সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁 #পর্বঃ২৩ #লেখনীতেঃsuraiya_rafa

0
23

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ২৩
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
[ক’পি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[প্রাপ্তমনস্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য]

নির্ঝঞ্জাট বিদ্যাপিঠ সানফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটি। সানফ্রান্সিসকোর মধ্যে সবচেয়ে সুপরিচিত এবং নামকরা হওয়াতে এই ভার্সিটিতে ফরেইনার শিক্ষার্থীদের অভাব নেই। সেই সাথে সাথে ফরেইনার প্রফেসরদেরও। তবে আজ ভার্সিটি ক্যাম্পাসে খুব একটা শিক্ষার্থীদের আনাগোনা নেই। এর কারন শীতের শেষ ভাগ চলছে যার দরুন সবাই সি’বিচ, জঙ্গল, পাহাড়, এথায় সেথায় ক্যাম্পিং এ গিয়েছে।

এখানকার শিক্ষার্থীরা বইয়ের পাতায় নয়, হাতে কলমে, কিংবা পর্যবেক্ষন করেও অনেক কিছু শেখে। সারাবছর তাদের ক্লাসরুমের বাইরেও অনেক কার্যক্রম থাকে। অরুও বিগত কয়েকমাসে অনেক কিছুই শিখেছে, অনেক কিছু লক্ষ করেছে,ভালোমন্দ দুটোই। আমেরিকার সংস্কৃতির মধ্যে এমন অনেক কিছুই আছে যা শুনলে বা দেখলে গা ঘিনঘিন করে ওঠে, তার মধ্যে নিখিল ভাইয়ের রিলেশন শীপ অন্যতম। এখনো ক্রীতিকের বলা কথাগুলো মনে পরলে নাক সিকোয় উঠে যাচ্ছে অরুর।

ভার্সিটির গেইট পেরিয়ে, নরম সবুজ ঘাসগুলোকে পায়ে মারাতে মারাতে হিজিবিজি ভাবনায় বিভোর হয়ে আছে অরু। ওর পরনে চিকন কারীর সফেদ রঙের লং কুর্তি আর লেগিংস। কুর্তির উপরে এটে আছে লেডিস ডেনিম জ্যাকেট। লম্বা চুলগুলো পোনিটেল করে গার্ডার নিয়ে বাঁধা। ধীরগতিতে হাঁটার জন্য মাথাটাও নিচু হয়ে আছে সেই কখন থেকে।ওই জন্যইতো সায়নী যে সেই কখন থেকে ওর সাথে সাথে হাঁটছে অরুর তাতে হদিস নেই। এতোক্ষণ ধরে পাশেপাশে হাঁটার পরেও মেয়েটা একবার মাথা তুলে তাকালো না অবধি, কি এমন ভাবছে ও? মনেমনে বিরক্ত হয়ে, সোজা গিয়ে অরুর সামনে দাড়িয়ে খানিকটা গাল ফুলিয়ে সায়নী জানালো,
— কি এমন ভাবছো বলোতো? সেই তখন থেকে তোমার সাথে সাথে হাঁটছি খেয়ালই করছো না।

অরু চট করে ভ্রম থেকে বেরিয়ে মাথা তুলে বললো,
— আরে সায়নী যে, কেমন আছো বলো?

— এতোক্ষণে জিজ্ঞেস করার সময় হলো?

— আ’ম সরি, একটু বেখেয়ালে ছিলাম।

সায়নী এবার বুঝতে পারার মতো করে হ্যা সূচক মাথা দুলিয়ে বললো,
— ইট’স ওকে, কিন্তু তুমি এতোদিন কই ছিলে?
কতদিন ক্যাম্পাসে আসোনা বলোতো?

সায়নীর কথায় অরুর মনে পরে যায়, সেই নিখিল ভাইয়ের সত্যি জানার পর থেকেই আর ভার্সিটির গেইট মারায়নি ও, তারপর আরও কত কিই’না হয়ে গেলো,জীবনটাই এখন এলোমেলো।

— আবার কি ভাবতে বসলে?

