সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি #পর্ব_৩ #লেখনীতে_suraiya rafa

0
384

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি
#পর্ব_৩
#লেখনীতে_suraiya rafa
.শুধু মাত্র প্রাপ্ত মনস্কদের জন্য।
.
রাস্তার দু’ধারে সারিসারি ম্যাপল গাছের বহর।বসন্ত হওয়ার দরুন টুপটাপ বৃষ্টি কনার ন্যায় গায়ে এসে একটু একটু বাসন্তিক ছোয়া লাগিয়ে উড়ে গিয়ে নিঃশব্দে পিচঢালা তকতকে রাস্তায় লুটিয়ে পরছে হলুদ কমলা রঙের ম্যাপল লিফ।
এমন দৃশ্য দেখতেই যেন প্রশান্তি খেলে যায় চোখে।আর ফরেইন কান্ট্রি থেকে এলেতো কথায়ই নেই,নিরব শুনশান রাস্তার ধারে ফাঁকা বেঞ্চিতে বসে বসন্ত বিকেলের একটু খানি সৌন্দর্য্য দেখে দেখেই পুরো যুগ পার করে দেওয়ার মতোই সস্থিতে দুচোখ ভরে ওঠে।

তবে এই মূহুর্তে রাস্তার দুই সাইডে দাড়িয়ে থাকা লোক সমাগমের কারোরই ম্যাপল লিফের সৌন্দয্য বিশ্লেষনে আগ্রহ নেই। বরং সুন্দর টকটকে ম্যাপল গাছের ফাঁক ফোকরে উচ্ছ্বাসিত জনতার ভীর যেন উপচে পড়ছে। তারা অন্যকিছু দেখার জন্য অধীর আগ্রহে সামনের রাস্তায় তাকিয়ে হাত নেড়ে যাচ্ছে নির্বিগ্নে সেই সাথে তাদের প্রবল উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে একই সুরে হইহই করে ওঠা প্রতিধ্বনিতে।ছেলে, বুড়ো যুবক যুবতী সবাই তাতে সামিল। দেখে মনে হচ্ছে তারা কোন পারফর্ম কিংবা প্রতিযোগিতা দেখার জন্য জমায়েত হয়েছে। শুধু যে এইটুকুনি যায়গা ধরে মানুষের ভীর এমনটা নয়, লোকালয় ছাড়িয়ে সানফ্রান্সিসকো শহরের গোল্ডেন গেইট ব্রীজ পেরিয়ে প্রশান্ত মহাসাগর আর পাহাড়ের মধ্যবর্তী সরু আঁকাবাঁকা রাস্তাটা যতদূর অবধি চোখে পরে,ঠিক ততোদূর পর্যন্তই উচ্ছ্বসিত মানুষের সমাগম।
সায়নী সিওর এই রাস্তা ক্যালিফোর্নিয়া অবধি চলে গিয়েছে।

মানুষের এতো আগ্রহ আর হইচই দেখে একটু কৌতুহল নিয়েই সামনে রাস্তায় ওদের দিকে এগিয়ে গেলো সায়নী।

ঠিক তখনই, হুট করে একদম হুট করেই বেশ কয়েকটা বাইক ভোঁ ভোঁ আওয়াজ করে তরিৎ গতিতে রাস্তা অতিক্রম করে চলে গেলো। বাইক গুলো এতোই তারাতারি চলে গিয়েছে যে সায়নি চোখে পলক ফেলা’র সময়টুকু অবধি পেলোনা।

বাইক গুলো রাস্তা ক্রস করতেই সবাই জেকে জেকে বলে চেঁচিয়ে উঠলো। সবার চিয়ারআপ আর উচ্ছ্বাস দেখে সায়নি বোধ করলো এখানে বাইক রাইডিং কম্পিটিশন হচ্ছে। কিন্তু এরকম ঠান্ডা আবহাওয়ায় পাহাড়ি রাস্তায় কিকরে এতো দ্রুত রাইড করছে এরা?? ভয় ডর নেই নাকি?? এগুলো দেখে আবার মানুষ আনন্দে নাচানাচি করছে,যেমন এরা তেমন এদের বিনোদন স্টুপিড আমেরিকান,ঠোঁট উল্টে মনেমনেই মেজাজ খারাপের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় সায়নী।

