সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁 #পর্বঃ০৬ #লেখনীতেঃsuraiya_rafa

0
47

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ০৬
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
প্রাপ্ত মনস্কদের জন্য।

সানফ্রান্সিসকো থেকে মাইল ত্রিশেক দুরে ছোট্ট নির্জন এই শহরতলীর আবহাওয়া বরই অদ্ভুত। সপ্তাহে বড়জোর দু-একটিবার রোদের মুখ দেখা যায়, বাকিটা সময় ঘুটঘুটে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ নয়তো কুয়াশা ঢাকা ঝাপসা প্রকৃতি,তারউপর হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডাতো আছেই।
ঘরের মধ্যে কৃত্রিম তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন ব্যাবস্থা থাকায় সেই হীমধরা শীত ছুতে পারেনা মানুষের শরীর। মাইনাস জিরো ডিগ্রিতেও এদেশের মানুষের কর্মব্যাস্ত জীবন অনড়।

কিন্তু একা একা এভাবে, রুমের মধ্যে বসে বসে ঠিক কতক্ষণ থাকা যায়? গত দুদিন ধরেই এভাবে কাটাচ্ছে অরু। খাও, দাও আর ঘুমাও। আপাও সকাল হতে না হতেই হসপিটালে ছোটে। ক্রীতিক বাড়িতে থাকা না থাকা একই কথা, সে কখন আসে কখন যায় সেই ধারণাটুকু পর্যন্ত নেই অরুর। তাছাড়া এই ব’দমেজাজি লোকের সাথে মুখ দেখাদেখি না হওয়াটাই ভালো, এককথায় গুড লাক।

রুমের মধ্যে এদিক ওদিক পায়চারি করছে অরু। অলস মস্তিষ্কটা ভাবছে কি করা যায়? কিভাবে সময় কাটানো যায়, তখনই গুরুদায়িত্ব মনে পরার মতোই মনে পরে যায় নিখিল ভাইয়ের কথা। গত দু’দিনে অরুতো ভুলেই গিয়েছিল নিখিল ভাইয়ের সাথে একই দেশে আছে ও।
— কিন্তু মাত্র এই কয়েকদিনের দুরত্বে কিভাবে আপনাকে ভুলতে বসলাম আমি নিখিল ভাই?

ওর অবচেতন মস্তিস্ক বললো,
–ভালোবাসলে ভোলা যায়??

— তারমানে কি আমি তাকে ভালোবাসিনা? না না কি ভাবছি এসব। ভুলভাল চিন্তাদের দূরে ঠেলে দিয়ে নতুন ভাবনা সংযোজন করলো ও, —যে করেই হোক নিখিল ভাই কে খুঁজে বের করবো আমি।কিন্তু কিভাবে?

তখনই চোখ গেলো বেড সাইড টেবিলে অযত্নে পরে থাকা মুঠো ফোনটার দিকে, যেটা গত দু’দিন ধরে বন্ধই পরে আছে।
অরু এগিয়ে গিয়ে ফোনটা হাতে তুলে নিলো, মনে মনে ভাবলো এটাকে চার্য দিয়ে লাভ নেই কারণ ওর কাছে সিমকার্ড নেই।
তাহলে এবার কি হবে??

অরু পা দুলিয়ে খাটে গিয়ে বসে পরে। তারপর ভাবতে ভাবতে আনমনে বলে,
— আমাকে ধাপে ধাপে এগোতে হবে, সবার আগে নিখিল ভাইয়ের ভার্সিটি খুজে বের করতে হবে, আর সেটা জানতে হলে তিথিকে কল করতে হবে, একমাত্র ওই জানবে নিখিল ভাই কোন ভার্সিটিতে হায়ার স্টাডিসের জন্য এসেছে। তারপর এড্রেস নিয়ে সোজা নিখিল ভাইয়ের মুখোমুখি।