অরু না সূচক মাথা নাড়িয়ে ছোট্ট করে বললো,
— কিছু না।

সায়নী এবার হাসির দ্বারা ঠোঁট প্রসারিত করে বললো,
— এ্যাই অরু, জেকে স্যারের কি খবর?

অরু ঠোঁট উল্টে বললো,
— ওনার কথা আমি কি করে জানবো, ওনাকে গিয়েই বরং জিজ্ঞেস করো।

সায়নী এবার ভ্রুকুঞ্চিত করে বললো,
— তুমি ওনার স্টেপ সিস্টার ,তুমি জানবে নাতো কে জানবে? ঢং।

সায়নীর কথায় অরু কিঞ্চিত ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো, পরক্ষণেই সায়নী আবারও শুধালো,
— বলোনা একটু, এতোদিন স্যার ভার্সিটিতে কেন আসেনি?

— আমি যতদূর জানি উনি ব্যাংকক গিয়েছিলেন।

অরুর উত্তর শুনে সায়নী বেশ খুশি হয়ে যায়, খুশি হয়ে অরুর হাত জড়িয়ে ধরে বলে,
— এই না হলে আমার ননদিনী, তুমি জানো জেকে স্যারকে আমি অনেক পছন্দ করি, কিন্তু বলার সাহস হয়ে ওঠেনা, শুনেছি ব্যাক্তি জীবনে উনি অনেক বেশি রাগী,আসলেই কি তাই?

সায়নীর কথার বিপরীতে অরু কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর চোখ আটকে যায় ক্যাম্পাসের অন্যপাশে পুলসাইডে কিছু মানুষের ভীরের মাঝে, সেখানে নিখিল ভাই ও উপস্থিত। তারা সবাই কোনো কিছু একটা নিয়ে বেশ উল্লাসে মেতে আছে। কিন্তু কি নিয়ে? অগত্যাই সায়নীর দিকে তাকিয়ে উল্টে প্রশ্ন ছোড়ে অরু,
— আচ্ছা সায়নী ওখানে কি হচ্ছে?

সায়নী অরুর দৃষ্টিপাত অনুসরণ করে,সেদিকে একবার তাকিয়ে বললো,
— সাইন্টিস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে বাংলাদেশী নিখিল ভাই ওদের গ্রুপের টীম লিডার হয়েছে, সেটারই সেলিব্রেশন করছে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে।

— ওহ আচ্ছা।

অরুর কথার মাথায় সায়নী অবিশ্বাসের সুরে বলে,
— হি ইজ আ ভেরি ট্যালেন্টেড গাই। কত অল্প সময়েই কেমন টীম লিডার হয়ে গেলো। তারউপর দুই দুইটা সুন্দরী গার্লফ্রেন্ড সবদিক থেকে সোনায় সোহাগা, আহা।

অরু মুখ ভঙ্গিমায় বিরক্তির ছাপ টেনে বললো,
— একজন মানুষের আবার দুইটা গার্লফ্রেন্ড হয় কেমন করে?

সায়নী কুটকুটিয়ে হেঁসে বললো,
— হয় হয়, আমেরিকাতে সব হয়, চাইলে তুমিও….

সায়নীর কথা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই,পেছন থেকে ডেকে উঠল কেউ,
— অরোরা!

অরু জানে এটা কে হতে পারে, এই পুরো ক্যাম্পাসে অরোরা বলে ওকে একজনই ডাকে। কিন্তু ও এখন কিছুতেই এই মানুষটার মুখোমুখি হতে চায়না, তাই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে, না শোনার ভান করে চোখ খিঁচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই।
সায়নী পেছনে ঘুরে বললো,
— আরে নিখিল ভাই যে আপনি অরুকে চেনেন?

নিখিল হ্যা না কোনো উত্তর না দিয়ে স্মিত হেসে অরুর দিকে তাকিয়ে পুনরায় ডাকলো,
— অরোরা?

