সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁 #পর্বঃ১৬ #লেখনীতে_suraiya_rafa

0
23

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ১৬
#লেখনীতে_suraiya_rafa

একতরফা ভালোবাসা বরাবরই বিরহের। নিজের অস্তিত্ব জানান না দিয়ে তাকে দিনের পর ভালোবেসে যাওয়া, তার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম অভ্যাসটাকে চুপিচুপি আপন করে নেওয়া। কিংবা পুরো মানুষটাকে ঘিরেই অজানা সুখের সপ্নজাল বোনা, এমন আশাতীত সপ্ন বিলাশ সবাই করতে পারেনা।কারন সবাই তো আর ভালোবেসে কষ্ট সইতে চায়না। তাছাড়া হৃদয়ে লুকোনো ভালোবাসার অস্তিত্বের খোজ সচারাচর কয়জনই বা করে? তবে সেই অস্তিত্ব, সেই সপ্ন যদি এক নিমিষে গুড়িয়ে যায়?অন্তরের অন্তস্থলে থাকা মানুষটা যদি সবচেয়ে জঘন্য আর ঘৃণিত মানুষে পরিনত হয়? তাহলে ভুলটা কার? যে ভালোবেসেছিল সেই মানুষটার নিশ্চয়ই? তাইতো অরুও আজকাল নিজেকে অপরাধী ভাবে। ভালোবাসার দোষে অপরাধী।
কিন্তু অরু যেটাকে একপাক্ষিক ভালোবাসা ভেবে বসে আছে সেটা কি আদৌও ভালোবাসার অনুভূতি ছিল? নাকি নিতান্তই টিনএজ ফ্যান্টাসি? যদি তা নাই হবে,তবে নিখিলের বাইরে দ্বিতীয় পুরুষ হিসেবে ক্রীতিকের কাছে আসাটা কেন এতো রোমাঞ্চকর?কেন ডানা ঝাপটানো বন্য পাখির ন্যায় বেসামাল, আর ব্যাতিগ্রস্থ।

আজ আবহাওয়াটা বেশ ভালো।মাথার উপর তীর্যক আলো ছড়াচ্ছে সূর্য কীরন।তবুও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বাতাসে ক্যালিফোর্নিয়ার আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। ঠান্ডা থাকা সত্বেও অন্যান্য শীতল দিনের সাথে তুলনা করলে বলা যায় আজ গড়ম পরেছে বেশ।
নিয়ন সূর্যতাপ গায়ে মাখাতে মাখাতে রাস্তার ফুটপাত ধরে এলোমেলো পা ফেলে হাটছে অরু। পরনে লংস্কার্ট আর ডেনিম টপস তারউপর পাতলা কালো কোর্ট।হাতের ভাজে পোকেমোন আঁকা কালো রঙা টেটো ব্যাগ।
মাত্রই বাস ধরে হসপিটাল থেকে ফিরেছে সে। আর এখন গন্তব্য ক্রীতিকের জনমানবহীন শুনশান শহরতলী।আজ প্রায় সপ্তাহ খানিক পর বাইরের পৃথিবীর মুখ দেখলো ও। তাও আপার জোরাজোরি তে। গত একসপ্তাহে ভার্সিটি যায়নি অরু, আর নাতো যাওয়ার ইচ্ছা জেগেছে মনে।সারাদিন কক্ষবন্ধী হয়ে থাকে বলে,আজ জোর করেই অনু হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল ওকে। মায়ের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। আজকালের মধ্যেই অপারেশন হবে। আর তারপর হয়তো সব কিছু আবার আগের মতো হয়ে যাবে। অরু অনুর দুঃখের দিন ঘুচে যাবে। কিন্তু আদতে কি ঘুচবে? ভেবে পায়না অরু। কিকরেই বা পাবে? মাত্র কয়েকমাসের ব্যাবধানে ওর হৃদয়টা যে ভে’ঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। একটা জঘন্য চরিত্রের মানুষকে দিনের পর দিন অন্ধের মতো মনেমনে ভালোবেসে গিয়েছে ও,অথচ তার ওই নোংরা চোখের ভাষা টা অবধি বুঝতে পারেনি,ছিহ।
নিজের উপর আরও একবার রাগের নদীতে তে জোয়ার এলো অরুর। ও যে কতবড় আহাম্মক সেটা ভেবে নিজেকেই নিজে হাজারটা চ’ড় থা’প্পড় আর গালাগাল দিতে ইচ্ছে করছে ওর।

