#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ২২
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
[ক,পি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[প্রাপ্তমনস্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য]
চারিদিক জনমানবশূন্য হয়ে আছে, বিস্তৃত তিমিরে ঢাকা কালো রাতের ইতি টেনে সবে সবে ভোরের আলো ফুটেছে ধরনীতে। সূর্য এখনো তার তে’জস্ক্রিয়তা ছড়ায়নি পুরোপুরি ,প্রকৃতিতে হীম ধরা শীতল পরিবেশ বিরাজমান।
হাইওয়ে রাস্তার অদূর থেকে ভেসে আসছে দু একখানা কাভার্ড ভ্যানের শাঁইশাঁই আওয়াজ। রাস্তার দু’পাশে স্থীর মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারিসারি বৈদ্যুতিক খুঁটির মাথায় বসেছে জোড়ায় জোড়ায় বন্য পাখিদের ঝাঁক। একের পর এক বন্য পাখিদের চোখের আড়াল করে নিভু নিভু ভোরে ফাঁকা রাস্তার মাঝ দিয়েই আপন গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রীতিকের চার চাকা ব্ল্যাক মার্সিডিজ। গন্তব্য সানফ্রান্সিসকো ছাড়িয়ে নিজের নির্জন ছোট্ট বাড়িটা। এখন অবশ্য শুধু নিজের বলা যায়না, যেহেতু ও একজনের সারাজীবনের দায়িত্ব নিয়েছে,সেহেতু ক্রীতিকের যা তাতো তারও বটে।
এই হীম ধরা ঠান্ডার মাঝেও গাড়ির জানালার গ্লাস খুলে তাতে দু’হাত রেখে তারউপর চিবুক ঠেকিয়ে ফুপিয়ে কাঁ’দছে অরু। যদিও ক্রীতিক কা’ন্নাকাটি একদম পছন্দ করেনা, কিন্তু তাতে আপাতত অরুর হেলদোল নেই, জীবনটাই যেখানে এলোমেলো করে ছেড়ে দিয়েছে,সেখানে পছন্দ অপছন্দ দিয়ে কি আসে যায় আর?ক্রীতিক কি ভাববে সেসব কথা মাথায় না ঢুকিয়ে, এয়ারপোর্ট থেকে বেড়িয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে গাড়িতে ওঠার পর থেকেই কেঁদে ভাসাচ্ছে সে। মুখমন্ডল জুড়ে তার আকাশসম দুঃখের ছড়াছড়ি।
অরু প্যাসেঞ্জার সিটে বসা সত্ত্বেও পা’দুটো তুলে রেখেছে সিটের উপর । ও আরাম করে বসে আছে দেখে ক্রীতিকও বুঝে শুনেই গাড়ি ড্রাইভ করছে আপাতত, যাতে অরুর কোথাও না লাগে। অরুর বাধনহারা রেসমের মতো লম্বা সিল্কি চুলগুলো ক্রমাগত উড়ে এসে আঁচড়ে পরছে ক্রীতিকের চোখে মুখে, মাঝেমধ্যে ড্রাইভ করতেও অসুবিধা হচ্ছে খুব, তবুও ক্রীতিক কোনো কিছুরই পরোয়া করছে না, কারন ওর কাছে এই চুলের মিষ্টি গন্ধটা হৃদয় জুড়িয়ে দেওয়ার মতোই প্রশান্তিদায়ক। দরকার পরলে এক ঘন্টার রাস্তা দুই ঘন্টায় অতিক্রম করবে তবুও নিজের শরীর থেকে অরুর চুল সরাবে না।
কিন্তু অরুতো সেই ভোর রাত থেকেই বাইরে মুখ দিয়ে বসে আছে, বাইরের হীম ধরা পুরো ঠান্ডাটা ওর চোখেমুখে এসে হা’মলে পরছে, এরকম ঠান্ডার মধ্যে বাইরে মুখ দিয়ে আরও কিছুক্ষন বসে থাকলে বাড়িতে যেতে যেতেই অরুর নিউ’মোনিয়া হয়ে যাবে নিশ্চিত। তাই ক্রীতিক এবার একহাতে ড্রাইভ করতে করতেই অন্যহাত দিয়ে জানালার কাঁচ টা তুলে দিলো।
জানালার কাঁচ টেনে দেওয়াতে একটু পিছিয়ে বসেছে অরু, তবুও কা’ন্না থামায়নি। চোখ দিয়ে তার এখনো গঙ্গা যমুনা বয়ে যাচ্ছে। অরুকে এখনো কাঁদ’তে দেখে সামনে ফোকাস করেই বিরক্ত ভঙ্গিতে কথা ছো’ড়ে ক্রীতিক,
— কাঁদছিস কেন এভাবে? মে’রেছি তোকে?