সায়নী সামনে দাড়িয়ে আছে,নিখিল ও এগিয়ে এসেছে, এবার আর ইগনোর করার সুযোগ নেই পেছনে ঘুরতেই হবে, কিছু করার নেই ভেবে নিখিলের মুখোমুখি হতে যাচ্ছিল অরু, এখনো পেছনে ঘোরেনি, ঘুরবে ঘুরবে ভাব, ঠিক তখনই কোত্থেকে যেনো বাজখাঁই কর্কষ আওয়াজ কানে ভেসে এলো ওর,

— অরুউউউ।

আচমকা ক্রীতিকের আওয়াজ পেয়ে কেঁপে উঠলো অরু, তরিৎ গতিতে চোখ দুটো খুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগলো তাকে, খানিক্ষন খোজাখুজির পর দেখলো ভবনের দোতলার অফিসরুমের করিডোরে দাঁড়িয়ে ওর দিকেই কটমট করে তাকিয়ে আছে ক্রীতিক। ক্রীতিকের চোখের দিকে একপলক তাকিয়ে একটা শুষ্ক ঢোক গিলে সায়নীকে উদ্দেশ্য করে অরু বলে,
— চলো ক্লাসে যাই দেরি হয়ে যাচ্ছে।
এই বলে সায়নীর হাত ধরেই দ্রুত ক্লাসের দিকে পা বাড়ায় অরু।

পেছন থেকে নিখিল ডেকে বললো,
— আরে অরোরা কথাটাতো শুনে যাও। নিখিল এখনো অরুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে, তখনই অন্যদিক থেকে একজন এসে নিখিলের উদ্দেশ্যে বলে,
— আরে ভাই তুমি এখানে, তোমার গার্ল ফ্রেন্ডদের কেউ ধা’ক্কা মে’রে পুলে ফেলে দিয়েছে। একটাও তো সাঁতার জানেনা, দু’টোই হাবুডুবু খাচ্ছে ।

নিখিল আশ্চর্য হয়ে বললো,
— কি বলছো? কে ফেললো?

—তাতো জানিনা, ভীরের মাঝে কে কাকে ধা’ক্কা দিয়েছে বলা মুশকিল, তুমি তারাতাড়ি যাও।

নিখিল হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে, দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করে।

অরু, সায়নী, নিখিল সবাই যে যার মতো চলে গিয়েছে, যার ফলে নরম ঘাস আবৃত্ত যায়গাটা শূন্যই পরে আছে, দোতলার করিডোর দিয়ে ক্রীতিক এখনো সেই শূন্যস্থানের দিকে তাকিয়েই ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসছে।
*****************************************

পায়ের স্যান্ডেল দুটো আঙুলের ভাঁজে নিয়ে খালি পায়ে সাগরের কোল ঘেঁষে হাটছে অনু। প্যান্টটা একটুখানি গুটিয়ে গোড়ালি থেকে উপরে তুলে, প্রত্যয়ও অনুর পাশাপাশি হাঁটছে । সাগর পারের চারিদিকে শঙ্খচিল আর পানকৌড়ির চিউ চিউ আওয়াজ, অনু বাবল টিতে একটা করে সিপ নিচ্ছে আর চোখ বন্ধ করে পাখির কলরব শুনছে। সেই কখন থেকে ওদের মাঝে নিরবতা বিরাজমান, অনেকক্ষণের নিরবতা ভেঙে সর্বপ্রথম প্রত্যয়ই বলে ওঠে ,
— তুমি না মানে আপনি, ভারী অদ্ভুত জানেন? কখন যে রে’গে যান, আর কখন যে ঠান্ডা হয়ে যান আমি নিজেই বুঝতে পারিনা, এতো মুড সুইং কেন হয়?

প্রত্যয়ের কথায় অনু শব্দ করে হেসে বললো,
— ইউ ক্যান কল মি “তুমি”। এতো ইতস্তত কেন হচ্ছেন? আফটার অল উই কিসে’স ইচ আদার।

অনুর কথায় কালকের দৃশ্যপট ভেসে উঠলো প্রত্যয়ের চোখে, ও তৎক্ষনাৎ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
— ইয়ে মানে তোমার কিছু জানার নেই?

অনু গম্ভীর গলায় বললো,
— হুম আছেতো, অনেক কিছু জানার আছে,
প্রত্যয় শুধালো,
— বলো কি জানতে চাও? সব বলবো তোমায়।নো লুকোচুরি।

—আমাকে ইউজ করা কেন হলো শুনি?আপনার লং টাইম লাভ হিস্ট্রি। তাহলে আমার প্রতি দূর্বলতা অনুভব করারই বা কারনটা কি?