অরু যখন হাজারটা দোষী সাব্যস্ত করে বারবার নিজেকেই নিজে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। ঠিক তখনই রাস্তার বিপরীত পাশ থেকে জেব্রা ক্রসিং পার হয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো একজন। পুরো শরীর তার কালো দিয়ে আবৃত। এমন কি মুখটাও মাংকি টুপি দিয়ে আটকানো। চোখ দুটোতে হিং’স্রতা জ্বলজ্বল করছে লোকটার। চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে লোকটা বিশ্রী ভাবে হাসছে।
লোকটাকে দেখে ভাবনায় পরে গেলো অরু, ওর মনে হচ্ছে এই চোখ দুটো এর আগেও কোথায় যেন দেখেছে ও। দেখলে দেখেছে কিন্তু এভাবে পথ আটকে দাড়ানোর মানে কি?
নিজ ভ্রু কুঞ্চিত করে অরু বিরক্ত সুরে লোকটার উদ্দেশ্যে বললো,
— আপনি আবার কোন ক্ষেতের মুলা? এমনিতেই ভারী অশান্তিতে আছি পথ ছাড়ুন তো।
লোকটা বোধ হয় অরুর কথা বুঝলো না,বিদেশি হবে হয়তো। তাই ও ইংরেজিতে বলার চেষ্টা করলো,
—- হু? হু আর ইউ??

লোকটা জবাব দিলো না নিঃশব্দে, নির্লিপ্ত কপট চোখ দুটো নিক্ষেপ করলো নিজের হাতের দিকে। অরু ও তার চোখ অনুসরণ করলো, আর যা দেখলো তাতে পিলে চমকে উঠলো ওর। লোকটার কালো রঙের গ্লোভস পরা হাতে বেশ বড়সড় একটা ধারালো ছু’রি। দেখে মনে হচ্ছে অরুকে আঘাত করার জন্যই অগ্রসর হচ্ছে তার হাতটা। কিন্তু কেন? আমেরিকার মতো একটা অচেনা, অজানা দেশে অরুর মতো একটা তুচ্ছ দু পয়সার মেয়ের সাথে কিসের এমন শ’ত্রুতা এই ভ’য়ানক লোকটার?

সে যে শ’ত্রুতাই হোকনা কেন,আপাতত এই লোকটার থেকে পালিয়ে প্রানে বাঁচাটা জরুরি। নয়তো এই শুনশান নিরব রাস্তায় ওকে বাঁচানো তো দূরে থাক,ওর লা’শটাও খুঁজতে আসবে না কেউ । অজস্র কুন্ডলি পাঁকানো দুশ্চিন্তারা ঘীরে ধরেছে অরুর মন মস্তিষ্ক। ভেতরের ভয়টা দলা পাকিয়ে গলায় আঁটকে এসেছে। অরু যেন শ্বাস প্রশ্বাস নিতেও ভুলে গিয়েছে। তবে ওর এসব ভাবনাকে প্রশ্রয় দিলো না লোকটা। বরং তার আগেই ক্ষীপ্ত গতিতে তেড়ে এসে ছু’রিকাঘাত করতে অগ্রসর হলো অরুর পানে। ঘটনাটা এতোই দ্রুত ঘটছে যে, কিছুই ঠাহর করতে পারলো না অরু। লোকটা এগিয়ে আসতেই হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে প্রানপনে উল্টো দিকে দৌড় লাগালো ও। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো লোকটা ওর পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে না, বরং সাইকোপ্যাথ দের মতো চা’কু হাতে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। দেখে মনে হচ্ছে লোকটা জানে অরুর শেষ গন্তব্য কোথায়?