ক্রীতিকের কথার পেছনে অরু মৌনতা পালন করে, শুধু মনেমনে বলে,
— এর থেকে মা’রলে বেশি ভালো হতো।
একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে, সেই কখন থেকে চুপ হয়ে আছে অরু, আদৌও উত্তর দেবে বলেও মনে হচ্ছে না। গতকাল থেকেই মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে মেয়েটা। ক্রীতিক জানে কাকে কিভাবে কথা বলাতে হয়, তাই ও খানিকটা কৌশলী পন্থা’ই অবলম্বন করলো। হুট করেই মাঝরাস্তায় গাড়ির ব্রেক কষলো। এভাবে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়াতে অরু হকচকিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললো,
— এসে গেছি?
কথাটা বলে বাইরে তাকিয়ে যেই দেখলো এটাতো মাঝরাস্তা, তৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে ক্রীতিকের পানে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অরু। ওর চাহনিকে পাত্তা না দিয়ে,গাড়ির ড্রয়ার থেকে একটা রুপোর নুপুর বের করে সেটাকে চোখের সামনে ধরে ক্রীতিক শুধালো,
—এটা তোর?
ক্রীতিকের প্রশ্নে অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়।
— চাই এটা?
এবারও অরু উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো।
— তাহলে গাড়ি থেকে নাম।
ক্রীতিকের শেষ বারের কথায় অরু চোখ কপালে তুলে বললো,
— নামবো মানে? এই অচেনা রাস্তায় আপনি আমায় নামিয়ে দিয়ে যাবেন?
— ইডিয়েট।
অস্ফুটে কথাটা বলে ক্রীতিক নিজেই গাড়ি থেকে নেমে গেলো। অরু ক্রীতিকের যাওয়ার পানে চোখ রেখে বুঝলো এটা একটা পেট্রোল পাম্প। তারপাশেই ছোটখাটো একটা মার্ট, হয়তো প্রয়োজনীয় কিছু কিনতে গিয়েছে সে।
.
খানিকক্ষণ বাদে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল হাতে নিয়ে ফিরে এলো ক্রীতিক।অতঃপর গাড়িতে বসে সেটা অরুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
— বাইরে গিয়ে চোখ মুখ ধুয়ে আয়, তোকে পেত্নীর মতো দেখাচ্ছে, আমি রীতিমতো ভ’য় পাচ্ছি।
ক্রীতিকের কথাটা অরুর মোটেই পছন্দ না হলেও, এই মূহুর্তে চোখে মুখে আদতে একটু পানি ছিটানো প্রয়োজন, তাই গাইগুই না করে লম্বা চুল গুলোকে হাত খোঁপা বেধে গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো অরু। চোখে মুখে ইচ্ছে মতো পানির ঝাপটা দিয়ে, নাক টেনে নিজেকে একটু সাভাবিক বানিয়ে পুনরায় গাড়িতে ফিরে এলো ও। অরু গাড়িতে বসতেই ওর দিকে টিস্যু এগিয়ে দিলো ক্রীতিক। অরু টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,
— এবারতো দিন, নুপুরটা আমার ছোট বেলার স্মৃতি ।
— নুপুরটা নিয়ে যাওয়া কি খুব দরকার? পরে নিলে হয়না?
