সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁 #পর্বঃ০৯ #লেখনীতেঃsuraiya_rafa

0
21

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ০৯
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa

ভোর হতে না হতেই গোল্ডেন গেইট ব্রীজ দিয়ে ছুটছে গাড়ির বহর। কেবল গাড়িই নয় ফরেইনার টুরিস্ট থেকে শুরু করে স্থানীয় পথচারী, সবাই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পা চালাচ্ছে আপন গতিতে। সানফ্রান্সিসকোর ছোট্ট শহরতলী ছাড়িয়ে মূল শহরে পা রাখলেই কেবল মনে হয় যান্ত্রিক গাড়ি ছাড়া মানুষ পায়ে হেটেও পথ চলে। এছাড়া যায়গাটা টুরিজম এরিয়া হওয়ায় সর্বক্ষনই লোকে লোকারন্য হয়ে থাকে।

ছাঁদ খোলা মার্সিডিজে বসে দিকভ্রান্তের মতোই এদিক ওদিক তাকিয়ে, মানুষ দেখছে অরু। যেন হাজার বছর পরে এই প্রানীকূলের দেখা পেলো সে। আর এমনটা হবে নাই’বা কেন?গত একমাস ধরে ওই নির্জন, শুনশান বাড়িতে থেকে থেকে বিরক্তি ধরে গিয়েছে ওর। ঘরকুনো হওয়ার দরুন টিকতে পেরেছে বৈকি অন্য কেউ হলে আলবাত পাগল বনে যেত।
তবে অরুও এই মূহুর্তে পা’গলের মতোই উদ্ভট চাহনি ফেলে চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখছে। যেন পৃথিবীর মাটিতে আজই ওর প্রথম দিন।
অরুর কাহিনি দেখে ক্রীতিক হুট করে গাড়ির বাটনে প্রেস করে ছাঁদটা তুলে দিলো।
ক্রীতিকের এমন কান্ডে অরু মুখ কালো করে ওর পানে চাইলো।
সুন্দর ফর্সা চেহারার সাথে এটে থাকা তীক্ষ্ণ চোয়ালটা শ’ক্ত হয়ে আছে বরাবরের মতোই, চোখের সৌন্দর্যে সামিল হয়ে আছে কালোরঙা চৌকো রোদচশমাটা। রাস্তার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে থাকা থেকে শুরু করে একহাত দিয়ে ড্রাইভ করা প্রত্যেকটা কাজেই উপচে পরছে নজর কারা আভিজাত্য আর পুরুষত্ব। এই পুরুষের প্রতি যে কেউ এক দেখায় ফিদা হতে বাধ্য, তবে তার আচার আচরণ এমন অ’মানবিক কেন? ভাবছে অরু। কারন এই বাহ্যিক সৌন্দর্য্যের সাথে ভেতরের মানুষটার যে কোনোরূপ মিলই খুজে পায়না ও।

— আমাকে দেখা বন্ধ কর, আমি ডিসট্রাক্ট হচ্ছি।

তৎক্ষনাৎ চোখ নামিয়ে নিজের হাতের দিকে চাইলো অরু। সফেদ রঙা ব্যা’ন্ডেজ হাতে নিয়েই আজ প্রথম দিন ভার্সিটিতে যাচ্ছে ও। আর এই ব্যান্ডেজ করা ক্ষ’তটা অন্য কারও নয় বরং ওর পাশের মানুষটার দ্বারাই তৈরি।

যদিও ক্রীতিক সবসময় গোমড়া মুখেই থাকে তবুও রাতের সেই ভ’য়ানক, কোল্ডহার্ট আর অ’গ্নিদৃষ্টিরত ক্রীতিকের সাথে এখন কার ক্রীতিকের দিন রাত তফাৎ।
আজ প্রথম দিন তাই ক্রীতিকের সাথেই যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে অরু,কারণ ক্রীতিক ওই একই ভার্সিটির প্রফেসর। তবে ক্রীতিক এটাও সাফসাফ জানিয়ে দিয়েছে আজই ফার্স্ট আর আজই লাস্ট এরপর আর ও কখনো অরুকে নিয়ে যেতে পারবে না। তার বদলে অরুর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে একটা ছোট্ট সাইজের প্যাডেল বাইক বা সাইকেল।

