সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁 #পর্বঃ১৭ #লেখনীতে_suraiya_rafa

0
579

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ১৭
#লেখনীতে_suraiya_rafa
[শুধুমাত্র প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য]

আমেরিকার আবহাওয়া মানেই আধুনিক ভাষায় মুড সুইং। এদেশে আলাদা করে বর্ষা মৌসুম নামে কিছু নেই বলে পুরো বছরের যখন তখনই প্রকৃতি ধারণ করে তীব্র বর্ষারূপ। বিশেষ করে শীতে প্রকান্ড কুয়াশা আবৃত ধরনীকে আরও খানিকটা শীতল কনকনে ঠান্ডা জলে ভিজিয়ে দিতে নেমে আসে এক পশলা ঝুম বৃষ্টি। আজও তেমন করে অপ্রত্যাশিত ভাবেই প্রকৃতিতে হানা দিয়েছে তীব্রাকার বর্ষাকাল। সকাল সকাল তো ভালোই রোদ উঠেছিল,আর এখন দিনের আকাশ মেঘে ঢেকে ঢুকে সন্ধ্যারাতে পরিনত হয়েছে। জানালার কাঁচ গলিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে আচঁড়ে পরছে রুমের মেঝেতে। অনু হাতের কাজ রেখে দ্রুত এগিয়ে দিয়ে জানালার কাঁচটা পুরোপুরি টেনে দিলো। এখন ঠান্ডাও কম লাগছে খানিকটা। সেই কখন থেকে অনুর ডাকাডাকির ফলস্বরূপ এতোক্ষণে উঠে গিয়ে রোবটের মতো সকালের কাজ গুলো সেরে নিলো অরু।

খানিকবাদে ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে ঘ্যানঘ্যান করে অনুকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো,
—- কি দরকার আপা, আমি যেতে চাইনা ওনাদের সাথে, তুই কেন অযথা জামা কাপড় গোছাচ্ছিস?

অরুর জামাকাপড় গুলো গুছিয়ে সযত্নে ট্রলি ব্যাগে রাখতে রাখতে অনু বলে,
—- যেতে চাস না মানে? সারাদিন তো ঘরে মনমরা হয়ে বসে থাকিস, ভার্সিটিতেও যাচ্ছিস না কিছুদিন ধরে, আমার তো আর তোকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার সময় হয়ে ওঠেনা,তারচেয়ে বরং ক্রীতিক ভাইয়াদের সাথে ঘুরে আয়। মন ভালো হয়ে যাবে। তাছাড়া ক্রীতিক ভাইয়ার মেয়ে বান্ধবী কি যেন নাম?

অরু ঘাড় ঘুরিয়ে জবাব দেয়,
—- এলিসা আপু।

— হ্যা, উনি তো তোকে অনেক আদর করে তাহলে তোর চিন্তা কিসের?

নিজের অলস শরীরটাকে বিছানায় ছেড়ে দিয়ে অরু বলে,
—– আমি এখন বড় হয়ে গিয়েছি আপা, কারও আদর করা না করা নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই।

অনু সব কিছু ঢুকিয়ে লাগেজের চেইন লাগাতে লাগাতে বললো,
—- তাহলে অযথা যাবোনা যাবোনা বলে কেন ঢং করছিস? দেখ অরু, আগামী কয়েকদিন হসপিটালে অনেক ব্যাস্ত থাকবো আমি, ঠিক মতো বাসায় আসতে পারবো কিনা সন্দেহ। তারচেয়ে বরং তুই এই ফাকে ঘুরে আয়, এসে দেখবি আমাদের মায়ের অপারেশন সাকসেসফুল। তাছাড়া ক্রীতিক ভাইয়াতো বলেছে তারা ঘুরতেই যাচ্ছে।

অরু মুখ ফুটে আর জবাব দিলো না, শুধু মনে মনে ভাবলো,
—- সমস্যাটা তো ওই ক্রীতিক ভাইয়াকে নিয়েই। সে তো এলিসা আপু টাপু কাউকেই মানে না, আর এখন এতো দুরে তার সাথে গেলেতো মাথার উপর উঠে তান্ডব নৃত্য চালাবে। কথার মাথায় উঠাবে আর বসাবে। সারাক্ষণ অর্ডার আর হুকুম, এসব আমি একদম নিতে পারিনা।

