#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্বঃ১৯
#লেখনীতে_suraiya_rafa
[ক’পি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[প্রাপ্তমনস্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য]
পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত দোচালা আলিশান ভিলার গা ডাবিয়ে দেওয়া নরম বিছানাতে এপাশ ওপাশ করেও কিছুতেই ঘুম নামছে না দু’চোখের পাতায়। অবাধ্য মনটা ক্রমাগত অন্যকারো নাম জপে যাচ্ছে বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার পর থেকেই। রুমের এক পাশে স্থীর মূর্তির মতো দাড়িয়ে থাকা দক্ষিণের জানালাটা হাট করে খোলা। সেথা থেকে পাতলা ফিনফিনে সফেদ পর্দা ছাপিয়ে হুহু করে বাসন্তিক হিমেল হাওয়া এসে শরীর নাড়িয়ে দিচ্ছে বারংবার , তবুও ঘুম কুমারীর দেখা নেই।
হুট করে বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে আকর্ষনীয় স্টাইলিশ চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করতে করতেই দক্ষিণ জানালার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো ক্রীতিক। কপালে তার গভীর চিন্তার ভাঁজ।ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট ধরিয়ে, মুখে বিড়বিড়ানো অস্পষ্ট আওয়াজ,
— কি করবো আমি?দিনে দিনে আমার আনহেলদি্ অবসেশনে পরিনত হচ্ছিস তুই । পাশ ফিরেই তোকে দেখতে পাবো এমন দিনের জন্য আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে আমায়?তোকে যে আমার চাইই চাই।
এইটুকু বলেই ক্রীতিকের সাভাবিক মুখভঙ্গিমা অনেকটা কাঠিন্য রূপ ধারণ করে, ব্লে’ডের মতো তীক্ষ্ণ চোয়ালটা শক্ত করে পুনরায় বিড়বিড়ালো সে,
— যেই মূহুর্তে মনটাকে আর মানাতে না পারবো, ঠিক সেই মূহুর্তে এসব ফা’কিং বয়সের পার্থক্য, সম্পর্কের জটিলতা কিংবা এর চেয়েও আরও বড় কোনো বাধা, সব কিছুকে জাস্ট উপড়ে ফেলে দেবো আমি। মাইন্ড ইট অরোরা শেখ। সেদিন আমার কাছে কেঁদে কেটেও লাভ হবেনা, আমি এতোটাও সদয় নই। নিজের জিনিস আমি চেয়ে নয় কেড়ে নিই।
একমনে হাজারো কথা আওড়ে কাবার্ড থেকে শার্ট বের করে সেটাকে টিশার্টের উপর পরে, শার্টের হাতাদুটো ভাজ করতে করতেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় ক্রীতিক।
*****************************************
গভীর আমাবস্যা রাত। মাথার উপর আজ আর চাঁদের দেখা নেই। ছোট বড় তারকারাজিরাও মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে। চারিদিকে ঘুম ঘুম পরিবেশ বিরাজমান। এই মূহুর্তে সবাই হয়তো ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে ঘুমের দেশে পারি জমিয়েছে।কিংবা কেউ কেউ মেতে উঠেছে ভালোবাসা আদান প্রদানের চড়ম প্রতিযোগীতায়। অথচ অরুর রুমে চকচক করছে ইলেকট্রনিক বাল্বের চোখ ধাঁধানো আলো, শরীরটা ক্লান্তিতে ভার হয়ে আসছে,চোখ জোড়াও ঘুমাতে যাওয়ার জন্য নিসপিস করছে সেই কখন থেকে, কিন্তু তার উপায় কোথায়? এই অবস্থায় ঘুমাতে গেলে হাত পায়ের কাঁ’টা ছেড়া যায়গা গুলোতে মলম কে লাগাবে? তাছাড়া জঙ্গলে দৌড়াতে গিয়ে পিঠের কাছেও অনেকটা কেঁ’টে গিয়েছে। সেখানটাতেই আপাতত কটন দিয়ে একটু একটু করে এন্টিসেফটিক লাগাচ্ছে অরু, আর খানিকবাদে বাদে চোখ ঘুরিয়ে জানালা গলিয়ে নিশুতি আধার রাতে হাতড়ে বেড়ানো জোনাকিপোকা পরখ করছে ,যাতে কাজ করতে করতে ঘুম না পেয়ে যায় আবার। অরু যখন নিজেকেই নিজে সারিয়ে তোলার কাছে প্রচন্ড মনোযোগী ঠিক তখনই কোনোরূপ নক না করেই পাসওয়ার্ড টিপে ওর রুমের ভেতর প্রবেশ করে ক্রীতিক।
এতো রাতে আচমকা কারও উপস্থিতি টের পেয়ে অসাবধানতায় লাফিয়ে ওঠে অরু, মাথা তুলে ক্রীতিককে দেখতে পেয়ে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে দ্রুত নিজের কাধ থেকে জামাটা তুলে ফেলে মিনমিনিয়ে বলে,
— মেয়ে মানুষের রুমে নক করে ঢুকতে হয়,সেটাও জানেন না? ম্যানারলেস লোক কোথাগার।
— তোর রুমে আবার আমাকে অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হবে? পিচ্চি মেয়ে একটা, দেখি কোথায় লেগেছে?