সফেদ ব্যা’ন্ডেজটা নখ দিয়ে খুঁটতে খুঁটতেই অরু যখন নানান অযাচিত চিন্তায় বিভোর , ঠিক তখনই আপন সুরে বেজে উঠলো ওর মুঠো ফোনটা। কোন এক কারণে অনেকটা তরিঘরি করেই ফোনটা কানে তুললো অরু,ওপাশের ব্যাক্তিকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়েই অরু বললো,
— হ্যালো নিলীমা, অবশেষে ফোন করলি তুই, জানিস কাল সারারাত তোকে ফোনে কতবার ট্রাই করেছি, একবারও কল তুলিস নি তুই।

অরু যতটা উচ্ছ্বাস নিয়ে কথাগুলো বললো, নিলীমার কন্ঠস্বর ছিলো ততটাই নির্জীব আর ক্লান্ত ও বললো,
— আমি বুঝতে পারিনি এটা তুই, তাছাড়া কাল সারারাত হসপিটালে ছিলাম ফোন হাতের কাছে ছিলোনা।

অরু জিজ্ঞেস করে,
— কেন কি হয়েছে? তুই ঠিক আছিস??

— হ্যা’রে আমি ঠিকই আছি, কিন্তু তিথি।

তিথি নামটা শোনা মাত্রই অরুর মনে পরে যায় সেদিনের তিথির করা অজস্র অ’পমানের কথা, পাছে এসে ভর করে তিথির প্রতি একরাশ ঘৃ’ণা আর বির’ক্তি। তবুও কথা আগাতে জিভ দিয়ে সামান্য ঠোঁট ভিজিয়ে অরু শুধায়,
— কি হয়েছে?

নিলীমা কাঁ’দো কাঁ’দো গলায় বলে,
—জানিনা অরু, হুট করে আমাদের তিথির মতো চঞ্চল হাসি খুশি মেয়েটার সাথেই এরকমটা কেন হলো।

— কি হয়েছে সেটাতো বল?

— মাত্র একদিনে ওর সাথে অনেক কিছু হয়েছে অরু, কিছু তুচ্ছ কারনে ভার্সিটি তিথির ছাত্রত্ব বাতিল করে দিয়েছে, আর ঠিক সেদিনই হুট করে ওর বাবার এতোবড় পজিশনের জবটাও চলে গিয়েছে, একদিনের ব্যাবধানে ওর ক্যারিয়ার ওর বাবার ক্যারিয়ার সব শেষ হয়ে গিয়েছে, তাহলে ওর মনের অবস্থাটা একটাবার ভাব।আর সব থেকে আশ্চর্য ব্যাপার হলো তিথির বাবা জেকে গ্রুপের মার্কেটিং ডিমার্টমেন্টের কর্মকর্তা ছিলেন, বহু বছরের ক্যারিয়ার হুট করেই শেষ। বলতে বলতে অনেকটা কা’ন্নাই করে দেয় নিলীমা।

— তাহলে হসপিটালে কেন ছিলি?

—- এতো গুলো শকট একসাথে নিতে পারেন নি তিথির আম্মু,এসব ঘটনায় কাল রাতে হুট করেই উনি স্টো’ক করে বসেন ,তাই সেখানেই ছিলাম সারারাত ।

কথাগুলো শুনে অরুরও খারাপ লেগেছে, কিন্তু ওর তো এখানে কিছুই করার নেই, তাই অরু চাঁপা নিঃশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করল ,
— আন্টি এখন কেমন আছেন?

— হুম, আগের চেয়ে বেটার।এখন বল তোর খবর কি অরু?