ও চলেই যাচ্ছিল তখন আবারও দ্বিতীয় বারের মতো হাওয়ার গতিতে ছুটে আসা বাইক গুলো রাস্তা ক্রস করে চলে যায়, তৎক্ষনাৎ সবার মুখে মুখে আবারও সেই জেকে নামের হিরিক পরে যায়।

— আচ্ছা জেকে কে??

কৌতূহলী মস্তিস্কে প্রশ্নটা আসতেই হাটার গতি থামিয়ে দিলো ও দাড়িয়ে থাকলো এই ভ’য়া’নক বাইক রেচিং শেষ হবার অপেক্ষায়।

টানা তিনবার একই ভাবে রাইড শেষে চারবারের সময় শেষ হলো কম্পিটিশন। পরপর সাতটা বাইক এসে একই যায়গায় থামলো। সায়নী জানে সবার আগে যে(kTM 390 adventure) বাইকটা পৌঁছেছে ওটাই জেকে রাইড করেছে।
কারন চারদিক থেকে ভেসে আসা জেকে নামের জয়জয়কার আর আনন্দ উচ্ছ্বাসই তার জানান দিয়ে যাচ্ছে।

তবে জেকে নামক লোকটা একটু অন্যরকম এতোএতো চিয়ারআপেও কোনোরূপ হেলদোল নেই তার, খুবই সাভাবিক মুখভঙ্গি,চ্যাম্পিয়ন হয়েও খুশির লেসমাত্র নেই তার মুখে। অথচ রানার আপ হওয়া বাইকারটা খুশিতে ফেটে যাচ্ছে। সেই খুশি তার মুখে চোখে জোয়ারের জলের ন্যায় উপচে পরছে।

জেকে হেলমেট খুলে উরুর উপরে সেটাকে সটান বসিয়ে দেয়, হেলমেট খুলতেই বেরিয়ে আসে তার স্টাইলিস ঘাড় ছুঁইছুঁই লম্বা চুল গুলো।ঘার অবধি চুলে তাকে জেন্টেলম্যান লাগছে না মোটেই বরং স্টাইলিস্ট সুপারস্টার বললে হয়তো মানানসই হবে বাক্যটা। মনে হচ্ছে ব্র্যান্ড নিউ বাইকের কয়েকদফা শ্যুট করে মাত্রই থেমেছে সে ।
ডানহাত দিয়ে বেখেয়ালে চুলগুলোকে ব্যাকব্রাশ করতে করতেই অন্য হাতে পরে থাকা অ্যাপেল ওয়াচটায় একনজর চোখ বুলিয়ে নিয়ে আবারও হেলমেটটা পরে নিলো সে।

ওদিকে চ্যাম্পিয়ন পুরস্কার বিতরণের জন্য স্টেজে তাকে বারবার ডাকা হচ্ছে। জেকে হেলমেট পরেই সেদিকে একবার চাইলো। আশ্চর্য্য সবাই ডাকছে তবুও কেমন বেখেয়ালি ভঙ্গিমা তার, শেষমেশ কতৃপক্ষের একজন তারকাছে এগিয়ে আসতেই জেকে বলে,

–ওয়েট আ মিনিট।

তারপর কাউকে কল করতেই কয়েক মিনিটের মধ্যে একটা কালো গাড়ি এসে থামলো ওখানে,
গাড়ি থেকে ফর্মাল ড্রেসকোর্ট পরিহিত একজন নামতেই, জেকে লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–লুক হি ইজ মাই এসিসট্যান্ড প্রত্যয় এহসান, গিভ হিম দা প্রাইজ মানি।

লোকটা বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকায়,
–আর ইউ কিডিং মি?

