সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁 #পর্বঃ১২ #লেখনীতে_suraiya_rafa

0
20

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ১২
#লেখনীতে_suraiya_rafa
[কপি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[প্রাপ্তমনস্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য]

পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে ধীরে ধীরে। গোধূলির আকাশ সিদূর রাঙা হয়ে আছে। গর্জে ওঠা সাগরের উত্তাল ঢেউ আর শঙ্খচিলের চিউ চিউ গলা ফাটানো আওয়াজ ভেসে আসছে ক্ষনে ক্ষনে। খানিক বাদে বাদে এলোমেলো বাতাসে বালু আস্তরিত সাগর কোল ভিজে যাচ্ছে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের পানিতে। মাঝে মধ্যে সেই পানি পার ছাপিয়ে এসে আঁচড়ে পরছে মোমের মতো ফর্সা দু’পায়ে। পায়ের সাথে সাথে চিকচিকে বালুতে ভরে যাচ্ছে সুন্দর কারুকাজ করা রুপোলী নুপুর জোড়া। অনু সাগরের কোল ঘেষে নরম বালুতে , “দ” আকারে বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হাত দিয়ে ভেজা নুপুরটা নাড়াচাড়া করছে সেই কখন থেকে। এতোক্ষণ একাই বসেছিল। তবে একটু আগেই ওর পাশ ঘেঁষে বসে পরে প্রত্যয়। হাতে দুটো বাবল টি এর জার।
একটা বাবল টি’তে স্ট্র ঢুকিয়ে অনুর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে প্রত্যয় বলে,
— এখানকার বাবল টি অনেক ফ্যামাস,টেস্ট ইট।
অনু হাত বাড়িয়ে সেটা গ্রহন করে নিঃশব্দে একটা সিপ নেয়, আসলেই মজার চা টা।কিন্তু এতো বড় জারে চা কে খায়? ভাবছে অরু।
নিস্তব্ধতা কাটিয়ে প্রত্যয় বললো,
— এবার বলুন, হঠাৎ করে এই অধমের তলব কেন করলেন?
—- তার আগে আপনি বলুন, এতদূরে কেন নিয়ে এলেন? আমিতো স্রেফ হসপিটালের সামনে ওয়েট করতে বলেছিলাম।

অনুর জবাবে প্রত্যয় হেসে বলে,
— আপনি কি করে ভাবলেন যে, শুধু মাত্র দেখা করেই আমি ক্ষান্ত হবো?

প্রত্যয়ের কথার জবাবে, অনু একটু ব্যাথাতুর হেসে বললো,
— আমার জীবনটা সামনে থেকে দেখতে যতটা সহজ আর সাবলীল মনে হয় ততটাও সহজ নয়,প্রত্যয় সাহেব। হুটহাট ডেটে যাওয়া, ঘুরে বেড়ানো, দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে একাকী সময় কাটানো কোনোটাই আমার দ্বারা সম্ভব নয়।

আপনি হয়তো আরও একটা জিনিস জানেন’না আমি আন্ডার গ্রাজুয়েট। ইন্টারমিডিয়েটের পর আর পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি আমার।

— এগুলো আমাকে কেন বলছেন?

অনু রোবটের মতো জবাব দেয়,
— আমি নিজেও জানিনা আপনাকে কেন এসব বললাম, শুধু মনে হলো বলা উচিৎ।

প্রত্যয় সাগরের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললো,
— তারমানে আপনি বুঝতে পারেন আমি আপনার জন্য কি ফিল করি তাইতো?