ক্রীতিকের কথায় অরু আচমকা দৃষ্টিপাত করলো ওর চোখের দিকে, মনেমনে বললো,
— আশ্চর্য, আমার নুপুর দিয়ে ওনার কাজটা কি?
অরুর ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে একটানে ওর পা দুটো নিজের উরুর উপর তুলে নিলো ক্রীতিক। এভাবে পা তুলে ফেলায় অকস্মাৎ পেছনে ঝুঁকে গেলো অরু, পুরো গাড়ি জুড়ে তখনও পিনপতন নীরবতা বিরাজমান । যার দরুন অরুর তীব্র শ্বাসপ্রশ্বাস আর হঠাৎ বেড়ে যাওয়া হৃদস্পন্দনের আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ক্রীতিক ।অরুর এহেন পরিস্থিতিকে গ্রাহ্য না করে, আলতো হাতে ওর পায়ে নুপুর পরানো শুরু করে সে।নিজ পায়ে ক্রীতিকের হাতের নরম স্পর্শ অনুভব হতেই ঠোঁট কামড়ে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে অরু । নিজের এলোমেলো অজানা অনুভূতিতে বিরক্ত ও। যা সম্ভব নয় তাই সম্ভব করে ছেড়েছে ক্রীতিক। কিন্তু অরুকেই কেনো ব’লির পাঁঠা বানিয়ে এইরকম একটা অসাভাবিক সম্পর্কে জড়ালো সে?কেন অরুর সাথে সাথে নিজের জীবনটাকেও অগ্রহনযোগ্য সম্পর্কের মাঝে ঠেলে দিলো?কি চাইছে ক্রীতিক? এভাবে অরুর জীবনটা নষ্ট করে কোন ভুলের শোধ নিলো সে? একটা দু’টো নয়, অরুর মনে হাজারো দানা বাঁধা প্রশ্নের ছড়াছড়ি। কিন্তু কে দেবে এতো প্রশ্নের উত্তর?ক্রীতিক তো উত্তর দেওয়ার মতো ছেলেই নয়, অরুর প্রশ্নের তো মোটেই নয়।
অথচ এখন এই মূহুর্তে কি সুন্দর করে মনোযোগ দিয়ে অরুর পায়ে নুপুর পরাচ্ছে সে। দেখে মনে হচ্ছে এর চেয়ে প্রয়োজনীয় আর সুক্ষ্ম কাজ কোনোদিন করেনি ক্রীতিক। অরু তখন থেকে হিজিবিজি চিন্তায় বিভোর হয়ে আছে, চারিপাশে ওর খেয়াল নেই মোটেই । ক্রীতিক নিজের হাতের কাজটা শেষ করে একপলক ভাবুক অরুর চোখের দিকে তাকালো, অতঃপর নিজের হাতের বাধনটা আরও শক্ত করে, ওর পায়ে অকস্মাৎ হ্যাচকা টান মে’রে অরুকে নিজের কাছাকাছি টেনে নিয়ে এলো। আচমকা পায়ে টান দেওয়াতে সুতির ঘাগড়াটা অনেকটা উপরে উঠে গিয়ে মোমের মতো সুন্দর পা’দুটো দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে ক্রীতিকের চোখের সামনে। ক্রীতিক শুষ্ক ঢোক গিলে সেদিকে একবার পরখ করে, চোখ ঘুরিয়ে অরুর অস্রুসিক্ত নয়নে চোখ রাখলো,তারপর আরেকটু কাছে এগিয়ে গিয়ে, নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ওর চোখের জলটুকু মুছিয়ে দিতে দিতে মাদকতায় নিবিষ্ট চাহনী নিক্ষেপ করে, দু’ঠোঁট নাড়িয়ে হাস্কি স্বরে বললো,
— “বউ”
ক্রীতিক খুব আস্তে করে শব্দটা উচ্চারণ করলেও অরুর শ্রবনেন্দ্রীয়তে তা স্পষ্ট ভাবে পৌঁছেছে, কথাটা শোনা মাত্রই অজানা শিহরণে শরীর ছেয়ে গেলো অরুর। কাটা দিয়ে উঠলো শরীরের প্রত্যেকটা লোমকূপ। অজান্তেই তলপেটের মাঝে ডানা ঝাপটাতে শুরু করে দিলো অসংখ্য প্রজাপতির দল। ইশশ কি অসস্থিদায়ক অনুভূতি। অরুর কেমন কেমন লাগছে, গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে মূহুর্তেই। ক্রীতিক এখনো একই ভাবে তাকিয়ে আছে। অরু আমতা আমতা স্বরে বলে উঠলো,
— আআমি পানি পান করবো।
অরুর কথায় ক্রীতিকের ঘোর কেটে যায়, ও মূহুর্তেই অরুর থেকে দুরত্ব বাড়িয়ে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দেয়, ড্রাইভ করতে করতে মনেমনে ক্রীতিক ভাবছে,
—যাক কান্নাকাটি তো অন্তত থেমেছে।
ওদিকে অরু এক নিঃশ্বাসে ঢকঢক করে পানি পান করে পুরো বোতল খালি করে ফেলেছে। তবুও কোনো কিছুর তৃষ্ণাতে হাসফাস করছে ভেতরটা, কি অদ্ভুত এই অনুভূতি, ক্রীতিক কি জাদু জানে?