–নো আ’ম সিরিয়াস।

–দেন হোয়াই আর ইউ এটেন্ড দা গেইম?এন্ড রি’স্ক ইউর লাইফ?লোকটার কথায় বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট।

জেকে তীর্যক হাসলো, কাঁধ দুটো সামান্য উপরে তুলে ভাবলেশহীন মুখে বললো,
— ইউ নো?রাইডিং ইজ থ্রি’লিং অলসো ডে’ঞ্জা’রাস। এন্ড আই লাভ ডে’ঞ্জা’র আ লট।

শান্ত এবং স্থীর কন্ঠস্বর, তবে শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দেবার মতোই ভ’য়া’নক কথার টোন।
শেষ কথাটা বলে,চোখে বিশালাকৃতির রোদচশমা চড়িয়ে, শাঁই শাঁই করে নিজের( kTM 390) বাইক নিয়ে পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে মূহুর্তেই হারিয়ে গেলো জেকে। সবার দৃষ্টি এখনো সেদিকেই স্থীর। কতৃপক্ষের লোকটা বিরক্ত হলো,তবে চটে গেলোনা, এই ছেলে প্রতি বছর একটা না ঝামেলা পাঁকাবেই এটা তার বোধগম্য হয়ে গিয়েছে এতোদিনে, হয় কোনো প্রতিদন্দ্বিকে ইচ্ছে মতো পে’টাবে, নয়তো রাইডিং এর মাঝ পথেই বাইক ঘুড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে, আর না হলে প্রাইস গিভিং এ এসে ঝামেলা পাঁকাবে।
শুধু পপুলারিটির আর অডিয়েন্সের ডিমান্ডেই সারা বছর ঘুরে ঘুরে রাজি করানো হয় তাকে, নয়তো এমন আধপাগ’ল, র’গচটা ছেলেকে জীবনেও কম্পিটিশনে আনতেন না তিনি। বাপের বয়সই হোক কিংবা দাদার কারও কথার দু পয়সা সম্মান পর্যন্ত দেয়না এই ছেলে।

–সাচ আ সাই’কোপ্যাথ। বিরবিরিয়ে কথাটা বলে থমথমে মুখ নিয়ে নিজ স্থানে ফিরে গেলো লোকটা।

–এটিটিউড, এপেয়ারেন্স, গুড লুক এভরিথিং ইজ সো ম্যানলি। মুগ্ধ নয়নে ফাঁকা রাস্তার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো এক বিদেশিনী।
সায়নীর পাশেই মেয়েটা দাঁড়ানো।
ও মেয়েটার মুগ্ধতা দেখে একটু যেচেই জিজ্ঞেস করলো,

–হু ইজ হি?

মেয়েটা নে’শা লাগানো চোখে বললো,
— হি ইজ জেকে, দা চ্যাম্পিয়ন।

সায়নী মাছি তাড়ানোর মতো করে বললো,
–আই নো দ্যাট বাট….
সায়নীর কথাটা শেষ করতে হলো না, তার আগেই বিদেশিনী ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলে,
–ওহ হি ইজ ওয়াসিপ ঝায়ান খ্রিতিক। হি ইজ আ ভেরি গুড রাইডার।

বিদেশিনীর আধও আধও বাংলা শুনে সায়নী মুঁচকি হাসে, তারপর পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলে,
–হি লুকস ডিফরেন্ট।

বিদেশিনী ভ্রু কুঁচকায়।

সায়নী মনে মনে ভাবে, লোকটা দেখতে একেবারেই অন্যরকম, টকেটকে গৌড় বর্ন, শরীরের গঠন, চেহারা সব কিছুতে ব্রিটিশদের ছাপ স্পষ্ট,অথচ গোল ভাসমান কালো মনি যুক্ত চোখদুটো দেখলে যে কেউ বলবে এশিয়ান কোনো দেশের, কোনো এক সম্ভ্রান্ত গোত্রের উত্তরাধিকার সে, এটলিস্ট এটিটিউড তো তাই বলে।

বিদেশিনী এখনও তার ধূসর চোখে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে, সায়নী মেকি হেসে বলে নাথিং নাথিং, আই জাস্ট সে, হি ইজ সো হ্যান্ডসাম।

–ইয়াহ লুক লাইক আ হলিউড হিরো।

বাই’দা ওয়ে হটস ইওর নেম?