কথাটা ভেবেই লজ্জায় নিজের মুখে দু-হাত চেপে মু্ঁচকি হাসে অরু।

—কিন্তু তিথির সাথে যোগাযোগ করার উপায় কি??
বুদ্ধিদীপ্তদের মতো চোখ জোড়া বড় করে অরু বললো আইডিয়া, এতোবড় বাড়িতে নিশ্চয়ই একটা ল্যান্ডলাইন থাকবে? হ্যা থাকবেই, শুধু খুজে বের করতে হবে।নিজেকেই নিজে আস্বাস দিলো ও।
তারপর আর দেরি করলো না, তৎক্ষনাৎ ডায়েরির পাতা থেকে তিথির নাম্বার টুকে রাখা পৃষ্ঠাটা ছিড়ে নিচের দিকে ছুট লাগালো নতুন কোন সুযোগের আশায়।
*************************************
বেখেয়ালি অরু একপ্রকার নাচতে নাচতেই নিচে নেমে এলো। তবে শেষ সিঁড়িটা পেরোতেই ওর পায়ের উদ্যম গতি থেমে গেলো,সেই সাথে হাস্যোজ্জল মুখটাও চুপসে গিয়ে থমথমে দৃশ্য ধারণ করলো।
অন্ধকার হল রুমে, কালকের মতোই ডিভানে বসে টি টেবিলের উপর দু’পা তুলে বাইক রাইডিং ভিডিও গেইম খেলছে ক্রীতিক।

অরু মনে মনে বিরক্ত হলো,
—এতো বড় হয়েও সারাদিন ভিডিও গেইম খেলে এই লোক,আশ্চর্য অফিস টফিস নেই নাকি?
আবার হতেও পারে কোটি পতি বংশের একমাত্র উত্তরাধীকারী মি.কুম্ভকর্ণ।

নিজের মনের কথায় নিজেই ঠোঁট টিপে হেঁসে ওঠে অরু।
সঙ্গে সঙ্গে মনিটরের গেইমটা পজ হয়ে যায়।
ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড,তারপর গম্ভীর স্বরে বলে,

— হোয়াট হ্যাপেন্?? এভাবে হাসছিস কেন? আমি বয়সে তোর থেকে ঠিক কত বছরের বড় তুই জানিস?

অরুর হাসি থেমে যায়, চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার তার সাথে নিস্তব্দ পরিবেশ, কেবল মনিটর থেকে আসা মৃদু আলো ছাড়া আর কোনো আলোই জলছে না হল রুমে।জানালা থেকে শুরু করে, কাচের দেওয়ালের পর্দাটা পর্যন্ত টেনে দেওয়া।
এমন পরিবেশে ক্রীতিকের রাগি আওয়াজ বেশ ভ’য়ানকই ঠেকলো অরুর কানে।
আর এই মূহুর্তে ক্রীতিক যে, ওর দিকে চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে,ব্যাপারটা ভয়ের উপর যা থাকে সেখানে গিয়ে পৌঁছেছে। অরু এই নিরবতা ভাঙতে চাইলো,তাইতো নিস্তব্ধতা কাটিয়ে রিনরিনে আওয়াজে বললো,
— আ..আপনার অফিস নেই?

— কোন অফিস??

— এমা, কি বলছেন আপনাদের কোম্পানি, জেকে গ্রুপ।ওয়েট “জেকে “তারমানে কোম্পানিটা আপনার নামে আর কালকে ওই ভাইয়াটা আপনাকেই ডাকছিল, জায়ান ক্রীতিককে ছোট করে জেকে।

আঙুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে অরুর করা বিশ্লেষণ ক্রীতিক শুনেছে কি শোনেনি কে জানে?

ওও আবারও মনিটরে নজর দিয়ে বললো,
— আমার সামনে একদম হাসবি না তুই। তোর হাসিটা বি’শ্রী লাগে আমার।আর ওটা আমার নয়, তোর মায়ের অফিস। আর না ওখানে আমি বসি, তুই চাইলে অবশ্য বসতে পারিস।

অরু মনে মনে ভরকায়,
—কি বলে এই লোক। আমি কেবল কলেজ পাশ করে এডমিশন নিলাম,উনিকি ঠাট্টা করছেন, মানুষ এতো সিরিয়াস ফেস নিয়েও ঠাট্টা করতে পারে? অদ্ভুত।

অরু আর ঘাটায় না ক্রীতিককে বেশি ঘাটালে হুট করে কি জানি কি অপ’মান করে বসে তার ইয়ত্তা নেই। তাই অরু কথা ঘুরিয়ে বলে।
— বলছি যে লাইটটা জ্বালাতাম, একটু কাজ ছিল।
— নো। সচকিত জবাব আসে ক্রীতিকের দিক থেকে।
— কিন্তু কেন?
— আমার অন্ধকার ভালো লাগে তাই,যা করার এই অবস্থাতেই করে যা।

হালকা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো অরুর বুক চিড়ে, ক্রীতিক বলেছে মানে, সে কথা এক চুলও নরবে না।তাই অন্ধকার হাতরেই ল্যান্ড ফোনের সামনে গিয়ে সফেদ কার্পেট বিছানো মেঝেতে বসে পড়লো অরু। কাগজ থেকে খুব সাবধানে নাম্বারটা টুকে,কল লাগালো তিথির নাম্বারে।
কয়েকবার রিং পরতেই কল ধরেছে তিথি বাংলাদেশে তখন রাত দশটা কি এগারো তবুও কথা শুনে মনে হচ্ছে ঘুমে কাতরাচ্ছে তিথি।
— তিথি আমি অরু বলছি। কেমন আছিস?