*****************************************
অনু ফ্রন্ট ইয়ার্ডেই দাড়িয়ে ছিলো। অরু অনুকে দেখা মাত্রই ফেঞ্চ গেইট ঠেলে ভেতর প্রবেশ করে দৌড়ে গিয়ে অনুর গলা জড়িয়ে ধরে হাউমা’উ করে কেঁ’দে ওঠে। অনু জানে অরুর এমন কান্নার কারন ও নিজেই। তাই নিজের কাজে বড্ড অনুতপ্ত অনু। অরুর এমন হৃদয় নিংড়ানো কা’ন্নার গতিবেগে অনুও আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না,বোনকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে , ডুকরে কেঁ’দে উঠে অনু বলে,
—আপার উপর অভিমান করে এভাবে কাঁদিস না সোনা, আপা খুব সরি, আর কখনো তোকে এভাবে বকবো না, আমার ঘাট হয়েছে।
অনুর কথায় ক্রদনরত অরু এদিক ওদিক না সূচক মাথা নাড়ায়। অরুর ভাব ভঙ্গিমা অনুর বোধগম্য হয়নি, তাই অনু পুনরায় নরম সুরে বললো,
— বলেছিতো আর কখনো বকবো না এভাবে, এসেছিস থেকে কেঁদেই যাচ্ছিস, কি হয়েছে ক্রীতিক ভাইয়া কিছু বলেছে, দেখি আমার দিকে তাকা?
অরুর গাল দুটো আঁজলা করে ধরে, মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে অনু আবারও শুধায়,
—- ক্রীতিক ভাইয়া কিছু বলেছে?
অনুর প্রশ্নে অরু পেছনে দৃষ্টি নিক্ষেপন করে, তাকিয়ে দেখে ক্রীতিক নেই, হয়তো ভেতরে চলে গিয়েছে অনেক আগেই। তারপর পুনরায় অনুর দিকে তাকিয়ে না সূচক মাথা নাড়িয়ে নাক টেনে অরু বলে,
— কেউ কিচ্ছু বলেনি।
অনু নিশ্চিন্ত হয়ে অরুর দু’চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,
— মায়ের অ’পারেশন হয়ে গিয়েছে, এখন
আই সি ইউ তে আছে, দু’একদিনেই হয়তো চোখ খুলবে মা, তারপর আমরা মায়ের সাথে কথা বলতে পারবো, মাকে নিয়ে দেশেও ফিরে যাবো আর দুঃখ নেই।
এতো বড় একটা খুশির খবরেও কেন যেন খুশি হতে পারলো না অরু, কি করে পারবে? গতকাল রাতেই নিজের সবটা সৎ ভাইয়ের নামে লিখে দিয়ে এসেছে। এসব কথা জানা জানি হলে মা আপা কেউই ওকে মেনে নেবেনা। ভালোবাসবে না। উল্টে নোংরা বলে আখ্যায়িত করবে। এতোগুলো দিন পরে একটু খানি খুশির মুখ দেখেছিল ওর পরিবারটা, অথচ অরু সবার আড়ালে সেটা ধূ’লিসাৎ করে মাটিতে মিশিয়ে এসেছে। ক্রীতিক কেন করলো এমনটা?