*****************************************
একটানা দিগ্বিদিক দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে উঠেছে অরু। শেষমেশে আর দৌড়াতে না পেরে রাস্তার মাঝেই হাটুতে দু’হাত ভর করে দাঁড়িয়ে পরলো ও। হাঁপাতে হাঁপাতে পেছনে তাকিয়ে খুব সাবধানে পরখ করে নিলো রাস্তার অদূর পর্যন্ত। নাহ, দু একটা চলন্ত গাড়ি ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হাঁপাতে হাঁপাতে অরু ভাবছে,
—- আহ!তার মানে এ যাত্রায় প্রানে বেঁচে গিয়েছি।

ঠিক তখনই ওর খুব কাছ থেকে ভেসে এলো একটা অচেনা অপ্রিতীকর কন্ঠস্বর,
— জেকে স বেবি গার্ল, আই কট ইউ।

আচমকা এমন একটা ভয়ানক আওয়াজ শুনে চমকে উঠে সামনে তাকালো অরু, দেখলো তখনকার লোকটা ওর সামনেই, কিচ্ছু বদলায় নি।আগের মতোই বিশ্রী চাহনি দিয়ে ওর পানে তাকিয়ে আছে সে। হুট করে আবারও ওই লোকটাকে দেখে অকস্মাৎ লাফিয়ে উঠে পেছনের পিচ ঢালা রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পরে গেলো অরু। শুষ্ক ঢোক গিলে চারপাশে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলো এতোক্ষণ দৌড়াতে দৌড়াতে ঘুরে ফিরে গোলকধাঁধাঁর মতো আবার আগের যায়গাতেই ফিরে এসেছে ও। নিজের মূর্খামির ফল সরূপ আরও একবার ফেঁ’সে গেলো অরু। আপা কতো করে বলেছিল আমি এগিয়ে দিয়ে আসি, অথচ অরু শোনেনি। আর এখন সামনে মৃ’ত্যু খেলা করছে ওর। এছাড়া তো কোনো উপায় নেই।
লোকটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে অরুর দিকে। অরু যে উঠে দাড়িয়ে আবারও দৌড়ে পালাবে সেই শক্তি নেই ওর শরীরে, উল্টে হাত পা কন্ঠ সব কিছু রোধ করে রেখেছে এক অজানা আ’তংক। অরুকে ভয় পেতে দেখে লোকটা খিকখিক করে হেঁসে বললো,
— এ্যান্ড আ’ল কি’ল ইউ, প্রিন্সেস।

অরু এবার ঠোঁট চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলো, কাঁদতে কাঁদতেই দু’হাতে ভর করে পেছাতে লাগলো কুচকুচে পিচঢালা রাস্তা ধরে । তবে লোকটার গতিবেগ ছিল দিগুন। সে এতোক্ষণে ওর খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে পরেছে। মাথাটা এদিক ওদিক কাত করে ঘাড় ফুটিয়ে,তীব্র আক্রোশে উদ্যত হয়েছে অরুকে ছু’ড়িকাঘাত করার জন্য। লোকটার পরবর্তী পদক্ষেপের কথা ভেবেই অরু চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে ফেললো , এই মূহুর্তে প্রিয়জনের মুখগুলো ভাসছে ওর মানসপটে, মা, আাপা, আর তো কেউ নেই। অথচ মানসপট জুড়ে দুটো নয়, বরং তিন তিনটে মুখ ভেসে উঠছে। মা আপা আর সব শেষে জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী। ওর স্টেপ ব্রাদার, যে ওকে সব সময় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, সবার কাছে বাড়ির চাকর হিসেবে পরিচয় দিয়ে বেড়ায়, ওর গা’য়ে হা’ত তোলে, ওকে শীতের রাতে ঘরে থেকে বের করে দেয়, মাঝ রাস্তায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়, হুটহাট রেগে গিয়ে সবার সামনে অপমান করতেও দু’বার ভাবে না। অথচ এই মূহুর্তে হৃদয়টা তাকে ঘৃণা করতে চাইছে না,মনে হচ্ছে ক্রীতিক নিজেকে ঠিক যতটা খারাপ প্রমান করতে চায়, ততটাও খারাপ সে না, নয়তো তিঁতে হয়ে যাওয়া হৃদয়টা তাকেই কেন স্বরণ করছে বারবার তাও এমন একটা মূহুর্তে? ক্ষনিকের জন্যে হলেও মনে হচ্ছে আজ ক্রীতিক থাকলে ওকে এতোটা বি’পদে পরতে হতো না। কোনো না কোনো ভাবে ঠিক বাঁচিয়ে নিতো সে।
অরু সেই কখন থেকে আজগুবি চিন্তায় বিভোর, অথচ লোকটা ওকে আ’ঘাত না করে চুপ চাপ দাঁড়িয়ে আছে, তা কি করে হয়?