কথা বলতে বলতেই অরুর কাছে এগিয়ে যায় ক্রীতিক। হাত বাড়িয়ে দেয় অরুর ঘাড়ের কাছে। অরু দ্বিধা গ্রস্থ হয়ে নিজের জামাটা চেপে ধরে বললো,
— আপনার চেয়ে ছোট হতে পারি,তবে বয়সের দিক দিয়ে আমি অতোটাও ছোট নই।
নিজের গোপনীয় ক্ষতটা ক্রীতিককে দেখাতে অরু সংকোচ বোধ করছে বুঝতে পেরে, ক্রীতিক হাঁটু গেড়ে অরুর মুখোমুখি হয়ে বসে ওর এক পা তুলে নেয় নিজের উরুর উপর,তারপর সেটাকে মনোযোগ সহকারে উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে বলে,
— তাই নাকি? বিয়ের বয়স হয়েছে?
–কিহ!
ক্রীতিক চোখ তুলে অরুর চোখে চোখ রেখে পুনরায় শুধালো,
— বিয়ের বয়স হয়েছে? বরকে সামলাতে পারবি?
ক্রীতিকের হঠাৎ করা ছো’বলের মতো প্রশ্নে অরুর লজ্জায় চোখ বুঝে আসছে, ও দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে বলে,
— ব্যাথা পায়ে হাত কেন দিয়েছেন?
— আরো ব্যাথা দেবো বলে।
ক্রীতিকের উত্তরে চোখ মুখ কুঁচকে গেলো অরুর,অবিশ্বাস্য কন্ঠে নিজের পা’টা ক্রীতিকের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে, ও বললো,
— সত্যিই আবার ব্যাথা দেবেন?
অরুর কথাটা বলতে যতক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে পুরোরুমে ঝঙ্কার তুলে শব্দ করে হেসে উঠলো ক্রীতিক। ক্রীতিককে এভাবে হাসতে দেখে আপনা আপনি ফাঁক হয়ে গিয়েছে অরুর ওষ্ঠাধর। চোখ দুটো হয়ে উঠেছে হাঁসের ডিমের মতো গোল গোল। ও কি সত্যি দেখছে,নাকি সবই স্বপ্ন বুঝে উঠতে পারছে না অরু। অরু কে সেই কখন থেকে হা হয়ে থাকতে দেখে ক্রীতিক নিজের চিরাচরিত রূপে ফিরে এসে, গম্ভীর মুখে বলে,
— হা করে আছিস কেন? মাছি খাওয়ার শখ হয়েছে?
ক্রীতিকের কথার পাছে অরু অবিশ্বাসের সুরে বলে ওঠে,
— আপনি হাসতেও পারেন?
অরুর কথায় কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া না করে ক্রীতিক হাত বাড়িয়ে বলে,
— ওই পা দেখি।
অরু সামান্য উঁকি দিয়ে দেখলো, ওর একটা পায়ে খুব সুন্দর করে ব্যান্ডেজ বেধে ফাস্টএইড করে দিয়েছে ক্রীতিক, এরপর আরেকটা পা-ও নিজের উরুর উপর রেখে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে বললো,
— এই পায়ের নুপুর কোথায়?
অরু ঠোঁট উল্টে অসহায় সুরে বললো,
— হারিয়ে ফেলেছি।এই নুপুরটা আমার খুব পছন্দের ছিল জানেন, তাইতো একটা হারিয়ে যাওয়ার পরেও আরেকটা খুলিনি।
নুপুরের প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য পায়ে ব্যান্ডেজ লাগাতে লাগাতে হঠাৎ করেই ক্রীতিক শুধালো,
— আচ্ছা অরু, সেদিন ক্যাথলিন তোকে রেগেমেগে কি এমন বলেছিল?
প্রথমে অরু একটু সময় নিয়ে ভাবে,তারপর মনে পরার মতো চট করেই মিনমিনিয়ে ঠোঁট টিপে হেঁসে ওঠে ও।
— কি ব্যাপার হাসছিস কেন?
অরু হাসতে হাসতেই জবাব দেয়,
— হাসবো না? এলিসা আপুর কাজিনতো তো আপনার জন্য এক কথায় ফিদা, রাগে গজগজ করতে করতে আমাকে কতোকথাই না শোনালো সেদিন।বলে কিনা, আমাকে যাতে আপনার ধারে কাছেও আর না দেখা যায়। আমি আসার পর থেকে নাকি আপনি বদলে গিয়েছেন।
কথাটুকু বলে আবারও অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে অরু, হাসতে হাসতে বলে,
— উনিতো আর জানেনা, আমি আপনার চিরাচরিত শ’ত্রু, জানলে বোধ হয় এসব কথা জীবনেও বলতো না। আমার কি মনে হয় জানেন? এলিসা আপুর কাজিনের মাথা নির্ঘাত সমস্যা আছে।
ক্রীতিক নিজের হাতের কাজ থামিয়ে বললো,
— এমন কেন মনে হলো তোর?