বিদেশিনী সম্মোহনী হাসি দিয়ে জানায়,
— ক্যাথলিন ক্রিসটিয়ান। ইওর?

–আ’ম সায়নী মুখার্জি।

— ওহ আর ইউ ফরেইনার?

— ইয়াহ আ’ম ফ্রম ইন্ডিয়া।

তারপর নিজেদের মধ্যে আরও কিছু কুশল বিনিময় হয় ওদের। এক পর্যায়ে সায়নী জানতে পারে ক্যাথলিন জেকে কে মোটামুটি পার্সোনালি চেনে। আর জেকে আসলে ব্রিটিশ ফ্রিটিশ কিছু নয়,বরং আমেরিকান সিটিজেন ধারী আদ্যপান্ত বাঙালি পুরুষ। তাহলে এই ছেলের চেহারায় এতোটা ভীনদেশী ছাপ কেন? প্রশ্নটা থেকেই গেলো সায়নীর কৌতুহলী মনে।

*************************************
টানা দু’দিন হতে চললো মামিরা বিদেয় হয়েছে। অরু জানতো অনু বাড়িতে ফিরলেই ঝামেলা শুরু হবে, আর হয়েছেও সেটাই।
মামির গা জালানো কথা অরু চুপচাপ মেনে নিলেও অনু খালি মুখে সহ্য করতে পারে না মোটেই, কারন আর যাই হোক মাকে হাসপাতালের এক কামরার বেডে শুয়িয়ে রেখে তার পক্ষে বিয়ের পিঁড়িতে বসা সম্ভব নয়, রেজার মতো পাতি মা’স্তানের সাথে তো নয়ই।

মামিকে এসব মুখের উপর বলে দেওয়া মানে ভ’য়াব’হ ঝড়ের পূর্বাভাস, আর তাই হলো কথায় কথায় গমগমে হয়ে উঠলো পুরো মহল,একপর্যায়ে কথাকা’টাকা’টি থেকে শুরু হয়ে গেলো বিশাল ত’র্ক ।

অনুর মেজাজ সর্বক্ষনই তুঙ্গে থাকে, এই মূহুর্তে মামির কথার আ’ঘাত তার মধ্যে চরম বিরক্তি আর উত্তেজনার সৃষ্টি করলো, শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পরলো অযাচিত ক্ষো’ভ আর রাগ, রাগের মাথায় হলরুমের কাঁচের জিনিস গুলো একটা একটা করে আঁ’ছার মেরে ভা’ঙতে লাগলো সে।
হলরুমে ঝনঝন করে কাঁচ ভা’ঙার আওয়াজ শুনে অরু নিজের কা’ন্নাকাটিতে লাগাম টেনে বাইরে বেরিয়ে এলো,দেখলো তার ভদ্র,শান্ত, আর নরম মনের আপার সবচেয়ে ক্ষু’ব্ধ রূপ।
ওর এমন রাগ দেখে মামি যে খানিকটা ভরকে যায়নি এমন নয়, তবে সেও দমে যাওয়ার পাত্রি নন,তার ক্ষি’প্ত মুখশ্রী দেখে মনে হচ্ছে এর শেষ দেখেই ছারবেন তিনি।

অবশেষে পরিস্থিতি সামাল দিতে, রেজা নিজের মাকে নিয়ে তৎক্ষনাৎ ক্রীতিক কুঞ্জ থেকে বিদায় নেয়।

–আর কখনো আসবেনা তোমরা…
ওরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনু গিয়ে ঝনাৎ করে মহলের সদর দরজা আটকে দেয়,তারপর নিজের রুমে ঢুকে কক্ষ বন্ধী করে নয় নিজেকেও।