কপালের উপর তরল জাতীয় কিছু অনুভব হতেই, ভাবনার সুতো ছিড়ে যায় অরুর। জিনিসটা কি তা দেখার জন্য, হাত দিয়ে কপালটা স্পর্শ করে সেটা চোখের সামনে এনে ধীরে ধীরে চোখ খুললো ও । দেখলো ওর হাত ভর্তি তরতাজা র’ক্ত। তাহলে কি লোকটা ওকে আঘাত করেছে? কই ব্যাথা লাগলো না তো? নাকি ইতিমধ্যে ইহলোক ত্যাগ করেছে অরু?

ব্যাপারটা ঠিক ভাবে আন্দাজ করার জন্য আচমকা মাথা তুলে চাইলো অরু। আর যা দেখলো তাতে ওর দম আটকে যাওয়ার উপক্রম হলো। বিশ্বাস করতেও খানিকক্ষন কষ্ট হলো।কিন্তু চোখের সামনে ঘটতে থাকা ঘটনা তো আর মিথ্যা হতে পারেনা। তাই চোখে কয়েকবার পলক ছেড়ে আবারও খেয়াল করে তাকালো ও,দেখলো ওই ধারালো ছু’রিটাকে নিজ হাতে মুঠিবদ্ধ করে রেখেছে ক্রীতিক। এতো জোরেই সেটাকে চেপে ধরেছে যে, ক্রীতিকের হাত কে’টে টুপটুপ করে র’ক্ত অরুর কপাল আর নাক বেয়ে চুয়িয়ে চুয়িয়ে পরছে। কারণ ওই লোকটা ক্রীতিকের মধ্যেখানে বসে আছে অরু।

ক্ষনিকের মধ্যে ক্রীতিকের ঝরে পরা র’ক্তে অরুর জামা কাপড়ও র’ক্তরঞ্জিত হয়ে উঠেছে,তবুও ছু’ড়ি কিংবা ওই মুখ ঢাকা ছদ্মবেশি লোকটাকে কিছুতেই ছাড়ছে না ক্রীতিক। এক পর্যায়ে অরু সচকিত হয়ে উঠে দাড়িয়ে ক্রীতিকের ছু’ড়ি চেপে ধরা হাতটা টানতে শুরু করলো, আর্তনাদ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— কি করছেন ? এটাকে ছাড়ুন, আপনার হাত কে’টে যাচ্ছে তো।

ক্রীতিকের অরুর কথায় কান নেই একটুও।ও তো ওই লোকটার মুখোশ উন্মোচনে ব্যাস্ত। এক পর্যায়ে টানতে টানতে লোকটার মাংকি টুপিটা খুলেই ফেললো ক্রীতিক। এভাবে নিজের ছদ্মবেশ খুলে যেতেই লোকটা নিজের ছু’ড়ি আর টুপি ফেলে রেখেই দু’হাতে মুখ ঢেকে তরিৎ গতিতে দৌড়ে পালালো।