— তো মনে হবে না? আপনার সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলছে আপুর কাজিন,আর মানুষ পেলোনা আমি আর আপনি?সাপ আর বেজি, নানা দা আর কুমড়ো!!কথা বলতে বলতে আবারও কুটকুটিয়ে হেসে ওঠে অরু।
এতোক্ষণ ধরে বসে বসে অরুর কথার বহর শুনে গেলেও ওর শেষ কথাটা বোধ হয় পছন্দ হয়নি ক্রীতিকের। অরুর হাসি মুখের দিকে এক নজর বি’ভৎস চাহনি নিক্ষেপ করে সঙ্গে সঙ্গে ওর ব্যান্ডেজ করা ক্ষ’ত পা’টা শক্ত হাতে চেপে ধরলো ক্রীতিক। ক্রীতিকের হাতের বাধনটা এতোটাই বেশি শক্ত ছিল যে হুট করেই অরুর মনে হলো, ওর কলিজা ধরে টান দিয়েছে কেউ, হঠাৎ করে এমন প্রচন্ড ব্যাথায় আঁতকে উঠে শব্দ করে চিৎকার দিয়ে উঠলো অরু,
— আহহহ, কি করছেন?ব্যাথা কেন দিচ্ছেন?
ক্রীতিক ওর পা’টা ধা’ক্কা মে’রে সরিয়ে দিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলে,
— আমি তোর নার্স কিংবা সার্ভেন্ট নই যে রাত যেগে বসেবসে তোর ক্ষ’ততে মলম লাগাবো।
ধা’ক্কা লেগে ক্ষত থেকে পুনরায় তরতাজা র’ক্ত বেরিয়ে এসে সাদা ব্যান্ডেজ র’ক্তরাঙা হয়ে ভিজে উঠেছে, অরু সেখানটায় হাত দিয়ে চেপে ধরে চোখ খিঁচে রেখেছে। বন্ধ চোখ জোড়া থেকে নিঃশব্দে গড়িয়ে পরছে অস্রুসিক্ত নোনাজল।
ক্রীতিক তাতে নজর না দিয়েই হনহন করে বেরিয়ে যায়, যাওয়ার আগে শেষবারের মতো পেছন ঘুরে মনেমনে আওড়ায়,
— তোর ভুল ধারনা খুব শীঘ্রই ভেঙে যাবে অরু। তুই আমার না হলে, অন্য কারোর না।
****************************************
সন্ধ্যা হতে না হতেই স্ফটিকের লাল,নীল, বেগুনি আলোর ঝলকানিতে চিকচিক করছে সুবিশাল ক্লাবের চারিদিক। ভেতর থেকে ডিজে গানের ধিমধিম আওয়াজ ভেসে আসছে রাস্তা পর্যন্ত। একে একে ভেতরে প্রবেশ করছে,ক্যাডিলাক,মার্সিডিজের মতো নামি দামি গাড়ির বহর। পৃথিবীতে হাতে গোনা নামি-দামি যে কয়েকটা ক্যা’সিনো ক্লাব রয়েছে তার মধ্যে ব্যাংককের কিং ক্লাব একটি। বছরের বিভিন্ন সময়ই পৃথিবীর নামি-দামি পকার প্লেয়াররা জু’য়ায় টাকা জেতার জন্য জমায়েত হয় এখানে। একের পর বেট ধরে জিতে নেয় কোটি কোটি টাকা। এলিসাও তাদের মধ্যে একজন,সবার প্রিয় নাম্বার থার্টিন। এই নামেই সবাই ওকে চেনে। সবার ভালোমতোই জানা যেই ক্লাব ওকে নিতে পারবে তারাই তরতর করে সবচেয়ে ধনী ক্যা’সিনো ক্লাবে পরিনত হবে। কিন্তু এলিসাতো আর এসবে জড়াবে না,আজকেই এই পা’পের দুনিয়াতে ওর শেষ দিন। শুধু একবার ভালোয় ভালোয় বাবাকে নিয়ে ফিরতে পারলেই হলো।
স্ফটিকের আলোতে জ্বলজ্বল করতে থাকা কিং ক্লাবের নেইম-প্লেটের সামনে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা চারজন।
চারিপাশের পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে এলিসার বেশভূষা ও চোখ ধাঁধানো আজ। ঝিকিমিকি টপস আর লেগিংসের সাথে পায়ে এটে আছে কয়েক ইঞ্চি লম্বা পেন্সিল হীল। মেকআপের আস্তরনের সাথে ম্যাচিং করে ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক,চোখে কালো সানগ্লাস। ওর পাশেই স্যুট বুট পরে ফর্মাল লুকে দাড়িয়ে আছে সায়র,চোখে পরেছে মোটা ফ্রেমের চশমা। দেখতে তাকে পুরোপুরি এ্যাসিসট্যান্টের মতোই লাগছে। সায়রের পাশেই বাইকে হ্যালান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লেদার জ্যাকেট আর হেলমেট পরিহিত জেকে। চারিদিকে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে সবটা পরখ করে, অর্নব এগিয়ে এসে বললো,
— গাইস সব ঠিকঠাক, এলিসা তুই সায়রকে নিয়ে ফ্রন্ট গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ কর। আমি বেজমেন্টে ঢোকার সাথে সাথেই কাজ শুরু করবো, মনে রাখিস হাতে মাত্র দশমিনিট সময়।আই রিপিট মাত্র দশমিনিট। এরপর আর এতোগুলা সার্ভার একসাথে নিজের কন্ট্রোলে রাখতে পারবো না আমি।আর জেকে তুই এখানেই ওয়েট কর, এলিসা ওর বাবাকে নিয়ে বের হওয়ার সাথে সাথে তুই এলিসাকে নিয়ে চলে যাবি, ওর বাবাকে আমরা ম্যানেজ করবো।
কথাটুকু শেষ করে সবার কানে একটা করে ব্লুটুথ লাগিয়ে দিলো অর্নব।
— নাও গো….