অনুর অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর একসাথে দেওয়ার জন্য প্রত্যয় একটু রয়েসয়ে বললো,
—প্রথমত তিন্নি আমার সাথে ভালোবাসার হাজারো প্রতিস্রুতি দিয়ে বছরের পর বছর চি’ট করেছে, জামাকাপড়ের মতো সুগার ড্যাডি চেঞ্জ করেছে, তাহলে ওর প্রতি আমার ভালোবাসাটা রইলো কোথায়? তাছাড়া ও হাইলি ড্রা’গ এডিক্টেড। এক কথায় বলতে পারও ওর জীবনে শুদ্ধ বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। এসবের কারনে তিন্নির প্রতি আমার ঘৃ’ন্য মনোভাব তৈরি হয়েছে আরও কয়েকবছর আগেই। আর এখন তো ওকে মনে রাখার প্রশ্নই ওঠেনা। ওকে মাঝে মধ্যেই আমার পা’গল মনে হয়, জানো? এতোদিন খবর ছিলোনা, যেই আমি বছর খানিক ধরে একটু মুভ অন করেছি। এখন আবার আঠার মতো পেছনে লেগে আছে। ওর কাজই বোধ হয় আমার জীবনটাকে অগোছালো করে দেওয়া। তবে হ্যা এরপর ও যদি দ্বিতীয়বার এমন কিছু করে আমি যথাযথ ব্যাবস্থা নেবো, আই প্রমিস।

একটুখানি থেমে বুকের ভেতরের চাপা নিঃশ্বাসটা উগড়ে দিয়ে, প্রত্যয় আবারও বলে,

—এবার তুমি যদি বলো তুমিই কেন? সেটার উত্তর আমার জানা নেই। তোমাদের ভিসা টিকেট প্রসেসিং এ অসংখ্যবার তোমার ছবি দেখেছি আমি, তেমন কিছুই ফিল হয়নি, কিন্তু সেদিন ক্যাফেতে তোমার এক ঝলক হাসির মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলাম আমি। উত্তাল ঢেউয়ের পানে চেয়ে একমনে কথাগুলো বলে অনুর দিকে তাকিয়ে প্রত্যয় শুধালো,
— প্রেম তো অনেকের সাথেই হয়, ভালোবাসার মানুষ কয়জন হতে পারে বলো? অনু, তুমি কি আমার শেষ ভালোবাসা হবে?

— জানিনা।

প্রত্যয়ের মুখের উপর কথাটা বলে সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ঠোঁট কামড়ে মুখ টিপে হাসছে অনু।
প্রত্যয় ওর পেছন পেছন হেঁটে এসে বললো,
— এ্যাই মেয়ে, এতো মুড সুইং হয় কেন তোমার?

অনু পেছনে ঘুরে শুধালো ,
— কেন ভ’য় করছে? সামলাতে পারবেন না?

প্রত্যয় ওর হাতের মাঝে হাত ঢুকিয়ে বললো,
— তুমি বিশ্বাস হয়ে থেকে গেলে, আমি নিঃশ্বাস দিয়ে হলেও সামলে নেবো।

*****************************************
গোধূলি বেলা চলমান, তবে আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আমাবস্যা রাত। পুরো আকাশ ঘুটঘুটে কালো মেঘে ছেয়ে আছে। বিদ্যুতের ঝলকানিতে ক্ষনে ক্ষনেই পশ্চিম আকাশ র’ক্তিম হয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠছে। তারসাথে বাতাসের তান্ডব তো আছেই। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে সেই বিকেল থেকেই রাতে বোধ হয় ঝড় আসবে।