নিলীমাকে তৎক্ষনাৎ থামিয়ে দিয়ে অরু বলে,
— আমার কথা পরে বলবো ক্ষন,তার আগে তুই আমাকে বল নিখিল ভাই কোন ভার্সিটিতে এডমিশন হয়েছে নিলীমা?

অরুর মুখ থেকে কথাটা বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে আকস্মিক ব্রেক কষলো ক্রীতিক।
হঠাৎ করে এমন হওয়াতে কম্পিত হয়ে উঠলো অরুর বক্ষপিঞ্জর। সামনের দিকে হুমরি খেয়ে পরতে পরতেও যেন বেঁচে গেলো ও। আ’তংকে চোখ দুটো বড়বড় করে ঘুরে তাকালো ক্রীতিকের পানে। তখনও মোবাইল ফোনটা অরুর কানেই ছিল।
তবে খুব বেশিক্ষণ সেটা আর কানে স্থীর রইলো না, অরু কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফোনটাকে অরুর কান থেকে ছি’নিয়ে নিয়ে সেটাকে সজোরে মাঝরাস্তায় ছু’ড়ে মা’রে ক্রীতিক। কয়েক মূহুর্তের মধ্যে সুন্দর চকচকে হ্যালো কিটি কাভার দিয়ে মোড়ানো ফোনটা পরিনত হয় ধ্বংসাবশেষ এ।

নিজের শখের ফোনের এমন করুন দশা দেখে আঁত’কে উঠলো অরু, হিং’স্র বা’ঘিনীর ন্যায় দৃষ্টিপাত করলো ক্রীতিকের পানে। তবে মুখ দিয়ে কিছু বলার অবকাশ দিলোনা ক্রীতিক,
বরং তার আগেই গাড়ির দরজা খুলে গ’র্জে উঠে বললো
—গেট আউট।

অরু চমকে উঠে বললো,
— কি বলছেন, এই মাঝ রাস্তায় কোথায় নামবো আমি??
— গেট আউট,
ক্রীতিক একই বাক্য পুনরায় উচ্চারণ করে,একপ্রকার হাত ধরে ঠেলেই মাঝরাস্তায় নামিয়ে দিলো অরুকে। তারপর ওয়ালেট থেকে একটা একশো ডলারের নোট বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—সামনেই বাস স্টপেজ, নেক্সট বাস সোজা ভার্সিটির সামনে গিয়ে থামবে।গো এহেইড।

অরু বেচারি না পারতে টাকা’টা হাতে নিলো।

ক্রীতিক তৎক্ষনাৎ ঠা’স করে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
যাওয়ার আগে নিজের শরীরের কালো রঙের কোর্টটা খুলে জানালা দিয়ে ছু’ড়ে মা’রে অরুর মুখের উপর।
কোর্টটাকে উল্টে পাল্টে দেখে ক্রীতিকের গাড়ির দিকে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো অরু।
ক্রীতিক যেতে যেতে লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে বলে,
—হাতে নিয়ে সং এর মতো দাড়িয়ে থাকার জন্য দেয়নি, গায়ে পরতে দিয়েছি।

ব্যাস এইটুকুই তারপর শাঁই শাঁই করে হাজারো অচেনা গাড়ির ভিরে হারিয়ে গেলো একমাত্র চেনা মার্সিডিজটা।
অজ্ঞাত অরু ভাবলেশহীন চোখে সেদিকেই তাকিয়ে রইলো খানিকক্ষণ , মাথায় তখন একটাই প্রশ্ন খেলে গেলো ওর, ক্রীতিক কি আদৌও মানুষের কাতারে পরে?
*****************************************
মনের মাঝে একরাশ হতাশা আর ক’ষ্ট নিয়ে কোন মতে ভার্সিটিতে এসেছে অরু। শীত নিবারক হিসেবে গায়ে জড়িয়ে রেখেছে ক্রীতিকের ব্র্যান্ডেট ব্ল্যাক কোর্ট।
গেইট দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকতে ঢুকতে অরু ভাবছে,
এভাবে ভে’ঙে পরলে চলবে না,যত যাই হোক পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতেই হবে তাকে। তবে সে ভাবনারা বেশিদূর এগোতে পারলোনা। নিজেকে নিজেই মোটিভেশন দিতে দিতে কখন যে হাজারও অচেনা অপরিচিত মুখের ভীরে কাঙ্খিত, পরিচিত,শ্যাম পুরুষের মুখ খানা চোখের সামনে চলে এলো, সে কথা ঠাওর করতে পারলো না অরু। ঠিক আগের মতোই ক্যাম্পাসের প্রসস্থ সিঁড়িতে আসন পেতে কানে হেড ফোন লাগিয়ে বই পড়ছে সে।হঠাৎ করেই কি জানি কি হয়ে গেলো, ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ তুলে জোয়ার আসার মতোই বানভাসি হলো মনের নদী,মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে এলো খুব পরিচিত সেই চেনা নাম,
— নিখিল ভাই?

