙ্গে, তারউপর এখন বারবার পথ আটকাচ্ছে মেয়েটা, কি চাইছে ও??
রাগের তোপে দাঁত কটমট করতে করতে ক্রীতিক বলে,
— কি চাই,যাবি আমার সাথে? পকেটে করে নিয়ে যাবো? উঠবি পকেটে? আয় তাহলে।

অরু এদিক ওদিক মাথা নাড়ায়।

—মাথা গড়ম হয়ে আছে অরু , রাস্তা ছাড় নয়তো তোর ওই নরম গালে ক’ষিয়ে একটা থা’প্প’ড় দেবো আমি। যেটা আমি দিতে চাচ্ছি না।

অরু শুকনো ঢোক গিলে, একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলো ক্রীতিকের মুখের দিকে।
ক্রীতিক ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
— কি এটা?

অরু ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে জবাব দেয়,
— পায়েস। আজ আপনার জন্মদিন তাই, জানেন আপা বলে আমার হাতের ডেজার্ট নাকি অমৃত। সম্পর্ক যেমনই হোক না কেন আপনিতো আমার ভাইয়েরই মতো,তাইনা?

অরুর বলা শেষ কথাটা তী’রের ফলার মতোই মস্তিস্কে গিয়ে আ’ঘা’ত করলো ক্রীতিককে। ও চুপচাপ প্যাকেটটা হাতে নিলো, অতঃপর দু’কদম এগিয়ে গিয়ে প্যাকেটটা ময়লার বিনে ফেলে দিয়ে চোয়াল শক্ত করে, অরুর দিকে অা’গুনঝ’রা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
—– শেইম অন ইউর ফা’কিং সিমপ্যাথি।

তারপর হুরমুর করে বেরিয়ে গেলো, গেট ছাড়িয়ে।

অরু এখনো একই যায়গায় সটান দাঁড়িয়ে। না চাইতেও এভাবেই বারবার অপমানিত হতে হয় ক্রীতিকের কাছে। কই অনুর সাথে তো এমন আচরন করেনা, শুধু ওর সাথেই কেন?? ওর উপর কিসের এতো রাগ ক্রীতিকের?ভেবে পায়না অরু। তাছাড়া ওতো কোন সিমপ্যাথি দেখানোর জন্য ডের্জাট টা বানায়নি, বরং অনেকটা ভালোবাসা আর আন্তরিকতা থেকেই তো বানিয়েছিল। যেখানে ওর নিজেরই করুনা অপছন্দ সেখানে ও কিনা কাউকে করুনা করবে?তাও আবার জায়ান ক্রীতিককে? যার করুনায় বেঁচে আছে ওরা।হাস্যকর।
তাহলে ক্রীতিক আদতে কোন করুনার কথা বোঝালো??হট ডিড হি মিন?

******************************************
রাস্তার সাইডে স্থীর দাড়িয়ে থাকা চেনা পরিচিত মার্সিডিজ গাড়িটা দেখেই বেশ অবাক হলো সায়র। মনে মনে ভাবলো,
—মাঝরাস্তায় ক্রীতিক গাড়ি থামিয়ে করছে টা কি?? আশ্চর্য।

তৎক্ষনাৎ নিজের গাড়ির ব্রেক কষে, রাস্তা পার হয়ে, স্থীর গাড়ির জানালার গ্লাসে আঙুল দিয়ে দু-তিনবার টোকা দিলো ও।ভেতর থেকে সায়রকে দেখতে পেয়ে জানালার কাঁচ নামিয়ে ক্রীতিক বলে,
— কি সমস্যা?

— অনেক সমস্যা,
এই বলে গাড়ির ভেতর এসে বসে পরে সায়র।গাড়িতে বসা মাত্রই ক্রীতিকের দিকে তাকিয়ে সায়র যা দেখলো তাতে আপাতত ওর চোখ কপালে।

গাড়িতে ঢুকে সায়র দেখতে পায় ক্রীতিক আড়াম করে বসে অন-টাইম চামচ দিয়ে পায়েশ খাচ্ছে।
সায়র সন্দিহান হয়ে চোখ ছোট ছোট করে বললো,
— তুই এই রাস্তার মাঝখানে পায়েস কোথায় পেলি?
ক্রীতিক খেতে খেতে, বাম হাত উঁচিয়ে পেছনের ডাস্টবিনটার দিকে দেখিয়ে দিলো।

ক্রীতিকের কথায় সায়র চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো, অবিশ্বাসের সুরে বললো,
— কিহ!! তুই ডাস্টবিন থেকে খাবার তুলে খাচ্ছিস?

ক্রীতিক উপর নিচ মাথা নাড়ালো।

— ছিহ ক্রীতিক ছিহ,তুই এখনো এতোটাও অসহায় হয়ে যাসনি যে ওখান থেকে খাবার তুলে খেতে হবে তোর। আমরা এখনো আছি কি করতে?বাই দা ওয়ে আমাকে একটু দে, ইটস লুক ইয়াম্মি।

— সরি ব্রো, এটার এক চিমটি ভাগও আমি কাউকে দিতে রাজি নই, ইভেন কোনোদিন না।
পুরোটা আমার।
তারপর বিরবিরিয়ে অস্পষ্ট সুরে বলে,
— ও পুরোটাই আমার,ওয়ানলি মাইন।

সায়র বোঝার চেষ্টা করে বললো,
— তুই আবার ডেসার্টের প্রতি এতোটা অবসেসট কবে হলি?

