সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁 #পর্বঃ১৫ #লেখনীতেঃsuraiya_rafa

0
24

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্বঃ১৫
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
[প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য]

অন্ধকার বদ্ধ রুমে আটকে থাকার ফলস্বরূপ, অরুর শরীরে যে জ্বরের দাপদাহের সূচনা হয়েছিল,আজ প্রায় পাঁচ দিনের মাথায় তা একটু একটু কমেছে। জ্বর পুরোপুরি না কমলেও অরু যেচে পরে সবার কাছে নিজের সুস্থতা প্রমান করতে চাইছে, কারণ আগামীকাল নিখিলদের ট্যুর।
ধরনীতে নতুন সূর্য উদীয়মান। সুন্দর ঝকঝকে সকাল। ছাঁদবারান্দার ফাঁক গলিয়ে সূর্যের তীক্ষ্ণ মোলায়েম আলো এসে হানা দিচ্ছে দোতলার সরু করিডোরে। রুম থেকে বেরিয়ে, করিডোর ধরে সামনে এগুচ্ছে অরু, সাথে পিছু নিয়েছে ওর ছায়াটাও।গন্তব্য ক্রীতিক সাহেবের রুম।

ক্রীতিকের রুমটা করিডোরের শেষ প্রান্তে।হাতে একটা ম্যাক্রোকোনোমিক্সের বই আর ডোরাকে কোলে নিয়ে ক্রীতিকের রুমের দরজায় এসেই থামলো অরু। সেই যে প্রথম দিন এসে ক্রীতিকের বেডে ঘুমিয়েছিল, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত ওর রুমের চৌকাঠ অবধি মাড়ায়নি অরু। কিন্তু আজ তো আসতেই হতো, যে করেই হোক ক্রীতিককে রাজি করিয়ে, আগামীকাল ভার্সিটিতে যাওয়ার ব্যাবস্থা করতেই হবে, আর তার পর ভার্সিটি থেকে সোজা নিখিল ভাইয়ের সাথে ট্যুরে।

সেই কখন থেকে দরজার সামনে সটান দাড়িয়ে আছে অরু।নক করতে কেমন যেন ইতস্তত লাগছে ওর। রুমের দরজা লাগিয়ে ক্রীতিক কি না কি করছে, কি করছে কে জানে? দেখা গেলো নক করতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এসে অকস্মাৎ থাপ্প:ড় লাগিয়ে দিলো দু’গালে। সেসব হাবিজাবি ভেবে শুষ্ক একটা ঢোক গিলে বুকের মাঝে অনেকটা সাহস জুগিয়ে শেষমেশ দরজায় টোকা মে’রেই দিলো অরু। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে কাঠকাঠ আওয়াজ ভেসে এলো ক্রীতিকের,
— কি চাই?

অরু বাইরে থেকেই জবাব দিল,
— কিছু চাইনা, একটু একটু….

অরু কথা শেষ করার আগেই ক্রীতিক বললো,
— দরজা খোলাই আছে।

ক্রীতিকের জবাব শুনে অরু তারাহুরো করে ডোরাকে কোল থেকে নামিয়ে নিজের শরীরটা ঝেড়েঝুরে ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরে ঢুকতেই অরু দেখতে পায় ক্রীতিক তোয়ালে দিয়ে চুল মুচ্ছে,পড়নের ট্রাউজার আর টিশার্ট দুটোর রঙই কালো। মনে হচ্ছে শাওয়ার শেষে মাত্রই বেরিয়েছে সে। পুরোরুম জুড়ে স্যান্ডালউড পারফিউম আর মাতাল করা পুরুষালী গন্ধ মো মো করছে। ক্রীতিকের রুমে, ক্রীতিকেরই সামনে দাড়িয়ে, অরু বেহায়াদের মতো মনে মনে ভাবছে,
— আচ্ছা, রুম থেকেই এতো সুন্দর সুঘ্রাণ বের হচ্ছে । তাহলে ওনার শরীরের গন্ধটা কেমন? ওনার বউতো মনে হয়, ওনার শরীরের সুঘ্রানেই পাগল হয়ে যাবে।
আপন মনকে দাঁত খিঁচিয়ে অরুর অন্যমনটা বলে ওঠে,
—ছি ছি আবারও ভুলভাল ভাবছি। তওবা তওবা।