চারিদিকে কে আছে কে নেই কিছুই আর চোখে পরলো না অরুর,বরং নিস্পলক হয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো সেই চেনা মুখের মানুষটির দিকে। তবে পুরো পুরি কাছে যাওয়া হলোনা,তার আগেই নিখিলের কাছে পৌঁছে গেলো ভিনদেশী দুজন সুন্দরী আগন্তুক রমনী। কয়েকমূহুর্তের মধ্যেই তাদের সাথে হাসি ঠাট্টায় মাতোয়ারা হয়ে উঠলেন নিখিল। তাই অরুর আর সেদিকে পা বাড়ানোর সাহস হলোনা, বরং দূর থেকেই নিখিলের হাস্যোজ্জল মুখের পানে চেয়ে শুধালো,
— আপনি ভালো আছেন নিখিল ভাই?

অরুর থেকে কয়েক মিটার দূরত্বে দাড়িয়ে এই পুরো ব্যাপারটা দু’হাত মু’ঠিবদ্ধ করে স্ক্যান করে নিলো আরেকজন। তবে সেটা অন্য কেউ নয়,অরুতে ভীষন ভাবে আসক্ত এক ছ’ন্নছাড়া পুরুষ মি.জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী।

অরু বাসে আসলেও অরুর পরেই ভার্সিটিতে প্রবেশ করেছে ক্রীতিক,কারণ ও গাড়ি নিয়ে বাসের পেছন পেছনই এসেছে। তারপর ক্যাম্পাসে ঢুকতেই এই কাহিনি। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো এই মূহুর্তে ক্রীতিকের চোখে মুখে কোন গম্ভীরতার লেসমাত্র নেই। বরং ঠোঁটের কোনে আটকে আছে একটা রহস্য জনক কপট বাঁকা হাসি। কপট হাসিটা ধরে রেখেই ক্রীতিক অস্ফুটে বলে,
— আমার বোকা পাখি। সত্যিটা জানলে কতোই না ক’ষ্ট হবে তোর জান।বাট আ’ম ওকে উইথ দ্যাট। কজ তুই শুধু আমার।
*****************************************
অরু আজ কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিল কে জানে? প্রথম দিন ভার্সিটিতে আসার উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পর থেকেই একটার পর একটা ঝামেলা লেগেই আছে পেছনে। প্রথমে ক্রীতিকের মতো ব’দমেজাজি লোকের সাথে বের হতে হলো, অতঃপর রাস্তায় বিশাল অ’ঘটন, একটু আগে নিখিল ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েও হলোনা, আর এখন ক্লাস থেকেই বের করে দিলো ক্রীতিক ওকে।

এখন অবশ্য দোষটা ক্রীতিকের নয় অরুরই বেশি ছিলো। ক্লাসের মধ্যে বাইরে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে নিখিল ভাইকে খুজতে গিয়েই বেজেছে বিপত্তি। ভরা ক্লাসে সবার সামনে ক্রীতিক এক রাম ধ’মক দিয়ে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছে অরুকে। কিন্তু অরু এটা ভেবে পায়না, বাংলা ডিপার্টমেন্ট থেকে এসে ইকোনমিকস কে নেয়??