— কিরে কি ভাবছিস? ঘুরে আয় এতে তোরই লাভ। আমার সুযোগ থাকলে তো আমিও যেতাম। তাছাড়া মা সুস্থ হয়ে গেলেতো আবার আগের মতো জীবন কাটাতে হবে, তুুইতো জানিস মা ঘোরাঘুরি একদম পছন্দ করেন’না।

অনুর কথায় অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে, দু’হাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
—– তুই বেস্ট আপা। ইশশ তুই যদি আমার মা হতি?

অনু অরুর দু’হাতের উপর নিজের হাত রেখে বলে,
—– হয়েছে আর তেল দিতে হবে না, এখন দ্রুত রেডি হয়ে নে, ক্রীতিক ভাইয়া ভার্সিটিতে গিয়েছে সেখান থেকে ফিরে তোকে পিক করে সোজা এয়ারপোর্ট যাবে।
কয়েকমূহুর্ত কথা থামিয়ে আবারও সচকিত নয়নে অনু বলে,
—– তুই একটা জিনিস খেয়াল করেছিস অরু?

—– কি জিনিস।

—– ক্রীতিক ভাইয়া বোধ হয় এতোবছর পর অবশেষে আমাদের বোন হিসেবে মেনেই নিয়েছে,নাহলে তোকে সাথে করে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা কেন বলবে?

—– অরু নিজ পায়ে স্লিপার পরতে পরতে বললো,সে আমি জানিনা,বাদ দে তো ওনার কথা, এই ভালো এই খারাপ। কই কোনো দিন তো বলতে শুনলাম না,” অরু বোন আমার এদিকে আয়”। ওসব করুনা বুঝেছিস?

অরুর কথার পাছে অনুর বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে অজানা দীর্ঘশ্বাস।
অরু উঠে গিয়ে জানালা গলিয়ে বাইরের বৃষ্টি ভেজা তকতকে রাস্তায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো,
তৎক্ষনাৎ মনে পরে গেলো কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া সেই ভ’য়ানক গা ছমছমে ঘটনার কথা, সেদিন ক্রীতিক সময় মতো না এলে কি হয়ে যেতো? ভাবলে এখনো শরীরের সবকটা লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায় অরুর। আচ্ছা, সেদিনের সবটাই কি ক্রীতিকের করুনা ছিল? নাকি অন্যকিছু? অন্যকে করুনা দেখাতে গিয়ে, মানুষ কোনোদিনও নিজেই আঘাত প্রাপ্ত হয় ?উত্তর জানা নেই অরুর।
চোখের সামনে কালো মার্সিডিজটা দেখেই অরুর ভাবনার সুতোতে টান পরে। তারমানে ক্রীতিক চলে এসেছে, ওদিকে অরু এখনও রেডি না হয়ে আকাশ পাতাল কল্পনায় বিভোর। আনমনা মেয়ে একটা……

***********************************************
খারাপ আবহাওয়া আর ঝুম বৃষ্টির মাঝেই ইউ এস এ ছেড়েছে ওদের প্রাইভেট জেট’টা। তবে ভৌগোলিক দূরত্ব বৃদ্ধি পেতেই ধীরে ধীরে আবহাওয়া ঠিক হয়ে গিয়েছে এখন।
সেই সন্ধ্যা রাত থেকেই নিজ ক্যাভিনে পরে পরে ঘুমাচ্ছে অরু। এছাড়া অবশ্য করার কিছুই নেই ওর, কারণ চোখ খুললেই কেমন মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। পেট থেকে উগরে বেরিয়ে আসে সব খাবার। অরুর মতে সবার সামনে বমি করে ভাসিয়ে নিজের মানসম্মান খোয়ানোর চেয়ে ঘুমিয়ে থাকাই শ্রেয়, তাতে যে যা ভাবে ভাবুক।