অরুকে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে বললো,
—কিছু বলার না থাকলে যেতে পারিস। আমি রেডি হবো, ম্যাচ আছে।

অরু তৎক্ষনাৎ ভ্রম থেকে বেরিয়ে এসে বললো,
— ইয়ে মানে, একটু পড়া বুঝতে এসেছিলাম কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না।

অরু পড়া বুঝতে এসেছে তাও ক্রীতিকের কাছে?ব্যাপারটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়,নিশ্চয়ই ঘাবলা আছে,সেটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে ক্রীতিক, তবুও অরুর উদ্দেশ্য ধরার জন্য বললো,
— আমি যখন ক্লাসে লেকচার দিই,তখন মন কোথায় থাকে তোর? বিশ্বাস কর অরু ফার্স্ট সেমিস্টারে ফেইল করলে তোকে আর পড়াবো না আমি।

অরু ঠোঁট উল্টে বললো,
— এতোকথা কেন শোনাচ্ছেন, দিননা একটু বুঝিয়ে, টিচার হোন আপনি আমার,স্টুডেন্টের প্রতি এইটুকুনি কর্তব্য তো আছে, নাকি?

— তোর আমাকে কর্তব্য শিখাতে হবে না।এসব কর্তব্য টর্তব্যের ধারধারিনা আমি।

অরু জানে ও কিছুতেই ক্রীতিকের সাথে তর্কে পেরে উঠবেনা, তাই দমে গিয়ে নরম সুরে অনুনয় করে বললো,
—- দিননা প্লিজ।

অরুর অনুরোধে বোধ হয় কাজ হলো,ক্রীতিক অরুর মুখের উপর নিজ তোয়ালেটা ছু’ড়ে মে’রে বললো,
— ঠিকাছে বুঝিয়ে দিবো, তার আগে কাজ শেষ কর।

অরু কয়েক কদম এগিয়ে এসে ক্রীতিকের মুখ বরাবর দাঁড়িয়ে ওর চুল ছোঁয়ার চেষ্টা করছে, পা উঁচু করে, দু আঙুলের উপর দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে ক্রীতিকের চুল মুছতে যাবে, তার আগেই ক্রীতিক ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললো,
— হয়েছে আর লাগবে না, এইটুকু কাজ সেটাও ঠিক মতো করতে পারিস না, বিয়ে হয়ে গেলে তখন কি করবি?

অরু মিনমিনিয়ে বললো,
— খাম্বার মতো দাড়িয়ে ছিলেন কেন?মাথাটা একটু নোয়ানো যেতো না?

— কিছু বললি?

অরু না সূচক মাথা নাড়ালো।
— কোন টপিকটা দেখিয়ে দিতে হবে?

অরু বই সমেত ক্রীতিকের দিকে এগিয়ে এলেই ওকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে ক্রীতিক বলে,
— খবরদার কাছে আসবি না, যা বলার ওখানে দাঁড়িয়ে বল।

— কাছে না এলে, পড়া বুঝবো কি করে?