নিজের ভাবনার মাঝেই,অরু তৎক্ষনাৎ মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে ক্রীতিককে ও প্রশ্ন করবেই করবে, তাতে যা খারাপ হওয়ার হোক। তাছাড়া ক্রীতিক তো ওর সাথে খারাপ কোনো কিছু করার বাদ রাখেনি, তাহলে এতো ভ’য় কিসের?
অরুর অজ্ঞাত ভ্রমকে ভাঙিয়ে দিয়ে ফ্রেঞ্চ গেইট ঠেলে আগমন ঘটে প্রত্যয়ের। প্রত্যয়কে দেখে অরু এক নজর অনুর মুখের দিকে তাকিয়ে দ্রুত হেটে বাসার ভেতরে চলে যায়। অরু চলে গেলে অনু নিজেও পা বাড়ায় ভেতরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। এই মূহুর্তে প্রত্যয়ের সাথে কথা বলাতো দূরে থাক, ওর মুখটাও দেখতে ইচ্ছে করছে না অনুর।
কিন্তু পেছনে ঘুরে কয়েক কদম পা বাড়াতেই প্রত্যয় ওকে টেনে ব্যাক ইয়ার্ডে নিয়ে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে। প্রত্যয়ের এমন কান্ডে অনু রেগেমেগে ঝাঁজিয়ে উঠে বলে,
— কি অস’ভ্যতা শুরু করেছেন, বাড়িতে ক্রীতিক ভাইয়া আছে।
প্রত্যয় ওর মুখটা শ’ক্ত হাতে চেপে ধরে বললো,
— শুউউ, ওই জন্যই তো বলছি আস্তে কথা বলো।
অনু ওর হাতটা ঝটকা মে’রে সরিয়ে দিয়ে বললো,
— কি চাই আপনার, আমাকে ইউজ করে স্বাধ মেটেনি? নাকি তিন্নির সাথে আজ দেখা হয়নি? তাই রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে আমার কাছে এসেছেন।
প্রত্যয় চটে আছে খুব, মেয়েটার তেজের সাথে কিছুতেই পেরে ওঠেনা সে, কিন্তু এই মূহুর্তে অনুর ব্লে’ডের মতো ধারা’লো কথার আ’ঘাতে র’ক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে হৃদয়টা, সেইসাথে মস্তিষ্ক হয়ে উঠেছে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য।প্রত্যয় নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে, চড়াৎ করে তুঙ্গে উঠে যাওয়া মেজাজের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো তৎক্ষনাৎ, অনুর হাতদুটো মাথার উপরে তুলে দেওয়ালের সাথে চে’পে ধরে, ওর গলার কাছে মুখ নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে প্রত্যয় বলে,
— কথা না শুনলে জা’নে মে’রে ফে’লবো। গত দুদিন ধরে কু’কুরের মতো পিছনে পরে আছি, কিছু একটা এক্সপ্লেইন করতে চাচ্ছি। একবারও সুযোগ দিয়েছো আমায়? এতো তেজ কেনো তোমার?
প্রত্যয় এই প্রথমবার অনুকে তুমি করে অধিকার খাটিয়ে কথা বললো। প্রত্যয়ের মুখের তুমি আওয়াজটা যে এতোটা সুমধুর তা অজানাই ছিল অনুর। প্রত্যয়ের মুখে তুমি শুনে হতবাক হয়ে ওর চশমার আড়ালে ধূসর চোখ জোড়ার দিকে বিনাবাক্যে তাকিয়ে আছে অনু।
একটুখানি থেমে প্রত্যয় পুনরায় কঠিন সুরে বললো,
— আর কি যেন বললে, ইউজ। ইউজ করা কাকে বলে সেটা কি আদৌও বোঝো তুমি? নাকি বুঝেই যাকে তাকে গিয়ে এসব বলো?