তখন মাঝরাত, আরেকটু পরেই থাইল্যান্ডের ব্যাংকক শহরে ল্যান্ড করবে ওরা। অরু সারারাত ঘুমিয়ে কাটালেও ওরা চারজনের একজনও ঘুমায়নি, সবাই মিলে রাত জেগে একটা বড়সড় প্রি-প্ল্যান তৈরি করেছে ওরা। মাঝরাত্তিরে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শেষ করে, ক্রীতিক এসেছে অরুকে একনজর দেখার জন্য। অরুর কেবিনের দরজাটা হাট করে খোলা ছিলো,যার ফলে নক করতে হয়নি আর, ক্রীতিক সোজা ঢুকে গিয়েছে ভেতরে। অরু তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ড্রিম লাইটের নীল আলোতে আজও ওর সুন্দর লতানো শরীটা দৃশ্যমান। এলোমেলো হয়ে ঘুমানোর দরুন পাজামা উঠে আছে হাঁটুর কাছে, মোমের মতো সুন্দর পা দুটোর একটাতে নুপুর নেই। কি করে থাকবে? সেটাতো বহু আগেই পার্টিতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছে অরু।

পায়ের দিক থেকে চোখ সরে গিয়ে ক্রীতিকের দৃষ্টিগত হলো অরুর মেদহীন দুধে-আলতা বর্ণের লতানো পেট। পেটের মাঝখানে সেই কুচকুচে কালো তিল। দেখলে মনে হবে অরুর নারীদেহের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যই তার এমন মাঝ বরাবর অবস্থান।
ঘোর লাগা চোখে খানিকক্ষণ ওই তিলটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিরবে শুষ্ক ঢোক গিললো ক্রীতিক।
কোন এক অজানা সংযমের কারনে ওর হাত দুটো মুঠি বদ্ধ হয়ে আছে। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কেভিনের মধ্যেও ঘেমে যাচ্ছে শরীরটা। ক্রীতিকের পরনে ছিল ব্ল্যাক টিশার্ট আর ট্রাউজার,হাতে ক্রোকোডাইল স্কিনের ব্ল্যাক বেল্ট ঘড়ি। জিভ দিয়ে অধর জুগল ভিজিয়ে, এ-সির পাওয়ার আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিলো ও। নাহ তবুও ঠান্ডা লাগছে না।
ওদিকে প্রচন্ড ঠান্ডা পেয়ে অরু নরেচরে আরও খানিকটা গুটিশুটি মেরে শুয়েছে। এবার শুধু পেট নয়, পেট পিঠ দুটোই দৃশ্যমান। উন্মুক্ত ফর্সা পিঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রেশমের মতো লম্বা চুল গুলো। ক্রীতিক নিজের অবাধ্য বাসনা গুলোকে বারবার মাথা থেকে দূর করতে চাইছে। মনটাকে রাম ধমক দিয়ে বারবার বলছে, —-ওর পেটের দিকে নয় ওর মুখের দিকে তাকা কি ইনোসেন্ট,মায়ামায়া ঘুমন্ত মুখটা।

অথচ চোখ দুটো আটকে আছে ধবধবে ফর্সা পেটে। ইচ্ছে করছে সেখানটায় আঙুল ঘুরিয়ে হাজারটা আঁকিবুঁকি করতে। কিন্তু তাতো সম্ভব নয়।
ক্রীতিক খারাপ,রগচটা,বদমেজাজি হতে পারে তবে ক্যারেক্টার লেস কিংবা মেয়েবাজ ছিলোনা কোনোকালেই। ওর হৃদয়ে অরুর প্রতি এই অবাধ্য অনূভুতি গুলো কাজ করা নিতান্তই সাভাবিক। তবে এসব অদম্য অনুভূতিকে এই মূহুর্তে প্রশ্রয় দেওয়াটা ঠিক হবে না মোটেই, তাই ঘুমন্ত অরুকে কয়েকদফা ঝারি দিয়ে দ্রুত ওর কেভিন ত্যাগ করে ক্রীতিক।