— সে আমি জানিনা, তুই আমার কাছে আসবি না ব্যাস।

অরু অসহায় মুখে ক্রীতিকের পানে তাকিয়ে আছে, আর ক্রীতিক তীর্যক চোখে অরুর আগা গোড়া পরখ করছে,কালো ফ্রক আর লেগিংস, সেই সাথে মেঘের মতো ঘন কালো লম্বা চুল। সব কিছু কালোরঙ দিয়ে মুড়িয়ে রাখায় ফর্সা শরীরটা যেন জলজল করছে ওর। দেখলেই কেমন চোখ ধরে যায়।হৃদয়টা নিসপিস করে।

কিছু একটা ভেবে ক্রীতিক অরুর উদ্দেশ্যে বলে,
— তুই স্টাডি টেবিলে গিয়ে বস, আমি এখান থেকেই বুঝিয়ে দিচ্ছি।

অরু ক্রীতিকের কথা মতো তাই করলো।গিয়ে বসলো ক্রীতিকের অত্যাধুনিক টেবিল চেয়ারে। এরপর শুরু হলো ক্রীতিকের প্রফেশনাল আচরণ। একে একে পুরো চ্যাপ্টারের প্রত্যেকটা টপিকের উপর টানা একঘন্টা লেকচার দিয়ে তবেই থামলো সে।এই একঘন্টায় অরু পাঁচ মিনিট ঠিক মতো শুনেছে কিনা সন্দেহ। ও কতক্ষণ নিখিল ভাইয়ের কথা ভেবেছে, তো কতক্ষণ চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ক্রীতিকের রুমটা পর্যবেক্ষন করেছে। পুরো রুমটা গ্রে থীমে সাজানো। সবকিছুতেই কেমন অন্ধকার অন্ধকার ভাব। দেখলে মনে হবে,রুমের সব আসবাবপত্র মুখ গোমড়া করে বসে আছে। যেমন মালিক তেমন তার ঘর বোরিং।

— কি বোরিং?

ক্রীতিকের হঠাৎ ছোঁ’ড়া প্রশ্নে কম্পিত হয়ে উঠলো অরু, মুখ ফসকে কখন যে কথা বেরিয়েছে সে খেয়াল নেই ওর। দাঁত দিয়ে জিভ কেটে,তারাহুরো করে উত্তর দিল,
— আআপনাকে বলিনি, রুমের কথা বলেছিলাম।

ক্রীতিক নিজের কপালে গম্ভীরতার ভাজ টেনে এগিয়ে এসে অরুর গাল চেপে ধরে বললো,
— আমার মূল্যবান সময় নষ্ট করছিস কেন? কি চাই, সত্যি করে বল?

ক্রীতিকের র’ক্ত চক্ষুর দিকে একপলক তাকিয়ে, চোখ নামিয়ে অরু বলে,
— আমি কাল ভার্সিটিতে যেতে চাই।

— কেন, কাল কি আছে?

নিখিলের ব্যাপারটা পুরোপুরি এরিয়ে গিয়ে অরু বলে,
— এএ..একদিনের একটা ট্যুর আছে, শুধু আমাদের ব্যাচ। সবাই যাবে, তাই আমিও যেতে চাই।

ক্রীতিক কিছুক্ষণ নিস্প্রভ তাকিয়ে রইলো অরুর মুখের পানে, তারপর বেশ সাবলীল ভাবে জবাব দিলো,
— ওকে ফাইন।ইউ ক্যান গো।

ক্রীতিকের সম্মতি পাওয়ার সাথে সাথে অরুর বুক থেকে যেনো পাথর নেমে গেলো। চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো খুশিতে। সবচেয়ে কঠিন কাজ সম্পাদন করার মতোই আনন্দ হতে লাগলো ভেতরে ভেতরে। ও আর ক্রীতিকের রুমে বসে থাকলো না,কারণ এখানে তো ওর আর কোনো নেই,তাই নাচতে নাচতেই বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।