তিথি চমকায়, একেতো বিদেশি নাম্বার তার উপর দেশে থাকতেই সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল অরু, এখন হুট করেই আবার কেন কল দিলো?

তিথি কিছু বলবে তার আগেই অরু বলে,
—তিথি আমার তোর সাথে অনেক কথা আছে সব খুলে বলবো তোকে,তার আগে ছোট্ট একটা ইনফরমেশন দে, নিখিল ভাই কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য ইউ এস এ এসেছে?

তিথি ওপাশ থেকে কি বললো,সেটা শোনা না গেলেওও আপাতত মনিটরে এতোক্ষণ ধরে নির্দ্বিধায় চলতে থাকা বাইকটা ব্রে’ক ফে’ইল করে বি’দ্ধস্ত হয়ে পরে আছে।পর্দায় বড় বড় অক্ষরে লেখা উঠেছে “গেইম ওভার”।

কেন যেন হুট করে ফুপিয়ে কেঁ’দে উঠেলো অরু,

— কাঁ’দতে কাঁ’দ’তে অসহায়ের মতো করে বলছে, তিথি তুই কি ড্রাং’ক এভাবে কেন কথা বলছিস, তুই কি কোন বা’জে ছেলেদের পাল্লায় পরেছিস??বলনা?

ওপাস থেকে টলতে টলতে তিথি বললো, —বেশ করেছি বলেছি, তুই আমার বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা রাখিসনা। আমাদের ফ্রেন্ডশীপটাকে কোনোকালেই গুরুত্ব দিস নি তুই, উল্টে সবসময় আমাকে আর নিলীমাকে ইউজ করে গেছিস,এটা বল, ওটা বল,এটা জানা, সেটা জানা, কেনরে আমিকি তোর চাকর ?? তোর ইনফরমেশন কালেক্ট করাই কি আমার কাজ?? তারউপর সবসময় এমন ভাব করে এসেছিস যেন তুইই পার্ফেক্ট, তুইই ক্রীতিক কুঞ্জের মালকীন। আর আমরা কি? লেইম?

—কি বলছিস এসব তিথি, তোর মাথা ঠিক আছে?

খানিকটা তাচ্ছ্যিল্যে হেসে তিথি আবারও বলে –আরেহ তুইতো আসলেই কচুরিপানারে।আমার মাথা ঠিক আছে কি নেই সেটা জিজ্ঞেস করার তুই কে? আমিতো এই ভেবে তোকে বন্ধু বানিয়েছিলাম যে তুই অতবড় বাড়ির মেয়ে,পুরান ঢাকার নামকরা রিয়েলএস্টেট ফ্যামিলি বিজনেস তোদের। ওমাই গড। কিন্তুু তুই তো আসলে ওবাড়ির কেউই নস, আশ্রিতা মাত্র, তোদের জন্য ওই বাড়ির একমাত্র ছেলে জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী নিজ বাড়িতে পা রাখেনা পর্যন্ত।তাহলে ভাব তোরা কত নিচ। আর তোর সাহস দেখে তো আমি রীতিমত অবাক হচ্ছি,তুই কিনা নিখিল ভাইয়ের খোজ করছিস? তুই জানিস নিখিল ভাই কতবড় সাইন্টিস্ট হবে? তুই তার নখের যোগ্যতাও রাখিস না অরু। তাই তোর ভালোর জন্যই বলছি ওনার বউ হওয়ার যে দিবাস্বপ্নটা দেখছিস না? সেটা এবার বন্ধ কর।আর যাই হোক নিখিল ভাইয়ের মতো হাই স্ট্যাটাসের ছেলে অন্তত, তোকে বিয়ে করবে না।