অতঃপর মনসংযোগ অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য, কেভিনের বাইরে চলে গিয়ে বসে পরে ল্যাপটপ নিয়ে। কিন্তু একি, ল্যাপটপেও একটু আগের দৃশ্য ভাসমান। ক্রীতিক তৎক্ষণাৎ ঠাস করে ল্যাপটপ বন্ধ করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, ছোট্ট জানালা ভেদ করে তিমিরে ঢাকা আকাশ পানে।
তখনই একজন কেভিন ক্রু এসে,খুবই নমনীয় সুরে শুধালো,
—- স্যার ঘন্টা খানিকের মধ্যেই ল্যান্ড করবো আমরা, কোন কোল্ড ড্রিংকস অথবা স্ন্যাক্স খাবেন?
—- পেট।
ক্রীতিকের কথাটা ঠিক বোধগম্য হলোনা লোকটার,তাই তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
—- ইয়ে মানে স্যার,কি খাবেন?

ক্রীতিক বিরক্ত হয়ে জানালা থেকে চোখ সরিয়ে বলে,
—- বললাম তো পেট খাবো।

ক্রীতিকের জবাবে লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ওর দিকে আশ্চর্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাড়িয়ে আছে। লোকটার কিংকর্তব্যবিমূঢ় চাহনি দেখে এতোক্ষণে ক্রীতিকের ও বোধগম্য হলো যে ওর জিহ্বা স্লিপ কে’টে ভুল যায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে। আর এই মূহুর্তে এমন একটা কথা বলায় কেমন যেন অসস্থি ও হচ্ছে ওর নিজের, তাই তারাহুরো করে বললো,
—- কিছু নেবোনা, ইউ ক্যান গো।

লোকটা বো করে সম্মান জানিয়ে দ্রুত চলে যেতেই। ক্রীতিক দুহাতে নিজের চুল টেনে কটমটিয়ে অস্পষ্ট সুরে বললো,
—- তোর জন্যে কবে যেন আমি, সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যাই অরু। দুনিয়াতে আর মানুষ পেলিনা, তোকে আমার স্টেপ সিস্টারই হতে হলো? না পারছি তোকে ধরতে, আর না পারছি ছাড়তে।
**********************************************
ল্যান্ডিং এর পর আরও ঘন্টা খানিক গাড়ির পথ অতিক্রম করে ভোর রাতের দিকে হোটেলে এসে পৌঁছালো ওরা পাঁচ জন। এটা হোটেল কম রিসোর্ট বেশি মনে হচ্ছে, পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই রিসোর্টের বিশাল জানালা দিয়ে চাইলে স্পষ্ট চোখে সি-বিচ দেখা যায়। সেই সাথে অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো আছে।
ওরা দুইটা ভিলা বুক করেছে, একটাতে দু’টো রুম। অন্যটাতে পাশাপাশি তিনটা। কিন্তু কে কোন রুমে থাকবে সেই নিয়েই বাধলো বিপত্তি। এলিসা কিছুতেই অর্নবের ধারে কাছে থাকবে না, ওদিকে এলিসার মতামতে অর্নবের ঘোর আপত্তি। এলিসার পাশের রুম ছাড়া কিছুতেই অন্যত্র রুম গ্রহন করবে না সে।
সায়র ওদের লাভ বার্ডের মধ্যে থাকতে নারাজ, এদিকে ক্রীতিকও সায়র কে কোনো মতেই অরুর ধারে কাছে থাকতে দেবেনা। শেষ পর্যায়ে কোনো উপায় না পেয়ে এলিসা, অর্নব, আর সায়র রক পেপার সিজার খেলেই রুম ভাগাভাগি করে নিলো।