অনু এবারও পুরোপুরি নিশ্চুপ, ও ধ্যানমগ্ন হয়ে চেয়ে আছে প্রত্যয়ের চোখে।
অনুকে তখন থেকে এভাবে অবাক নয়নে চেয়ে থাকতে দেখে রা’গী আওয়াজটা মূহুর্তেই নিচু হয়ে গেলো প্রত্যয়ের, চোখ দুটোতে হিং’স্রতার জ্বল’ন্ত অ’ঙ্গার দপ করে নিভে গিয়ে তাতে জড়ো হলো একরাশ মুগ্ধতা। এলোমেলো অনুভূতি গুলো উথাল-পাতাল ঢেউ তুলে আঁচড়ে পরছে মনের তটে। অনু এতোটা কাছে দাড়িয়ে আছে, এতোটা কাছে,যে ওর তপ্ত নিঃশ্বাস গুলো প্রত্যয়ের মুখমন্ডলে ছড়িয়ে পরছে বারেবারে ।এবার আর কোনো কথা নয় অনুর নিস্প্রভ চোখে একপলক চোখ রেখে প্রত্যয় নিজের খেইর হারিয়ে ফেললো। মূহুর্তেই নিজের ওষ্ঠাগত করে নিলো অনুর তিরতির করে কাঁপতে থাকা অধর যুগল। অনুর ঠোঁটের ছোঁয়ায় হঠাৎ করেই যেন উন্মাদনা ছড়িয়ে পরলো প্রত্যয়ের শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অনুর দিক থেকে কোনোরূপ বাঁধা না আসাতে, পরম আবেশে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেলো আপনা আপনি।
এদিকে প্রত্যয়ের নরম ঠোঁটের স্পর্শে অনুর জান যায় যায় অবস্থা। খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও পরক্ষণেই দু’হাত দিয়ে প্রত্যয়কে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে তরিৎ গতিতে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো অনু। অনুর ধাক্কায় প্রত্যয় নিজের সম্বিত ফিরে পেয়ে, নিজের কর্মকান্ডের জন্য লজ্জিত হয়ে নরম সুরে বললো,
— আ…আ’ম সরি।আসলে..
অনু ওকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে না ঘুরেই জবাব দিলো,
— সরি বলতে হবে না আপনি যান এখন।
আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই অনু, একান্তে, আমায় কি একটু খানি সময় দেওয়া যায়না?
অনু এবার ঘুরে দাড়িয়ে প্রত্যয়ের মুখোমুখি হয়ে শুধালো,
— প্রত্যয় সাহেব, আপনি শুধু আমার তাইতো?
প্রত্যয় সেদিনের মতোই কন্ঠে দৃঢ়তা টেনে বললো,
— হান্ড্রেড পার্সেন্ট।
—আগামী কাল বিকেলে সি-বিচে অপেক্ষা করবো।
অনুর এইটুকু আস্কারা পেয়ে প্রত্যয় যেন চাঁদ হাতে পেয়েছে। খুশির ঝিলিক ফুটে উঠেছে ওর চোখে মুখে। প্রত্যয়কে এভাবে নিঃশব্দে ঠোঁট কামড়ে হাসতে দেখে, অনু ভেতরে যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে আবারও পেছনে তাকিয়ে বললো,
— আর হ্যা, বাবল টি আনতে ভুলবেন না যেন।
প্রত্যয়ের নরম হাসি এতোক্ষণে পুরো ঠোঁট জুড়ে প্রসারিত হলো, ও পেছন থেকে হাঁক পেরে বললো,
— যথাআজ্ঞা মহারানী।
*****************************************
মাঝরাতে ফেইরী লাইটের নিভু নিভু আলো আর সুইমিং পুলের নীলচে পানির কলকলানি মিলেমিশে পুরো ছাঁদ বারান্দা জুড়ে ম্যাজিক্যাল আলোছায়া তৈরি করেছে। মাথার উপর খোলা আকাশ, আকাশে রুপোর থালার মতো মস্তবড় চাঁদ উঠেছে । কখনো কখনো সেই চাঁদ ঢেকে যাচ্ছে, পেঁজা তুলোর মতো উড়ো মেঘে। আবার কখনো তীর্যক রুপোলী আলো ছড়াচ্ছে,পুরো ভুবন জুড়ে।