ভার্সিটির গেইটের সামনে একটা কাক পক্ষিও অবশিষ্ট নেই। সবাই যে যার মতো চলে গিয়েছে। শুধু মাত্র অরুই ছাতা হাতে নিয়ে সেই কখন থেকে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। শেষ বাসের এখনো সময় হয়নি, কিন্তু এই ঝড়ের মাঝে শেষ বাস আসবে কিনা সন্দেহ। ওদিকে বৃষ্টির তোপ ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে, হাতে ছাতা থাকা সত্বেও পায়ের দিকটা ভিজে গিয়েছে। অরু হাত দিয়ে জামা কাপড় থেকে বারবার বৃষ্টির পানিগুলো ঝেড়ে সরাচ্ছে। তখনই বিকট আওয়াজে হর্ন বাজিয়ে ভার্সিটির গেইট থেকে বের হয়, ক্রীতিকের কালোরঙা মার্সিটিজ। বাইরে ততক্ষণে ঝুম বৃষ্টি। ক্রীতিক অরুর সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে, জানালার কাঁচ নামিয়ে নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
— উঠে আয়, রাত হলে ঝড় আরও বাড়বে আজ আর বাস আসবে বলে মনে হচ্ছে না।

থাইল্যান্ড থেকে আসার পর থেকেই ক্রীতিকের উপর মহা বিরক্ত অরু, না পারতে কথা বলেনা। এখনো বলতে ইচ্ছে করছে না। তাই ও দাঁড়িয়ে না থেকে চুপচাপ হাঁটা ধরে বৃষ্টিস্নাত রাস্তার ফুটপাত ধরে। কেন যেন মনের মাঝে জিদ চেপে বসেছে, ক্রীতিকের কথাটা কিছুতেই শুনবে না আজ। সবসময় ক্রীতিকের জিদের কাছে পরাজিত হয়ে ক্লান্ত অরু। ক্রীতিকের জিদের বসে করা কর্মকান্ড মনে পরতেই হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দিলো ও। পায়ের জুতা পানিতে ভিজে জপজপ আওয়াজ হচ্ছে, তবুও হনহনিয়ে হাঁটছে অরু। তবে বেশিদূর এগোনোর আগেই পেছন থেকে ওর ছাতাটা টান মে’রে নিয়ে নেয় ক্রীতিক। মাথার উপর থেকে ছাতা সরে যাওয়ায় কয়েকমূহুর্তের মাঝেই ঝুম বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে যায় অরু। ক্রীতিক ও তাই, ফর্মাল ড্রেসআপ, ব্ল্যাক সুজ,রিস্টওয়াচ সবকিছু ভিজে একাকার। হুট করে ছাতা কেড়ে নেওয়াতে অরু, ভ্রু কুঁচকে পেছনে ঘুরে দেখতে পায়, ওর হ্যালো কিটি ছাতাটার বেহাল দশা করে ছেড়েছে ক্রীতিক। সেটাকে দুমড়ে মুচড়ে ভে’ঙে ডাস্টবিনে ছু’ড়ে মে’রে ক্রীতিক বললো,
— এবার যা।

অরুও কম যায়না, ক্রীতিকের বাক্য শ্রবনের সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির মাঝেই হাটা ধরে সামনের দিকে, তবে দ্বিতীয়বার স্পর্ধা দেখিয়ে আর পার পেলোনা অরু, সামনের দিকে এককদম দিয়েছে কি দেয়নি তার আগেই ওর বুকের কাছের জামাটা খামচে ধরে ক্রীতিক।এভাবে হঠাৎ আ’ক্রমণে কেঁপে উঠে অরু হকচকিয়ে বলে,
— কি করছেন জামাটা ছিড়ে যাবে তো।

ক্রীতিক ওর কথায় পরোয়া না করে, অরুর চোখের দিকে নিজের বাঁজপাখির মতো তীর্যক চাহনি নিক্ষেপ করে বললো,
— কথা শুনছিস না,অনেক সাহস বেড়ে গিয়েছে দেখছি,আমার সামনে তেজ দেখাতে এলে, সোজা গাড়িতে নিয়ে বাসর সেরে ফেলবো। আর তুই এটা ভালো করেই জানিস, আমি যা বলি তাই করি, তাই নিজের ভালো চাইলে চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বস।