অনু জবাব দিলো না, বরং আগের ন্যায় মাথাটা এলিয়ে দিলো দু’হাটুর উপর, অহেতুক তাকিয়ে রইলো অন্যদিকে।তখনই কানে এসে পৌঁছালো প্রত্যয়ের ডিপ ভয়েস।
—- আমাকে সময় দিতে হবেনা, আমার সাথে সারাদিন কথা বলতে হবে না,আমাকে প্রেমিক ভাবতে হবেনা, প্রেমিকার মতো আবদারও মেটাতে হবেনা, আমার খোঁজও নিতে হবে না, শুধু একটা শর্ত।

প্রত্যয়ের কথায় বেশ কৌতুহল বোধ করলো অনু, তাই এবার ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলো প্রত্যয়ের পানে।

প্রত্যয় আগের মতোই সাগরের পানে চেয়ে বললো,
—- একজীবনে আমি ছাড়া দ্বিতীয় পুরুষের কথা কল্পনাতেও ভাবা যাবেনা।

— ব্যাস এইটুকুই?

প্রত্যয়, অনুর হাটুতে এলিয়ে দেওয়া মুখের পানে চাইলো, সূর্যের নিংড়ানো শেষ আলোটুকু ধ’নুকের ন্যায় তীর্যক হয়ে আঁচড়ে পরছে অনুর চোখে মুখে। ঘন পল্লব বিশিষ্ট আঁখি দু’টো টল-টল করছে অশ্রু জলে। সোনালী আলোর ছটা আঁচড়ে পরে ছলছলে চোখ দুটো ঝিলিক দিচ্ছে বারবার, কয়েক সেকেন্ডের জন্য প্রত্যয়ের মনে হলো, এগুলো কোন চোখ নয়, বরং গহীন অভ্যায়রন্যের মাঝে দুটো জংলা দিঘী, কাঁচের মতোই স্বচ্ছ সেই দিঘীর মায়াবী জল।এই দিঘীর মায়াতে হারিয়ে যাওয়া যায় অনায়সে অকপটে। প্রত্যয়ও নিজেকে হারিয়ে ফেললো অনুর দীঘির মতো টলটলে চোখে, অতঃপর অনুর প্রশ্নে আস্তে করে জবাব দিলো,
— ব্যাস এটুকুই।

অনু এবার সার্থপরের মতো বললো,
— বিপরীতে আমি কি পাবো??

— যা চাইবেন তাই।

অনু আড়ালে চাপা নিঃশ্বাস ছেড়ে বুক ভরে সাগর পারের স্নিগ্ধ বাতাস ভেতরে টেনে নিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। তারপর জিভ দিয়ে নিজের শুকনো অধর ভিজিয়ে বললো,
— আমি আপনার শর্তে রাজি আছি প্রত্যয় সাহেব। বিনিময়ে আমারও যে কিছু চাই।

—কি চাই?

—- আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিবেন?এখন এই মূহুর্তে?

অনুর মুখশ্রী জুড়ে অসহায়ত্বের ছাপ সুস্পষ্ট।খুব অল্প বয়সে অনেক বেশি ভারী দায়িত্ব বহন করতে করতে ক্লান্ত মেয়েটা। অথচ এতো কিছুর পরেও দিনশেষে নিেজর ছেলেমানুষী, নিজের আবদার কোনোটাই তুলে ধরার যায়গা ওর নেই। মা বোন থেকেও পৃথিবীর বুকে বড্ড একা এই অনু। ওর স্নেহের প্রয়োজন, দিন শেষে ক্লান্ত শরীরটাকে আগলে রাখার জন্য দুটো বাহুর প্রয়োজন।আর এই মূহুর্তে ও সেটাই চায়। অন্য কিছুই নয়, না কোনো শারীরিক চাহিদা, না কোনো কমিটমেন্ট, না সারপ্রাইজ, না কোন আয়োজন। কিচ্ছু না, ওর শুধু একটা বাহুডোর আর একটুখানি স্নেহের পরশ প্রয়োজন।

আশ্চর্যজনক হলেও প্রত্যয় অকপটে তা দিতে সায় জানালো, তৎক্ষনাৎ উপর নিচ মাথা দুলিয়ে অনুকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো সে,পরম আবেশে একহাত বুলিয়ে দিলো অনুর মাথায়, আর তারপর আরো খানিক টা গভীর ভাবে ছুয়ে দিলো ওর ছোট্ট কপালটাকে। কপালের মাঝ বরাবর একটা উষ্ণ আর গভীর চুমু এঁকে দিয়ে তবেই ক্ষান্ত হলো প্রত্যয়।