অরু দৌড়ে যায় বোনকে আটকানোর জন্য, তবে সেটা বড্ড দেরি হয়ে যায়, তার আগেই সপাটে দরজার খিল আটকে দেয় অনু।
অরু জানে তার আপা আজ রুম থেকে বের হবে না, অরু ডাকতে ডাকতে বেহুশ হয়ে গেলেও না। তবু ও কিছুক্ষন ধরে ডাকাডাকি করে ক্ষান্ত হয়ে ফিরে যায় অরু।সে রাতে দু বোনের কারোরই আর খাওয়া হলো না।
পরেরদিন সকালে নিজ হাতে নাস্তা,মায়ের জন্য স্যুপ সব কিছু বানিয়ে অরু আবারও কড়া নারলো অনুর দরজায়।
এবার অনু দরজা খুললো, পড়নে স্যুতি চুড়িদার হাতে টোটে ব্যাগ, লম্বা চুল গুলোতে এটে আছে সুন্দর ফ্রেন্স বেনি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য একেবারে তৈরি হয়েই বেরিয়েছে সে।
আপাকে পরিপাটি হয়ে বেরোতে দেখে বিমূর্ষ চোখ দুটো খুশিতে টইটুম্বুর হলো অরুর।
অনুকে প্রশ্ন করার কোনো অবকাশ না দিয়েই অরু একেরপর এক বলতে লাগলো,
–টেবিলে নাস্তা রেডি, মায়ের স্যুপ হটপটে ভরে রেখেছি, আর ইমেইল ওও পাঠিয়ে দিয়েছি।
চল একসাথে খাবো,

কথা শেষ করে অরু সামনে হাঁটা ধরতেই, ওর হাত টেনে ধরে ওকে বুকে জড়িয়ে ন্যায় অনু। আপার রাগ কমেছে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে, খুশিতে পুলকিত হয়ে শক্ত হাতে বোনের গলা জড়িয়ে ধরে অরু নিজেও।
— আপা তুই কেন বদলে গেলি বলতো, কাল তোর রা’গ দেখে আমি নিজেও ভ’য় পেয়ে গিয়েছিলাম।

অনু ঠোঁট টিপে মুচকি হাসে, তারপর বলে,
— বিশ্বাস কর আমি একটুও বদলাইনি,স্বজন রূপী কাল সা”প গুলোকে বের করার জন্যই একটু বেশিবেশি করেছি, নইলে কতদিন পরে পরে আমাদের মাথা খেতো কে জানে??

— তোর কি বুদ্ধি আপা,জিনিয়াস।

অনু আবারও হেসে বলে, হয়েছে, কাল থেকে কিছুই খাইনি,চল নাস্তা খাবো, নয়তো মায়ের কাছে যেতে লেট হয়ে যাবে।
অরু আনমনে বলে,
–আমার আপার হাসি সব চেয়ে সুন্দর নিখিল ভাইয়ের চেয়েও।
************************
নিখিল ভাই, নামটা মস্তিস্কে গিয়ে ঠেকতেই দুদিন আগের ভাবনার ইতিটানে অরু। সকালে ঘুম থেকে উঠে ইমেইল পাঠাতে গিয়েই সেদিনের কথা গুলো ভাবছিল ও,তারপর সেদিন সকাল থেকে বিকেল অবধি ঘটে যাওয়া কুৎ’সিত ঘটনা গুলো একেএকে হানা দেয় আনমনা মস্তিষ্কে।

আজ শুক্রবার আপা একটু দেরি করেই হাসপাতালে যাবে আজ, অরু রাতেই বলে রেখেছিল যে সেও মাকে দেখতে যাবে। তাই খুব সকালে উঠেই ইমেইলের কাজ সেরে ফেলছে ও।
তারপর একটা লম্বা শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে যখন মোবাইল হাতে নিলো দেখলো নিলীমার অনেকগুলো মিসডকল ভাসছে।
–নিলীমা কল দিয়েছে, তারমানে ইম্পরট্যান্ট কিছুই হবে, কিন্তু কি??