কেনইবা ক্রীতিক বেছে বেছে এই বিদঘু’টে সাবজেক্টেই ভর্তি করালো ওকে? এটা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ফরেইনার স্টুডেন্টদের অভাব নেই এখানে,সেই সাথে সাবজেক্টেরও।তাহলে ইকোনমিকসই কেন???

এখন তো তিনদিন অন্তর অন্তর মাইক্রোকোনমিক্স ক্লাসে ক্রীতিকের মুখোমুখি হতে হবে, সাথে হাজারটা ফ্রী অ’পমান তো আছেই।
ক্লাসের বিপরীত করিডোরের মাঝখানে, উঁচু থেকে শুরু করে সবুজ ঘাস অবধি বিছানো সিঁড়িতে বসে বসে অরুর মনের সাথে মস্তিস্ক যখন বিশাল দ্বন্দে লিপ্ত ঠিক তখনই ল্যাপটপ ব্যাগ হাতে আগমন ঘটে নিখিলের।
— অরোরা না?

পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে হকচকিয়ে পেছনে চাইলো অরু। দেখলো গালের মাঝে টোল পরা হাসি মুখ নিয়ে দাড়িয়ে আছে নিখিল ভাই। এতোদূর এসে, বিদেশের মাটিতে নিখিল ভাইকে দেখতে পেয়ে অরুর ভীষণ আনন্দ হলো। ও বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে দু’কদম এগিয়ে গেলো নিখিলের কাছে, তবে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে পারলো না আগের মতো জড়তাটা রয়েই গিয়েছে।
এবার নিখিলই প্রশ্ন করলো প্রথমে,
— অরোরা তুমি হঠাৎ এখানে? জানো ওই যে দেখছো তিনতলার ল্যাব ওখান থেকে তোমাকে দেখেই ছুটে এসেছি আমি।বারবার মনে হচ্ছিলো আমি ঠিক দেখছি তো?

মাত্রাতিরিক্ত খুশিতে অরুর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, তবুও খানিকটা কষ্ট করে মিনমিনিয়ে জবাব দিলো,
— জ্বি আমি এখানে, ইকোনমিকস ডিপার্টমেন্ট ফার্স্ট ইয়ার।

সঙ্গে সঙ্গে আবারও প্রশ্ন করে নিখিল,
— আচ্ছা অরোরা,তিথি কেমন আছে? ওর ফোন কেন বন্ধ বলতে পারবে??

তিথিকে নিয়ে নিখিলের এতোবেশি কৌতুহল আর উদ্বেগ দেখে ফাটা বেলুনের মতোই চুপসে গেলো অরুর হাস্যোজ্জল মুখটা।

অন্যদিকে,ক্লাসের বিশাল থাই লাগানো জানালার ফাঁক দিয়ে এক পলক ওদের দিকে চাইলো ক্রীতিক, অতঃপর অর্নব কে কল করে নরম সুরে, একদম সফ্ট টোন যাকে বলে, সেভাবেই বললো,
— আমাদের ভার্সিটির সি’সিটিভি কন্ট্রোল সিস্টেমটা হ্যা’ক করতে হবে দোস্ত। বেশি না ওয়ানলি ফর ফাইভ মিনিটস।
*****************************************
তিথি সম্মন্ধে কথা বলতে মোটেই আগ্রহী নয় অরু। কেন যেন ভেতর থেকেই আসছে না কোন কথা, কি বলবে তাহলে ও??
কিন্তু নিখিল দ্বিতীয়বার আবারও একই প্রশ্ন করলো ওকে,
— কি হলো অরোরা, জানো তিথি সম্মন্ধে কিছু?
অরুর মন বলছে, আমি এতদূর কিভাবে আসলাম, কেন আসলাম, সেসব কথা আপনার একটা বারও জানতে ইচ্ছা করলো না নিখিল ভাই? তাছাড়া আপনি হঠাৎ তিথিকে নিয়েই বা কেন এতো আগ্রহী?
— হ্যালো,অরোরা, কি ভাবছো এতো?