তখনও সাগরের ঢেউয়ের তালেতাল মিলিয়ে বাড়ছিল অনুর কা’ন্নার গতিবেগ ।
*****************************************
ড্রেসিং টেবিলের সামনে মুখ কালো করে অসহায়ের মতো বসে আছে অরু। ওর ঠিক সামনে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে দক্ষ হাতে, সুন্দর ফর্সা গালে একে একে প্রাইমার,ফাউন্ডেশন, কনসিলার,ব্ল্যাশ আর হাইলাইটারের আস্তরণ লাগিয়ে যাচ্ছে এলিসা।
অরু মেকআপ বলতে ওই সান্সক্রীন আর লিপস্টিক ছাড়া তেমন কিছু ব্যাবহার করেনি কখনো। করতে যে খুব ভালো লাগে তেমনটাও নয়। ওর কাছে সাজুগুজুর চেয়ে স্কিন কেয়ার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাইতো এতো ক্যা’মিক্যাল মিশ্রিত মেকআপ লাগানো হয়না কোনো কালেই।তবে আজ যখন এলিসা নিজে থেকে এসে বললো সাজিয়ে দিবে, তখন আর না করতে পারেনি অরু। চুপচাপ ভদ্রমেয়ের মতো গিয়ে বসেছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে।

মনেমনে ভাবছে ক্রীতিক আদৌও জানেতো যে ও এলিসার বার্থডে পার্টিতে যাচ্ছে।

এই খানিকক্ষণ আগের কথা। ভার্সিটি থেকে ফিরে মাত্রই ফ্রেস হয়ে বেরিয়েছিল অরু। বাড়িতে আপাতত ক্রীতিক, অনু কেউই নেই।

অনু আজকাল দেরি করে ফিরলে অরু তেমন একটা ভাবেনা, কারন ওর দৃঢ় বিশ্বাস প্রত্যয় ভাইয়া অনুকে ঠিক দেখে রাখবে,কোনো অযাচিত বিপদে পরতেই দেবেনা। আর ক্রীতিকের চিন্তা করে লাভ নেই, সে তো কখন ফেরে আবার কখন বেরিয়ে যায় তার কোন হদিসই জানেনা অরু।

কেউ নেই দেখে অরু একাই কিছু একটা সহজে বানিয়ে খাবে বলে কিচেনে পা বাড়িয়েছিলো কেবল। ঠিক তখনই আগমন ঘটে এলিসার। ভেতরে এসে এলিসা জানায়, আজ তার জন্মদিন। অরু সম্মোহনী হাসি দিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালে,এলিসা বলে ও অরুকেই নিতে এসেছে। অর্নব নাকি এলিসার জন্য ছোটখাটো একটা পার্টির এ্যারেঞ্জ করেছে।

অর্নব পার্টি এ্যারেঞ্জ করেছে কথাটা মাথায় আসতেই খানিকক্ষন আগের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে, চট করে এলিসাকে প্রশ্ন করে বসে অরু,
—- অর্নব ভাইয়া তোমাকে পছন্দ করে তাইনা আপু?

অরুকে খুব যত্ন করে আই শ্যাডো লাগিয়ে দিতে দিতে এলিসা বলে,
— পছন্দ টছন্দ কিছুইনা, পাগলটা হুদাই আমার পেছনে পরে আছে।

—- পছন্দ করে দেখেই পিছনে পরে আছে আপু,আর তাছাড়া তোমার মতো সুন্দরী মেয়েকে কে না পছন্দ করে?