অজানা অনেক প্রশ্নে আবারও মাথাটা ধরে এলো অরুর,কিন্তু ও এতো ভাবতে চায়না,তাই তারাহুরো করে নিলীমাকে কল ব্যাক করলো।
একবার রিং হয়েছে কি হয়নি,তারমধ্যেই নিলীমা কল তুললো।

— কি হয়েছে নিলীমা, এতো গুলো কল দিলি তুই ঠিক আছিস?

— আমি ঠিকই আছি, তুই ঠিক আছিস কিনা সেটা বল, আচ্ছা তুই এমন কেন? দিন দুনিয়া ভুলে হিমালয় পর্বতের সন্ন্যাসীনি হয়ে যাস, নাকি মহাসমুদ্রে ডুব দিস কোনটা বল আমাকে?

— কি অদ্ভুত প্রশ্ন নীলিমা,আমি কেন এসব করতে যাবো? শোন আমার বিয়ে করে সংসার করার বহুত শখ সন্ন্যাসী টন্ন্যাসী এসব কথা ভুলেও বলবি না।

— তাহলে ফোন কেন তুলিস নাআআআ।বিরক্তিতে চিৎকার দিয়ে উঠলো নিলীমা।

— আহ আস্তে বল কানে লাগছে তো, আর ফোন সাইলেন্ট মুডে ছিল।

— তাহলে তুই কেন বসে আছিস এখনো? তুই ও সাইলেন্ট মুডে চলে যা, আর তোর শখের নিখিল ভাই আমেরিকা গিয়ে কোন এক সাদাচামড়ার মেয়েকে বিয়ে করে সুখে ঘর সংসার করুক।

–কি হয়েছে নিলীমা?
অরুর কন্ঠে দৃঢ়তা আর সচকিত ভাবটা স্পষ্ট।

–নিখিল ভাই আজই চলে যাচ্ছে, এতোক্ষণে হয়তো এয়ারপোর্টের কাছাকাছি চলেও গিয়েছে, এটাই তোর শেষ সুযোগ অরু, আমি আর তিথি মেইন রাস্তায় সিএনজি তে ওয়েট করছি তারাতারি চলে আয়, নয়তো এ জীবনে আর নিখিল ভাইকে দেখতে পাবি না তুই।

নিখিল ভাইয়ের সাথে আর দেখা হবেনা, টোল পরা মন ভুলানো হাসিতে মাতোয়ারা হবেনা হৃদয়টা, নিখিল ভাইকে ছাড়া ক্যাম্পাসটাই তো ম”রে যাবে, হৃদয়টা হাড়হীম করা ব্যাথায় শক্ত হয়ে এসেছে অরুর, এবার আর অজান্তে নয়, জেনে শুনেই ফু্ঁ’পিয়ে কেঁ’দে উঠলো ও। মোবাইলের নেটওয়ার্ক ছাপিয়ে সেই ফোঁ’পানোর আওয়াজ গিয়ে পৌঁছালো নিলীমার কানেও।

— দ্রুত চলে আয়, শেষ বারের মতো দেখা হয়েও যেতে পারে,নিঃসংকোচে কথাটা বলে কল রেখে দিলো নিলীমা।

নিলীমার শেষ কথাটা কর্নকূহরে পৌছাতেই অরু আর কা’ন্নাকা’টি করে সময় নস্ট করলো না, টেবিল থেকে পার্সটা ছো মেরে নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
নিখিল ভাই চলে যাচ্ছে যাক, কিন্তু মনের কথাটা তো একটাবার শুনে যাক, নিজের একপাক্ষিক ভালোবাসার কোন প্রতিদান চায়না অরু,শুধু শেষবারের মতো মুখ ফুটে বলতে চায়, দিনের পর দিন নিজের মন গহীনে বোনা মাকড়শার জালের ন্যায় ঠুনকো সপ্ন গুলোর কথা।
এই মূহুর্তে অরুর অষ্টাদশী মন বলছে তাকে মন গহীনের সুপ্ত ভালোলাগার কথা না জানালে জীবনটাই বৃথা।

অনু কেবলই খাবার দাবার হটপটে ভরে রেডি হয়ে নেমেছে, তখনই দেখতে পায় হনহন করে কোথাও বেরিয়ে যাচ্ছে অরু।

–কিরে কোথায় যাচ্ছিস, হাসপাতালে যাবিনা?