.
দশমিনিট প্রায় শেষ হতে চললো, ক্রীতিক সুক্ষ্ম নজরে কাচের দেওয়াল বেস্টিত ক্লাবের দিকে তাকিয়ে আছে, এতদূর থেকে ভেতরের কোনো কিছুই ঠাহর করার উপায় নেই, শুধু বোঝা যাচ্ছে এতোক্ষণ ধরে জ্বলতে নিভতে থাকা ঝিকিমিকি আলোর বহর হুট করেই পুরোপুরি নিভে গিয়েছে। ভেতরের মিউজিক আলো দুটোই নিভে যাওয়ার দরুন ক্রীতিক সচকিত হয়ে ব্লুটুথে মনোযোগ দিলো, কিন্তু না ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ নেই। তৎক্ষনাৎ কোথা থেকে যেন দৌড়ে এলো অর্নব, আশেপাশে একনজর চোখ বুলিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে শুধালো,
— দশ মিনিট শেষ হতে চললো, ওরা কোথায়?
ক্রীতিক ঠোঁট কামড়ে বললো,
— ঠিক বুঝতে পারছি না, কোনো বড় বি’পদ হওয়ার আগে আমাদের ভেতরে যাওয়া দরকার, সায়র যা ভীতুর ডিম ওকে ভরসা নেই।
ক্রীতিকের কথায় সায় জানিয়ে অর্নব তৎক্ষনাৎ ক্লাবের দিকে হাটা দেয়, পেছন থেকে ক্রীতিক আবারও ডেকে ওঠে ওকে,ক্রীতিকের ডাকে সারা দিতে অর্নব ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে চাইলে, ওর দিকে একটা রি’ভলবার ছুড়ে দিয়ে ক্রীতিক বললো,
— ক্যাচ ইট।
অর্নব রি’ভলবারটা ক্যাচ করে, হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ক্রীতিকের চোখের দিকে চাইলো, নিজের কোমড়ের খাঁজে আরও একটা রি’ভলবার গুঁজতে গুঁজতে হালকা চোখ টিপে ক্রীতিক বলে,
— ফর সেইফটি পারপাস, আফটার অল ভেতরের সবার কাছেই এটা আছে।
.
এলিভেটর দিয়ে ওরা দুজন যখন ক্লাবের সবচেয়ে বড় হলরুমটাতে প্রবেশ করে,তখন চারিদিকে নিস্তব্ধতায় ঘেরা, এতো মানুষ এতো হইহট্টগোল সব কেমন হাওয়ায় উবে গিয়েছে, বাইরে থেকে আসা নিয়ন আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চারিদিকের টেবিল চেয়ার গুলো উল্টেপাল্টে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, অর্নব আর ক্রীতিক ভ্রু কুঞ্চন করে চোখাচোখি করলো, অর্নব নিচু স্বরে বললো,
— হোয়াটস রং? সবাই কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো?
— যে যেখানে খুশি যাক, এলিসার বাবাকে আমার মোটেও সুবিধার মনে হয় না, লোকটা চরম ধূর্ত। এই মূহুর্তে এলিসা আর সায়রকে সেফ রাখাই আমাদের মেইন টার্গেট।
ক্রীতিকের কথায় অর্নব হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো। তখনই ওর পায়ের সাথে ধাক্কা লেগে একটা কাঁচের ক্যা’সিনো সাজানো টেবিল ঝনঝন করে মেঝেতে পরে যায়। সঙ্গে সঙ্গে হল রুমের লাইট জ্বলে ওঠে, ভেতরের রুম থেকে একে একে বেরিয়ে আসে সবাই। সায়র আর এলিসার কপালে ব’ন্দুক ঠেকিয়ে রেখেছে সয়ং এলিসার বাবা। ওদের দুজনকে দেখা মাত্রই খু’নখুনিয়ে কেঁদে ওঠে সায়র,
অর্নব ওর দিকে তাকিয়ে বিরক্ত সুরে বলে,
— মেয়েদের মতো কাঁদছিস কেন হাদারাম, তোদের বাঁচাতেই তো এলাম।
ক্রীতিক এগিয়ে গিয়ে এলিসার বাবার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
— আবারও নিজের মেয়ের সাথেই নোংরা চাল চাললেন মি.ত্রিপিটক।
ক্রীতিকের কথায় লোকটা কপট হেঁসে বললো,
— এতো কথা ভাল্লাগছে না, চলো সহজ ডিলে আসি, তুমি তোমার বন্ধুকে নিয়ে চলে যাও, আর আমার মেয়েকে আমার কাছে রেখে যাও, ওকে ছাড়া আমার ক্যাসিনো বিজনেসটা একেবারে নড়বড়ে হয়ে আছে।
লোকটার কথায় ক্রীতিক ঠোঁট কামড়ে একটু তাচ্ছিল্য করে হাসলো, অতঃপর ঘাড় কাত করে বললো,
— গেলে আমরা চারজনই যাবো। প্রয়োজন পরলে আপনাকে উপরে পাঠিয়ে যাবো,কারন আপনাদের মতো মানুষের প্যারেন্টস হওয়ার কোনো যোগ্যতাই নেই।
কথাটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই এলিসাকে টান দিয়ে ওর মাথায় রি’ভলবার ঠেকালো ক্রীতিক। ক্রীতিকের কান্ডে এবার অর্নব ও কিছুটা ভরকে গিয়ে বললো,
— জেকে কি করছিস ?