— তুমি আমার থেকে কোনো অংশে কম নও অরু, বরং অনেকটা বেশি।তুমি ন্যাচারাল বিউটি, আর আমিতো সবসময় মেকআপে ঢেকে থাকি।তাছাড়া তোমার চুল দেখেই তোমার স্বামী তোমার প্রেমে পরে যাবে, আ’ম ড্যাম সিওর।

অরু লাজুক হেসে বলে,
—আপসোস কেউ পরলো না।

—-পরবে পরবে, আর একটু বড় হও ঠিক পরবে, তখন ক্রীতিকের নিজের বোনকে পাহারা দেওয়ার জন্য পেছনে হাজারটা বডিগার্ড লাগিয়ে রাখতে হবে।

— উনি আমাকে বোন হিসেবে পরিচয় দিতে চায়না আপু, তাই আমিও চাইনা যেচে পরে কারও বোন হতে।
নির্লিপ্ত কন্ঠে জবাব আসে অরুর দিক থেকে।

— ওর কথা বাদ দাও, জেকে সব সময়ই এমন করে,বেশি ভাব দেখায়। আসো তোমার চুল গুলো ঠিক করে দিই।
অরু বুঝলো ক্রীতিকের কোনো খারাপ অভ্যাসই, এদের কাছে দোষের নয়। তাই আড়ালে ফোঁস করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে আয়নায় দেখতে লাগলে ও।

নিজের পরিপাটি চেহারাটা আয়নায় দেখে, অরু বলে,
— অর্নব ভাইয়া তো ভালো মানুষ, তাহলে তাকে কেন ক’ষ্ট দিচ্ছো আপু।

অরুর চুলে হেয়ারব্রাশ চালাতে চালাতে এলিসা বলে,
— আমারও এই একটাই আপসোস জানোতো। অর্নবের মতো ছেলে আমার মতো একটা মেয়েকেই কেন পাগ’লের মতো ভালোবাসে দুনিয়াতে কি ভালো মেয়ের অভাব ছিল?

অরু চকিতে পেছনে ঘুরে শুধালো,
— মানে?

— তুমি প’কার প্লেয়ার মানে বোঝো?

অরু অজ্ঞাতদের মতো এদিক ওদিক মাথা নাড়ালো।

— জু’য়া চেনো নিশ্চয়ই ? কার্ড দিয়ে যে খেলে?

একটা শুষ্ক ঢোক গিলে, অরু এবার হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বলে,
— হ্যা!টট…টিভিতে দেখেছি।

আমি ওটাই খেলতাম অরু। ইভেন যেমন তেমন নয়,আজ পর্যন্ত প’কার খেলে আমাকে কেউ বিট করতে পারেনি। প’কার প্লেয়ারদের কাছে আমি সেলিব্রিটিদের মতোই। ওরা আমার একটা অটোগ্রাফের জন্য তৃষ্ণার্থ চাতকের মতোই অপেক্ষা করে থাকে। আর যে সেটা একবার পেয়ে যায়, তার ডিমান্ডও বেড়ে যায়।

অরু পেছনে ঘুরে এলিসার হাত ধরে বললো,
— আপু এটাতো খা’রাপ কাজ তাহলে বেরিয়ে কেন আসছো না??

এলিসা জোরপূর্বক হেসে জবাব দেয়,
— আমি ছাড়তে চাইলেও এই বিভীষিকা ময় খেলার জগত আমার পিছু ছারছে না অরু।
*****************************************
স্ফটিকের লাল,নীল, সবুজ আলোয় ঝিকমিক করছে পুরো হল রুমটা। কিছু কিছু নজর কাড়া লাইট সফ্ট মিউজিকের তালেতালে জ্বলছে আবার নিভছে। আর্টিফিশিয়াল বেবি পিংক কালারের থীমটা ভালোই মানিয়েছে লাইটিং এর সাথে। এককথায় চোখ ধাদানো ব্যাপার স্যাপার। হলরুমটা মানুষদ্বারা পরিপূর্ণ , বেশিরভাগই জোড়ায় জোড়ায়। তবে এতো এতো চিকচিক আলোয় কারোরই মুখ দেখে চেনার জো নেই। না এই মূহুর্তে অরু কারো মুখ দেখার মতো অবস্থায় আছে, এর কারন, ওর দৃষ্টি আড়াল করে শক্ত চোয়াল আর অ’গ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপন করে তাকিয়ে আছে ক্রীতিক।
দেখে মনে হচ্ছে পাবলিক প্লেস না হলে এই মূহুর্তে খুব বড়সড় সিনক্রিয়েট করতো সে।