অরু জবাব দেয়না, এক প্রকার ছুটে বেরিয়ে যায় বাগানবিলাসে ঘেরা ক্রীতিক কুঞ্জ থেকে।
অনুর অযাচিত মন আনমনে বলে,
–ইমেইলটা পাঠালো কিনা কে যানে? চেক করে দেখতে হবে।
**********************************
মানুষ জীবনে আশা নিয়ে বাঁচে, আশা বিহীন এই উত্থান পতনের জীবনে বেঁচে থাকা দূ’রহ বৈকি আর কিছুই না। সবাই দিন শেষে ভাবে নতুন প্রহর তার জন্য নতুন সুখ বয়ে আনবে। কিন্তু কখনো কখনো সেই নতুন প্রহর আসতে বড্ড দেরি হয়ে যায়, সেই সাথে হারিয়ে যায় সুখের আশাটুকুও। এখন এই মূহুর্তে দাড়িয়ে অরুর সুখের আশা’টাও হারিয়ে গিয়েছে,নীলাম্বর আকাশের কোন একফালি শুভ্র মেঘের আড়ালে।খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে কাঁ’দছে অরু। হৃদয়টা এবার সত্যি সত্যি ফাঁকা লাগছে, নিখিল ভাইয়ের সাথে শেষ দেখাটা হলোনা আর। এয়ার্পোটের সামনে এমন কা’ন্নারত মেয়েটাকে দেখে অনেকেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়।আবার অনেকেই ভাবছে হয়তো কাছের কেউ দূরদেশে পারি জমিয়েছে সেই দুঃখেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। তাতে অবশ্য অরুর যায় আসেনা,আপাতত হিতাহিত জ্ঞানশূন্য ওর মস্তিষ্ক। ও উড়ন্ত প্লেনের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,

–আমি আপনাকে ঠিক খুঁজে বের করবো নিখিল ভাই, আপনার আমার আবারও দেখা হবে, আমি ইউ এস এ যাবো,আপনার জন্য হলেও যাবো, ওই জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী না নিলেও যাবো।

–হয়েছে অরু থাম এবার।

তিথি ওকে থামাতে ব্যাস্ত, কে জানতো অরুর মতো চুপচাপ সভাবের মেয়েটা এভাবে কেঁ’দে কে’টে দুনিয়া ভাসাবে, তাহলে হয়তো ওরা এই প্ল্যান কোনোকালেই করতো না।

আবারও একই নাম ক্রীতিক জায়ান চৌধুরী। নিলীমা বুঝতে পারেনা ব্যাপারটা, তাই সচকিত হয়ে প্রশ্ন ছু’ড়ে,

— আচ্ছা অরু তুইতো শেখ, তাহলে তোর ভাইয়া চৌধুরী কেন??

অরু কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে বলে,
–ওই বদমা’শ লোকটা আমার ভাইয়া না, ইভেন কিছুই না আমাদের।

–তাহলে, তাকে কেন ইমেইল পাঠাস প্রতিদিন?

— তাকে পাঠাইনা তো, জেকে গ্রুপের হেড অফিসে পাঠাই, মায়ের অসু’স্থতা জানানোর জন্য, শুধু মাত্র জায়ান ক্রীতিকের এপ্রোভালের জন্যই সবটা আটকে আছে যে।আবারও কা’ন্নায় ভিজে আসে অরুর দু-চোখ।

— তাহলে কে সে??