অর্নবের কথায় কান না দিয়ে ক্রীতিক এলিসার বাবাকে বলে, আপনি ওকে মা’রতে পারতেন না ত্রিপিটক , কারন এলিসা আপনার সোনার ডিম পারা হাঁস, বাট আমি পারবো,কারন ও আমার দুই পয়সার কাজেও আসেনা,ইভেন নিজেকে বাঁচানো জন্য শুধু এলিসা কেন ওদের সবাইকে মা’রতেও আমার এক মিনিটও টাইম লাগবে না।যাস্ট পয়েন্ট আর তারপর শ্যু’ট।
এলিসার বাবা হেঁসে বললো,
— ভয় দেখাচ্ছো?
ক্রীতিক তৎক্ষনাৎ সায়রের পা বরাবর একটা গু’লি করে দেয়, গু’লির আওয়াজে গগন কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে সায়র। এলিসা অর্নব ওরাও ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে ক্রীতিকের দিকে। নিজের বন্ধুকে এভাবে উইথআউট ও’য়ার্নিং গু’লি করাতে এলিসার বাবাও খানিকটা ভরকে গিয়েছে মনে মনে ভাবছে,
— এই ছেলে যে যখন তখন এলিসাকে গু’লি করে দেবে না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই।
চারিদিকে গুমোট পরিবেশ বিরাজমান। ক্রীতিক এলিসাকে নিয়েই এক পা দু’পা করে মেইন গেইটের কাছে চলে এসেছে। সায়র এখনো বসে বসে কাঁদছে, ক্রীতিক অর্নবকে চোখ দিয়ে ইশারা করতেই অর্নবও ধীরে ধীরে দরজার কাছে চলে যায়, ওদিকে এলিসার মাথায় গা’ন পয়েন্ট করে রাখায় এলিসার বাবা নরতেও পারছে না চরতেও পারছে না, অর্নব কাছে এগিয়ে আসতেই ক্রীতিক স্পষ্ট বাংলায় বলে,
— দরজার গুপ্তমন্ত্র বদলে ফেল অর্নব।
ক্রীতিকের কথার আগামাথা বুঝতে না পেলে, অর্নব ভ্রু কুঁচকে বললো,
— কি বদলে ফেলবো?
— গুপ্তমন্ত্র, গুপ্তমন্ত্র, দরজার গুপ্তমন্ত্র।
অর্নব বিরক্ত হয়ে বললো,
— আরে ভাই গুপ্তমন্ত্রটা আবার কি?
ক্রীতিক দাঁত কটমটিয়ে বললো,
— ইংলিশে যদি বলি দরজার পাসওয়ার্ড চেঞ্জ কর তাহলে তো ওরা বুঝে যাবে ছাগল।
ক্রীতিকের কথায় অর্নব দ্রুত পাসওয়ার্ড বদলানোর কাজে লেগে পরে, ওদিকে অর্নব কে বুঝাতে গিয়ে, এলিসার বাবা সহ সকলেই ক্রীতিকের পালানোর উদ্দেশ্য ধরে ফেলেছে, তাই তারাও ধীর পায়ে ওদের ধরার জন্য এগিয়ে আসছে, সায়র এখনো পা ধরে বসে বসে কাঁদছে।
— ডান।
অর্নব শব্দটা উচ্চারণ করতেই দ্রুত দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যায় ওরা তিনজন, যাওয়ার আগে দরজা ঠেলে সায়রের উদ্দেশ্যে ক্রীতিক চেঁচিয়ে বললো,
— দ্রুত আয় গাঁধা তোর পায়ে কিছু হয়নি, তাকিয়ে দেখ গু’লিটা প্যান্টে লেগেছে।
ক্রীতিকের কথা কানে পৌঁছাতেই সচকিত হয়ে তখনি তরিৎ বেগে দৌড়ে দরজার বাইরে চলে এলো সায়র। এবং আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে দরজাটা সশব্দে লাগিয়ে দিলো ক্রীতিক। যেহেতু অর্নব পাসওয়ার্ড বদলে দিয়েছে তাই এলিসার বাবা সহ ক্লাবের সবাই কক্ষের মধ্যেই আটকা পরে গিয়েছে। বাইরে এসে এলিসাকে ধা’ক্কা মে’রে অর্নবের বুকে ঠেলে দিয়ে সায়রের হাত টেনে, ওকে নিয়ে দৌড়াতে লাগলো ক্রীতিক।
হঠাৎ এলিসাকে এতো কাছে আবিষ্কার করে ওর গালে টুপ টুপ করে কয়েকটা চুমু খেয়ে নিলো অর্নব। এলিসা বিরক্ত হয়ে কটমটিয়ে কিছু বলবে তার ফুরসত না দিয়েই ওর হাত ধরে অর্নব ও দৌড়াতে লাগলো স্ব গতিতে ।
পেছনে একবার চোখ ঘুরিয়ে পর্যবেক্ষন করে দৌড়াতে দৌড়াতেই ক্রীতিক বললো,
— তারাতারি চল, অরু ভিলাতে একা আছে।
সায়র ছোটার গতি কমিয়ে দিয়ে বললো,
— তারাতারি যাওয়ার কি আছে ভাই, অর্নব তো পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে দিয়ে এলো।
ক্রীতিক অর্নবের দিকে তাকিয়ে শুধালো,
— অর্নব কঠিন পাসওয়ার্ড দিয়েছিস তো?