নিখিল হাত নাড়িয়ে ইশারা করতেই সম্বিত ফিরে পেলো অরু। এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই ফোন চলে আসে নিখিলের।
ওপাশ থেকে কি বললো, কে জানে, নিখিল আর এক মূহুর্তের জন্যও দাঁড়ালো না ওখানে বরং দ্রুত পায়ে ছুটতে লাগলো তিনতলার ল্যাব রুমের উদ্দেশ্যে।
অযাচিত অরু পেছন থেকেই প্রশ্ন ছুড়লো,
— কি হয়েছে নিখিল ভাই, এনিথিং রং?

নিখিল যেতে যেতে জবাব দিলো
— সাম হাউ ক্যা’মিক্যা’ল পরে গিয়ে আমার সব রিচার্জ রিপোর্ট গুলো পু’ড়ে গিয়েছে।

এমন দু’র্ঘটনার কথা শুনে অজান্তেই মুখে হাত চলে গেলো অরুর। বিরবিরিয়ে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন ছুড়লো,
— আজ হচ্ছেটা কি এসব?

ক্লাস শেষে অরুকে এভাবে থ হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ওর কাছে এগিয়ে আসে উজ্জ্বল শ্যাম বর্নের মোটা ফ্রেমের চশমা পরিহিত একটি মেয়ে। কারও উপস্থিতি টের পেয়ে অরু পেছনে চাইলে মেয়েটা হাত বাড়িয়ে বলে,
—হ্যালো আ’ম সায়নী, সায়নী মুখার্জি। আ’ম ফ্রম ইন্ডিয়া।

দুর দেশে হাজারো সাদা চামড়া ওয়ালা বিদেশি মানুষের ভীরে প্রতিবেশি দেশের কাউকে দেখতে পাওয়াটা পাশের বাড়ির প্রতিবেশির মুখ দেখতে পাওয়ার মতোই অনেকটা। অরুরও সে-রকমই ঠেকলো, ও জলদি সায়নীর হাতে হাত মিলিয়ে বললো,
— আমি অরোরা শেখ, আই মিন অরু।

— অরু? হাউ সুইট।
তারপর আঙুল দিয়ে ইশারা করে সায়নী বলে চলো ক্যান্টিনে যাই, তোমাকে ভার্সিটি ক্যান্টিনের সবচেয়ে বেস্ট খাবারটা টেস্ট করাবো আজ, লেটস গো।
অরু সম্মোহনী হাসি দিয়ে বললো,
— আচ্ছা চলো।
নরম ঘাসের আস্তরণ মাড়িয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা দুজন, যেতে যেতে সায়নী শুধায়,
— আচ্ছা আজ জেকে স্যার তোমাকে ওভাবে বক’লো কেন বলোতো? উনি সাধারণত কারোর সাথেই আনপ্রফেশনাল আচরণ করেন না এটলিস্ট আমিতো দেখিনি।

অরু ঠোঁট উল্টে বললো,
— কি জানি।
তবে মনে মনে বললো,
—তোমার জেকে স্যারের বকু’নি খেয়ে আমার অভ্যেস আছে।

সায়নী প্রতিউত্তরে উৎকন্ঠা নিয়ে বললো,
— জানো? জেকে স্যার ইজ আ ভেরি গুড রাইডার। ভার্সিটিতে তাকে যতোটা কুল লাগে, বাইক রাইডার জেকে স্যারকে ঠিক ততটাই ডেস্পারেট আর ড্যাসিং মনে হয়। যেন আস্ত একটা চকোলেট বয়।

অরু জানতো যে ক্রীতিক একজন রাইডার তবে সেটা মনিটরের ভিডিও গেইমে। কিন্তু বাস্তবেও যে ক্রীতিক বাইক রাইডিং করে সেটা ওর অজানাই ছিল।তাই চকিতে বলে,
— কি বলছো তুমি? আমিতো জানতাম না।