অরু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, এলিসা ওকে রেখে কই যে উধাও হয়ে গেলো সেটাই ভাবছে আপাতত।

— চুপ করে থাকিস না অরু, কথা বল ? আমাকে না জানিয়ে এখানে কোন সাহসে এলি তুই?

ক্রীতিকের আকস্মিক ধ’মকে অরু, মাথা তুললো,
একটা ব্ল্যাক ভেলভেট পার্টি জ্যাকেট পরে আছে ক্রীতিক। ঘার অবধি চুল গুলো জ্যাকেটের সাথে ম্যাচিং করেই সেট করা। মনে হচ্ছে কোন হেয়ারস্টাইলিস্ট এর সূক্ষ হাতের কাজ এটা।
তবে ক্রীতিককে দেখতে যতটা ড্যাশিং লাগছে, ওর সুন্দর হ্যান্ডসাম রাগী চেহারাটা দেখতে ততটাই ভ’য়ানক লাগছে। সুন্দর বড়বড় ছোট দুটি যেন জ’লন্ত অ’ঙ্গার।

অরু ভেবে পায়না ও করেছেটা কি? এলিসা নিতে গিয়েছে দেখেই তো এলো। তাহলে এতো রাগের কি আছে, আর সব ব্যাপারেই কেন ক্রীতিককে জানাতে হবে? কি হয় ক্রীতিক ওর? এইরকম শাসন করার মতো এতোটাও তো ক্লোজ ওরা নয়, তাহলে?? মনে মনে ক্রীতিকের উপর খুব বি’রক্ত হলো অরু। অজানা কারনে জিভটা নিম পাতার মতোই তেঁতো ঠেকলো ওর। তাই ইচ্ছে করেই মৌনতা পালন করলো ক্রীতিকের হাজারটা প্রশ্নের জবাবে।

— অরু আমাকে রাগাস না, তুই এখানে কি করছিস? এভাবে আমাকে না জানিয়ে আর কোথায় কোথায় যাস তুই ?কি হলো জবাব দে?

অরু চুপ রইলো এবারও। কিন্তু ক্রীতিক আর নিজের রা’গ সংবরণ করে রাখতে পারলো না, পকেট থেকে হাত বের করে চেপে ধরলো অরুর নরম চিকন হাতটা। তৎক্ষনাৎ পেছন থেকে কথা ছুড়লো এলিসা,
—- কি করছিস জেকে।

ক্রীতিক অরু সমেত এলিসার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁতেদাঁত চেপে বললো,
— ওকে এখানে নিয়ে এসে কাজটা তুই একদম ঠিক করিস নি এলিসা? তুই ভালো করেই জানিস আজকে পার্টির পেছনে আমাদের অন্য উদ্দেশ্য আছে, আর সেখানে তুই আমার দূর্বলতা টেনে নিয়ে এলি? হোয়াই?

এলিসা লম্বা একটা শ্বাস টেনে অরুকে ক্রীতিকের থেকে ছাড়িয়ে বললো,
— যদি কিছু হয়, সেটা আমার সাথে হবে, অরুর সাথে নয়,তাছাড়া, কিছু যে হবে তাও তো সিওর না, তাহলে আমার বার্থডে টাকে নরমাল বার্থডে পার্টি কেন ভাবতে পারছিস না? আর সবচেয়ে বড় কথা অরু ছোট বাচ্চা নয়, তুই সবসময় ওকে এভাবে ডমিনেট করিস কেন বলতো?