ক্রীতিক মনে মনে বলে,
— ঠিকই বলেছিস সি ইজ মাইন ডেজার্ট। কথাটা বলতে গিয়ে, এক চিলতে মৃদু হাসি খেলে গেলো ওর ডার্ক ব্রাউন ঠোঁট জুড়ে, তারপর আবারও তলিয়ে যায় গভীর ভাবনায় আনমনে বিরবিরিয়ে বলে,তোর আপা ঠিকই বলে হার্টবিট, তোর রান্না করা ডেজার্ট অমৃত।

ক্রীতিকের কথার টোন ধরতে পারছে না সায়র, ও কখনোই এতোটা নরম সুরে, ঠোঁটে হাসি রেখে কথা বলতে দেখেনি ক্রীতিককে।জায়ান ক্রীতিক অলওয়েজ স্ট্রং থাকতে পছন্দ করে, উইক বিহেভিয়ার ওর দ্বারা হয়না, তাহলে হুট করে হলোটা কি? ভাবছে সায়র।
একমাত্র ড্রাংক হলেই এমন আচরণ করে ক্রীতিক ।তাই উদগ্রীব হয়ে সায়র শুধালো,
— আর ইউ ওকে ব্রো?

ক্রীতিক কুটিল হেঁসে জবাব দেয়,
—one day you’ll meet someone sayor, and it’ll literary take your br’eath away…
তখন ভালো, মন্দ ঠিক, বেঠিক উচিত, অনুচিত কোনোটাই মস্তিস্কে আটকায় না, যা এসে হৃদয়ে আটকায় সেটা হলো কাছে পাবার প্রবনতা।এট এনি কষ্ট, তাকে চাইই চাই।

ইউ নো হট, আমি জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী মাত্র ডাস্টবিন থেকে তুলে এনে খাবার খেয়েছি,ইট ওয়াজ ওয়ার্ম।এন্ড আই ফিল সো মাস হ্যাপি।

সায়র ওর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলো না, কার কথা বলছে ওও??কেনই বা বলছে?? আগেতো কখনো বলেনি, ইভেন প্রেম ভালোবাসা এই সমস্ত কথা শুনলেও রে’গেমেগে আ’গুন হয়ে যেত যে মানুষটা তার হঠাৎ হলোটা কি আজ??

চকিতে প্রশ্ন ছুড়লো সায়র
— ব্রো ওই ডেজার্টে কিছু মেশানো ছিলোনা তো?

ক্রীতিক জবাব দেয়না,শুধু বাঁকা হেসে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে আনমনে বলে,
—-ছিলোতো আমার হার্টবিটের “ছোঁয়া “।এন্ড ইটস মাই পার্সোনাল ড্রা”গ।
*******************************************
সন্ধ্যা হতে না হতেই ঝুম বৃষ্টি নেমেছে আকাশ বাতাস ছাপিয়ে।বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই, মোম জ্বালিয়ে রেখেছে অরু। অনু একটু আগেই কল দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে বৃষ্টিতে হসপিটালে আটকা পরেছে ও চিন্তা না করতে।

অরু মাত্রই কথা শেষ করে উপরে চলে যাচ্ছিলো, তখনই গেট খুলে ভেতর ঢোকে বৃষ্টিতে ভিজে জুবুথুবু হয়ে যাওয়া ক্রীতিক।

মোমের আলোয় থরথর করে কাঁপতে থাকা ক্রীতিক কে দেখে মায়া হলো অরুর, ও এগিয়ে গিয়ে কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করতে চাইলো, কিন্তু তখনই সকালের সেই অপমানের কথা মনে পরতে আবারও পিছু হেটে পা বাড়ালো নিজের ঘরের দিকে।
তবে দু’পা সিঁড়ির দিকে এগোতেই পেছন থেকে কাঠকাঠ আওয়াজ ভেসে এলো ক্রীতিকের,
—- দেখছিস শীতে কাঁপছি তবুও টাওয়াল এগিয়ে না দিয়ে চলে যাচ্ছিস?? আক্কেল কি পানির সাথে গুলে খেয়েছিস?

অরু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড় বলে,
— নিয়ে আসছি।

উপর থেকে টাওয়াল নিয়ে এসে চেহারায় একটু রাগি রাগি ভাব করেই এগিয়ে যায় ক্রীতিকের কাছে, অরু টাওয়াল দেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই ক্রীতিক খপ করে অরুর হাত সহ টাওয়ালটা ধরে নেয়, তারপর ওর হাত দিয়েই নিজের মতো করে চুল মুছতে থাকে।
— আরে আরে কি করছেন? লাগছে তো হাতে।

— ভাত তো আমার থেকে বেশিই খাস, তাহলে লাগে কেন?

—- খাওয়ার খোঁটা দিচ্ছেন??

— তুই আমার সব সম্পত্তি খেয়ে ফেললেও সেটা দেবোনা।

— কি বললেন??

অরুর কথার পিঠে ক্রীতিক কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই দরজা ঠেলে এলিসা,অর্নব,সায়র, ক্যাথলিন সবাই একসুরে চেঁচিয়ে বলে ওঠে সারপ্রাইজ….
ওদিকে কারও উপস্থিত টের পেতেই অরুকে একঝটকায় দুরে সরিয়ে দেয় ক্রীতিক।
অরু মেঝেতে ছি’টকে পরে, আর্তনাথ করে বলে ওঠে,
–আহ…আমার কোমড়….

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here