সায়নী হাত দিয়ে মাঁছি তাড়ানোর মতো করে বললো,
— আরে তুমি কি করে জানবে? নতুন এসেছো না।দাঁড়াও আমার কাছে টিকেট আছে।
এই বলে ব্যাগ থেকে দুইটা টিকেট বের করে একটা অরুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সায়নী বললো,
— আগামী কাল ভার্সিটির হান্ড্রেড ইয়ার সিরিমনি, তাই কোন ক্লাস নেই, সারাদিন কোন না কোন প্রোগ্রাম হবে। তারপরের দিনই জেকে স্যারের রাইডিং ম্যাচ, টিকেটটা রাখো আমি তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাবো, কেমন?

অরু হ্যা না কিছুই বললো না, সায়নী বলার অপেক্ষাও করলো না , অনেকটা অধিকার খাটিয়েই ওর ব্যাগে টিকেটটা ঢুকিয়ে দিলো।
*****************************************
এদেশে সন্ধা হওয়ার জন্য খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন পরে না, বিকেল চারটার পরে এমনিতেই সূর্যের হদিস পাওয়া বাহুল্য।
আধারের কালচে আস্তরনে গোধূলির ম’রা রোদ টুকু ঢেকে গিয়েছে বহু আগেই।
আবছা আঁধারের মাঝেই ভার্সিটির গেইট দিয়ে ধীরগতিতে বের হয়েছে অরু।
ওদিকে গেইটের বাইরে গাড়িতে হেলান দিয়ে সটান দাড়িয়ে আছে ক্রীতিক।
আপাতত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অরুর গতিবেগ গননা করাটাই ওর মোক্ষম কাজ মনে হচ্ছে।
অরু যখন একদম সামনে এসে দাঁড়ায়, ঠিক তখনই ঘড়ি থেকে চোখ সরিয়ে ক্রীতিক বললো,
— হোয়াই সো লেট?

অরু জবাব দেয়না, উল্টে অবিশ্বাসের নজরে ক্রীতিকের মুখশ্রী পরখ করে মনে মনে বলে,
— এই গো’মড়া মুখো লোকটা,এতো মেয়েদের ক্রাশ? সব মেয়েরা রাইডার রাইডার করে নাঁচে। কি এমন রাইড করেন উনি?

অরুর এমন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করা দেখে ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে বললো,
— হোয়াট??

অরু লাফিয়ে উঠে দূরত্ব বাড়ালো।

—কি হলো দূরে সরে কেন গেলি? কাছে আয়।

— ক..কাছে কেন আসবো?

ক্রীতিকের নির্লিপ্ত জবাব,
— আমি আসতে বলেছি তাই আসবি, আয় বলছি।
প্রতিউত্তরে অরু কিছু বলবে তখনই গেইটের কাছে আগমন ঘটে দা ক্রাশ বয় নিখিলের।
হাতে সাইকেল নিয়ে দাড়িয়ে আছে সে। অরুকে দেখা মাত্রই নিখিল আন্তরিক হেসে বললো,
— আরে অরোরা, বাসায় যাবে নাকি? চলো তোমায় এগিয়ে দিচ্ছি আমি।

অরু তো খুশিতে বাকরুদ্ধ, এ যেন মেঘ না চাইতে জল। ও ক্রীতিকের মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে বললো,
— ইয়ে.. ভ..ভ..ভাইয়া।আসলে।

— কি?
তী’রের ছিলার মতো একটা ভ্রু উঁচিয়ে শব্দটা উচ্চারণ করে ক্রীতিক।

অরু বলতে ভ’য় পাচ্ছে ক্রীতিককে, তবে এই মূহুর্তে নিখিলের সাথে বাড়ি যাওয়ার মতো এতো বড় সুযোগটাও হাত ছাড়া করতে চাইছে না মোটেই, তাই বুকের মাঝে অনেকটা সাহস জুগিয়ে বললো,
— আ..আমি নিখিল ভাইয়ের সাথে যেতে চাই।