বুকে দু’হাত গুঁজে টেবিলে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে অরুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে ক্রীতিক বললো,
— কি সুন্দর মিথ্যা কথা বলতে শিখেছিস জান।
কথাগুলো বলার সময় অ’গ্নিস্ফুলিঙ্গের মতোই চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছিল ওর।
*****************************************
বিকেল বেলা এলিসা আর অর্নব এসেছে ক্যাথলিনের ডরমেটরিতে। গত একসপ্তাহ ধরে মেয়েটার কোন হদিস নেই। এলিসার বাবা জে’ল থেকে ছাড়া পেয়েছে কয়েকমাস হলো। সেই থেকেই বিভিন্ন পকার ক্লাব থেকে একেরপর এক হু’মকি আসছে ওর নিকট।সবাই নাকি ওর বাবার কাছ থেকে টাকা পায়, ওর বাবা বারবার জু’য়ায় হেরে মোটা অঙ্কের ঋণগ্রস্থ। এখন এলিসাকেই সেইসব টাকা পকার খেলে শোধ করতে হবে। নয়তো ওর বাবাকে শ্যু’ট করে মে’রে ফেলা হবে। এলিসা কখনোই চায় না ওর বাবা টাকার জন্য মা’রা যাক, কিন্তু আগের বার ঠিক একই কৌশলে এলিসাকে ওই পাপের খেলায় সামিল করেছিল ওর বাবা। এবারও যে একই নোংরা কাজ করবে না তার গ্যারান্টি কি?
কারন ওর বাবার কাছে এলিসা মেয়ে নয়, কেবলই টাকা বানানোর মেশিন মাত্র। সেবার ক্রীতিক, অর্নব আর সায়রের সাহায্যে জুয়ার জগত থেকে বের হতে পেরেছিল এলিসা, অথচ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার সেই একই পিছুটান ওকে তাড়িয়ে বেরাচ্ছে যত্রতত্র। এলিসা জানে এবার আর এতো সহজে সবটা সমাধান হবেনা,এবার হয়তো সত্যিই ওর বাবা জু’য়ারিদের হাতে মা’রা পরবে। মা’রা পরলে পরুক,তবুও আর ওই পাপের খেলা খেলবে না এলিসা।
নিজের মধ্যে গুমোট হয়ে কুন্ডলী পাকানো এতো এতো দুশ্চিন্তার মাঝেই ক্যাথলিনের সাথে কি থেকে কি হয়ে গেলো। ওরই বেস্টফ্রেন্ড এই নিন্দনীয় কাজটা করেছে, ভাবতেই লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে এলিসার।
—ক্যাথলিন মেয়েটা জেকে কে চোখে হারাতো অথচ জেকে এটা কি করলো?বিরক্তিতে ফোসফাস করছে এলিসা।
পাশ থেকে অর্নব বললো,
— ক্যাথলিনের আগেই বোঝা উচিৎ ছিল,ও যার লেজে পা দিয়েছে সে কোনো ডোড়া সাপ না,বরং বি’ষ দিয়ে ভরা ড্রাগন।

এলিসা ভ্রু কুঞ্চিত করে অর্নবের দিকে তাকিয়ে বললো,
— কি এমন করেছে আমার ছোট্ট বোনটা? আর যদি কিছু করেও থাকে সেটা কি মুখে বলে সমাধান করা যেত না?? এরকম একটা অ’পমান জনক কাজ করতে হলো? একটা মেয়ের জন্য চুল ঠিক কতোটা ইমোশন ধরে রাখে তোরা ছেলেরা আদৌও তা বুঝিস? ভালো বলিস আর খারাপ বলিস জেকে একটা হার্টলেস, একটা মেয়ের চুল কে’টে দিতে ওর বুক কাঁপলোনা একবারও?

—- ক্যাথলিন যখন অরুর চুল কা’টতে গিয়েছিল তখন ওর বুক কেঁপেছিল?
অর্নবের কথায় ডরমিটরির গেইটে এসে হাটার গতি থেমে যায় এলিসার।

— কিহ! কার চুল কে’টেছে?