ক্রীতিক তীক্ষ্ণ কন্ঠে জবাব দিলো,
— কারণ ও আমার।

— বলা হয়েছে? এবার আমরা আসছি।

এলিসা কিংবা অরু কেউই ক্রীতিকের কথায় খুব একটা গুরুত্ব না দিয়েই ওখান থেকে চলে গেলো।
দু’হাত মুঠি বদ্ধ করে রেখে পেছন থেকে বিড়িবিড়িয়ে ক্রীতিক বললো,
— সাবধানে এলিসা, সি ইজ মাই হার্টবিট।
*****************************************
পার্টিতে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছুই ঘটেনি, বরং সবাই জমিয়ে আনন্দ করেছে, কেক কে’টেছে খাওয়া দাওয়া হৈ-হুল্লোড় করে অনেকটা সময় অতিবাহিত করেছে। পুরোটা সময়ই অরুকে সাথে সাথে রেখেছে এলিসা, সেই সাথে চোখে চোখে রেখেছে অন্য আরেকজন।

আজ প্রথমবার ক্রীতিক বোধ করলো ও খুব দূর্বল হৃদয়ের, অন্তত অরুর ক্ষেত্রে তো তাই। পুরো পার্টিতে ঘুরে ফিরে ওর দুচোখ অরুতেই নিবদ্ধ ছিল । কয়েক সেকেন্ডের জন্যেও যদি অরু চোখের আড়াল হয়েছে তো ক্রীতিকের মনে হচ্ছিলো এই বুঝি দুশ্চিন্তায় ব্যাকুল হৃদয়টা এক্ষুনি ব্লা’স্ট করবে।

কিন্তু এখন এই মূহুর্তে ক্রীতিক নিশ্চিন্তে ডিভানে গা এলিয়ে দিয়ে ড্রিংক করছে, কারন অরু ওর চোখের সামনেই বসে আছে, যদিও ওদের মাঝে দূরত্ব বেশ অনেকটা, তবুও চোখের সামনে তো আছে। ক্রীতিক যখন নির্বিগ্ন বসে বসে এসব ভাবছিল,তখনই বল ড্যান্সের ঘোষনা করা হয়।

পশ্চিমা সংস্কৃতিতে বল নাচ খুবই জনপ্রিয়। আজকাল বাংলাদেশেও বিভিন্ন পার্টি কিংবা অনুষ্ঠানে কপোত-কপোতীদের বল নাচের আয়োজন করা হয়। কিন্তু অরু কিভাবে নাচবে? একেতো পার্টনার নেই তার উপর বোকার মতো জরজেট শাড়ি পরে এসেছে। তাই বসে বসেই সবার পারফরম্যান্স দেখতে লাগলো ও।

ঠিক তখনই ক্রীতিকের দৃষ্টি আড়াল করে অরুর সামনে এসে দাঁড়ালো সায়র। রাজকুমার দের মতো করে মাথাটা হালকা নুইয়ে ডানহাত বাড়িয়ে দিয়ে অরুকে শুধালো,
— লেটস হ্যাভ আ ডান্স।

অরু না করতে চাইলো, কিন্তু না করাটা মূর্খতার লক্ষন, সবার সামনে না করে দিলে সবাই ওকেই আনস্মার্ট ভাববে, তাছাড়া সায়র ও অনেকটা লজ্জিত হবে। সেই ভেবে ও নিজেও হাত বাড়ালো বল নাচের উদ্দেশ্যে। তবে সায়রের হাতের মাঝে আর হাত রাখা হলোনা ওর, তার আগেই মসৃণ হাতটা ঈগলের মতো ছোঁ মে’রে নিজের হাতে নিয়ে এলো ক্রীতিক। সায়রকে ইচ্ছা করেই ধা’ক্কা মে’রে দাড়িয়ে পরলো অরুর সামনে।
হুট করে একদম হুট করে, চোখের পলকে ঘটনাটি ঘটায়, কিছুই ঠাহর করতে পারলো না অরু, শুধু দেখতে পেলো ওর হাতটা সায়র নয় ক্রীতিক ধরে আছে।