ক্রীতিকের লাগামহীন কথার পাছে গলার স্বর মূহুর্তেই ক্ষীণ হয়ে এলো অরুর। বরাবরের মতো এবারও ক্রীতিকের জিদের কাছে হেরে গিয়ে ভেজা শরীর নিয়ে চুপচাপ গাড়িতে বসে পরলো ও। অরু গাড়িতে বসতেই ক্রীতিক এসে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
.
বাইরের বৃষ্টির রিমঝিম আওয়াজ গাড়ির হাই কোয়ালিটির জানালা ভেদ মোটেই ভেতর আসতে পারছে না। চারিদিকে পিনপতন নীরবতা, শুধু একটু পরপর নিরবতা ভেঙে সশব্দে হাঁচি দিচ্ছে ক্রীতিক। হাঁচি দিতে দিতে চোখ, নাক লালচে বর্ণ ধারণ করেছে তার। সেই কখন থেকে মানুষটা একাধারে হাঁচি দিচ্ছে দেখে অরু একটু আগ বাড়িয়ে বলে,
— বৃষ্টিতে ভিজে আপনার ঠান্ডা লেগে গেলো বোধ হয়।

ক্রীতিক আবারও হাঁচি দিতে যেয়ে নিজেকে সংবরণ করে বলে,
— গত দুদিন ধরে জ্বর। তাই হয়তো বৃষ্টির পানিতে পুনরায় ঠান্ডা লেগে গিয়েছে।

ক্রীতিকের কথায় অরু বেশ অবাক হয়, একই বাড়িতে থাকে ওরা তিনজন, অথচ একটা মানুষের গত দুদিন ধরে জ্বর, ওরা সেটা জানেই না। আর ক্রীতিকই বা কেমন,জ্বর হলে মানুষ এতোটা সাভাবিক কি করে থাকতে পারে? মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই যে মানুষটার শরীর খারাপ, সবসময় সেই রা’গী রা’গী ভাব।

*****************************************
উত্তাল প্রকৃতি রাত বাড়ার অপেক্ষা করেনি আর।সন্ধ্যা রাতেই শুরু করে দিয়েছে তীব্র ঝড়ের তা’ন্ডব। অনুর সাথে মাত্রই কথা হলো অরুর, সেও ঝড়ের মাঝে কোনো এক ক্যাফেতে আটকা পরেছে,সাথে অবশ্য প্রত্যয় আছে চিন্তা করার কারন নেই।
অনুর সাথে কথা হওয়ার পরপরই বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে। এভাবে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় অরু একটু ভরকে গেলো। অন্য সময় বিদ্যুৎ গেলেও বাইরে থেকে আসা সোডিয়ামের আলোয় আলোকিত থাকে হলরুম। অথচ আজ নিকোশ কালো ঘুটঘুটে অন্ধকার। ব্যাপারটা বোঝার জন্য কাঁচের দেওয়ালে উঁকি দিতেই অরু দেখতে পায়, বাড়ির বাইরের রাস্তায় কোথাও একফোঁটা আলো নেই। হয়তো ঝড় বৃষ্টিতে কোথাও বৈদ্যুতিক তাড় বিচ্যুত হয়ে এমনটা হয়েছে। কিন্তু এই মূহুর্তে চারিদিকের এমন তীব্র অন্ধকারে অরুর কেমন গা ছমছম করছে। ও কোনোমতে অন্ধকারে সিঁড়ি হাতরে ক্রীতিকের রুমের দিকে পা বাড়ায়। ক্রীতিক রুমেই আছে, অথচ ওর রুমটাও পুরোপুরি তিমিরে ঢাকা। একটু সময় নিয়ে খুজতে খুজতে ক্রীতিকের রুমের দরজার বাইরে কয়েকবার টোকা মে’রে অরু মিনমিনিয়ে বললো,
— একটু ফোনের ফ্ল্যাশটা অন করবেন ভ’য় করছে।

অরু বলার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতিক মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করে বললো,
— ভেতরে আয়।

অরু দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই মৃদু আলোতে দেখতে পায় ক্রীতিক কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। আর গতানুগতিকের চেয়ে একটু জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। অরু জানে ক্রীতিক কখন এমনটা করে, তাই ও এগিয়ে গিয়ে শুধালো
— জ্ব’র বেড়েছে? আমি কি একটু চেক করে দেখবো?