— কা’টেনি কা’টতে চেয়েছিল, তাছাড়া ক্যাথলিনই অরুকে ব্যাকস্টেজের বেজমেন্টে আট’কে রেখেছিল।

আরও একবার চমকালো এলিসা, মুখ ফুটে বললো,
— ক্যাথ হঠাৎ এসব কেন কেন করতে যাবে?

অর্নব এলিসার হাতটা ধরে যেতে যেতে বললো,
— সেটা তো আমারও প্রশ্ন।চল এবার ক্যাথলিনকে দেখে আসি।

এলিসা এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে বললো,
— হাত ধরেছিস কোন অধিকারে? হাত ছাড়।

অর্নব পুনরায় ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
— তোকে আমি ভালোবাসি, বিয়ে করবো, তুই আমার ভবিষ্যত বাচ্চার মা, সেই অধিকারে ধরেছি, এখন চুপচাপ চল।
*****************************************
ডরমিটরিতে এসে একটানা আধঘন্টা যাবত ডাকাডাকির পরে রুমের দরজা খুললো ক্যাথলিন। ওর চোখ মুখের অবস্থা বি’ভৎস দেখেই বোঝা যাচ্ছে সারাদিন রাত একাকার করে কেঁ’দেছে।বাদামি রঙের বেনি হ্যাট দিয়ে পুরো মাথাটা ঢেকে রেখেছে বলে, চুল আছে কি নেই বোঝা যাচ্ছে না। এলিসাকে দেখে পুনরায় আরও এক দস্তুর কেঁদে ভাসালো ক্যাথালিন। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— আপু জেকে ভাইয়া আমার সাথে এসব কেন করলো বলোতো?

এলিসা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে শুধালো,
— এসব মানে?

ক্যাথলিন হেঁচকি টেনে জানায়, শুধু চুল কা’টা নয়, সেদিন ক্রীতিকের বাসায় ইলেকট্রিক্স শকট টাও ক্রীতিক ইচ্ছা করেই দিয়েছে।

ক্যাথলিনের কথায় এলিসা অর্নবের চোখ কপালে। এলিসা উদ্বিগ্ন হয়ে শুধালো,
— তুই কি করে জানলি কাজটা ক্রীতিক করেছে?
— জেকে ভাইয়া নিজ মুখে বলেছে।
পেছন থেকে অর্নব শুধালো,
—কি বলেছে?

— বলেছে তুমি আমার হৃদয়ে আ’ঘাত করেছো তাই তোমাকে সেদিন ইলেকট্রিক্স শক টা আমিই দিয়েছি। আর আজ আবারও একই ভুল করেছো, তাই আজও শা’স্তি দেবো। জানো আপু, তখন আমি জেকে ভাইয়াকে চিনতেই পারছিলাম না,কি ভ’য়ানক দেখতে লাগছিল,আর তারপর….কথাটুকু শেষ করার আগেই ডুকরে কেঁদে উঠলো ক্যাথলিন।
অর্নব দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বিড়বিড়িয়ে বললো,
— সায়র ওয়াজ কমপ্লিটলি রাইট।হি ইজ অবসেশট উইথ হিজ স্টেপ সিস্টার। হলি শীট…
****************************************

মন মস্তিষ্কের আন্দোলন তীব্র বেদনাদায়ক।তারউপর মনের মানুষটার মন যদি হয় অন্যকারও দখলে। এতোদিন ধরে ক্রীতিক যেটা আড়ালে অনুভব করে এসেছে। আজ তা সরাসরি অনুভব করলো অরু। সকাল সকাল এতো এক্সাইটমেন্ট এতো আনন্দ সব কিছু পু’ড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে এতোক্ষণে। হবে নাই’বা কেন? আনন্দঘন দিনের শুরুতেই বুঝতে পেরেছে নিখিল ভাই আসলে ওকে কথার কথা ট্যুরে ইনভাইট করেছিল। আসলে ওর যাওয়া না যাওয়ায় নিখিলের কিছুই আসে যায়না।