লোকটা পালিয়ে যাচ্ছে দেখে ক্রীতিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সেদিকে। মনে হচ্ছে ও আজ লোকটাকে ধরেই ছাড়বে।কিন্তু সেসব চিন্তার ইতি ঘটিয়ে অরু ওর হাত টেনে ধরে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
— আ..আমার ভয় করছে, যাবেন না দয়াকরে।

ক্রীতিকের পূর্ন দৃষ্টি এবার অরুর দিকে চলে গেলো, যে এই মূহুর্তে ওর র’ক্তে মাখামাখি হয়ে দাড়িয়ে আছে। র’ক্তে ভেজা অরুকে দেখে ক্রীতিকের চোখ জ্বলে উঠলো, কপালে তৈরি হলো দুশ্চিন্তার কয়েক খানা ভাঁজ। ও দ্রুত হাতে অরুর বাহু চেপে ধরে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে, আহত সুরে শুধালো,
— কোথায় লেখেছে তোর? এতো র’ক্ত কেন?

অরু কাঁদতে কাঁদতে বিস্ময়ে বিমূর্ত হয়ে জবাব দিলো,
— এগুলো আপনার র’ক্ত। হাত কেটে গিয়েছে আপনার। ভুলে গেলেন?

অরুর কথায় ক্রীতিক সস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে ওকে হুট করেই বুকে চেপে ধরে বললো,
— ওহ, থ্যাংকস গড।

এবার আর দূর থেকে নয়, ক্রীতিকের শরীরের স্যান্ডালউড পারফিউমের মারাত্মক পুরুষালী গন্ধটা খুব কাছ থেকে এসে সুরসুরি দিলো অরুর নাকে। তবে ও আপাতত এসব কিছু ভাববার মতো মানসিক অবস্থায় নেই। তাই ক্রীতিকের বাহুতে আগলে ধরাটা নিতান্তই সাভাবিক আর আন্তরিকতার চোখেই দেখলো অরু।
*****************************************

অরুকে পাঠিয়ে দিয়ে সারাদিন হসপিটালেই ছিলো অনু। আজ আর পার্ট টাইমেও যাওয়া হয়নি ওর।খুব শীঘ্রই অপারেশন হবে মায়ের। অনুর জন্য এই মূহুর্তে হসপিটালে থাকাটা খুব জরুরি। তাই অনু ভেবেছে পার্ট টাইম থেকে কয়েকদিন ছুটি নিয়ে, পুরো সময়টা হসপিটালে কাটাবে ও। এখন সন্ধ্যারাত, অনু কেবলই হসপিটাল থেকে বেরিয়েছে, সারাদিন কিছু না খাওয়ার দরুন শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছে ওর। হসপিটাল থেকে কিছুদূর হেটে গেলেই একটা গ্রোসারি শপ পাওয়া যায়। অনু হাটতে হাটতে গ্রোসারিতে গিয়ে কিছু খাবার কিনে নিলো। তারপর গিয়ে বসলো রাস্তার পাশের একটা খালি বেঞ্চিতে, সেখানে বসেই খেতে আরম্ভ করলো শুকনো খাবার গুলো । ওর মনটা আজ বড্ড ফুরফুরে,সেই সাথে ভেতরটাও হালকা লাগছে কয়েকগুণ। মনে হচ্ছে এতোদিনের কষ্ট, পরিশ্রম, ত্যাগ কোনোটাই বিফলে যায়নি। অবশেষে সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার দারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে ওরা। হাতে থাকা বাবল টিতে একটা লম্বা সিপ টেনে মুচকি হেঁসে অনু আনমনে বলে ওঠে,
— আপনাকে খুব মিস করছি। প্রত্যয় সাহেব।

তারপর আবারও একটা লম্বা সিপ…. তবে এবার অনু চা’য়ের সিপ নিয়েছে ঠিকই কিন্তু সেটা আর গলা থেকে নামাতে পারলো না, তার আগেই ওর দৃষ্টিগত হলো অনাকাঙ্ক্ষিত এক দৃশ্য।
গ্রোসারি শপের সামনেই প্রত্যয় একটা মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছে , ওর হাতেও দুটো বাবল টি এর জার।মেয়েটার ভাবভঙ্গিমা এমন যেন এখনই লাফ দিয়ে কোলে উঠে পরবে প্রত্যয়ের।