ক্রীতিক হাস্কি স্বরে জবাব দিলো,
— নিষেধ করেছি?

অরু এবার একটু সংকোচ নিয়ে ক্রীতিকের কপালে হাত ছোঁয়ায়,অতঃপর বলে,
— আপনার অনেক জ্বর কি করে ঠিক আছেন বলুন তো?

কথাটা বলে অরু মোবাইল হাতে নিয়ে উঠতে নিলে, ক্রীতিক নিজের তপ্ত হাত দিয়ে অরুর হাত টেনে ধরে শুধায়,
— কোথায় যাচ্ছিস?

অরু পেছন ঘুরে বলে,
— কাপড় ভিজিয়ে নিয়ে আসছি, মাথায় জলপট্টি দিলে ভালো লাগবে ততক্ষণ একটু অন্ধকারে থাকুন।
.
সন্ধ্যারাত গড়িয়ে ঘড়ির কাটা গিয়ে ঠেকেছে রাত দশটার কোঠায়। বিদ্যুৎ এখনো আসেনি। আর না অনু ফিরেছে । অরু সেই যে ক্রীতিকের শিওরে বসেছে এখনো বসেই আছে। বৃষ্টির রিমঝিম আওয়াজে চোখদুটো ভার হয়ে এসেছে ঘুমে। এবার মনে হচ্ছে যাওয়া দরকার, তাই ও ক্রীতিকের মাথার জলপট্টিটা উল্টে দিয়ে বললো,
— আমি এখন যাই, ঘুম পেয়েছে।

তৎক্ষনাৎ ওর হাতটা শ’ক্ত করে চেপে ধরে চোখ বন্ধ রেখেই ক্রীতিক বলে,
— কোথাও যাবিনা, এখানেই বসে থাক।

— বৃষ্টি কমেছে, বিদ্যুৎ, আপা দুটোই চলে আসবে। তাছাড়া আমার ঘুম পেয়েছেতো।

ক্রীতিক অরুর কথায় তোয়াক্কা না করে বললো,
— ঘুমাতে হবেনা।আমি বলেছি তুই যাবিনা, তার মানে যাবিনা, নয়তো সবাইকে বলে দেবো তুই আমার বউ।

অরু দাঁত কিরমির করে বিরক্ত হয়ে বললো,
— ব্লা’কমেইলটা আপনি খুব ভালোই করতে পারেন, সব আমাকে শা’স্তি দেওয়ার ধান্দা।

ক্রীতিকের সাথে কথায় না পেরে, অগত্যাই অরু ঘুমু ঘুমু চোখ নিয়ে টলতে টলতে ক্রীতিকের কাছেই বসে থাকে।
*****************************************
একটা শ্বাসরু’দ্ধ কর পরিস্থিতিতে পরে খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছে অরুর। কেমন যেন গরম লাগছে সবকিছু, গলার কাছে গরমটা একটু বেশিই লাগছে। চোখ দুটো তখনও খোলেনি ও। তবে আশেপাশের সুঘ্রাণটা বারবার নাকে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে, চন্দনকাঠের স্নিগ্ধ মন মাতানো সুবাস। একটা লম্বা শ্বাস টেনে সুবাসিত বাতাসটা ভেতরে পুরে নিয়ে নড়েচড়ে ওঠে অরু। কিন্তু একি নড়াচড়ার করার কোন উপায়ন্তর নেই। মনে হচ্ছে হাত পা কেউ বে’ধে রেখেছে। কিন্তু কে দেখাবে এই দুঃসাহস?নিজেকে এভাবে বাঁধনে আবিষ্কার করে, আচমকাই চোখ খোলে অরু। চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়া দুলে ওঠে ওর।
অরু ক্রীতিকের বিছানায়, ক্রীতিকের সাথে ঘুমিয়ে আছে। ক্রীতিক নিজের হাত পা দিয়ে অরুকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। অরুর লম্বা চুলগুলো ক্রীতিকের কালো টিশার্টের সাথে মিলেমিশে একাকার। এভাবে ক্রীতিকের পাশে নিজেকে আবিষ্কার করে অরু ঘাবড়ে গিয়েছে। মনেমনে ভাবছে,
— আপা জানলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে, আমার এক্ষুনি চলে যাওয়া উচিৎ।