অরু চোখ দুটো বন্ধ করে সমস্তটা শুনে গেলো। এই ভ’য়টাই তো পেয়ে এসেছিল এতো গুলো বছর ধরে। আজ এতো দুরে এসেও সেই ভ’য় থেকে পালাতে পারলো না ওও। ঠিকই মুখোমুখি হয়ে গেলো তি’ক্ততায় পরিপূর্ণ কিছু চড়ম সত্যের।
নিস্তব্দ শুনশান হল রুমে অরুর ফোঁ’পানির আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
অরু কান্না ভেজা গলায় আরও একবার তিথি কে অনুরোধ করলো,
— প্লিজ তিথি তুই আমাকে যা খুশি বল আমি শুনবো, শুধু নিখিল ভাইয়ের ভার্সিটির নামটা বল প্লিইইজ। তুই না বললে আমি আর কোনো দিনও নিখিল ভাইকে খুঁজে পাবোনা।

—রিডিকিউলাস

ওপাশ থেকে এতোটুকুই শোনা গেলো, তারপর শুধু কল কে’টে যাওয়ার পিঁক পিঁক আওয়াজ হলো।

অরুর কি হলো কে জানে, আশেপাশে কে আছে কে নেই, কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে কল কা’টতেই হুহু আওয়াজ করে কেঁ’দে উঠলো। হয়তো নিজের ঘনিষ্ট বন্ধুর কাছ থেকে এই তিরস্কারটা মোটেই হজম করতে পারেনি ও।

আধারে ঢাকা বদ্ধ ঘরে সেই কা’ন্নার আওয়াজ বরই ব্যা’থাতুর শোনালো। লম্বা সিল্কি চুল গুলো পুরো মেঝে জুড়ে ছড়িয়ে আছে, দু’হাত মেঝেতে রেখে তাতে নিজের ভর ছেড়ে দিয়ে অনর্গল কাঁ’দছে অরু।কা’ন্নার তোপে শরীরটা বারবার ঝাঁকি দিয়ে উঠছে, সেই তালেতালে মৃদু রিনঝিন শব্দ করছে পায়ে আটকে থাকা নুপুর জোড়া।পেছন থেকে ওর কালো মেঘের মতো ঘন চুল দেখে যে কেউ বলবে ডিজনি প্রিন্সেস রুপাঞ্জেল তার সবচেয়ে দুঃখের সময় পার করছে।

কিন্তু সবার দৃষ্টিভঙি এক নয়, ধ্যান ধারণাও এক নয়,কারও ক্ষেত্রে হৃদয়টা হয় বরফের মতোই নির্জীব আর অনুভূতিহীন।সামান্য কা’ন্নাকা’টি দিয়ে সেই বরফ গলানো দুষ্কর।

এই যেমন অরুর কান্নাকাটিও পাশের ডিভানে বসে থাকা ক্রীতিকের হৃদয় ছুতে পারলোনা। ওও হুট করেই একটা অদ্ভুত কাজ করে বসলো।
নিজের যায়গা ছেড়ে উঠে এসে অরুর হাতে হ্যাঁচকা টান মে’রে ওকে জো’র করে দাঁড় করিয়ে দিলো। তারপর ওই হাত ধরেই টা’নতে টান’তে দরজার বাইরে বের করে দিয়ে বললো,

— আউট।

অরু কিছু বুঝে ওঠার আগেই শব্দটা উচ্চারণ করে ধাপ করে দরজা আটকে দেয় ক্রীতিক।
তারপর ভেতরে গিয়ে মেঝেতে পরে থাকা কাগজের টুকরোটা তুলে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে, পকেট হাতরে ফোন বের করে কাউকে কল লাগায়,
— আমি একটা নাম্বার ফরওয়ার্ড করেছি তোকে, এর এ টু জেট সব ইনফরমেশন চাই।এস সুন এস পসিবল।

বাইরে এলোপা’থারি ঠান্ডা হাওয়া বইছে। শুধু ঠান্ডা বললে ভুল হবে মা’রাত্মক ঠান্ডা। আকাশটাও মেঘাচ্ছন্ন যখন তখন বৃষ্টি চলে আসতে পারে, এতো ঠান্ডা সয়ে অভ্যাস নেই অরুর তারউপর ওর পরনে কোনো শীতের কাপড়ও নেই, এককথায় জা’ন যায় যায় অবস্থা। অরু একটু সময় নিজের কা’ন্নাকা’টি থামালো, তারপর দু’হাত দিয়ে সজোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলো।
ক্রীতিক বয়সে অরুর চেয়ে অনেক বড়, তারউপর সম্পর্কটা এতোটাও সহজ নয় ওদের, তাই কখনোই ক্রীতিককে কিছু বলেনি ডাকেনি অরু। কিন্তু এই মূহুর্তে একটু দ্বিধা নিয়েই ডাকতে শুরু করলো ও।
— ভাইয়া, ক্রীতিক ভাইয়া, দরজা খুলুন না, আমি ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি তো। ভাইয়াআআ।