অরু সচকিত হয়ে কিছু বলতে চাইলো, তবে তার ফুরসত দিলোনা ক্রীতিক। টেনে নিয়ে গেলো বল নাচের স্টেজে।
অরুর এক হাত নিজের কাধে রেখে, নিজের শক্ত হাতটা ছোঁয়ালো অরুর লতানো কোমড়ে। অন্যহাত ঢুকিয়ে দিলো অরুর পাঁচ আঙুলের ভাঁজে। বল নাচের মঞ্চটা ছিল পুরো পুরি অন্ধকার। ফেইরী লাইটের ম্যাজিকাল আলো ছায়ায় কোন কিছুই খুব ভালো করে দেখা যাচ্ছেনা। অরুও দেখতে পেলো না, ক্রীতিকের আ’গুন ঝরা চোখ জোড়া ওর শরীরের স্পর্শ পেয়ে মূহুর্তেই কতোটা কামুকতায় ডুবে গিয়েছে।
ব্যাকরাউন্ডে তখন সবার প্রিয় বাংলা গানের দুটো লাইন বাজছিল,

“হালকা হাওয়ার মতোন চাইছি এসো এখন..
করছে তোমায় দেখে.. অল্প বে’ঈমানী মন
বাঁধবো তোমার সাথে… আমি আমার জীবন। ”

ওরা দুজনও তখন সফ্ট মিউজিকের তালে তালে পা মেলাচ্ছে নির্দ্বিধায় । কি জানি হুট করে কোথায় হারিয়ে গেলো দুজন। এতো জড়তা, এতো দূরত্ব, এতো প্রতিকূলতা সব কেমন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। পাছে শুধু পরে রইলো দু’টো অশান্ত মন।
ক্রীতিক নাচের তালে তালে অরুকে ঘুরিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বললো,
—তুই সত্যিই অসাধ্য সাধন করতে পারিস অরু, আমাকে দিয়ে কেমন ডান্স করিয়ে ছাড়লি।

অরু নাচের মুদ্রা অনুসরন করতে করতে ক্রীতিকের পেশিবহুল ঢেউ খেলানো বুকে দুহাত রেখে বললো,
— কেন এলেন? আপনার সাথে নাচতে আমার ভ’য় করছে বড্ড ।

ক্রীতিক এবার অরুকে নিজ বাহুতে ছেড়ে দিয়ে, আবারও কাছে টেনে নিয়ে এলো, খুব কাছে । হুট করে টান দেওয়াতে অরুর রেশমের মতো লম্বা খোলা চুল গুলো আঁচড়ে পরলো ক্রীতিকের চোখে মুখে। অরুর মাতাল করা চুলের সুবাস ছড়িয়ে পরলো ক্রীতিকের শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

ক্ষনিকের নিরবতা ভে’ঙে ক্রীতিক অরুকে আঙুলের মাথায় ঘোরাতে ঘোরাতে বলে,
— আজকের পার্টিতে না এলে হতোনা? তুই কি ঠিক করেই নিয়েছিস?আমাকে এ জীবনে টেনশন ফ্রী থাকতে দিবিনা?

অরু দু’হাতে ক্রীতিকের গলা জড়িয়ে নাচের তালে তালে বললো,
— আমি আপনাকে একদম বুঝতে পারিনা।আপনি কি আসলেই জায়ান ক্রীতিক?

ক্রীতিক এবার অরুকে টেনে একটু খানি আলোতে নিয়ে এসে ওর চোখে চোখ রেখে বললো,
— কি করে পারবি, বুঝতে চেয়েছিস কখনো আমায়?