অরু এখানে সবার চেয়ে ছোট, তারউপর ক্রীতিকের সাথে এসেছে তাই নিরব দর্শকের মতোই যে রুমটা ওর জন্য বরাদ্দ করা হলো তাতেই গিয়ে ঢুকে পরলো। সারারাতের জার্নিতে বড্ড ক্লান্ত লাগছে শরীরটা, এখন একটু ঘুমানো দরকার, তাই দেরি না করে জামাকাপড় ছেড়ে আবারও এক দস্তর ঘুমিয়ে নিলো অরু।
***********************************************
ভোর রাতে ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে রুমে এসে এলিসাও ঘুমিয়ে গিয়েছিল দ্রুতই। তবে ভিডিও গেইমের গো’লাগু’লির কর্কষ আওয়াজে মাত্র কয়েকঘন্টার ব্যাবধানেই সেই ঘুম দৌড়ে পালালো ওর। ঘুম ভেঙে যাওয়ার দরুন একরাশ বিরক্তি নিয়ে ভ্রু কুঞ্চিত করে পাশ ফিরে তাকালো এলিসা।
তখনই দেখতে পায়, অর্নব ওর রুমের ডিভানে শুয়ে শুয়ে ফোনে গেইম খেলছে। অর্নব কে দেখেই এলিসার জিভটা তেঁতো হয়ে উঠলো, ভেতরটা চিড়বিড়িয়ে ফেটে পড়লো রাগে। ও চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,
—- এখানে কি করছিস তুই?

অর্নব নরম কন্ঠে বললো,
—- আরে আরে আস্তে, আশেপাশে সবাই ঘুমাচ্ছে।

—– হ্যা তো? আমিওতো ঘুমাচ্ছিলাম, তাহলে তুই এখানে কেন?

—– যদি ক্লাবের লোকজন তোর খোঁজ পেয়ে তোকে ধরে নিয়ে যায়? তাই পাহারা দিতে এসেছি। আমার ঘুমের প্রয়োজন নেই তুই গিয়ে বরং ঘুমা।

—– আমি ওদের সোনার ডিম পারা হাঁস অর্নব ।ধরে নিলেও কোনো ক্ষতি করবে না আমার।

অর্নব ভ্রু কুঁচকে বললো,
—- তোর এতো তেজ কেন বলতো? আমি বলে তোর এতো তেজ সহ্য করছি, অন্য কেউ কোনোদিন সহ্য করবে না দেখিস।

এলিসা ঝাঁঝ নিয়ে বললো,
—- কে বলেছে তোকে সহ্য করতে? দূর হ তুই।

—- আমাকে এতো বিরক্ত লাগে তোর?

—- হ্যা তোর এসব এক্সট্রা কেয়ার আমার বিরক্ত লাগে।কই সায়র আর জেকে তো এমন করেনা,তাহলে তুই কেন?

অনর্ব উঠে এসে এলিসার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
—– ওরা তোকে বন্ধুর চোখ দিয়ে দেখে তাই, কিন্তু আমি তোকে ভালোবাসার চোখ দিয়ে দেখি।

এলিসা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
—– ভালোবাসার আর মানুষ পেলিনা?

এলিসার আহত কন্ঠস্বরে অর্নবের রা’গে ফেটে পরা চোখ দুটো মূহুর্তেই যেন অসহায় হয়ে গেলো। ও একটানে এলিসাকে বুকের মধ্যে জাপ্টে ধরে বললো,
—– ভালোবাসা কি এতো গুনে বেছে হয় বল?তোর অতীত যেমনই হোক আমি তবুও তোকে ভালোবাসি, ভবিষ্যতেও ভালোবাসবো। তুই অবহেলা করলেও বাসবো। তুই যতবার আমায় দুরে সরিয়ে দিবি ঠিক ততবার আমি চুম্বকের মতো তোর টানে চলে আসবো। তুই যদি কখনো আমাকে কাছে টেনে নিস, আমি আরও কাছে গিয়ে তোর অন্তর্আত্নায় মিশে যাবো, তাও কোনোদিন তোর পিছু ছাড়বো না। শুধু একটা অনুরোধ আমার ভালোবাসা নিয়ে কখনো প্রশ্ন তুলিস না জান।ভালোবাসতে কারন লাগেনা। এটা ম্যাজিকের মতোই হুট করে হয়ে যায়। আমি শুধু তোর জীবন সঙ্গি হয়ে সারাটাজীবন তোর পাশে থাকতে চাই,এটা কি খুব বেশি চাওয়া বল?