সকাল সকাল বাসে উঠে অরু যখন নিজের পাশের বে’দখল সিটটা নিখিলের জন্য বাঁচিয়ে রেখেছিল, তখনই বাসের লুকিং গ্লাসে অরু দেখতে পায়, নিখিল ভাই আর তার বিদেশিনী বান্ধবী ইতিমধ্যে বাসে উপস্থিত। তারা কি নিয়ে যেন উল্লাসে মেতে আছে ঠিক সেদিনের মতোই। অরু এসেছে কি আসেনি সেদিকে বিন্দু মাত্র খেয়াল নেই নিখিলের। অরু যখন অসহায়ের মতো ঠোঁট কামড়ে পেছনে তাকিয়ে ছিল তখনই ওর পাশে এসে বসে পরে সায়নী।
সায়নীকে দেখে অরু, দ্বিধাগ্রস্থ কন্ঠে শুধায়,
— আচ্ছা সায়নী, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে যদি সারাক্ষণ একসাথে থাকে, একসাথে হাসাহাসি করে, তাহলে কি তারা শুধু বন্ধু?

ওপাশ থেকে সায়নীর নির্লিপ্ত জবাব আসে,
— হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে।

অরু ভেতরে ভেতরে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরে, এমনটা নয়তো,এই বিদেশিনীই নিখিল ভাইয়ের প্রেমিকা? এমনটা হলে অরুর হৃদয়টা ভে’ঙে যাবে পুরোপুরি।

কিন্তু এই মূহুর্তে সকালের সেই অযাচিত প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব অরুর সামনে। সন্ধ্যা রাতে, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, সউচ্চ চূড়া থেকে নেমে আসা ঝরনাকে সাক্ষী রেখে অ’ন্তরঙ্গ সময় পার করছে নিখিল আর তার বান্ধবী। অরু সকাল থেকেই নিখিল কে চোখে চোখে রেখেছিল। সারাদিন ওরা কি করেছে না করেছে সবই আড়ালে খেয়াল রেখেছে। কিন্তু ফিরে যাওয়ার আগে আগে হঠাৎ করে সবার চোখের আড়াল হয়ে যায় ওরা দুজন। তবে অরুর নজর তো নিখিলের দিকেই ছিল, তাই চুপিচুপি পিছু নিয়েছিল ওদের। খুজেও পেয়েছিল খুব সহজে। কিন্তু এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দেখতে হবে তা কল্পনাতেও ভাবেনি অরু।

সেই জগন্নাথে পা রাখার পর থেকে নিখিল ভাইয়ের পিছনে ছুটেছে ও।মায়ের অসুখ, আপার বকুনি কিংবা ক্রীতিকের অ’পমান কোনো কিছুই দমাতে পারেনি ওকে। সেই একই নিখিল ভাইয়ের পেছনে ছুটতে ছুটতে আজ এতোদূর চলে এসেছে ঘর কুনো মেয়ে অরু। অথচ আজ মনে হচ্ছে,এখানেই থেমে যেতে হবে ওর, আর কোনো আশা নেই,নিখিল ভাই নিজ হাতে ওর ছোটার রাস্তায় কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছে।

শরীরের জ্বরটা বোধ হয় হুহু করে বারছে। নিরব অস্রু জ্বলে ভিজে যাচ্ছে গ্রীবা। মেয়েটাকে করা নিখিল ভাইয়ের একেকটা চুম্বন অরুর শরীরে যেন বিষা’ক্ত তী’রের মতো বিঁধ’ছে, এই দৃশ্য কতক্ষণই বা দাড়িয়ে থেকে দেখা যায়? অরুও দাড়িয়ে রইতে পারলো না। কাঁ’দতে কাঁ’দত ধপ করে বসে পরলো অসম ভূমিতে। ঘাস আবৃত জমিনে দু’হাত চাপরাতে চাপরাতে বললো,
— কেন এমন করলেন নিখিল ভাই? আপনি যদি অন্য কাউকেই ভালোবাসবেন তাহলে আমাকে কেন নিয়ে এলেন? আমি তো কোনো কালেই ট্যুরে আসতে চাইনি, কেবল আপনার একটা কথাতে সবাইকে মিথ্যা বলে,অসুস্থ শরীরটাকে টানতে টানতে নিয়ে এসেছি আমি, তাহলে এটা কি দেখালেন আপনি? আমার হৃদয়ে ফোঁটা প্রথম প্রেমের ফুলটাকে আপনি এভাবে পা দিয়ে পিষি’য়ে দিলেন।কেন?