ওপাশ থেকে কোনরূপ প্রতিক্রিয়া এলোনা।
এভাবে ঠিক কতক্ষণ ডেকেছে মনে নেই অরুর। ডাকতে ডাকতে একপর্যায়ে দরজার সামনেই ক্লান্ত হয়ে বসে পরে ঠান্ডায় নীল হয়ে যাওয়া অসহায় অরু ।
**************************************
হাইওয়ে ধরে এগোলে রাস্তার একপাশে পেট্রোলপাম্প আর অন্যপাশে ম্যাকডোনাল্টস এর বিশাল ক্যাফেটেরিয়া। এই ছোট্ট শহরটা বেশ নীরব, তার চেয়েও নীরব এই স্টেট টা, যে কয়েকটা ফ্যামিলি আছে তারাও বৃদ্ধ বৃদ্ধা,নয়তো ক্রীতিকের মতো একঘেয়ে।মোদ্দাকথা যারা কোলাহল মুক্ত নিরবচ্ছিন্ন জীবন পছন্দ করে তারাই এই স্টেটে থাকে,নয়তো সানফ্রান্সিসকো থেকে এতোটা দুরে এমন নির্জন পরিবেশে সারাদিন কাটিয়ে দেবার মতো অযথা সময় কারোরই নেই।

দুপুর বেলা হওয়াতে ক্যফেটেরিয়ায় বেশ কিছু মানুষ আছে, তারা যে যার মতো ছাঁদ গোল টেবিলে বসে একটু একটু কফির সিপ নিচ্ছে আর গল্প করছে।
লাল সাদা লোগোর একটা গোল টেবিলে প্রত্যয় ওও বসে আছে। মাত্রই একটা গড়ম কফি শেষ করলো সে। এখন একটু নিকোটিনের ধোঁয়া ছাড়ার জন্য মনটা নিশপিশ করছে, তাই ঠোঁটের কোনে সিগারেট নিয়ে বা হাত দিয়ে দিয়াশলাই জ্বালানোর চেষ্টায় আছে ও।

তখনই ম্যাকডোনাল্ড লোগোর টিশার্ট পরিহিত একটা ব্রাউন স্কিনটোনের মেয়ে এসে ওর সামনে দাঁড়ালো। ঠোঁটের ভাঁজে একগাল হাসি টেনে বললো,
— সরি স্যার স্মো’কিং ইজ নট এলাউ।

প্রত্যয় মাথা তুলে একবার চাইলো,হুট একদম হুট করে চোখে চোখ রাখলো,অতঃপর হারিয়ে গেলো। মেয়েটা সাদা ফ্যাটফ্যাটে চামড়ার নয়,বরং দুধে আলতা রঙের মায়ায় ভরা চেহারা তার, প্রসস্থ হাসিতে স্নিগ্ধতা যেন উঁপচে পড়ছে ওর। ডাগর ডাগর চোখে কোন কৃতিম সৌন্দর্য নেই, চোখের নিচের সুক্ষ ডার্ক সার্কেলটাও তার সৌন্দর্যের সামিল। প্রচন্ড ঠান্ডায় ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষের যখন দিনাতিপাত করাই দুষ্কর, ঠিক তখনই প্রত্যয় আবিষ্কার করলো,এক অজানা উষ্ণতায় ছেয়ে যাচ্ছে ওর হৃদয়ের কানায় কানায়।
নিস্প্রভ তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঠান্ডা হাওয়ায় ওর চোখের কোনে জল জমে গিয়েছে, তাও মনে হচ্ছে এটা শীত নয় বসন্ত। এটা বরফ গলা হাওয়া নয় বরং বাসন্তিক মনমাতানো হাওয়া।
লোকটা এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে দেখে, এবার একটু ইতস্তত হয়ে হাত নাড়লো অনু।
— হ্যালো স্যার।

প্রত্যয়ের ধ্যান ভেঙে যায়,ও তৎক্ষনাৎ হুড়মুড়িয়ে সিগারেট টা ডাস্টবিনে ছু’ড়ে ফেলে দেয়।