অর্নবের একরাশ ভালোবাসার সীকারোক্তির মাঝেও এলিসা নিশ্চুপ। অথচ অর্নবের শার্টের ভাঁজে অশ্রু ভেজা নয়ন দুটো মুছে যাচ্ছে বারংবার, নিঃশব্দে নির্লিপ্তে……
***********************************************
প্রতি মাসের নির্দিষ্ট সময়ে আসা প্রচন্ড পেটের ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে ঘুম ভেঙেছে অরুর। ঘুমের ঘোরেই অস্পষ্ট সুরে অনুকে ডাকছে ও।
—- আপা পেট ব্যাথা করছে, এবার মনে হয় ম’রেই যাবো আমি।

কিন্তু আজ আর বিপরীত দিক থেকে কোন আওয়াজ এলোনা। খানিকক্ষণ ডাকাডাকি করেও অনুর সারা না পেয়ে অরু যখন চোখ মেলে তাকায়,তখনই মনে পরে যায় ওতো ব্যাংককে আছে, আপা কিকরে আসবে এখানে ? উপয়ান্তর না পেয়ে দু-হাত পেটে চেপে ধরে, অরু নিজেই উঠে গিয়ে ব্যাগ হাতরে প্রয়োজনীয় জিনিস খুজতে লাগলো। খুঁজতে খুঁজতে পুরো ব্যাগ তন্নতন্ন করে ফেলেছে অরু। কিন্তু সেসব কিছুই নেই। অরুর মনে আছে, আসার সময় অনু ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছিলো, অরু আঁতকে উঠে, অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো,
—– তারমানে কি আপা সেসব কিছুই দেয়নি? এখন কি করবো আমি? কাকে গিয়ে বলবো?

ওদিকে পেটের ব্যাথাটা ক্ষনিকের মাঝেই হলহলিয়ে ছড়িয়ে পরেছে সারা শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কোমড় আর পা দু’টো অসার হয়ে আসছে। অপারগ অরু প্রচন্ড পেটের ব্যা’থায় মেঝেতে শুয়েই গড়াগড়ি শুরু করে দিয়েছে। এলিসা অন্য ভিলায় আছে, পাশের রুমে কে আছে সেটাও জানা নেই অরুর। সময়ের ব্যাবধানে এতোক্ষণে হয়তো পরনের কাপড় চোপরের অবস্থাও বেগতিক ওর।

কোনোরূপ উপয়ান্তর না পেয়ে এভাবে মেঝেতে পরে থেকে ঠিক কতক্ষন যাবত কাতরাচ্ছিল তা মনে নেই অরুর। তখন দুপুর হয়ে এসেছে, দরজায় সজোরে কড়া নাড়ার ঠকঠক আওয়াজ হতেই কম্পিত হলো অরুর শরীর। মেঝেতে শোয়া অবস্থাতেই দৃষ্টিপাত করলো দরজার দিকে। বাইরে থেকে ক্রীতিকের গভীর কন্ঠ ভেসে আসছে,
—— অরু দরজা খোল।

ক্রীতিকের আওয়াজ পেয়ে অরু আরও বেশি গুটিয়ে গেলো, এমন একটা অপ্রিতীকর পরিস্থিতিতে ক্রীতিকের মুখোমুখি হতে চায়না ও। যতই হোক ক্রীতিক ওর চেয়ে গুনেগুনে বারো বছরের বড়। আজ এভাবে দেখে নিলে,এরপর ক্রীতিকের চোখের দিকে চাইবে কিভাবে ও? ওদিকে ক্রীতিক ডেকেই যাচ্ছে একনাগাড়ে ।
—– অরু দরজা খোল, নয়তো আমি পাসওয়ার্ড চেপে ভেতরে চলে আসলে গুনেগুনে শ খানেক থা’প্প’ড় খাবি তুই।

ক্রীতিকের অতিব মাত্রার হু’মকির মুখে পরে,
অরু মিনমিনিয়ে কাতর কন্ঠে বললো,
—- কিভাবে খুলবো?