দৌড়াতে দৌড়াতেই অর্নব মিনিমিনিয়ে জবাব দিল, তারাহুরোয় মাথায় কিছু আসেনি তাই এলিসার নাম দিয়ে এসেছি।
অর্নবের কথায় ওরা সবাই আহাম্মক বনে গেলো, ক্রীতিক দাঁত কিরমির করে বললো,
— ইডিয়েট, আগে বলবি না? জলদি দৌড়া।
ক্লাবের নিচেই বাইক রাখা ছিল, একটা বাইকে ক্রীতিক আর সায়র উঠে পরে, অন্যটাতে এলিসা আর অর্নব। অর্নব রাইড করতে পারেনা,তাই এলিসাই ওদের বাইকটা রাইড করছে।
রাইড করে কিছুদূর যেতেই পুলিশে কল দিয়ে সায়র নিজের নাম পরিচয় গোপন করে ক্যা’সিনো ক্লাবের ঠিকানা দিয়ে দিয়েছে। ওরা এখন পুরোপুরি আশঙ্কা মুক্ত ব্যাপারটা বুঝে আসতেই, বাইকে বসেই গুনগুনিয়ে গান ধরেছে সায়র। ক্রীতিক রাইড করতে করতেই বললো,
— কিরে, এমন একটা সময় তোর গানও মনে পরছে? একটু আগেই তো ভ্যা ভ্যা করে মেয়েদের মতো কেঁদে ফেলেছিলি।
— তা কাঁদবোনা? তুই কিভাবে পারলি আমাকে পয়েন্ট করে গু’লি ছু’ড়তে?
— তোর গায়ে তো আর লাগেনি।আমার নিশানার উপর আমার কনফিডেন্স আছে।
— কি করে শিখলি এতো ভালো গান পয়েন্টিং?
ক্রীতিক মৃদু হেসে বললো,
— মন্ত্রীর ছেলে বলে সেল্ফ প্রটেকশনের জন্য বাবা স্পেশাল ট্রেইনার দিয়ে শিখিয়েছিলেন।
ক্রীতিকের কথায় সায়র ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ালো।
বাংলাদেশের কথা মনে পরতেই সব রেখে ক্রীতিকের মস্তিষ্কে হানা দেয় শুধু মাত্র অরু, অরুর কথা মাথায় আসতেই ক্রীতিক বলে,
— সায়র ধরে বস।
— আমাকে কি তোর মেয়ে মনে হয়? যে সিনেমাটিক ওয়েতে ধরে বসবো?
— না ধরলে নাই।আমি জাস্ট ওয়া’র্ন করলাম।
কথাটা বলেই হাওয়ার বেগে বাইকের স্পীড বাড়িয়ে দিলো ক্রীতিক। সঙ্গে সঙ্গে ওর কোমড় চেপে ধরে সায়র কাঁপতে কাঁপতে বলে,
— একটু স্পীড কমা ভাই, ভয় করছে। বমি করে দেবোতো।
— পসিবল না অরু একা আছে। এই বলে আবারও ফ্লাই ওভারে টার্ন নিলো ক্রীতিক।
*****************************************
সামনে পেছনে চারিদিকের সবকিছু ঘোলাটে লাগছে, মাথাটা চলন্ত ফ্যানের ন্যায় ভনভন করে ঘুরছে। পেটের মধ্যে নাড়িভুড়ি দলা পাকিয়ে গলার কাছে চলে এসেছে। হাত পা থরথরিয়ে কাপছে। বাইক থেকে নেমে হেলেদুলে কেবলই নিজের রুমে এসেছে সায়র, তবুও এখনো হৃদপিন্ডটা কেমন ধুকপুক করছে ওর। হাই স্পীডে বাইক রাইড দিয়ে ওকে এক প্রকার রোগী বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে ক্রীতিক। রুমে এসে মনেমনে ক্রীতিকের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছে সায়র, হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে জোরে শ্বাস নিতে নিতেই কটমট করে সায়র বললো,
—কোন অলক্ষুণে ওর মতো মানুষ আমার বন্ধু হয়েছিল কে জানে? কখনো ঠাস করে গু’লি মে’রে দিচ্ছে, তো কখনো বাইকে চড়িয়ে কলিজা হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে, সাইকো একটা। সায়র কথাটা শেষ করতে পারলো না, তৎক্ষনাৎ ধাপ ধাপ করে দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে ওর কলার চেপে ধরে ক্রীতিক দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
— আমার অরু কই?