চাঁদের দিকে নিকোটিনে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সেটাই তখন থেকে বেশ আগ্রহ নিয়ে পরখ করছে ক্রীতিক। রাত প্রায় দু’টো বেজে পয়ত্রিশ তাও চোখের পাতায় ঘুম আসার নাম নেই, তাইতো রুম থেকে বেরিয়ে ছাঁদ বারান্দায় এসে সিগারেট ধরিয়েছে সে। সিগারেটের কুন্ডলী পাকানো ধোঁয়ার সাথে সাথে উড়িয়ে দিচ্ছে নিজের মনে জমানো অজস্র অযাচিত ভাবনা গুলোকে, অবশ্য এখন আর ভেবে লাভটাই বা কি?অরু তো সারাজীবনের জন্য ওর।
অরু নামটা ভাবতে যতটা দেরি হলো অরুর সেখানে উপস্থিত ততটা হতে দেরি হলোনা। নিশুতি রাতে কারও নিস্তব্ধ পায়ের আওয়াজ পেয়ে ক্রীতিক পেছনে ঘুরে দেখলো অরু দাঁড়িয়ে আছে। পরনে খয়েরী রঙের সুতির চুড়িদার লম্বা চুল গুলো দিয়ে টুপটাপ করে পানি ঝড়ে শরীর ভিজে যাচ্ছে, তাতেও হেলদোল নেই অরুর, চোখে মুখে চড়ম বি’ষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। হাত পায়ের ফর্সা ত্বকগুলো ফ্যাকাসে হয়ে কুঁচকে আছে, মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে পানিতে ভিজেছে, অরুর এমন উদভ্রান্তের মতো মুখশ্রী দেখে ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে শুধালো,
— এতো রাতে শাওয়ার কেন নিয়েছিস? কি প্রয়োজনে?
অরু জবাব দেয়না, চুপচাপ গিয়ে দাঁড়ায় ক্রীতিকের মুখোমুখি হয়ে, ক্রীতিকের পরনে কালো হুটি আর ওভার সাইজ ডেনিম। অরু নিস্প্রভ চোখে ক্রীতিকের কালো কুচকুচে হুডিটার দিকে চেয়ে আছে চুপচাপ , ওর কর্মকান্ড দেখে ক্রীতিক বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,
— এতো রাতে না ঘুমিয়ে এখানে কি? আমার সাথে ঘুমাবি? ঘুমালে চল আমিও একটু আরাম করে ঘুমাই।
ক্রীতিকের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দু-হাত দিয়ে ওর পেশিবহুল বুকের উপর ধা’ক্কা দিয়ে অরু কাঁদতে কাঁদত বললো,
— কেন করলেন এটা? কি দোষ করেছি আমি? কোন দোষের শা’স্তি সরূপ আমার জীবনটা এভাবে তছনছ করে দিলেন আপনি? বলুন কেন? কি হলো বলুন?
এবার, দু’বার, তিনবার যখন ক্রীতিকের বুকের উপর অরু ধা’ক্কা দিতে যাবে, তখনই ওর দু’হাত শক্ত করে চেপে ধরে ক্রীতিক। চেহারায় গাম্ভীর্য টেনে এনে, কঠিন সুরে বলে,
— যা করেছি, খুব ভেবে চিন্তে ঠান্ডা মাথায় করেছি, এবার এটা যত তারাতাড়ি মেনে নিবি ততই তোর জন্য মঙ্গল।
ক্রীতিকের কথায় অরু ঝাঁজিয়ে উঠে বললো,
— আপনি কি পা’গল? আপনার বাবা জামশেদ জায়ান চৌধুরী আমার মায়ের প্রয়াত স্বামী। সে হিসেবে আপনি আমার সৎ ভাই, কিভাবে ভুলে গেলেন এটা?