— থ্যাংক ইউ স্যার।

মুখে একচিলতে সুশ্রী হাসি ঝুলিয়ে রেখে অনু চলে যায় অন্য কাস্টমারদের কাছে।

প্রত্যয় বলতে চাইলো,
—তুমি এমন করে আর কারও সামনে হেসোনা অপরিচিতা। তোমার এই মনোমুগ্ধকর হাসিটা আমি, হ্যা আমি কেবল একাই উপভোগ করতে চাই। কিন্তু ও পারলো না, তার আগেই অন্যপাশ থেকে ত’র্কাত’র্কির আওয়াজ ভেসে এলো।

প্রত্যয় খেয়াল করলো, অনুকে ওরা কিছু বলছে।
ভারী শরীরের গু’ন্ডা মতো একটা সাদা চামরার লোক। দেখেই মনে হচ্ছে টাল হয়ে আছে,
স্মো’কিং না করতে বলায়, লোকটা ভীষণ চটে গিয়েছে অনুর উপর , অযথা ইংরেজিতে গা’লাগা’ল করছে। এক কথায় দুই কথায় সব মানুষ জড়ো হয়ে গিয়েছে ওদের কাছে, ক্যাফেতে এই মূহুর্তে অনু আর ওর শিফটমেট ডেইজি ছাড়া কতৃপক্ষের কেউ নেই। তারউপর অনু দুইদিন হলো জয়েন করেছে মাত্র, কিভাবে কি সামাল দেবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না ও।একপর্যায়ে লোকটা রে’গেমেগে গড়ম কফির মগটা ছু’ড়ে মারে অনুর দিকে। অকস্মাৎ ঘটনায় চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে নিলো অনু। এক সেকেন্ড দুই সেকেন্ড করে প্রায় ত্রিশ সেকেন্ড অতিবাহিত হয়ে যায়, শরীরের চামড়ায় গ’ড়ম বিভ’ৎস কোনো কিছুই অনুভব করতে পারলো না ও। ব্যাপারটা কি হলো বুঝে উঠতে ভয়ে ভয়ে চোখ খোলে অনু।দেখতে পায়, একটু আগের সিলভার কালার শার্ট পরিহিত সেই লোকটা, ওকে নিজের বাহুতে আড়াল করে চোখ মুখ খিঁচে দাড়িয়ে আছে।
—তার মানে কফিটা কি ওনার শরীরে পড়লো?
হায় হায়।
অনু ব্যাস্ত হয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই লোকটা ওর দিকে একরাশ মায়াচোখে তাকিয়ে বললো,

— আর ইউ ওকে?
***********************************
রিমঝিম বৃষ্টি আর বাজ পড়ার ভ’য়ানক শব্দ কানে আসতেই ঘুম ছুটে গেলো ক্রীতিকের।
হাত দিয়ে নিজের চুল গুলো ব্যাকব্রাশ করতে করতে উঠে বসলো ও, ঘরিতে তখন বিকেল চারটা।
তখন অরুকে বাইরে রেখে এসে কাউচে শুয়েই কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিল টের পায়নি ও।

“অরু” কথাটা মাথায় আসতেই নিজের চুল নিজেই খাঁ’মচে ধরলো ক্রীতিক।
—ও’নো মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল, মেয়েটা ঠিক আছেতো?

এক মূহুর্তও অপেক্ষা না করে ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিলো ক্রীতিক।

দরজার সামনেই দু হাটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে অরু। চেতনা আছে কি নেই বোঝা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ গতিতে থ’রথর করে কাঁ’পছে ওর ছোট্ট শরীরটা। সেই সাথে জোর তালে নিঃশ্বাস ফেলছে । দেখে মনে হচ্ছে শ্বা’স ক’ষ্ট হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডায় ফ্যাকাশে নীল বর্ন ধারন করেছে পুরো শরীর।
অরুর এ অবস্থা দেখে আড়ালে দীর্ঘঃশ্বাস ত্যাগ করলো ক্রীতিক, তারপর আলগোছে বাচ্চাদের মতো করেই নেতিয়ে পরা অরুকে দু-হাতে তুলে নিলো নিজের কোলে। ওর শরীর স্পর্শ করতেই চমকে ওঠে ক্রীতিক, বরফের মতোই ঠান্ডা হয়ে আছে শরীর,আরেকটু দেরী করে দরজা খুললে কি হতো কে জানে??
চলবে……
*********************************
কমেন্টস না করলে উৎসাহ হারাই😑

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here