ক্রীতিকের পিঠের নিচ থেকে নিজের চুলগুলো আস্তে করে টেনে বার করতে করতেই অরুর চোখ চলে যায় ক্রীতিকের ঘুমন্ত মুখের দিকে, এতো রা’গ, এতো জিদ, এতো বেপরোয়া সভাব কোনোকিছুর লেশমাত্র নেই ঘুমন্ত মুখটাতে। এখন যা রয়েছে সেটা কেবলই আকর্ষন, যে কেউ এই ঘুমন্ত মুখটা দেখলে তীব্র আকষর্ন অনুভব করবে। কি সুন্দর চেহারা, মাসআল্লাহ। ঘুমের মাঝে ক্রীতিক খানিকটা নড়েচড়ে উঠতেই ভ্রম ছুটে যায় অরুর। ও দ্রুত বিছানা ছেড়ে চুল গুলো হাত খোঁপা করতে করতে বেড়িয়ে যায়।যাওয়ার আগে কি ভেবে যেনো আরও একবার ফিরে এসে, ঘুমন্ত ক্রীতিকের কপালে হাত ছোঁয়ায়। অতঃপর মনে মনে নিশ্চিন্ত হয়ে বলে,
— যাক তীব্র জ্ব’রটা কমে গিয়েছে, এখন আমি দ্রুত ভাগি।
.
রুমে আসতেই পা’দুটো থমকে যায় অরুর, আপা এখনো ঘুমিয়ে আছে, এই ফাঁকে কিছু একটা অজুহাত বানাতে হবে, কিন্তু বানানো যায়?
অরু যখন অজুহাত ভাবতে ভাবতে দাঁত দিয়ে নখ কাঁ’টায় ব্যাস্ত, তখনই আড়মোড়া ভেঙে অনু বলে,
— কিরে এতো সকালে আবার কোথায় যাচ্ছিস?

অরু ধরা পরে যাওয়া চো’রের মতো আমতা আমতা করে বলে,
— ককোথাও না এখন আবার কোথায় যাবো।

অরুর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে অনু পুনরায় শুধালো,
— হ্যারে, কাল কখন এসেছিলি ঘুমাতে?

অরু ভ্রু কুঁচকে বলে,
— কোথা থেকে আসবো?

— আরে তুই’তো কাল রাতে ক্রীতিক ভাইয়ার মোবাইল থেকে ম্যাসেজ দিলি আমায়, তুই নাকি পড়ছিস, খুবই ইম্পর্টেন্ট টপিক ঘুমাতে দেরি হবে। ওই জন্যই তো তোকে আর ডিস্টার্ব করিনি, রুমে এসে ঘুমিয়ে পরেছি।

অরু এতোক্ষণে বুঝলো ওর হয়ে ক্রীতিক ম্যাসেজ করেছে অনুকে। এবার ও একটু সস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
— হ্যারে আপা, অনেক কঠিন পড়া ছিল, ওই জন্যই তো ক্রীতিক ভাইয়ার রুমে গিয়েছিলাম পড়া বুঝতে। বাড়িতে স্যার থাকলে যা হয় আরকি।

এক নিঃশ্বাসে কথাটুকু শেষ করে নিজের শরীরের গন্ধ নিলো অরু। পুরো শরীর জুড়ে স্যান্ডাল উড পারফিউমের গন্ধ মো মো করছে। যে কেউ কাছে কাছে এলে বুঝতে পারবে এটা ক্রীতিকের শরীরের গন্ধ। অরু উপায়ন্তর ভেবে না পেয়ে দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে অনুর উদ্দেশ্যে বললো,
— আমি একটু শাওয়ার নিয়ে আসছি তুই থাক।

অনু হাই তুলে আবারও ঘুমাতে ঘুমাতে বললো,
— এতো সকালে শাওয়ার নেওয়ার কি আছে? পা’গল মেয়ে।
চলবে…..
নেক্সট না লিখে গঠন মূলক কমেন্ট করলে উৎসাহিত হবো।
কাল বাসায় ইফতার পার্টি গল্প আসবে না হয়তো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here