— প্রেমে পরা কি এতোই সহজ?

পরিচিত,চমৎকার পুরুষালি কন্ঠস্বরটা কর্ণকূহরে পৌঁছাতেই অকস্মাৎ থেমে গেলো অরু।তরিৎ গতিতে পেছনে তাকিয়ে দেখলো পকেটে দুহাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী। মাথায় বাকেট হ্যাট, পরনে হোয়াইট ওভার সাইজ টিশার্ট। অরু বুঝতে পারছে না ক্রীতিককে দেখে ও কি খুশি হবে নাকি,লজ্জা পাবে।
— কি হলো আর কতো কাঁদবি, ক্রাশের জন্য?

অরু নাক টেনে জবাব দিলো,
— ভুল ভাবছেন উনি আমার ক্রাশ না।
তারপর হুট করেই বললো,
— আপনি সবটা জানতেন তাইনা? সব জেনে শুনেই আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন, তাইনা? কিভাবে পারলেন আপনি?

ক্রীতিক এগিয়ে গিয়ে অরুর হাতে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ওকে দাঁড় করায়,অতঃপর দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
— বিশ্বাস কর অরু, এই মূহুর্তে তোকে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে একটা থা’প্পড় দিতে ইচ্ছা করছে আমার। কিন্তু কি জানিস তো? সেটা আমি পারবো না।কারন আমার হাত অগ্রসর হওয়ার আগে আমার কলিজা কেঁপে উঠবে।

অরু ক্রীতিকের কথায় খানিকটা ভরকে গিয়ে আবারও নিখিলদের দিকে তাকালো, যারা এখন গভীর চুমুতে মত্ত।

— হি ইজ আ প্লেবয়, ওই যে মেয়েটা দেখছিস,ও আর ওর বান্ধবী দুইজনার সাথেই একত্রে লিভ টুগেদারের আছে বা’স্টার্ডটা।

অরু চমকে গিয়ে বোকার মতো শুধালো,
—দুইজনার সাথে, একই সাথে কিভাবে কি?

অরুর প্রশ্নে ক্রীতিক ঠোঁট টিপে হাসলো, কষ্ট পেয়ে মেয়েটা বোধ বুদ্ধি সব খেয়ে ফেলেছে মনে হয়। তবুও ক্রীতিক ওর কথার জবাব দিয়ে বলে,
— ট্রিও রিলেশনশীপ, এর বেশি বুঝাতে পারবো না, ব্যাপারটা তোর আর আমার বয়সের সাথে যায়না। তাছাড়া তোর বান্ধবী তিথির সাথেও দীর্ঘদিন ফিজিক্যাল রিলেশনে ছিল ও।

একদিনে ঠিক কতোগুলো শক নেবে বুঝতে পারছে না অরু, ওর মাথাটা ভঁনভঁন করে ঘুরছে, সেইসাথে নিখিলের প্রতি জমাট বাঁধা অভিমানটা পরিনত হয়েছে তীব্র ঘৃণায়।মনে মনে ভাবছে তাইতো সেবার তিথি এতোটা বা’জে ব্যাবহার করেছিল ওর সাথে।

— তুই বসে বসে তোর প্লেবয় নিখিল ভাইয়ের জন্য কাঁদতে থাক আমি গেলাম।
বাইকের চাবির রিংটা আঙুলে ঘুরাতে ঘুরাতে যেতে যেতে কথাটা বললো,ক্রীতিক।

অরুর ভ্রম ভেঙে গেলে ও ছুটে এসে ক্রীতিকের সাথে হাঁটতে হাঁটতে নাক টেনে বললো,
— আমি কি করে যাবো?