আচমকা আ’ক্রমণে লাফিয়ে উঠে বসলো সায়র কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
— তোর সমস্যা কি জেকে? অরু হারিয়ে গেলেই তুই সব সময় আমাকে তে’ড়ে আসিস, কেন ভাই? আমিকি তোর অরুকে পকেটে লুকিয়ে রাখি? তারপর নিজের পকেট ক্রীতিকের চোখের সামনে ধরে বললো,
— দেখ, এই দেখ কোথাও তোর অরু নেই।
সায়রের ফাজলামো গায়ে না মেখে ক্রীতিক পুনরায় শুধালো,
— দেখেছিস কিনা সেটা বল।
ক্রীতিকের অ’গ্নিমূর্তি লক্ষ্য করে, শুষ্ক ঢোক গিলে এদিক ওদিক মাথা নাড়ালো সায়র।
ক্রীতিক সায়রকে ছেড়ে এলিসা আর অর্নবের দরজায় গিয়ে সশব্দে কড়া নাড়লো। ওরা ও মাত্রই রুমে প্রবেশ করেছিল, ক্রীতিকের ডাকে দ্রুত বেরিয়ে এসে এলিসা শুধালো
—কি হয়েছে জেকে?
এলিসার মুখটা মলিন, নিজের বাবার বি’পদের কথা চিন্তা করতে গিয়ে দ্বিতীয়বার ঠকেছে মেয়েটা, বাবার হাতেই ম’রতে ম’রতে কোনো মনে বেঁচে ফিরেছে আজ। তাই নিজের রাগ ঢাক ভেতরে পুরে শান্ত স্বরে ক্রীতিক বললো,
— অরুকে দেখেছিস এলিসা?
এলিসা ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
— কেন রুমে নেই? এতো রাতে কোথায় যাবে?
— কোথাও নেই দেখেই তো তোদের জিজ্ঞেস করছি।
ততক্ষণে অর্নবও নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে, সবটা শুনে ও বললো,
— চল রিসিপশনে একবার জিজ্ঞেস করে দেখি, কোথাও বেরোলে তো ওখান থেকেই বেরিয়েছে।
অর্নবের কথা যুক্তিসঙ্গত মনে করে, হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে সেদিকেই এগিয়ে গেলো ক্রীতিক।
.
ওরা চারজন রিসিপশনে এসে জানতে পারে খানিকক্ষণ আগেই বেরিয়েছে অরু, কোথায় বেরিয়েছে সেটা তারা জানেনা।
রিসিপশনিস্টের কথায় মাথায় র’ক্ত চড়ে গিয়েছে ক্রীতিকের, মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছে আজ অরুকে পেলে ওর হাতের মা’র খেতে খেতে অরুর খবর আছে।
অর্নব, সায়র এগিয়ে এসে বললো,
— এখন কি করবি?
ক্রীতিক চোয়াল শক্ত করে বললো,
— ইডিয়েট একটা আমাকে চিন্তায় না রাখলে শান্তি হয়না মেয়েটার ,আজ খুঁজে পেলে খবর আছে ওর।
নিজের অর্ধেক বয়সী স্টেপ সিস্টারের জন্য ক্রীতিকের এমন বেসামাল, উদ্বিগ্নতা দেখে আবারও নতুন করে প্রশ্ন জাগে ওদের তিনজনার মনে, কেন এতো উন্মাদনা,কিসেরই বা এতো আসক্তি?