অনু বড্ড আত্মসম্মানী, একনজর দেখেছে বলে সারাক্ষণ হ্যাংলার মতো তাকিয়ে তাদের কান্ডকারখানা দেখবে এতোটাও নির্লজ্জ মেয়ে ও নয়। তাই প্রত্যয়ের চোখ এদিকে আসার আগেই অনু হাটা দেয় উল্টো পথে। হাটার সময় রাস্তার পাশের ডাস্টবিনে ছুড়ে মা’রে হাতে থাকা বাবল টি ভরতি জারটাকে। অনুর মতে এটা বারাবাড়ি নয়, এটাই ওর আত্মসম্মান। যা ও খুব সহজে খেলার জন্য কারও হাতে তুলে দেবেনা। যদিও প্রত্যয়কে সেটা তুলে দেওয়ার জন্য ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে উঠেছিল হৃদয়টা। তবে এখন মনে হচ্ছে সেটা নিতান্তই ভুল সিদ্ধান্ত
হতো।
*****************************************
অন্যান্য দিনের মতো আজও হল রুমের কাউচে বসে নিচের ক্ষ’ত সারাতে বসেছে ক্রীতিক।
তখন অরু খেয়াল করেনি, ক্রীতিক আগে থেকেই আ’হত ছিল, ওর দু’পা,কপালের কিছুটা অংশ, সব খানেই র’ক্তা’ক্ত ক্ষত ছিল। সেই সাথে বাইকার লেদার জ্যাকেটটাও ছিল ছেড়া।

জামা কাপড় পাল্টে নিজেকে পরিষ্কার করে মাত্রই নিচে এসেছে অরু।আপা বাড়িতে ফেরেনি, বিকেলের ঘটনার পর থেকেই ভেতরে অজানা আ’তংকটা জেনো জেকে বসেছে দিগুণ হারে। রুমের মধ্যেও একাএকা থাকতে কেমন যেন গা ছমছম করছে ওর। তাইতো রুমের কাজ সেরে দ্রুত নিচে নেমে এসেছে অরু। ক্রীতিক আজও ফার্স্টএইড নিয়ে বসে আছে। তবে ওর মুখ ভঙ্গিমা কেমন যেন অন্যরকম, নিজের শরীরের এতো এতো ক্ষত তে কোনোরূপ খেয়াল নেই ওর।মনে হচ্ছে কোন কিছু নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে আছে ক্রীতিক। অরু সেদিনের মতো করে ক্রীতিকের কাছে এগিয়ে গিয়ে আগ বাড়িয়ে বললো,
— দিন আমি ট্রিট করে দিচ্ছি।

হঠাৎ, অরুর আওয়াজে ধ্যান ভাঙে ক্রীতিকের। ও বিরক্ত হয়ে বলে,
— তুই পারবি না, যাতো নিজের কাজ কর গিয়ে।
অরু পাত্তা দিলোনা ওর কথায়। উল্টে গিয়ে বসলো ক্রীতিকের পায়ের কাছে। মেঝেতে বসে তুলার মধ্যে এন্টিসেফটিক লাগিয়ে ক্রীতিকের হাটুর উপর চেপে ধরতেই চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নিলো ক্রীতিক।তবে মুখ দিয়ে একটা টু শব্দও বের হলোনা ওর। অরু বিরক্ত হলো, লোকটার অনুভূতি বলে কিছু নেই নাকি? ও কেন যেন ধূর্ততা অবলম্বন করলো। হুট করেই, হাতের তুলাটা আরও শক্ত করে চেপে ধরলো ক্রীতিকের ক্ষতস্থানে। এবারও চুপচাপ নির্বিগ্ন সে।
শুধু চোখ বুঝেই হাস্কি স্বরে বললো,
— আমাকে ব্যাথা দিয়ে শান্তি পাস?

সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলো অরু, তারমানে ক্রীতিকেরও ব্যাথা লাগে, শুধু মুখে প্রকাশ করে না। ও পুনরায় এন্টিসেফটিক লাগাতে লাগাতে বললো,
— কি করে ব্যাথা পেলেন?

ক্রীতিক জবাব দেয়,
— যাস্ট এ মাইনর বাইক এ’ক্সি’ডেন্ট।

— বাইকে আপনার এতো আসক্তি?এতো ব্যাথা পাওয়ার পরেও বাইক রাইডিং ছাড়েন না।

ক্রীতিক ঠোঁট কামড়ে একটু হেসে বলে,
— তোর থেকে বহুগুন কম। তাহলে ভাব তোকে কিভাবে ছাড়ি?

পায়ের ক্ষতগুলোতে অন-টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়ে,ক্রীতিকের পাশে বসে ওর হাতটা দেখতে দেখতে অরু বললো,
— কি বললেন? শুনিনি।

— নাথিং, আমি যখন কথা বলি তখন কান কোথায় থাকে তোর?

অরু ঠোঁট উল্টে বললো,
— আমি ভাবছি হাতের ক্ষ’তটা অনেক গভীর, এটা আমি কিভাবে ব্যান্ডেজ করবো? দেখেতো মনে হচ্ছে সেলাই লাগবে।

ক্রীতিক নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
— না পারলে, দুরে সর। নিজেই তো পাকনামি করে এসেছিস সাহায্য করতে।এখন বলছিস পারবো না।আমি বলেছিলাম আসতে?

অরু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ক্রীতিকের হাতটা আবারও টেনে নিয়ে সেখানটায় ব্যাথা নাশক লাগাতে লাগাতে বললো,
— আপনি এমন কেন?

— কেমন আমি?

— ঝগরুটে, তিল কে তাল বানিয়ে ফেলেন, আপনার বউয়ের কপালে দুঃখ আছে।

অরুর কথায় ক্রীতিকের ঠোট বাঁকা হাসিতে প্রসস্থ হয়। তারপর হুট করেই চোখ মুখ কুঁচকে সামনের মনিটরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্রীতিক বলে,
— ঠিকই বলেছিস, আমার কথা না শুনলে তোর কপালে অনেক দুঃখ আছে।

— হ্যা সেতো জানিই, আপনি ক্রীতিক কুঞ্জের ছোট সাহেব কিনা, দুঃখ তো থাকবেই। আচ্ছা তখন হঠাৎ ছু’ড়িটা চেপে ধরতে গেলেন কেন শুনি?
— চেপে না ধরলে তো তোর আ’ঘাত লাগতো।

ক্রীতিকের হাতের ক্ষ’তটা অনেক বেশি গভীর, অরুর ভেতর ভেতর অনুশোচনা হচ্ছে ওর জন্যই আজ এমনটা হয়েছে। তাই ও ক্রীতিকের ক্ষতস্থানে হালকা ফু দিয়ে এনসেফটিক লাগাতে লাগাতে নরম সুরে শুধালো,
— বেশি ব্যাথা লাগছে?

নিজের শরীরটাকে কাউচে উপর ছেড়ে দিয়ে ক্রীতিক চোখ বন্ধ করে বললো,
— এখন কম লাগছে।
*****************************************
মাঝরাত চলমান…. দিনের আলো শেষ হতেই তাপমাত্রা নেমে গিয়ে চারিদিকে কনকনে শীতল হাওয়া বইছে, অনু আর অরু বোধ হয় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অথচ ছাঁদ বারান্দায় এখনো টিমটিমিয়ে ফেইরী লাইট জ্বলছে। সেখানে গোল হয়ে বসে আছে অর্নব, সায়র, এলিসা। ক্রীতিক ওদের থেকে খানিকটা দুরে দাড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ব্যাস্ত। ওরা সবাই সারারাত ধরে কিছু একটা পরামর্শ করেছে, অর্নব কোলের উপর ল্যাপটপ নিয়ে এখনো কি যেন করছে। এলিসা দ আকারে বসে অর্নবকে বললো,
— তুই কবে এসব বন্ধ করবি অর্নব?