—কি’করে বুজবো? আপনি যে রহস্যময় মানব।

অরুর কথা বিপরীতে কোনো জবাব দিলোনা ক্রীতিক। তার বদলে নিজ হাতে অরুর গাড়ো নীল জরজেট শাড়িতে লাগানো ব্রোঞ্জটা খুলে দিলো একটানে, সঙ্গে সঙ্গে পাতলা আঁচলটা কোমর ছাড়িয়ে নিচে পরে গেলো।
ক্রীতিক ওর আঁচল গলিয়ে উন্মুক্ত কোমরে আলতো হাত ছুয়িয়ে বললো,
— আমার জিনিস অন্য কাউকে দেখানোর কোন অধিকার তোর নেই।

অরু সেই কখন থেকেই ক্রীতিকের নেশালো চোখে তাকিয়ে আছে। হয়তো ওর চোখের ভাষা পড়তে চাইছে। কিন্তু জায়ান ক্রীতিক চৌধুরীর চোখের ভাষা পড়া কি এতোটাই সহজ?

অরু পড়তে পারলো না, উল্টে হুট করেই মনে পরে গেলো সেদিন বৃষ্টি ভেজা দুপুর বেলার কথা। সেই একই চোখ, একই হাস্কি কন্ঠস্বর, একই ভেজা অনুভূতি। অরুর হৃদমাঝারে আবারও তোলপাড় শুরু হয়েছে খুব। পেটের ইতিউতি উড়ছে অবাধ্য প্রজাপতির দল।

ক্রীতিক ওর সাথে কি করেছে,কি বলেছে কিছুই মস্তিষ্ক অবধি পৌঁছায়নি অরুর। ও তো ক্রীতিকের চোখেই ডুবে ছিল। ডুবে থাকতে থাকতেই উপলব্ধি করলো ক্রীতিকের চোখ দুটো বড্ড নে’শা ধরানো আর কাতরতা জড়ানো। কোন এক অজানা চৌম্বকীয় শক্তির দ্বারা ক্রীতিকের চোখ দুটো ওকেখুব করে টানে,হৃদয়টা বেসামাল করে তোলে বারবার। কিন্তু কি এমন আছে ওই ভাসমান গোলগোল চোখে? ভেবে পায়না অরু।

—- অরু?

ক্রীতিকের হঠাৎ ডাকে কম্পিত হয়ে উঠলো অরুর শরীর,নিজের হুশ খেয়াল ফিরে পেয়ে কোথায় যাবে কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারলো না খানিকক্ষণ । এখনো ক্রীতিকের বাহুতেই সিটিয়ে আছে অচল শরীরটা। চোখ মুখ লজ্জায় র’ক্তবর্ণ ধারন করেছে। কপালে বসানো স্টোনের বিন্দির আশেপাশে বিন্দু বিন্দু ঘামের ছড়াছড়ি। কার চোখের দিকে এতোক্ষণ তাকিয়ে ছিল ও? ক্রীতিকের? যে কিনা সম্পর্কে ওর মায়ের সৎ ছেলে ছি ছি।

ক্রীতিক নিজেও এই মূহুর্তে কৌতুহলী আর প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে ওর পানে।

অরু একঝলক ক্রীতিকের ফর্সা ড্যাসিং চেহারার দিকে তাকিয়ে শুষ্ক ঢোক গিলে বিড়বিড়িয়ে বললো,
— দয়া করে এভাবে তাকাবেন না, আমার কেমন যেন লাগে, আপনি যতই সুদর্শন হোননা কেন এটা কখনোই সম্ভব নয়।

নিজের মনে কিছু একটা বলে, ক্রীতিকের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে ওই স্থান ত্যাগ করে চলে গেলো অরু।
পেছনে ক্রীতিকের জন্য শুধু খুলে পরে রইলো অরুর এক পায়ের চিকন রুপোলী নুপুর।
চলবে…..
গঠন মূলক কমেন্ট করলে খুশি হবো।
হ্যাপি রিডিং 🫰🫰
আগামী কাল হয়তো গল্প দিতে পারবো না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here