অরু কথাটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতিক টান মে’রে একহাতে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে শ’ক্ত করে ওর গালদুটো চে’পে ধ’রে বললো,
— খবরদার নিজেকে আমার বোন বলবি না, একদম মে’রে ফে’লবো, তুই আমার বিয়ে করা বউ, তোর সব কিছু আমার, তোর পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত এভরিথিং ইজ বিলোংস টু মি।
তীব্র রা’গে কাঁপতে কাঁপতে কথাটুকু শেষ করে অরুকে ধা’ক্কা মে’রে সরিয়ে দেয় ক্রীতিক।
ক্রীতিক ছাড়তেই অরু কাঁ’দতে কাঁ’দতে মেঝেতে বসে পরে, অতঃপর হেঁচকি তুলে অস্পষ্ট সুরে বলে,
—-সমাজ কোনোদিনও এই বিয়েকে সীকৃতি দেবেনা।উল্টে আমাকে নোং’রা বলে ধি’ক্কার দেবে।তখন নিশ্চয়ই খুশি হবেন আপনি?
ক্রীতিক হাঁটু গেড়ে ওর মুখোমুখি হয়ে বসে বললো,
— আমি সমাজ মানিনা, আর যে সমাজ আমার বউয়ের দিকে আঙুল তুলে কথা বলবে আমি সেই সমাজই ধ্বং’স করে দেবো। আই রিপিট ধ্বং’স করে দেবো।
ক্রীতিকের কথা শুনে ওর চোখে চোখ রাখলো অরু, চোখ তো নয় যেন জ্ব’লন্ত আগ্নে’য়গিরির দাবানল। যে তাকাবে সেই ভস্ম হয়ে যাবে। অথচ ফর্সা পুরুষালী তীক্ষ্ণ চোয়াল জোড়া মুখশ্রীটা কতোটাই না সুদর্শন। এক মূহুর্তের জন্য অরুর মনে হলো, এই অসম্ভব সুদর্শন মানুষটা ওর স্বামী, হুট করেই কেমন ক্রীতিককে অন্য নজরে আবিষ্কার করছে অরু। কয়েক মূহুর্তের জন্য নিজেকে বসিয়ে দিলো ক্রীতিকের বাম পাশে তার পত্নী রূপে। পরবর্তীতেই অন্যমনটা লাফিয়ে উঠে বললো,
—না না এটা কি করে সম্ভব? এমন একটা রা’গী বদ মেজাজী, বেপরোয়া লোকের সাথে সারাজীবন কাটানো অসম্ভব।
কারন আর যাই হোক সারা জীবন ক্রীতিকের হাতে মা’র খাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই অরুর।
— কি হলো?
হঠাৎ করে ক্রীতিকের কথায় ধ্যান ভাঙে অরুর, বেরিয়ে আসে নিজের দিবাস্বপ্ন থেকে। ছোট্ট করে জবাব দেয়,
–কিছু না।
ক্রীতিক ওর ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে আসস্থ করে পুনরায় বলে,
— অনেক রাত হয়ে গিয়েছে ঘুমিয়ে পর। চিন্তা নেই পুরো দুনিয়া আমি দু’হাতে সামলে নেবো, তোর গায়ে কল’ঙ্কের আঁচও আসতে দেবোনা, এটুকু ভরসা রাখতেই পারিস,হার্টবিট।
ক্রীতিকের শেষ কথাতে অরু চকিতে মাথা তুলে বললো,
— কিহ!
—বলেছি তুই আমার হার্টবিট।
…আআ, অরু কিছু বলবে তার আগেই ওর দিকে চোখ পাকিয়ে ক্রীতিক বললো,
— আর একটাও প্রশ্ন করবিনা, তাহলে মা’র খাবি।
অপারগ অরু আর কিইবা করবে, মা’রের ভয়ে চুপচাপ পা বাড়ায় নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমের দিকে।
ক্রীতিক অরুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে দ্বিতীয় বার বিড়বিড়ায়,
— হার্টবিট।
চলবে….