অর্নব ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
— বন্ধ করবো মানে? তোর বাবাকে ওরা আটকে রেখেছে, ভিডিও প্রুফ পাঠিয়েছে, তুই না গেলে ওরা তোর বাবাকে মে’রে ফেলবে, আর তুই ভাবছিস তোকে আমরা ওই রিস্কি যায়গায় একা যেতে দেবো?

সায়র পাশ থেকে বললো,
— আচ্ছা আমরা পুলিশ কে কেন বলছি না?

অর্নব দাঁত কিরমিরিয়ে বললো,
— গর্ধব পুলিশকে জানালে এলিসাও ফেঁসে যাবে, তাছাড়া ক্লাবটা ইউ এস এ’র নয় থাইল্যান্ডের।
ওদের বাকবিতন্ডার মাঝে ক্রীতিক না ঘুরেই বললো,
— অর্নব প্রাইভেট জেট বুক কর, অরুর ফ্লাইট ফোবিয়া আছে ওকে নিয়ে বিজনেস ক্লাসে যেতে পারবো না।

আশ্চর্য্যের শেষ সীমানায় গিয়ে সায়র, অর্নব, এলিসা সবাই একই সুরে বললো,
— অরু???

তীরের ছিলার মতো এক ভ্রু উঁচিয়ে ক্রীতিক জবাব দেয়,
— ইয়েস অরু।

সায়র ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বললো,
— লাইক সিরিয়াসলি জেকে? আমরা একটা মিশন নিয়ে থাইল্যান্ড যাচ্ছি, আর তুই সেখানে বিপ’দের মধ্যে অরুকে নিয়ে যাবি?
— আমি যেখানে থাকবো, সেখানে অরুর কোন বি’পদ নেই।

এলিসা শুধালো,
— কিন্তু হঠাৎ অরুকে, এভাবে?

ক্রীতিক সিগারেটের শেষ অংশটা পায়ে পিষ্ট করে দাঁত চেপে বললো,
— ইয়েসটারডে সাম ওয়ান ট্রাইড টু এ্যা’টার্ক হার।
এবারও সবাই তারস্বরে বলল,
— কিহ?

ক্রীতিক হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
—ঠিকই শুনেছিস, কাল ওই বা’স্টা’র্ড টার ভাগ্য ভালো ছিল যে আমি উইক ছিলাম। তবে চিন্তা নেই খুব শীঘ্রই নিজ কর্ম ফল ভোগ করবে সে। কিন্তু এই মূহুর্তে আমি অরুকে একা রেখে দেশের বাইরে গিয়ে কিছুতেই নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো না।

— কিন্তু অনু?ওর উপর কোনো এ্যা’টার্ক আসবে না তার কি গ্যারান্টি?

এলিসার প্রশ্নের জবাবে ক্রীতিক বলে,
— অনুর জন্য চিন্তার কারন নেই কারন ও বেশির ভাগ সময়ই হসপিটালে থাকে। তাছাড়া প্রত্যয় থাকতে অনুর সাথে খারাপ কিছু হওয়ার চান্স নেই।

এতোক্ষন পর সায়র উচ্ছ্বাসিত হয়ে বললো,
— ভালোই হবে, তোরা তোদের মিশন, ফিশন শেষ করবি, সেই ফাঁকে আমি আর অরু, একটু ব্যাংককের সমুদ্র বিলাশ সেরে আসবো।নট আ ব্যাড আইডিয়া ।

তৎক্ষনাৎ ওর পশ্চাৎদেশ বরাবর লা’ত্থি মে’রে, কনকনে বরফ শীতল ঠান্ডা পানিতে ফেলে দিয়ে ঠোটের কোনে একটা কপটতা মিশ্রিত হাঁসি ঝুলিয়ে ক্রীতিক বলে,
— নো চান্স ব্রো, শি ইজ মাইন …..

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here