— আমরা একটা অমিমাংশিত সম্পর্কে আটকে আছি নিলীমা, আমার যখন আট বছর বয়স তখন মায়ের সাথে ক্রীতিক কুঞ্জে প্রথম পা রাখি আমরা দু বোন।তখন ওনার বয়স কতইবা হবে বিশ বছর।উনি আমার থেকে প্রায় বারো বছরের বড়। আমার মা, জায়ান ক্রীতিকের বাবা মানে জামশেদ জায়ানের দ্বিতীয় স্ত্রী।
শুনেছি ওনার দাদাসাহেব জোর করে ওই বয়সে দ্বিতীয় বার বিয়ে করিয়েছিলেন ওনার বাবাকে কোন এক কারনবশত।

তিথি আর নিলীমা একই সুরে বলে,
— তার মানে তোদের সাথে ওনার র’ক্তের কোন সম্পর্ক নেই??

অরু এদিক ওদিক না সূচক মাথা নাড়িয়ে বলে
–না নেই, তবে ওনার বাবার অবর্তমানে আমার মা’ই জেকে গ্রুপের চেয়ারম্যান।

তিথি বললো,
— আচ্ছা অরু উনি দেশে আসেন না।আই মিন বাড়িটা তো ওনার।

অরু না সূচক মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলো,
— গত আট বছর ধরে আসেনি, বছর তিনেক আগে যখন ওনার বাবা মা’রা গেলেন তখন নাকি এসেছিলেন, তবে বাড়িতে প্রবেশ করেননি, বাইরে থেকেই দাফন কাফনের কাজ সেরে সেদিনের ফ্লাইটেই চলে গিয়েছেন।

তিথি ঠোঁট উল্টে বললো,
— বুঝেছি তোদের উনি একটুও পছন্দ করেননা, সেই জন্যই তো নিজের বাড়িতে পর্যন্ত আসেননা।যতই হোক তোরা হলি ওনার সৎ মায়ের আগের পক্ষ।

অরু ঠোঁট উল্টে বললো,
–কি জানি।

তখনই হঠাৎ করে মোবাইল স্ক্রীনে অনুর নাম্বার ভেসে ওঠে।
সচকিত হয়ে ওঠে অরু, সেই সাথে অকস্মাৎ ভেঙে যায় অবচেতন মস্তিস্কের ধ্যান। আসপাশটা অবলোকন করে বুঝতে পারে ও কত বড় বোকামি করেছে, গভীর থেকে গভীরতর গোপনীয় কথাটা তরতর করে সাজিয়ে গুছিয়ে বান্ধবীদেরকে বলে দিয়েছে। এবার তো তিথি আর নিলীমাও ওকে কচুরিপানা অথবা পরগাছা উপাধি দেবে।

–আচ্ছা তাহলে তোর বাবা কোথায়??

অরু আর জবাব দেয়না,বরং আড়ালে শুষ্ক ঢোক গেলে,
— আপা কল করছে আমি আসি। এই বলে দ্রুত প্রস্থান করে অরু।

তিথি আর নিলীমা পেছন থেকে উদগ্রীব হয়ে বলে, আরে আরে এভাবে টলতে টলতে কই যাচ্ছিস পরে যাবিতো।

অরুর তাতে ধ্যান নেই, ওও যতদ্রুত সম্ভব ওদের চোখের আড়াল হতে চায়।

******************************
একরাশ ভারাক্রা’ন্ত মন আর নিজের করা বোকামিতে বিরক্ত হয়ে দ্রুত বাড়ি ফেরে অরু।
সদর দরজা পার হতেই অনুর হাতের শক্ত চপ’টা’ঘা’তে আবারও বিশ্বয়ে বিমূঢ় হয়ে ওঠে ওর মুখশ্রী। মনে মনে একটাই প্রশ্ন আওরায় নিজেকে

–কি করেছি আমি? আমার উপরেই কেন পৃথিবীর সবার এতো রা’গ??
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here