ওপাশ থেকে বিরক্তির চড়ম সীমানায় গিয়ে ক্রীতিক বলে
—- কিভাবে খুলবি মানে? হাত দিয়ে খুলবি।

অরু কাঁদো কাঁদো সুরে জবাব দিলো,
—- আপনি ফিরে যান দয়াকরে।

অরুর কথাটা বলতে বাকি তার আগেই পাসওয়ার্ড চেপে ভেতরে প্রবেশ করে ক্রীতিক।
—– তুই নাকি ব্রেকফাস্ট করতে যাসনি? কেন যাসনি?
শাসাতে শাসাতে ভেতরে ঢুকে অরুকে এভাবে মেঝেতে পরে থাকতে দেখে দ্রুত এগিয়ে এলো ক্রীতিক। ওর মাথার কাছে হাটু গেড়ে বসে উদ্বিগ্ন হয়ে শুধালো,
—-কি হয়েছে তোর? এভাবে মেঝেতে শুয়ে আছিস কেন?পেট ব্যাথা করছে? শরীর খারাপ লাগছে খুব? ডাক্তার কে কল করবো?

অরু কাচুমাচু হয়ে চোখ খিঁচে বললো,
—— আপনি দয়াকরে চলে যান।

—– যাবো মানে? তুই হুকুম করবি আর আমি চলে যাবো? আমি কি তোর সার্ভেন্ট?

অরু জবাব দিলোনা,একেতো পেটের অসহনীয় ব্যাথা,তার উপর এই লোকের মাথা খারাপ করা ধ’মকা ধ’মকি,না পেরে নিরবে কাঁদছে অরু।
ক্রীতিক অরুকে কোলে নেওয়ার জন্য দু-হাত বাড়াতে যাবে তখন আবারও ঘোর আপত্তি জানিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে অরু,
—-নাআআ,ছোবেন না আমায়। অনুরোধ করছি।

ক্রীতিক এবার অ’গ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো অরুর পানে,অতঃপর চোয়াল শক্ত করে বললো,
—- তোর অনুরোধ কিংবা নিষেধ কোনোটারই ধার ধারিনা আমি, সেটা ভবিষ্যতে আরও ভালো করে বুঝতে পারবি।

কথা শেষ করে একটানে অরুকে কোলে তুলে নিলো ক্রীতিক। সঙ্গে সঙ্গে ওর একহাত হাত ভিজে এলো তরল জাতীয় কোন পদার্থে। ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে অরুকে কোলে রেখেই নিজের হাতের দিকে দৃষ্টিপাত করলো।

এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে এ জীবনে পরেনি অরু।তাই করনীয় কিছু না পেয়ে ক্রীতিকের কলার চেঁপে ধরে চোখ দুটো খিঁচিয়ে বন্ধ করে রেখেছে ও। লজ্জায়, ভয়ে মনে হচ্ছে মাটিটা ফাঁক হয়ে যাক,আর অরু তাতে ঢুকে আশ্রয় নিক। এ দুনিয়াতে আর কোন কাজ নেই ওর।
—- ওহ শীট,আমাকে কেন বলিস নি? আমি আরও ভাবলাম কি না কি।

নিজের হাতে নজর বুলিয়ে কথাটা বলে,ক্রীতিক অরুর মুখের দিকে চাইলো, যে এখনো চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে,
—– তুই কি এখনো ছোট্ট বাচ্চা অরু? তোর কি ফার্স্ট টাইম পিরিয়ড হয়েছে?

অরু চোখ বুঝে এদিকে ওদিক মাথা নাড়ালো।

ক্রীতিক দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—— তাহলে সারাদিন কেন এভাবে কষ্ট সহ্য করলি? কেন আমাকে বললি না? কি হলো উত্তর দে?

অরুর জবাব নেই, জবাব কি দিবে ওর তো লজ্জায় গলার আওয়াজই নেই।
ক্রীতিক নিজের রাগ সংযত করে অরুকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে এলিসাকে কল করে আসতে বললো।
অরু বিছানায় শুয়ে একচোখ সামান্য খুলে ক্রীতিককে দেখতে চেষ্টা করলো, যার সফেদ রঙা শার্টটা খানিকক্ষণ আগেই নষ্ট করে দিয়েছে অরুর নারী সত্তা। অথচ ক্রীতিকের সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। সে তো এখনো তার বোকা অরুকে বকাঝকা দিতেই ব্যাস্ত।
চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here