**********************************-*****
প্রায় ঘন্টা খানিক সি-বিচের এ মাথা ওমাথা হাতরে বেরিয়েছে ক্রীতিক। সেই সাথে সায়র অর্নবও অরুকে খুঁজেছে হন্যে হয়ে, রাত তখন প্রায় দশটা ছুঁই ছুঁই। চারিদিকের ঘুটঘুটে আঁধার ছাপিয়ে সাগরের তীর আলোকিত হয়ে জ্বলছে সোডিয়ামের নিয়ন আলো, নিস্তব্ধতায় ঘেরা সমুদ্রতীরে ঢেউয়ের গর্জন ভেসে আসছে বারেবারে, রাত গভীর হয়ে যাওয়ায় একে একে মানুষ ফিরে গিয়েছে স্ব গন্তব্যে, ক্রীতিকের বেজায় অস্থির লাগছে চোখ দুটো বারবার এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, এভাবে ঘুরপাক করতে গিয়েই ওর চোখ আটকে যায় অদূর থেকে হেঁটে আসা লম্বা চুলের মেয়েটার দিকে। ক্রীতিক চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারে ওই মেয়েটাই অরু। তাই ও আর স্থীর না থেকে হনহনিয়ে হাঁটা ধরলো অরুর পানে। অনেকটা দূরত্ব ঘুচে গিয়ে ক্রীতিক যখন পুরোপুরি অরুর মুখোমুখি,ঠিক তখনই ক্রীতিককে দেখতে পেয়ে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো অরু। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো অজানা আ’তঙ্কে। মনেমনে ভাবলো,
— আজ আমি শেষ। রিপ অরোরা শেখ।
অরুর পেছনে আরও দুইটা থাই মেয়ে ছিল হাতে তাদের ঘুড়ি আর লাটাই। ক্রীতিক তাদেরকে এক নজর পরখ করে অরুর কাছে এসে ওকে সজোরে চ’ড় মা’রতে উদ্যত হয়েও থমকে যায়, উল্টে দু’হাত দিয়ে টান মে’রে আচমকা টেনে নেয় নিজ বুকের মধ্যিখানে।
এক্ষুনি গালে চ’ড় হামলে পরবে, সেই ভ’য়ে চোখ মুখ খিঁচেই রেখেছিল অরু। কিন্তু কিছু সময় যেতেই শরীরে শিহরণ জাগানো সেই স্যান্ডাল উড পারফিউমের ঘ্রানটা নাকের খুব কাছে অনুভব হতেই পিটপিট করে চোখ খুললো ও।আবারও একই ঘোর লাগানো অনুভূতি, ক্রীতিকের শরীরের শুকিয়ে যাওয়া ঘাম, পারফিউম, ধুলোবালি মিশ্রিত এই মাতাল মাতাল পুরুষালি সুঘ্রাণটা কিছুতেই সহ্য করতে পারেনা অরু, হাত পা কেমন অসার হয়ে আসে, কান গাল সব কিছু ছুঁয়ে যায় অজানা উষ্ণতায়। বারবার বেসামাল হয়ে ওঠে ভেতরের সুপ্ত নারীসত্তাটা। অথচ ক্রীতিক ওকে নিজের বুকের মাঝে এমন ভাবে শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে যে ক্রীতিকের শরীরের নেশা ধরানো সুঘ্রাণটা ক্রমাগত অরুর হৃদয়ে গিয়ে ঠেকছে। খানিকক্ষণের নিরবতা ভেঙে ক্রীতিক উদ্বিগ্ন সুরে শুধালো,
— অরু তোর বয়স কতো?
কোথায় গিয়েছিলি, কেন গিয়েছিল, কিভাবে গিয়েছিলি কোনোরূপ প্রয়োজনীয় প্রশ্ন না করে এমন একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করায়, অবাক হয়ে মুখ উঁচিয়ে ক্রীতিকের চোখের দিকে চাইলো অরু। পরক্ষণেই ওর চোখ গেলো ক্রীতিকের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আরও তিন জোড়া চোখের দিকে, যারা এই মূহুর্তে রিয়েলিটি শো দেখার মতো করে অষ্টাদশীর প্রেমে বেসামাল হয়ে ওঠা জায়ান ক্রীতিক চৌধুরীকে দেখছে।
সবাইকে এভাবে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে অরু মুখ কাচুমাচু করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
— ছাড়ুন সবাই কি ভাবছে।
— আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি অরু।
ক্রীতিকের স্পষ্ট আদেশে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অরু বলে,
— আঠারো বছর, ছয়মাস, তেরোদিন। এবার ছাড়ুন।
— পার্ফেক্ট।
নিজেকে ছাড়াতে গিয়ে অরুর চোখ গেলো এবার ক্রীতিকের পায়ের দিকে, গোড়ালি থেকে খানিকটা উপরে ফোল্ড করা ডেনিম প্যান্ট পরে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্রীতিক। তা দেখে সঙ্গে সঙ্গে অরু বলে ওঠে,
— একি আপনার জুতা কোথায়?
পেছন থেকে হাঁক পেরে একজোড়া স্নিকারস দেখিয়ে সায়র বলে,
— এই যে আমার হাতে।তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমরা একটু পা’গল পা’গল হয়ে গিয়েছিলাম কিনা।
অরু দ্রুত সায়রের সামনে গিয়ে মিনতির সুরে বললো,
— সরি ভাইয়া আপনারা কেউ ছিলেন না বলে, না বলেই বেরিয়ে এসেছিলাম। আমি রিসিপশনিস্ট কে বলে এসেছিলাম কিন্তু উনি আমার ইংলিশ পুরোপুরি বুঝতে পারেনি বোধ হয় ।
— অরু যা, এলিসার সাথে রিসোর্টে গিয়ে ঘুমিয়ে পর।
এমনিতেই মাঝরাতে সবাইকে চিন্তাগ্রস্থ করে ছেড়েছে, তাই ক্রীতিকের কড়া আদেশে আর নাকোচ করতে পারেনি অরু চুপচাপ চলে গিয়েছে এলিসার হাত ধরে।
ওদিকে সায়র, অর্নব আর ক্রীতিক বসে পরেছে উত্তাল ঢেউয়ের মুখোমুখি হয়ে, আজ বোধ হয় ওরা আর ঘুমাবে না।
চলবে…..