—ইয়াহ সিওর।

একেবারে একবলে ছক্কা হাঁকানোর মতোই ভেতরটা ইয়াহু বলে চেঁচিয়ে উঠলো অরুর। খুশিতে এখানেই লাফাতে ইচ্ছে হচ্ছিল ওর।কিন্তু সেটা বড্ড বেমানান দেখায়,তাই চুপচাপ গিয়ে সাইকেলের পেছনে উঠে পরলো ও।

ক্রীতিক সেদিকে অনুভূতি শূন্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাড়িয়ে আছে, হাত দিয়ে এমন ভাবে নিজের লং হেয়ার গুলোকে ব্যাক ব্রাশ করছে যেন কিছুই হয়নি।এভরিথিং ইজ অল রাইট।

সাইকেল চলতে শুরু করলেই ক্রীতিক মাটির দিকে তাকিয়ে গুনতে শুরু করলো,
— ফাইব, ফোর, থ্রী, টু,ওয়ান এন্ড জিরো।

সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার মাঝখানে ঝনঝন করে কিছু একটা পরার শব্দ হলো। তৎক্ষনাৎ ওর ঠোঁটে খেলে গেলো অদ্ভুত সেই ক্রুর হাসি।

হুট করেই সাইকেলের টায়ার কিকরে পা’ঞ্চার হয়ে গেলো বুঝে উঠতে পারলো না নিখিল,অবশ্য এই মূহুর্তে সে বোঝার মতো অবস্থাতেও নেই, হাত পা ছিলে ছুলে যা-তা অবস্থা হয়ে গিয়েছে।
অরু নিজেও অনেকটা ব্যা’থা পেয়েছে। ক্রীতিক দ্রুত এগিয়ে এসে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে শুধালো,
— আর ইউ অল রাইট মি. নিখিল?

প্রতিউত্তরে নিখিল আদৌও জবাব দিলো কি দেয়নি, তার জন্য একমূহুর্ত ও অপেক্ষা না করে, ক্রীতিক দ্রুত অরুকে কোলে তুলে নিয়ে যেতে যেতে বলে,
— ওকে বায়, দেন।

অরুকে কোলে তুলতেই অরু, অবাক হয়ে জোরে জোরে বললো,
–আরে আরে নিখিল ভাই পরে আছে আর আপনি আমাকে নিয়ে চলে যাচ্ছেন?

ক্রীতিক হাঁটতে হাঁটতে জবাব দেয়,
— হ্যা, কারন আমি তোর নিখিল ভাইয়ের প্রতি একটুও ইন্টারেস্টেড না, আমি যার প্রতি ইন্টারেস্টেড তাকে সাথে করেই নিয়ে যাচ্ছি।

— কি বললেন? কার প্রতি আগ্রহী?

ক্রীতিক দু’হাতে আগলে রাখা অরুর দিকে তাকিয়ে কটমটিয়ে বললো,
— বিলিভ মি অরু, তুই আর একটাও বাড়তি কথা বললে, আমি তোকে এখানেই ফেলে চলে যাবো। আর তুই ভালো করেই জানিস আমি যেটা বলি সেটাই করে ছাড়ি। কারণ তোর পেছনে ওয়েস্ট করার মতো বেহুদা টাইম আমার নেই।সো মুখে ফুলস্টপ টান।

ক্রীতিকের কথার পাছে অরুও আর কথা বাড়ানোর সাহস পায়না, মুখে দাড়ি,কমা,ফুলস্টপ সবকিছু টেনে দিয়ে, মাথা এলিয়ে পরে থাকে ক্রীতিকের প্রসস্থ বাহুডোরে।
চলবে…….
হ্যাপি রিডিং 🫰🫰
রিচেইক করতে পারিনি, বানান ভুল থাকতে পারে।
গল্প নিয়ে দু’একটা গঠন মূলক কমেন্ট করলে কি হয়??🙄

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here