—কেন তোর নিখিল ভাইয়ের সাথে যাবি।

ক্রীতিকের কথায় অরু আবারও অসহায় দৃষ্টিতে নিখিলদের দিকে তাকালো, পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে গলার আওয়াজ শক্ত করে বললো,
— কক্ষনো না।

— তাহলে কিভাবে যাবি?

অরু মুখ ফুলিয়ে বললো,
— আপনার সাথে।

ক্রীতিক বাইকের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
— আমি মেয়ে মানুষ বাইকে নেইনা।

অরু দুকদম এগিয়ে এসে বললো,
— প্লিজ নিয়ে যান, আমি ওই বাজে লোকটার মুখোমুখি হতে চাইনা এজীবনে।

ক্রীতিক অরুর চোখে চোখ রেখে বললো,
— নিয়ে যাবো, বিনিময়ে আমি কি পাবো?

— যাই চাইবেন তাই দেবো, এখন চলুন।

ক্রীতিক বাঁকা হেসে শুধায়,
— আর ইউ সিওর যা চাইবো তাই?

—হ্যা তাই, শুধু আমাকে আর ডোরাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাইবেন না দয়া করে।

অরুর কথায় ক্রীতিক অন্যদিকে ঘুরে হাসি সংবরণ করলো,মনে মনে ভাবলো,
— পিচ্চি মেয়ের মায়ায় পরলে এই হয়।

—কি হলো, চলুন।

ক্রীতিক নিজের বাকেট হ্যাট, ওয়ালেট, সিগারেট সবকিছু বের করে অরুর হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বললো,
— ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কান্নাটা বন্ধ কর, নয়তো ফেলে চলে যাবো।

অরু নাক টেনে ক্রীতিকের জিনিস গুলো নিজের ব্যাগে ভরে নিলো। যেন ওই বহু বছর ধরে ক্রীতিকের গিন্নি দায়িত্ব পালন করে আসছে।
ক্রীতিক বাইকে বসে নিজে হেলমেট পরে আরেকটা হেলমেট বাড়িয়ে দেয় অরুর দিকে,
অরু করুন সুরে জিজ্ঞেস করে,
— এটাও ব্যাগে রাখতে হবে?

ক্রীতিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, নিজ হাতে অরুকে হেলমেট পরিয়ে দিতে দিতে বলে,
— স্টুপিড কি তোকে সাধে বলি???
.
নিশুতি রাতে পাহাড়ি আঁকাবাকা রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে বাইকটা। ঝিরিঝিরি মিষ্টি বাতাসে এতোক্ষণে বুকটা হালকা লাগছে অরুর। যদিও ভেতরের ক’ষ্টটা আকাশসম,তবুও ক্রীতিকের ভ’য়ে জোর করে কা’ন্না থামিয়ে রেখেছে ও।যার দরুন হেঁচকি ওঠাটাও বন্ধ হয়ে গেছে এখন। অরুর দুইহাত ক্রীতিকের কাঁধের উপর নিবদ্ধ । রাস্তার মোড় ঘুরতেই সেই হাতের বাধন বারেবারে শক্ত হয়ে ওঠে দিগুন তালে। এভাবেই যেতে যেতে একপর্যায়ে বহু সময়ের নিরবতা ভেঙে অরু শুধায়,
—- আপনি হঠাৎ পাহাড়ে কেন এলেন?
ক্রীতিক জবাব দেয় না, মনে মনে বলে,
— শুধু তোর জন্য…..
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here